সড়ক-মহাসড়কের বাস্তবতা ও একটি জরিপ

0

দেশের জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং জেলা সড়কের সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটারের বেশি ভাঙাচোরা। শতকরা হিসাবে সোয়া ১৬ ভাগ। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্থাৎ জাতীয় মহাসড়কের প্রায় ৫০০ কিলোমিটার ভাঙাচোরা; যা জাতীয় মহাসড়কের মোট দৈর্ঘ্যরে প্রায় সাড়ে ১৩ শতাংশ। শুধু তাই নয়, যোগাযোগব্যবস্থার মেরুদণ্ড হিসেবে পরিচিত জাতীয় মহাসড়কের ১৩২ কিলোমিটারের অবস্থা এতই খারাপ যে ওই অংশ যান চলাচলেরই অনুপযুক্ত। এমনই হিসাব দিচ্ছে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ) মহাসড়ক উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ (এইচডিএম) বিভাগ রোববার প্রকাশিত এক জরিপ রিপোর্টে। রিপোর্টে বলা হয়, ১৮ হাজার ৪৭৩ কিলোমিটার সড়ক ও মহাসড়ক জরিপ করা হয়েছে। প্রায় চার হাজার কিলোমিটার রাস্তা জরিপ করা যায়নি উন্নয়নকাজ চলমান থাকায় এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে। সওজ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যেসব রাস্তা খুব খারাপ হিসেবে চিহ্নিত সেগুলো আদৌ যান চলাচলের উপযোগী নয়। এ হিসাবে দেশের ৬৯১ কিলোমিটার রাস্তা যান চলাচলের অনুপযুক্ত।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এক হাজার ৫২৪ কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা নাজুক। এর মধ্যে জাতীয় মহাসড়ক ২১৯ কিলোমিটার, আঞ্চলিক মহাসড়ক ২৩৮ কিলোমিটার এবং জেলা সড়ক এক হাজার ৬৫ কিলোমিটার।
সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, সরকারি হিসাবের সঙ্গে বাস্তবের প্রায়ই তেমন মিল থাকে না। সরকারি কর্মকর্তারা সেভাবেই হিসাব উপস্থাপন করেন যেমনটা সরকারের কর্তাব্যক্তিরা পছন্দ করবেন। এ জন্যই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে হিসাব বিবিএস বা অন্য সরকারি সংস্থা প্রকাশ করে বিশেষজ্ঞরা সেগুলোকে বাস্তবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হিসেবে বর্ণনা করেন। বস্তুত, সরকারের সাফল্য দেখানোতেই কর্মকর্তাদের যত আগ্রহ । প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরা তত নয়। কারণটা সহজেই বোধগম্য। সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে সওজের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যে পরিসংখ্যান দিয়েছে তাতে প্রকৃত চিত্র কতটা ধরা পড়েছে যাচাইয়ের উপায় নেই। কারণ, অর্থনৈতিক বিষয়ে যেমন বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা জরিপ করতে পারে সড়ক-মহাসড়ক নিয়ে তেমন সুযোগ নেই। তার পরও এই জরিপ থেকে যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা কোনোভাবেই আশাব্যঞ্জক নয়। সড়কের দায়িত্বে আছেন সরকারের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি যিনি ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক। সড়ক ও জনপথ মন্ত্রণালয়ের অনেক সাফল্যের কাহিনী গত এক যুগ ধরেই রীতিমতো ঢাকঢোল পিটিয়ে দেশবাসীর কানে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে বিপুল সমারোহে। সওজের জরিপে সেই সাফল্যের নমুনা দেখা যাচ্ছে না।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী একটি জাতীয় দৈনিককে বলেছেন, গত ১২ বছরে যোগাযোগ খাতে বিপুল বিনিয়োগ হয়েছে। প্রায় প্রতিটি জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং জেলা সড়ক মেরামত ও পুনর্র্র্নিমাণের আওতায় এসেছে।
কিন্তু এসব মেরামত ও পুনর্র্নিমাণ টেকসই হয় না। সওজের প্রধান প্রকৌশলী বলেছেন, অতিরিক্ত পণ্যবাহী যান চলাচল, অতিরিক্ত যান চলাচল ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে সড়ক ভেঙেচুরে যায়। যুক্তিটা কতটা গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কারণ জনগণ অন্ধ নয়। তারা দেখছে, কিভাবে বছরের পর বছর ধরে অতিশয় নি¤œমানের সামগ্রী দিয়ে সড়ক নির্মাণ ও পুননির্মাণ করা হচ্ছে। যোগাযোগ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে বড় ধরনের গলদ রয়েছে। নিম্নমানের নির্মাণকাজের কারণেই সড়ক বারবার ভাঙে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের একজন অধ্যাপক বলেছেন, একটি মহাসড়ক ভালোভাবে নির্মাণ করলে আট বছর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় হওয়ার কথা নয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেনের বয়স এখনো পাঁচ বছর হয়নি। কিন্তু আরো আগে থেকেই এগুলো ভাঙছে ও মেরামত করতে হচ্ছে। নির্মাণের পরের বছর থেকেই যদি মেরামত করতে হয়, তাহলে কিভাবে সেটা সড়ক হলো! সদ্য তৈরি করা সড়কও যে এক বছরের মাথায় মেরামত করতে হচ্ছে শুধু তাই তো নয়; তৈরির কাজ শেষ হবার আগেও পুরো সেতু ধসে পড়ছে এমন দৃষ্টান্তও তো পত্রিকার পাতা খুললে প্রায়ই চোখে পড়ে।