পর্যটন কেন্দ্র রক্ষায় তৎপর হন

0

বিদায়ী বছরের শেষ মুহূর্তে কিছু সংবাদমাধ্যমে ব্যতিক্রম খবর ছিল থার্টিফাস্ট ও নিউইয়ার উদযাপনের সময় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পর্যটক শূন্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনশূন্যতা বা স্বল্পতার ছবি দিয়ে ফলাও করে লিখেছে নানা কথা। নেটিজেনরা তীব্র সমালোচনা করে লিখেছে, এটা বিশ্বের দীর্ঘতম সামুদ্রিক পর্যটন কেন্দ্র ধ্বংস করার চক্রান্ত। তারা অনেকেই এ অবস্থার জন্য সার্বিক প্রশাসিনক ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন। দেশের স্বার্থে, মানুষের বিনোদনের স্বার্থে অবিলম্বে কক্সবাজার, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন, কুয়াকাটা ও পার্বত্য জেলার পর্যটক নিরাপত্তাত স্বল্প ব্যয়ে থাকা খাওয়া এবং নির্বিঘেœ ভ্রমণের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। আমরা মানুষের এই ভাবনাকে যথার্থই মনে করি। আশা করি পর্যটন স্বরাষ্ট্র ও অর্থমন্ত্রণালয়ের কর্তারা বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের সাথে দেখবেন।
গত বছরের করোনা লকডাউনে বাংলাদেশসহ বিশ্বের পর্যটন স্পটগুলো বন্ধ ছিল, খুলে দেয়ার পর পর্যটন স্পটগুলো আবার হাজারো পর্যটকে মুখরিত হয়ে উঠে। নভেম্বর থেকে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, কুয়াকাটা, বঙ্গোপসাগরের প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন, সুন্দরবন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন স্পটগুলোতে দেশি-বিদেশি পর্যটকের ভিড়ে সরগরম হয়ে ওঠার খবর পাওয়া যায়। সেই সাথে নানা রকম বিশৃঙ্খলা, বিড়ম্বনা, নিরাপত্তাহীনতা ও গলাকাটা বাণিজ্যের খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কক্সবাজারের সৈকত এলাকায় ৮০০ টাকার রুম ভাড়া ১০ গুণ বাড়িয়ে ৮ হাজার টাকায় আদায়, আলুর ভর্তা-ডাল-ভাতের অস্বাভাবিক মূল্য আদায় ইত্যাদি খবরগুলো যখন সারাদেশে মানুষের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা ও বিক্ষোভের জন্ম দিচ্ছিল, ঠিক তখনি ঢাকা থেকে বেড়াতে যাওয়া এক পরিবারের নারী সদস্যের কক্সবাজারে অপহৃত ও ধর্ষিত হওয়ার ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আবারো স্থানীয় প্রশাসন, পর্যটন পুলিশ এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা দেশের মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কেউ কক্সবাজার বর্জনের ডাকও দিয়েছেন। তবে বর্জন করে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দিকে সকলের মনোযোগ দিতে হবে বলে আমরা মনে করি। তবে অবাক হয়েছি স্থানীয় প্রশাসনের এক কান্ডে।
সন্ত্রাসী, অপরাধী ও বখাটে তরুণদের বিড়ম্বনা থেকে নারী ও শিশু পর্যটকদের রক্ষা করতে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন নারী ও শিশুদের জন্য আলাদা জোন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নের ব্যবস্থা না করে তাদের আলাদা জোন করার সিদ্ধান্তে স্বাভাবিকভাবেই পর্যটকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। ফলে ১০ ঘণ্টার মধ্যে সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন কর্তৃপক্ষ। ২৯ তারিখে বুধবার রাত সাড়ে ৯টায় কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের দফতর থেকে নারী ও শিশুদের জন্য এক্সক্লুসিভ জোন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া হয়। সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা ও সামগ্রিক বাস্তব পরিস্থিতি পর্যালোচনা না করেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা প্রত্যাহারের এই দৃষ্টান্ত থেকেই বোঝা যায়, কক্সবাজার প্রশাসন সেখানকার বাস্তব পরিবেশ ও পরিস্থিতি সম্পর্কে তেমন কোনো খবরই রাখেন না। অথবা, পর্যটন কেন্দ্রের কাজটাই ভালো বোঝেন না। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় পর্যটন কে“ন্দ্রর প্রশাসনকে আরো দক্ষ, দায়িত্বশীল ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হওয়া বাঞ্ছনীয়। কক্সবাজারসহ দেশের পর্যটন স্পটগুলোর পরিবেশ, নিরাপত্তা ও সেবার মানের উপর দেশের পর্যটনশিল্পের বিকাশ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা অনেকাংশে নির্ভরশীল। এবারের পর্যটন মওসুমে কক্সবাজারের সামগ্রিক পরিস্থিতির আলোকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সেখানকার ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সেবার মান ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষ কার্যকর পদক্ষেপ নেবে, এটাই সকলের প্রত্যাশা। এক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও পর্যটকদের আনন্দময় বিচরণ নিশ্চিতে ব্যর্থ কর্মকর্ততাদের সরিয়ে দিতে হলে তাই দিতে হবে।
নাগরিক জীবনের টানপোড়েন ও কর্মব্যস্ততার ফাঁকে অনেক মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে সমুদ্র সৈকত বা পাবর্ত্য এলাকার পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে বেড়াতে যায়। সামগ্রিক নিরাপত্তায় পরিবেশের উন্নয়ন ও পুলিশি নজরদারি বাড়ানোর বদলে নারী ও শিশুদের জন্য আলাদা জোন করার সিদ্ধান্ত এখানে গ্রহণযোগ্য নয়। বিশ্বের বড় বড় পর্যটনকেন্দ্রগুলোর সেবার মান ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার দিকে লক্ষ রেখে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্রগুলোর সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে হবে। পর্যটনকেন্দ্রে গলাকাটা দামে খাদ্য, হোটেল-মোটেল ও কেটারিং বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। শুধু কক্সবাজারই নয়, কুয়াকাটা, সেন্টমার্টিন, বান্দরবান, সুন্দরবন, সিলেটসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্পটগুলোকে আধুনিক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক ও নিরাপত্তার পাশাপাশি স্বল্প খরচে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা না গেলে লাখ লাখ দেশি পর্যটকের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকেরও হারাতে হবে।
প্রকৃতি আমাদের দেশকে উদার হস্তে মহামূল্য সম্পদ দান করেছে। যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও দক্ষতার মাধ্যমে সে সব সম্পদের কার্যকর ব্যবহার ও নিরাাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দেশের জন্য অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বয়ে আনা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সরকারের সঠিক নির্দেশনা স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সমন্বিত ও সচেতন উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। ওসি প্রদীপের মতোবা ধর্ষিতা ব্যবসায়ী বলে ধর্ষককে রক্ষার চেষ্টাকারী পুলিশ কর্মকর্তা ও মাদকের সাথে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেন কক্সবাজার বা অন্য কোনো পর্যটন কেন্দ্রকে জিম্মি করতে না পারে সেদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিশেষ নজর দিতে হবে। থাকা খাওয়ার সুবিধা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা সেই নিরিখে হতে হবে। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সৈকত এবং পুরো কক্সবাজারের নিরাপত্তা নিñিদ্র হতে হবে। বলাই বাহুল্য, দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতেও তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আশা করি, বিষয়টি কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করবেন।