মহান একুশের বিশেষ সংখ্যা

0

জিয়ার নাম মুছে ফেলা যাবে না
সৈয়দ আবদাল আহমদ

জিয়াউর রহমান আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য পাওয়া তার রাষ্ট্রীয় ‘বীর উত্তম’ খেতাব বাতিলের অপতৎপরতাকে কেন্দ্র করে জিয়াকে নিয়ে এই নতুন আলোচনা। কয়েক দিন আগেও আলোচনার ঝড় বইছিল আলজাজিরায় প্রচারিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার মেন’ নিয়ে। কিন্তু হঠাৎ করে এ আলোচনা উধাও হয়ে গেছে। নতুন ইস্যু হিসেবে এসেছে জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রীয় খেতাব বাতিলের প্রসঙ্গ। গত ১০ ফেব্রুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোর প্রধান খবরে বলা হয়, পরিবহন শ্রমিক নেতা শাজাহান খানের প্রস্তাবে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ৯ ফেব্রুয়ারির সভায় জিয়ার রাষ্ট্রীয় খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সভায় সভাপতিত্ব করেন জামুকা প্রধান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। খবরে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘বীর উত্তম’ খেতাব দেয়া হয়। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পর জামুকা এ খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রথম আলোকে শাজাহান খান জানিয়েছেন, জিয়াউর রহমানের মুক্তিযোদ্ধা সনদও বাতিল করা যায় কি না, সেটিও তারা খতিয়ে দেখছেন।
শাজাহান খান বলেন, ‘জিয়ার খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যায় মদদ দেয়ার জন্য।’ এ বিষয়ে সাংবাদিকদের কাছে আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘জিয়াউর রহমান সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন, স্বাধীনতাবিরোধী লোকজন নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন এবং বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশত্যাগে সহযোগিতা করেছেন।’ পরে আইমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘জিয়ার রাষ্ট্রীয় খেতাব বাতিলে আইনগত কোনো বাধা নেই।’ তিনি সাংবাদিকদের পাল্টা প্রশ্ন করেন, কেউ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নষ্ট করলে তার কি খেতাব রাখার অধিকার আছে? এ ছাড়া সরকারের মন্ত্রীরা জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বেনিফিশিয়ারি ছিলেন বলেও উল্লেখ করেন। এর আগে সরকারের প থেকে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা পদকও প্রত্যাহার করা হয়। জিয়ার রাষ্ট্রীয় খেতাব বাতিলে জামুকার সিদ্ধান্ত ও সরকারি তৎপরতা এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন আগামী ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হতে যাচ্ছে। দেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের পূর্তিও এই মার্চে। এটি স্বাধীনতার প্রতি এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতিই অবমাননা। কেননা বঙ্গবন্ধুই এই খেতাব দিয়েছিলেন।
কিন্তু এটি তো প্রমাণিত সত্য যে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমানের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারে মামলা করা হয় আওয়ামী লীগ আমলে এবং এর বিচারও সম্পন্ন হয়। এ মামলায় জিয়াউর রহমানকে আসামি করা হয়নি এবং মামলার রায়েও তা আসেনি।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড রোধে তৎকালীন সেনা কর্মকর্তাদের ব্যর্থতা ছিল। তবে এর মূল দায়িত্ব ছিল তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহ, ঢাকায় ৪৬ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের কমান্ডার এবং রীবাহিনীর কর্মকর্তাদের। বঙ্গবন্ধু নিজে সেনাপ্রধানকে ফোন করে সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু তাদের ব্যাপারে সরকার কোনো পদপে নেয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়, তাতে ২৩ জন মন্ত্রীর মধ্যে ২২ জনই ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা। এ মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন এইচ টি ইমাম। নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য জানিয়েছিলেন তিন বাহিনী প্রধান। এদের একজন পরে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন। আরেকজন এমপি। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা যখন হয় তখন জিয়াউর রহমান ক্যান্টনমেন্টের বাসায় গৃহবন্দী। তাদের বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থাটি হয় রক্তপাত এড়ানোর জন্য ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের সাথে আপস আলোচনার অংশ হিসেবে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বেনিফিশিয়ারি জিয়া এটি কি ঠিক? বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্রপতি হন আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাক। তিনিই সামরিক শাসন জারি করেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বসূচক খেতাব মুক্তিযুদ্ধের দলিল ও বাংলাপিডিয়া থেকে জানা যায়, একাত্তরে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অসম সাহসিকতা প্রদর্শন ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বসূচক খেতাবে ভূষিত করার জন্য তখনই চিন্তা করা হয়। এটি করা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বীরত্ব, সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের অনুপ্রেরণা সৃষ্টির জন্য। এর পরিপ্রেেিতই মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানী একাত্তরের ১৬ মে মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদে বিষয়টি প্রস্তাব আকারে পেশ করলে তা অনুমোদিত হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিপষিদ সভায় চার ধরনের বীরত্বসূচক খেতাবের নামকরণ করা হয়। বীরশ্রেষ্ঠ- সর্বোচ্চ পদপমর্যাদার খেতাব, বীর উত্তম-উচ্চ পদমর্যাদার খেতাব, বীর বিক্রম-প্রশংসনীয় পদমর্যাদার খেতাব ও বীর প্রতীক- বীরত্বসূচক প্রশংসাপত্রের খেতাব। ১৯৭২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ৪৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বীরত্বসূচক খেতাবের জন্য নির্বাচন করা হয়। এরপর একই বছরের ২৬ মার্চ এই ৪৩ জনসহ মোট ৫৪৬ জন মুক্তিযোদ্ধা খেতাবের জন্য চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে ও পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ইউনিট, সেক্টর, ব্রিগেড থেকে পাওয়া খেতাবের জন্য সুপারিশগুলো এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের নেতৃত্বে একটি কমিটি নিরীা করে। এরপর ১৯৭৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্রতিরামন্ত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খেতাব তালিকায় স্বার করে তাদের বীরত্বসূচক খেতাবে ভূষিত করেন।
মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা
একাত্তরের রণাঙ্গনে জিয়াউর রহমান একজন সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন না, মুক্তিযুদ্ধের তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক, একজন সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের প্রধান। একাত্তরের ২৬ মার্চের সূচনায় তিনিই প্রথম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ‘উই রিভোল্ট’ বলে বিদ্রোহ এবং মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ঘোষণা দেন। এরপর কালুরঘাট বেতার প্রন্দ্র থেকে ‘আমি মেজর জিয়া বলছি’ বলে স্বাধীনতা ঘোষণার ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্দীপ্ত করেন। এ সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের রেডিও ঘোষণাতেই আমি পরবর্তী দিকনির্দেশনা পেয়েছিলাম ২৭ মার্চ ফরিদপুর শহরে বসে।’ (সত্যের সন্ধানে প্রতিদিন, রিয়াজউদ্দীন আহমেদ)
একাত্তরের ১১ এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তাজউদ্দীন আহমদ উল্লেখ করেন, ‘চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলের সমর পরিচালনার ভার পড়েছে মেজর জিয়াউর রহমানের ওপর। পাকিস্তানিদের নৌ, স্থল ও বিমানবাহিনীর আক্রমণের মুখে চট্টগ্রাম শহরে যে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী ও বীর চট্টলার ভাইবোনেরা যে সাহসিকতার সাথে শত্রুর মোকাবেলা করেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই প্রতিরোধ স্ট্যালিনগ্রাদের পাশে স্থান পাবে।’ (মুক্তিযুদ্ধের দলিল ও বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, এইচ টি ইমাম)
এখন দেখা যাক, মুক্তিযুদ্ধের কয়েকজন সেক্টর কমান্ডার, সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধার বক্তব্যে কী আছে; মেজর রফিক-উল-ইসলাম বীর উত্তম মুক্তিযুদ্ধের ১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার। তার ‘অ্যা টেল অব মিলিয়নস’ (ল প্রাণের বিনিময়ে) গ্রন্থের ১০৫-১০৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘২৭ মার্চের বিকেলে তিনি (মেজর জিয়া) আসেন মনদঘাটে এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা দেন। প্রথমে তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান রূপে ঘোষণা করেন। পরে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন।’
মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ বীর উত্তম ৩ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। তিনি তার ‘বাংলাদেশ অ্যাট ওয়ার’ গ্রন্থের ৪৩-৪৫ পৃষ্ঠায় লিখেন, মেজর জিয়া ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সদলবলে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং তার কমান্ডিং অফিসার জানজুয়া ও অন্যদের প্রথমে গ্রেফতার ও পরে হত্যা করে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। পরে ২৬ মার্চে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মোকাবেলার জন্য সবাইকে আহ্বান জানান। প্রথমে রাষ্ট্রপ্রধান এবং পরে আরেক ঘোষণায় শেখ মুজিবুর রহমানের পে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন।’ মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী তিন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠক এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান ও এস আর মির্জার কথোপকথন নিয়ে প্রথমা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন’ বইতে বিরাট অংশজুড়ে স্থান পেয়েছে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা ও যুদ্ধের বিবরণ। এ কে খন্দকার বলেন, ‘২৭ মার্চ সন্ধ্যার কিছু আগে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। অবশ্য মেজর জিয়া কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে এসে প্রথম যে ঘোষণা দেন সেটি ভুলভাবে দেন। সেই ঘোষণায় তিনি নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছিলেন। যুদ্ধের সময় সামরিক বাহিনীর একজন বাঙালি মেজরের কথা শোনা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। আমি নিজে জানি, যুদ্ধের সময় জানি এবং যুদ্ধের পরবর্তী সময়েও জানি যে, মেজর জিয়া এ ঘোষণাটি পড়ার ফলে সারা দেশের ভেতরে এবং সীমান্তে যত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাদের মধ্যে এবং সাধারণ মানুষের মনে সাঙ্ঘাতিক একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করল যে, হ্যাঁ এবার বাংলাদেশ একটা যুদ্ধে নামল। জিয়ার ২৭ মার্চের ঘোষণা শোনার সাথে সাথে সারা দেশে এবং বাংলাদেশের বাইরে যারা, তাদের মধ্যে যে একটা প্রচণ্ড উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়, সে সম্পর্কে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়।’
মঈদুল হাসান বলেন, ‘অন্যের কথা কী বলব, মেজর জিয়ার বেতার ঘোষণা শুনে আমি নিজে মনে করেছিলাম যে, না, সত্যি তা হলে সামরিক বাহিনীর বিপুলসংখ্যক লোক বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। এটি আমার মনে বিরাট প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং আমি উৎসাহিত বোধ করি।’
এস আর মীর্জা বলেন, ‘২৫ মার্চের পর আমি সবসময় রেডিও সাথে রেখেছিলাম। ২৭ মার্চ বিকেলে পরিষ্কার শুনলাম, বঙ্গবন্ধুর প থেকে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। এ ঘোষণা শুনে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম এই ভেবে যে, হ্যাঁ এখন মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কারণ তাদের সাথে বাঙালি সেনারাও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত রয়েছে।’ জিয়ার ঘোষণাটি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে নিউজ বুলেটিন আকারে বারবার পড়ছিলেন তৎকালীন ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া ও ক্যাপ্টেন শমসের মোবিন। সুবিদ আলী ভূঁইয়া বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এবং আওয়ামী লীগের এমপি। ‘মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস’ গ্রন্থে তিনি লিখেন, ‘মেজর জিয়াকে ২৭ মার্চের সন্ধ্যায় দেখে উৎসাহ-উদ্দীপনায় ফেটে পড়ল বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা। ঘণ্টা দেড়েক চেষ্টার পর তিনি তার সেই ঐতিহাসিক ভাষণ তৈরি করে নিজেই ইংরেজি ও বাংলায় পাঠ করেন।’ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যত বই লেখা হয়েছে, প্রায় সবগুলোতেই রয়েছে এমন বিবরণ। মুক্তিযুদ্ধে ‘জেড ফোর্সের’ যুদ্ধগুলোর বীরত্বপূর্ণ বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিক মুক্তিযুদ্ধের দলিলে।
তাকে মুছে ফেলা যাবে না
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে শাহাদতবরণ করেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। সেদিন ঢাকায় তার নামাজে জানাজায় লাখ লাখো মানুষের অংশগ্রহণ ছিল তার প্রতি ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ। জানাজার পরদিন পত্রপত্রিকায় লেখা হয়, ‘জীবিত জিয়ার চেয়ে মৃত জিয়া আরো শক্তিশালী।’ পত্রিকার শিরোনাম হয়, ‘একটি কফিনের পাশে বাংলাদেশ।’ সেদিনের কথাগুলো পত্রিকায় তো এমনি এমনি ছাপা হয়নি।
প্রতিপ শক্তি জিয়াউর রহমানের নাম নিশানা চিরতরে মুছে দেয়ার জন্য কত অপচেষ্টাই না করে যাচ্ছে। জিয়াকে ঘায়েল করার জন্য, তার প্রতি বিদ্বেষ তৈরির জন্য নতুন নতুন ইস্যু তুলে আনা হচ্ছে। কখনো স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে, কখনো মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার ভূমিকা নিয়ে তাকে খাটো করার চেষ্টা চলছে। একবার সরিয়ে দেয়া হয় ক্রিসেন্ট লেকে জিয়ার মাজারের যাওয়ার ব্রেইলি ব্রিজ। আরেকবার লুই কানের সংসদ ভবনের মূল নকশার অজুহাত তুলে জিয়ার মাজার সরিয়ে ফেলারও অপচেষ্টা চলে। এখন তার ‘মুক্তিযুদ্ধের বীর উত্তম খেতাব’ বাতিলের পাঁয়তারা করা হচ্ছে। কিন্তু জিয়াকে নিয়ে যতই নতুন বিতর্ক তোলা হচ্ছে, ততই তিনি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসছেন। প্রাদপ্রদীপের আলোয় স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হচ্ছেন জিয়াউর রহমান। তিনি যে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নায়ক, তিনি যে বাংলাদেশের ত্রাতা ছিলেন, তিনি যে আধুনিক বাংলাদেশের নির্মাতা সে কথাই বেশি আলোচিত হচ্ছে। বাংলাদেশের জিয়াউর রহমান এক অনন্য নাম। মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ ও জিয়াউর রহমান কার্যত সমার্থক। ইতিহাস থেকে, মানুষের হৃদয়-মন থেকে জিয়াউর রহমানকে মুছে ফেলা যাবে না।
লেখক : সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস কাব
[সংকলিত]

মাতৃভাষা বনাম রাষ্ট্রভাষা
তৈমূর আলম খন্দকার

পবিত্র কুরআন মাজিদের মতে, সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ পাক মানুষকে কথা বলতে শিখিয়েছেন (সূরা আর-রহমান) এবং কথা বলার প্রধান মাধ্যম হলো ভাষা। জাতিসঙ্ঘ ‘ইশারা’ ভাষাকে ভাষার একটি ধরন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে বটে, কিন্তু ভাষা ছাড়া শুধু ইশারার মাধ্যমে মনের ভাব সঠিকভাবে প্রকাশ করা যায় না। যে মানুষটির কণ্ঠে ভাষা নেই, সে বুঝতে পারে পৃথিবীটা তার জন্য কতবড় বোঝা। যে পরিবারে একজন বধির বা বোবা জন্মগ্রহণ করে, সে পরিবারটি পৃথিবীর যে একটি ‘অন্ধকার’ চিত্র আছে তা উপলব্ধি করে বুঝতে পারে যে, পৃথিবীটা কতটুকু নিষ্ঠুর। ফলে ‘ভাষা’ পৃথিবীর মধ্যে সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে মূল্যবান উপহার। এ মূল্যবান উপহারের মধ্যে আরো মূল্যবান হলো ‘মাতৃভাষা’।
বাঙালি তাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মর্যাদাবান করতে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে; তথা পাকিস্তান সরকারের বুলেটে রক্ত ঝরিয়েছে। পৃথিবীতে মাতৃভাষার জন্য গুটিকয়েক জাতি প্রাণ দিয়েছে তাদের মধ্যে বাঙালি অন্যতম। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভারতের আসামে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য রক্ত দিতে হয়েছে। বাঙালি জাতিকেও স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিতে হয়েছে। এ জাতির যা কিছু অর্জন, তা হয়েছে রক্তের বিনিময়ে। অনেক কম জাতিই আছে যারা রক্তয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে নিজ মাতৃভূমিকে স্বাধীন করেছে। এ কারণেই বাঙালি জাতি যুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গৌরব বোধ করে। তবে দেশে স্বাধীনতার বীজ লুক্কায়িত ছিল মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় পরিণত করার আন্দোলনের মধ্যে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ায় বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পাকিস্তানিদের মুখামুখি দাঁড়ানোই ছিল বাঙালির প্রথম প্রতিবাদ যা পর্যায়ক্রমে স্বাধিকার, পরে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়। ফলে ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে পৃথিবীতে মাথা উঁচু করেছে। ফলে ২১ ফেব্রুয়ারিকে জাতিসঙ্ঘ ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভাষা আন্দোলনে যারা অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছেন তারা বলেছেন, ‘একুশ মানে মাথা নত না করা।’ এ প্রবাদটি এত জনপ্রিয়তা পেয়েছে, যা এখনো ‘বেদবাক্য’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ নিয়ে অনেক কবিতা, প্রবন্ধ রচিত হয়েছে, ছাপা হচ্ছে মনোমুগ্ধকর পোস্টার ও দেয়াল লিখন। প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালিরা বাংলাদেশে তো বটেই, বহির্বিশ্বেও যেখানে বাঙালি আছে সেখানে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে ভাষা শহীদদের স্মরণ করছে শ্রদ্ধার সাথে। কিন্তু বাঙালির প্রিয় মাতৃভাষা ‘বাংলা’ কি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রয়োগ করা হচ্ছে? এ দেশের সংবিধানের প্রথম ভাগের ৩য় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।’ কাগজ-কলমে রাষ্ট্রীয়ভাবে সংবিধানে ‘বাংলা’ রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বটে; কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বেেত্র বাংলা ভাষা কি ব্যবহৃত হচ্ছে? রাষ্ট্রের বিভিন্ন অফিস/আদালতে এখনো ইংরেজি ভাষাকে মর্যাদার আসনে বসানো হচ্ছে। আদালতসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন দফতরে ইংরেজিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। ইংরেজি যে না জানে, তার জীবনটাই যেন ব্যর্থ হওয়ার মানসিকতা এখনো আমাদের সমাজে বিদ্যমান। ‘ইংরেজি’ যেহেতু আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত, সেহেতু ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী থাকার অনেক গুরুত্ব রয়েছে বটে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় দফতরে ইংরেজি ব্যবহার এবং ইংরেজি ভাষায় পারদর্শিতা এক কথা নয়। স্পষ্টভাবেই বলছি যে, আন্তর্জাতিক ভাবধারা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী থাকা অবশ্যই বাঞ্ছনীয়, তবে দেশের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক ব্যবস্থার সর্বেেত্র ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য যথাযথ নয়। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত ও সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত বাংলাদেশের ইতিহাসে (১৭০৪-১৯৭১) ‘রাষ্ট্র ও শিা’ প্রবন্ধে (পৃষ্ঠা : ৭৯) দেখা যায়, ‘ব্রিটিশ সরকারের আর্থিক অনুদানে মাদরাসা ও সংস্কৃতি কলেজ পরিচালিত হয়েছে। ওয়ারেন হেস্টিংসের আনুকূল্যে ১৭৮১ সালে কলকাতা মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৯২ সালে জোনাথন ডানকান প্রতিষ্ঠা করেন সংস্কৃতি কলেজ। ১৮৩৫ সালে লর্ড বেন্টিঙ্ক মেকলের ভারত উপমহাদেশে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রসারকে ভারত সরকারের শিানীতির উদ্দেশ্য বলে গ্রহণ করেন। তৎকালীন সরকারি নীতির এ পরিবর্তনের ফলে ক্রমে বাংলায় বেশ কিছু সরকার পরিচালিত, সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ইংরেজি স্কুল ও কলেজ গড়ে ওঠে। এসব প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা প্রধানত বাংলায় উচ্চাভিলাষী পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখনই সরকারি চাকরিতে ইংরেজি শিতিদের অগ্রাধিকার প্রদানের নীতি প্রবর্তিত হয়।’
প্রখ্যাত লেখক বদরুদ্দীন উমর ‘ভাষা আন্দোলন’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘শুধু সাংস্কৃতিক মহলই নয়, রাজনৈতিক মহলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে ভাষাবিষয়ক কিছু উল্লেখযোগ্য চিন্তাভাবনা ছিল। ১৯৪৪ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম প্রাদেশিক কাউন্সিলের সামনে পেশ করার জন্য যে খসড়া ম্যানিফেস্টো প্রণয়ন করেছিলেন, তাতে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিাদানের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন ব্রিটিশ ভারতের সর্বশেষ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন কর্তৃক ভারত বিভাগ সম্পর্কিত রোয়েদাদ ঘোষণার পর মুসলিম লীগের অল্পসংখক বামপন্থী কর্মীর উদ্যোগে জুলাই মাসে ঢাকায় গণআজাদী লীগ নামে একটি রাজনৈতিক গ্রুপ গঠিত হয়। কামরুদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, তাজউদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ প্রভৃতি নেতৃস্থানীয় কর্মীর দ্বারা একটি কমিটি গঠিত হয়। এ গ্রুপ ‘আশু দাবি কর্মসূচি আদর্শ’ নামে যে ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয় : মাতৃভাষার সাহায্যে শিাদান করিতে হইবে। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষাকে দেশে যথোপযোগী করিবার জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা করিতে হইবে।’ এতে প্রতীয়মান হয় যে, পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই বাঙালি জাতি বাংলা ভাষার প্রয়োগের দাবিতে সোচ্চার ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রয়োগ করার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানগতভাবে বাংলা একাডেমির ওপর বর্তায়। কিন্তু একাডেমি সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। বাংলা একাডেমি এখন ‘সরকারি দলের একটি অঙ্গসংগঠন’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। সরকারি অফিস আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য ভাষার প্রয়োগ সাবলীল করার পদপে নেয়ার দায়িত্ব বাংলা একাডেমির। কিন্তু গবেষণামূলক কার্যক্রম থেকে সরে গিয়ে সরকারের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা তারা বাস্তবায়ন করছেন। প্রতি বছর কয়েক দফা পদক বিতরণ করাই একাডেমির যেন মুখ্য কর্ম। কিন্তু পদক বিতরণে একাডেমি নিরপেভাবে দায়িত্ব পালন না করে শুধু সরকারি ঘরানার লোকদেরই পদক পেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। একটি রাষ্ট্রে এমন কিছু প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার যাতে দল মত নির্বিশেষে সব মতের মানুষ একত্র হয়ে মতবিনিময়ের মাধ্যমে জাতির জন্য অবদান রাখতে পারে। বাংলা একাডেমি সে ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান হতে পারত। কিন্তু এর পরিবর্তে একাডেমি সরকারি দলের স্বার্থরায় প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সরকারবিরোধী লেখকদের বই বাংলা একাডেমি প্রকাশ করে না। গবেষণায় রয়েছে তাদের পপাতিত্ব। ইতিহাস সৃষ্টিতে রয়েছে সত্য-মিথ্যার দোলাচল; যে ইতিহাস রচনা করলে মতাসীনরা খুশি থাকবেন, সে ইতিহাসই বাংলা একাডেমির গবেষণার ফল। সবচেয়ে বড় কথা এই যে, একাডেমির অনেক জীবন ও সাধারণ সদস্য রয়েছেন। সদস্যদের মধ্যে দলমত নির্বিশেষে অনেকেই সদস্য রয়েছেন, যারা সরকারি ঘরানার বা সরকার সমর্থক সদস্য নন তাদের ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতা বাংলা একাডেমির কাছে নেই। সরকার দাবি করে, দেশে গণতন্ত্র বিদ্যমান। অথচ বাংলা একাডেমি চলছে একটি অনির্বাচিত কমিটি দ্বারা। আওয়ামী লীগ সরকার মতায় আসার পর এই একাডেমি কোনো নির্বাচিত কমিটি দ্বারা পরিচালিত হয়নি। সরকার দেশের সংস্কৃতিকে নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণে উদ্দেশ্যেই বাংলা একাডেমিকে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত করছে।
মাতৃভাষা কোনো সরকারের সম্পদ নয়। এটি একটি জাতীয় ঐতিহ্য ও সম্পদ। এ এটাকে জাতীয়ভাবেই রা করতে হবে। সবেেত্র ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমেই তা সম্প্রসারিত হবে। সরকার প্রাথমিক শিার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে বটে, কিন্তু এখন পর্যন্ত দেশের মানুষের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিরর। স্বাধীনতা উত্তরকালে নিররতা দূরীকরণের জন্য সরকারি যে উদ্যোগ ছিল তাও থেমে গেছে। স্বাধীনতার পর সরকারি উদ্দেশ্যেই কয়েকবার নিররতা দূরীকরণে উদ্যোগ নেয়া হলেও আমলাতান্ত্রিক অসহযোগিতার জন্য সফল হতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে (কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র) নিররতা দূরীকরণ অর্থাৎ ধনী-গরিব নির্বিশেষে নিরর ব্যক্তিদের অর জ্ঞান দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হলেও সে উদ্যোগও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অপমৃত্যুবরণ করে।
সমগ্র জাতিকে ভাষার সাথে পরিচিত করতে অর জ্ঞান শেখানো প্রয়োজন যা কোনো শিাপ্রতিষ্ঠান দ্বারা সম্ভব নয়; এ দায়িত্ব নিতে হবে গোটা শিতি সমাজকে। বস্তিবাসী গরিব মেহনতি মানুষ যাদের ‘নুন আনতে পানতা ফুরায়’ তাদের পে কোনো স্কুলে ভর্তি হওয়া সম্ভব নয় এবং অভাবের তাড়নায় বস্তিতে বেড়ে ওঠা তাদের সন্তানদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠানোর পরিবর্তে কর্মস্থলে পাঠানোই মেহনতি খেটে খাওয়া মানুষ জরুরি মনে করে। ভাষা শিার জন্য অর জ্ঞান এবং অর জ্ঞান সর্বস্তরে প্রদান করার জন্য সর্বজনীন শিাব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সরকারকে আরো উদ্যোগী ও সুদূরপ্রসারী টেকসই কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : আইনজীবী, কলামিষ্ট ও জীবন সদস্য, বাংলা একাডেমি
প্রতিষ্ঠাতা : কেন্দ্রীয় নিররতা দূরীকরণ সংস্থা

 

মাতৃভাষাই হোক শেষ অনুপ্রেরণা
লাভা মাহমুদা

জাতি হিসেবে গর্ব করার মতো অল্পকিছু উপাদানের সর্বাগ্রেই আছে আমাদের ভাষা, প্রাণের ভাষা, বাংলা ভাষা। পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী যাদের ভাষা বিস্তৃত ও ব্যাপক। এ ভাষার কারণেই আমরা অন্যসব প্রাণী থেকে আলাদা এবং অনন্য। ভূমিষ্ট হওয়ার পর মানব শিশু কান্নার যে শব্দ দিয়ে তার আগমনী বার্তা পৃথিবীকে জানিয়ে দেয়, সময়ের সাথে সাথে সেই শব্দই আধো আধো বুলিতে ভাষায় রূপ নেয়। এটাই তার মাতৃভাষা। এই ভাষার মাধ্যমেই ভাবের বিনিময় হয়, কথার আদান-প্রদান হয়, যা বিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে বিবেচিত। সৃষ্টির শুরু থেকে মানব সভ্যতার বিকাশের পাশাপাশি ভাষারও বিবর্তন ঘটেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। সেই সাথে জন্ম হয়েছে হরেক রকম ভাষার। সেখানে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে সময়, অবস্থান, ভৌগোলিক, রাজনৈতিক প্রোপটের মতো বহু গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। এ কারণেই, একটি দেশ বা অঞ্চলের মধ্যে কতো বিচিত্র ভাষা রয়েছে, তার কূলকিনারা করা সহজ কাজ নয়। পৃথিবীতে মাতৃভাষার সংখ্যা প্রায় সাত হাজার। অনেক ভাষা বিলুপ্তপ্রায়, অনেক ভাষা বদলাতে বদলাতে অন্য রকম হয়ে গেছে, অনেক ভাষায় হয়তো কথা বলে মাত্র গুটিকয়েক মানুষ।
অষ্টম শতকে শুরু হয়ে সময়ের বিভিন্ন ধারা পথে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে অষ্টাদশ শতকের শেষে এসে বাংলা ভাষা তার বর্তমান রূপ পরিগ্রহণ করে। বাংলার নব জাগরণে, বাংলার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে এক সূত্রে গাঁথতে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে সর্বোপরি বাংলাদেশ গঠনে বাংলা ভাষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদার আন্দোলন ১৯৪৭ এ শুরু হয়ে ১৯৫২ তে পূর্ণতা পায়। ভাষার জন্য আর কোথাও জীবন দেয়নি কেউ, ভাষার দাবিতে মরণপণ সংগ্রাম-লড়াই-আন্দোলন হয়নি পৃথিবীর আর কোথাও। সর্বোপরি আমাদের ভাষার কারণেই ২০০০ সালে জাতিসংঘ কতৃক ঘোষিত হয় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। ১৯০টি দেশের মানুষ এ দিবসটি পালনের মধ্য দিয়ে নিজের ভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা ব্যক্ত করে, যাতে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিটি ভাষা স্ব মহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তাই দুনিয়াজোড়া এত ভাষার মধ্যে আমাদের বাংলা অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও অনন্য ভাষা । ভাষাভাষীর সংখ্যার ভিত্তিতে পৃথিবীতে বাংলার স্থান পঞ্চম। ভাষাগত বৈশিষ্ট্য, অলংকরণ, সাহিত্য সব মানদণ্ডেই বাংলা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ভাষা। ‘তুই-তুমি-আপনি’-র মতো এমন বৈচিত্র্যময় প্রকাশ আর সুললিত সুমধুর আবেগের কারণে প্রিয় বাংলা ভাষাকে নিয়ে আমাদের ভালোবাসা আর গর্ব অনেক অনেক বেশি। ভাষার সমৃদ্ধি নির্ভর করে এর যথাযোগ্য ব্যবহার, চর্চা, গ্রহণযোগ্যতা আর সার্বজনীনতার উপর। ভাষা দুর্বল হয়ে যাওয়ার নানাবিধ কারণের মধ্যে আছে ভাষার বিকৃতিসাধন, রূপান্তর, ব্যবহারে অসচেতনতা, অপব্যবহার, মতাসীন মহলের উদাসীনতা।
বিশ্বায়নের কালে আকাশ সংস্কৃতি আর অবাধ তথ্য প্রবাহের এ সময়ে টিকে থাকার প্রতিযোগিতায় অন্যান্য ভাষার সাথে আমাদের সমৃদ্ধ বাংলা ভাষাকেও নামতে হয়েছে কঠিন পরীায়। কিছু বিদেশি শব্দ সময়ের দাবিতেই বাংলায় ঢুকেছে। ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে এবং আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা থাকায় আমাদের ভাষায় ইংরেজির অতিমাত্রায় প্রাধান্য লণীয়। আর কে না জানে বাঙালি নিজেদের কৌলিন্য প্রকাশ করতে ইংরেজিকেই যুৎসই বিবেচনা করে। ইংরেজি জানলে সমাজের উঁচু শ্রেণিতে স্থান পেতে আর কোন বাঁধা নেই এমন ধারণাও মজ্জাগত। একাধিক ভাষায় দতা থাকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মুক্তবাজার অর্থনীতির এ সময়ে বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে প্রতি মুহূর্তে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটোছুটির করতে ইংরেজির বিকল্প নেই। তবে ম্যান্ডারিন, স্পেনীয় বা পর্তুগিজ ভাষাও বৈশ্বিক ভাষা হিসেবে নিজেদের দাবি করতে পারে। কারণ অর্থনীতির সাথে ভাষার যোগসূত্র অনস্বীকার্য। তাই ভাষাগত দতা একজন মানুষের অর্জিত সাফল্য বলা যেতে পারে। ভাষা প্রবহমান নদীর মতোই, যার হাজারো বাঁক। বাঁকে-বাঁকে পরিবর্তনের ছোঁয়া। কালের যাত্রাপথে তাই অন্য ভাষার ব্যবহার ব্যকরণগতভাবেই মেনে নেওয়া হয়েছে । বিদেশি শব্দ বাংলায় রূপান্তর করার পরীা নিরীায় কিছু শব্দের রূপান্তর বাংলায় স্থান পায় আবার কিছু রূপান্তর অনুত্তীর্ণ হয়। যেমন ‘মোবাইল ফোন’ এর বাংলা ‘মুঠোফোন’ শব্দটি বেশ ভালোই জায়গা করে নিয়েছে বাংলায়। কিন্তু ‘ফেসবুক’ শব্দের বাংলা ‘বদনবই’ বা ‘ইন্টারনেট’ শব্দের বাংলা ‘অন্তর্জাল’ শব্দটি খুব একটা কদর পায়নি বাংলায়। ‘ফেসবুক’ বা ‘ইন্টারনেট’ এর মতো শক্তিশালী শব্দের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি এর বাংলা অর্থগুলো। তাই সময়ের দাবিতে সার্বজনীন শক্তিশালী বিদেশি শব্দ মেনে নেওয়ার বিকল্প নেই। তবে অতিমাত্রায় বিদেশি শব্দের ব্যবহার ভাষাকে সংকটে ফেলে, ভাষার নিজস্বতা বাধাগ্রস্ত হয়। তবে ভাষার বিকৃতি মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। ইংরেজি হরফে বাংলা লেখা যেমন দূষণীয় তেমনি ভুল বা অশুদ্ধ বানানে বাংলা লেখা, পড়া ও বলাও অগ্রহণযোগ্য। খুব অসচেতনভাবে আমরা আমাদের প্রাণের ভাষাটিকে আবর্জনায় পরিণত করেছি। আবার আঞ্চলিক ও কথ্যভাষার সংমিশ্রণে অদ্ভুত উচ্চারণে বিকৃতি ঘটানো হচ্ছে, যা বাংলাভাষাকে দুর্বল করছে, শক্তিমত্তা ুণœ করছে। সৈয়দ শামসুল হকের মতো আঞ্চলিক ভাষায় ‘নুরলদীনের সারাজীবন’ লেখার সমতা কয়জনেরইবা আছে। ভেবে দেখার সময় এসেছে, যে ভাষার জন্য পৃথিবীর একমাত্র জাতি হিসেবে জীবন দিয়েছি সেই ভাষাকেই কেন এত অবজ্ঞা করছি। মাতৃভাষা শুদ্ধভাবে বলতে পড়তে এবং লিখতে পারার মধ্যে যে পরমানন্দ আছে, যেদিন আমরা বুঝতে পারবো সেদিন থেকেই বাংলা আবারো ঘুরে দাঁড়াবে। রবীন্দ্রনাথের মতো মহামানব বাংলাতেই সৃষ্টি করেছেন তাঁর অনবদ্য সব রচনা। রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়ে, গান শুনে হৃদয়ে যে আবেগ উথলে ওঠে তা কি অন্য ভাষায় ধরা যেত? জীবনের পরতে পরতে বাস্তবতা এবং পরা বাস্তবতার বোধ যা হৃদয় মনকে আলোড়িত করে, চেতনাকে গভীরভাবে আচ্ছন্ন করে, তা শুধু নিজের ভাষাতেই ব্যক্ত করা যায়। হৃদয়ের গভীর আবেগকে স্বরে এবং সুরে প্রকাশে নিজের ভাষাই একমাত্র আশ্রয়। একজন গর্বিত বাঙালি হিসেবে, একজন বাংলাভাষী হিসেবে আমার ভাষাই আমার প্রথম এবং শেষ অনুপ্রেরণা।

 

রাষ্ট্রভাষা বাংলা, রাষ্ট্রের ভাষা হোক
এম আর খায়রুল উমাম

একযুগের বেশি সময় আগের ঘটনা। জেলা শহরে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাকল্পে পরিচালিত একটি সংগঠনের শাখা কমিটি হবে। অনেক আলোচনা-পর্যালোচনা, পরীা-নিরীার পর বাছাইয়ে কমিটির সদস্য হয়ে গেলাম। সদস্যদের সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতিশীলতা এলো এবং সময়ের ব্যবধানে কমিটির প্রধানের দায়িত্ব অর্পিত হলো আমার উপর। দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় হঠাৎ করেই এক পরিস্থিতিতে জানা যায় আমার শিাগত যোগ্যতা এমন কমিটিতে কাজ করার উপযুক্ত নয়। স্বান্তনা পাই এই ভেবে যে, বাংলাদেশের দুর্নীতিতে শিতি শ্রেণির অবদান বিবেচনায় কোনো মূর্খকে সংগঠনে রেখে কর্মসূচির বাস্তবায়ন শোভন পর্যায়ে থাকতে পারে না। গ্রাম বাংলায় একটা কথা আছে মূর্খের প্রলাপ। প্রকৃতই মূর্খ। মূর্খ বলেই পদে পদে আটকে যাই। আজও যেমন আটকে আছি আমাদের ভাষা সংগ্রাম কীভাবে ভাষা আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়ে গেল সে প্রশ্নে। একটা সংগ্রামে কতটা অর্জন হলে তাকে আন্দোলনে পরিণত করা যায়। এটা যদি আজ বুঝতে পারতাম তাহলে ভাষা সংগ্রামের অর্জনকে নিয়ে নিজের মনের বিরোধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম। বাংলা ভাষার আজকের অবস্থানে নিজেকে সন্তুষ্ট রাখতে পারতাম। অমর একুশ আজ শহীদ দিবস হয়ে গিয়েছে আর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্ববাসীর সাথে পালিত হচ্ছে। ভোরে খালি পায়ে দল বেঁধে “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি”, প্রভাত ফেরীর কথা ইতোমধ্যেই আমরা ভুলে বসেছি। তবে গানটি এখনও মাইকে শোনা যায় এই যা ভরসা। স্বাধীনতা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার সম্মান দিয়েছে। কিন্তু ভাষা সংগ্রামের প্রায় ৭০ বছরে বা স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছরে বাংলা ভাষাকে আজও সর্বস্তরে প্রচলন এবং প্রাপ্য সম্মানের পূর্ণতা দেয়া সম্ভব হয়নি।
আমাদের প্রচলিত শিা ব্যবস্থায় বাংলা ভাষাকে যথাযথ সম্মানে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। মাথার উপর সংবিধান রেখে হাতে শিানীতি নিয়ে সুপরিকল্পিত ভাবে যে শিাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে তাতে জনগণের মধ্যকার বৈষম্য ক্রমবর্ধমান। সাধারণ জনগণের জন্য শিার মাধ্যম বাংলা এবং বিত্তবান শ্রেণির জন্য ইংরেজি প্রক্রিয়াটি চলমান। এখনো দেশে চাকরি, ব্যবসা, সবকিছুতে ইংরেজি অপরিহার্য ভাষা হিসেবে বিবেচিত। এতে করে দেশের বড় চাকরি ও ব্যবসা বিত্তবানশ্রেণির সন্তানদের আয়ত্ত্বে। সাধারণ জনগণের শিা ব্যবস্থায় বাঙালি বলে বাংলা, ইসলাম ধর্মাবলম্বী বলে আরবি এবং উন্নয়নশীল দেশের মানুষ হিসেবে ইংরেজি শেখানো হয়ে থাকে। তিনটি ভাষার চাপ সহ্য করে এগিয়ে যেতে গিয়ে প্রতিনিয়ত মুখ থুবড়ে পড়ছে প্রজন্মের উত্তরাধিকারেরা। স্বপ্নে পাওয়া পরীা নিরীার চাপে পড়ে শিাব্যবস্থার সিস্টেম লস হিসেবের বাইরেই থেকে যাচ্ছে। বিপরীতে ইংরেজি শিা আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের বাইরে নিয়ন্ত্রনহীন ভাবে বিদেশি পরিচয় পাবার দৌড়ে বিদেশি আইনে দুর্বার গতিতে ছুটে চলেছে। বিত্তবানদের সন্তানরা এই শিার উপকারভোগী হওয়ার কারণে সংশ্লিষ্টরা উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে দিন কাটিয়ে দিচ্ছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় সন্তানদের উন্নত বিশ্বে পড়ানো বা পাঠানোর ব্যবস্থা, সুযোগ হলে দেশে ফিরে শাসক-শোষক হয়ে দেশের অর্থসম্পদ পাচার করে বিদেশে বসবাসের পাকাপাকি ব্যবস্থা করে রাখে যারা দেশে এখন এই শ্রেণির মানুষদেরই জয়জয়কার। বাংলাদেশের সুখ-শান্তি ভোগের একচেটিয়া অধিকার তাদেরই।
বিদেশি ভাবধারায় শিতি শ্রেণি আজ বাংলাদেশ প্রেমী, বাংলাভাষা দরদী। সারা বছর যাই হোক ফেব্রুয়ারি মাস আসলেই বাংলা ভাষার মহিমা প্রচারে নেমে পড়ে তারা। স্বদেশপ্রীতি আর বাংলা ভাষাপ্রীতি একাকার হয়ে যায়। সাধারণ মানুষকে অতীত ঐতিহ্যের গর্বে আত্মহারা করে দেয়। বাঙালির মাতৃভাষার জন্য আত্মত্যাগের মহিমাকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করতে সারা বিশ্বে আজ ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের একটা প্লাটফর্ম দেশের জনগণকে উপহার দেয়া হয়েছে। এই প্রাপ্তির গর্বে-গৌরবে জাতি আজ ছাগলের তৃতীয় বাচ্চার মতো অকারণ পূলকবোধ করছে, আনন্দে আত্মহারা হয়ে শহীদ দিবস উদযাপন করছে। সালাম-বরকত-জব্বার রফিকের আত্মত্যাগে বাংলা ভাষার অর্জন সংবিধানে স্বীকৃতি। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে। অঙ্গীকার ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার। বাংলাভাষা রাষ্ট্রভাষা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু রাষ্ট্রের ভাষা হয়নি। স্বাধীনতা যে সুযোগ সৃষ্টি করেছিল তা আমাদের নিজেদের অযোগ্যতার কারণে গ্রহণ করা গেল না। সর্বস্তরে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতার জন্য লজ্জিত হয়ে আত্মশোধনের গরজ অনুভব না করে নিজেদের আরো আত্মপ্রত্যয়ী শক্তিমান হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া সর্বব্যাপী চলমান। সারা বিশ্বে মাতৃভাষা কতটা মর্যাদাবান হলো তা বিচারের আগে আমাদের নিজেদের অবস্থান বিবেচনার দাবি রাখে।
স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী পালনের প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে বলতে হচ্ছে আজও আমাদের উচ্চশিায় আর উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠা লাভে ব্যর্থ। আশ্চর্য হই যখন শুনি আমাদের কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষা আজও অর্ডিনেন্সের মাধ্যমে বহাল আছে। আগে শুনতাম পাঠ্য বইয়ের অভাব। গত ৭০ বছরেও দেশ এ সমস্যার সমাধান করতে পারল না। আর উচ্চ আদালতে বাংলা প্রচলনের সমস্যা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। তবে একটা বিষয় খুব পরিস্কার আমাদের দার্শনিকরা মাতৃভাষায় নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারেন না। এটা যদি পারতেন তাহলে কি উচ্চশিা আর উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলনে সমস্যা হতো? সমস্যা সমাধানের ন্যুনতম কোনো প্রচেষ্টাও আমাদের মধ্যে দেখা যায় না। আজও প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানাতে হয় আদালতের রায় বাংলায় লেখার জন্য। এখানে আভিজাত্য প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা চলছে। পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে দূর্বল হিসেবে চিহ্নিত করে তার সীমাবদ্ধতাগুলো প্রকাশের প্রচেষ্টাও আছে। ইতিহাস বিচারে বিষয়টি স্বাভাবিক। বাংলাকে রাষ্টভাষার মর্যাদা প্রদানের দাবিতে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক পাকিস্তান গণপরিষদে আনীত প্রস্তাবের স্বপে উপস্থিত বাঙালি মুসলমান সদস্যরা কোনো কথা বলেননি। বরং কেউ কেউ প্রস্তাবের বিরোধীতা করেন। সেই ধারাবাহিকতা থেকে মুক্তি ৫০ বছরেও হলো না, আগামী কতদিনে আসবে অনুমান করা কঠিন।
বছর বিশেক আগের কথা। ব্রিটেন প্রবাসী এক ভদ্রলোকের সাথে আলাপ। তিনি আমাদের শিার্থীদের ইংরেজি জ্ঞান দেখে লজ্জা পান। তারা ইংরেজিতে কথা বলতে পারে না, উচ্চারণ যথাযথ হয় না। ইংরেজি জানা খুব জরুরি কিনা জানতে চাওয়ায় ভদ্রলোকের এক বিশাল বক্তৃতা শুনেছিলাম। বিশ্বব্যাপী প্রভাব, আন্তর্জাতিক ভাষা, ইত্যাদি, ইত্যাদি। অন্য বিতর্কে না গিয়ে একটাই প্রশ্ন রাখতে চাই– দেশের সব শিার্থীদের জন্য ইংরেজিতে ব্যুৎপত্তি অর্জন আবশ্যক? আমাদের ভাষা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধ এ প্রশ্নের সমাধান করতে পারতো। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে আজ ইংরেজি জ্ঞান বিচার করে শিার উচ্চতা মাপা হচ্ছে, চাকরি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দেয়া হচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এখানে ইংরেজিতে কথা বলা বা বক্তৃতা করার মতাকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করা হচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনভাবে সব সুযোগ ভোগে ইংরেজিকেই একমাত্র অবলম্বন করে ফেলা হয়েছে যা আমাদের ভাষা সংগ্রামের সঙ্গে প্রকৃত অর্থে সাংঘর্ষিক। এই অবস্থা থেকে মুক্তির পথ বের করার দায়িত্ব যে রাজনীতির, যে রাজনীতি সাধারণ জনগণের জন্য ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগকে অন্ধকারের পথ থেকে আলোর পথে আনবে, তারাই আজ সব আলো নিজেরা দখল করে নিয়েছে।
বাঙালির একটা সুনাম আছে তারা বিশ্বের যেকোনো ভাষা অন্য সবার থেকে তাড়াতাড়ি রপ্ত করতে সম। আমাদের মেধাবী সন্তানরা বিশ্বের অনেক দেশে গিয়ে কয়েক মাসের মধ্যে তাদের ভাষা রপ্ত করে শিার সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে থাকে। এটা যদি সত্য বলে মানি তাহলে আমাদের শিশু শিার্থীদের বিদেশি ভাষা শিা আবশ্যক কেন করা হয়? দেশে সবার জন্য বিদেশি ভাষা শিার প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে না। দেশ ও জাতির প্রয়োজন বিবেচনায় অল্প কিছু শিার্থী বা আগ্রহী কিছু শিার্থী বিশেষ ব্যবস্থায় বিদেশি ভাষা শিখে নিতে পারে। তাহলে আমাদের শিশু শিার্থীরা বিদেশি ভাষার চাপ থেকে মুক্তি পাবে। মাতৃভাষায় শিা গ্রহণের সুযোগ নিয়ে মানসম্পন্ন শিায় নিজেদের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার সুযোগ পাবে। আর থাকে অগ্রসরমান বিশ্বের জ্ঞানবিজ্ঞানকে ধারণ করার ব্যবস্থা করা। এেেত্র সরকার উদ্যোগী হলেই একটা অনুবাদকের দল তৈরি করতে পারে যারা প্রতিনিয়ত বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুবাদ শিার্থীদের হাতে তুলে দেবেন। এতে করে আমাদের শিার্থীরা মাতৃভাষায় বিশ্বকে জানতে পারবে এবং নিজেদের যোগ্য করে তুলতে সম হবে।
দেশ ও জনগণের জন্য বাংলা ভাষার পরিবেশ ও পরিস্থিতি এমনটা হলেও বাংলা ভাষার উন্নয়নে আমাদের অবদানও নেহাত কম না! শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখ রাখলেই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যায়। উপরন্তু বাংলা একাডেমি বাংলা বানান সংস্কার করে ব্যবহারকারীদের জন্য পথকে আরো সুগম করে দিয়েছে। বাংলা উন্নয়ন বোর্ড বন্ধ হয়ে গেলেও বাংলা একাডেমি এ সংস্কারের দায়িত্ব পালন করে চলেছে। কেন বাংলা একাডেমি কর্তৃক এ দায়িত্ব পালন করা হলো তা সাধারণ মানুষ জানে না। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইত্যাদি রথী-মহারথীদের বানান রীতি পরিবর্তন করার প্রয়োজনীয়তা বোধগম্যতো নয়ই বরং বলা চলে সনাতনী বানান রীতি পরিবর্তন করে বর্তমানে একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে। মুক্তির জন্য কত বছর অপো করতে হবে কে জানে? এই রীতি পরিবর্তন বাংলা ভাষাকে পিছিয়ে দিলো কিনা সেটাও ভেবে দেখা প্রয়োজন।
ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি সম্মান জানাতে বাংলাভাষাকে উপযুক্ত স্থানে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। জাতিগত দায় মেটাতে আজ সাধারণ মানুষের সর্বেেত্র মাতৃভাষাকে অপরিহার্য করে তোলা হোক। শিা ও প্রশাসনের সর্বস্তরে বাংলা ব্যবহার নিশ্চিত করা হোক, বাধ্যতামূলক করা হোক। আর এ কাজগুলো করার জন্য অমর একুশে শহীদ দিবস নয়, রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হোক। রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালন করা গেলে ৫২’র ভাষা সংগ্রামের কথা জাতি স্মরণ করতে পারবে এবং তার ল্য উদ্দেশ্য পূরণে আন্তরিক উদ্যোগী হবে। অমর একুশে পালন স্বার্থক হবে। যদিও মূর্খের প্রলাপে সাধারণ মানুষের চাহিদাকে ফলপ্রসূ করতে পারবে এমনটা আশা করা যায় না। তবে বাংলাভাষার উপর একের পর এক করে দিনে দিনে তাকে যে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে তা থেকে মুক্তির জন্য ফেব্রুয়ারি প্রকৃত সময়। সমাজ সংস্কারের দায়িত্ব গ্রহণকারীরা বাংলাভাষাকে আপন সম্মানে অধিষ্ঠিত করতে দায়িত্ববান হয়ে ব্যাপক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে অন্ধকার দূর করে আলোর বাংলাদেশ তৈরিতে নিবেদিত হবেন- এ আশায় থাকবো।

বাংলা গাথা
সাবরিনা করিম মুর্শেদ

গোপাল ভাঁড় আর মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের গল্প তো কারো অজানা নয়। আবারো বলি। কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় নাকি একজন বিদূষক ছিলেন যিনি অনেকগুলো ভাষায় কথা বলতেন; এবং তা এতটাই শুদ্ধ ভাবে বলতেন যে আদতে তার মাতৃভাষা কী, বা কোথা থেকে এসেছেন, কেউ বুঝতে পারত না। মহারাজ তাই একদিন বললেন, যে বলতে পারবে সেই বিদূষকের মাতৃভাষা কী, তাকে তিনি পুরস্কৃত করবেন। তাই শুনে গোপাল ভাঁড় রাজসভার দরজার পাশে অন্ধকারে লুকিয়ে থাকলেন। যেই বিদূষক রাজসভায় ঢুকতে গেলেন, গোপাল অন্ধকারের মধ্যে থেকে ছুটে এসে দিলেন এক প্রচণ্ড ধাক্কা।
ব্যস! ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠে বললেন, ‘সড়া অন্ধা আছিস?’
গোপাল তৎণাৎ একগাল হেসে মহারাজ কে বললেন, “মহারাজ, উনি উড়িষ্যা থেকে এসেছেন, ভাষা উড়িয়া।” মাতৃভাষা বা নিজের ভাষা, যাই বলা যাক না কেন, এমনই তার আবেদন। প্রচণ্ড আনন্দে বা চরম কষ্টের প্রকাশে অনিবার্যভাবেই উচ্চারিত হয় সেই ভাষা।
জননীর জঠর হতে মুক্তি লাভ করে শিশু কান্না করে তার আগমনী বার্তা জানান দেয়। কান্নার ভাষাই একমাত্র ভাষা যা তার মুখে ফোটে তখন। দেশ-কাল-পাত্রের ভেদে তাকে আলাদা করা যায় না। শিশুর মুখের সারল্য আর হাসির মতো তার সেই ভাষাও বড়ই মাধুর্যময়। তারপর ধীরে ধীরে সে শেখে তার নিজের ভাষা, তার মায়ের ভাষা। তার অস্তিত্ব জুড়ে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সেই ভাষা। মায়ের কাছে শেখা ভাষা তাকে স্বাবলম্বী করে তোলে নিজেকে প্রকাশ করতে, নিজের চাওয়া-পাওয়াগুলো জানিয়ে দিতে। নিজ ভাষা অপার মমতায় এভাবে জড়িয়ে পড়ে তার জীবনের প্রাত্যহিকতায়। মা যখন চাঁদকে ডাকেন তার চাঁদপানা সন্তানের কপালে টিপ দিতে, তখন শিশুও তার আধো আধো অর্থহীন ভাষায় মায়ের কপোলে আদরের চিহ্ন এঁকে দেয়।
এই যে ভাষার প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসার কথা বলছি, এটি একটি সার্বজনীন অনুভূতি। সর্বদেশে সর্বকালে নিজ নিজ ভাষা মানব জাতির কাছে শ্রেষ্ঠ। আদিম গুহামানবও তাদের চিত্রাঙ্কিত ভাষায় ব্যক্ত করেছে মনের কথা। ভাষার প্রতি ভালোবাসার েেত্র একমেবাদ্বিতীয়ম না হলেও, আবেগপ্রবণ জাতি হিসেবে বাঙালির ভাষাপ্রেম অনেক দৃঢ়। পৃথিবীতে একমাত্র জাতি আমরা, আমাদের মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে ১৯৫২ সালে সংগ্রাম করেছি, প্রাণ দিয়েছি। ১৯৯৯ সালে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করার জন্য আমাদের ভাষা দিবসকেই স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
বাঙালির মাতৃভাষা বাংলা, এ আমাদের মায়ের ভাষা, প্রাণের ভাষা। আমাদের প্রজন্মের সবাই যারা স্বাধীনতার পরে জন্মেছি, তারা ভাষা আন্দোলন দেখিনি, তবে অগ্রজদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে আর কিছু না পেলেও, পেয়েছি এই অত্যাশ্চর্য অনুভূতি; বাংলার প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসার অনুভূতি।
আমরা বেড়ে উঠেছি বাবা মায়ের হাত ধরে খালি পায়ে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে, ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাস জেনে। আমাদের বেড়ে ওঠার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। আমাদের অলস দুপুর কেটেছে রবি ঠাকুর, সত্যজিৎ রায় থেকে শুরু করে শাহরিয়ার কবিরের লেখনী শক্তির সাথে পরিচিত হয়ে। আমাদের শৈশবে ছন্দের মায়াজাল বিস্তৃত হয়েছে নজরুল থেকে বিপ্রদাশ বড়ুয়ার ছড়ায় ছড়ায়। না, আমি আমার প্রজন্মের হয়ে আত্মম্ভরিতা প্রকাশে আগ্রহী নই। এমনটা তো নয় যে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সবাই এই অনুভূতি, এই ভালোবাসাকে ধারণ করে না, অবশ্যই আমাদের বয়োকনিষ্ঠ অনেকেই বাংলা ভাষার প্রেমে সিক্ত।
বাংলা তার নিজের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার উজাড় করে দিয়ে সেই ভালোবাসা আদায় করে নেয়। ইট কাঠের পাঁজরায়, নিরেট প্রাত্যহিকতার মাঝে যেমন বাংলা মিশে থাকে নিতান্ত অভ্যাস হয়ে, তেমনি সে মাঝে মাঝে রূপকে উপমায় সালাঙ্কারা সুন্দরী হয়ে টোকা দেয় মনের গহীনে। খুব সাধারণ ভাবে বলা “কি খবর, ভালো আছো তো” তাদের যেমন আপন করে নেয়, তেমনি কবির কথায় “তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ” শুনে তাদের কারো কারো হৃদয় উথাল পাথাল হয় বৈকি! নজরুলের “আমি চাঁদ নহি, অভিশাপ” পড়ে যেমন এক অব্যক্ত আবেগে মন ভারাক্রান্ত হয়, তেমনি যখন অচিন রায় লেখেন “দাদুরী ডাকিছে সঘনে,” ব্যাঙের ডাকও বুঝি মিষ্টি শোনায়। আপনি বলতেই পারেন এ তো সাহিত্যের কথা। শুদ্ধ বাংলা যা শুধু গ্রন্থমাঝেই সীমাবদ্ধ। রোজকার কূটকাচালি পূর্ণ জীবনে যে বাংলা আমরা ব্যবহার করি, সে তো সেই রবি ঠাকুরের শেষের কবিতার ‘ঘড়ার জল’। এ তো আর অতল দীঘির জল তো নয় যাতে অবগাহন করা যায়।
একথা অনস্বীকার্য যে বাংলায় কথ্য ভাষার সাথে সাহিত্যের ভাষার পার্থক্য আছে। তবে সাহিত্য চর্চা কোন ভাষায় হবে, সুধীজনের ভাষায় না প্রান্তিক বা ব্রাত্য জনের ভাষায়, সে সম্পর্কে আলোচনা করার আলোচনা করার ধৃষ্টতা আমার নেই। কবি নজরুল কেন জানালার পাশে সুপারি গাছ না লিখে “জানালার পাশে গুবাক তরুর সারি” লিখলেন, তা নির্ণয়ের জন্য বাংলার অনেক দিকপাল, রথী মহারথীরা রয়েছেন। মনে পড়ছে, আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক খন্দকার আশরাফ স্যার কবি, অ-কবির পার্থক্য বোঝাতে বলেছিলেন, কবি যাকে বলবে ‘নীরস তরুবর’, আমরা অ-কবিরা তাকেই বলবো ‘শুষ্কং কাষ্ঠং’।
আমরা যারা ছা-পোষা বাঙালি, তাদের কাছে বাংলা ভাষা প্রতিদিনের ব্যবহারে শুষ্কং কাষ্ঠং হবার পরও অমলিন থাকে। বাংলা ভাষা নিয়ে এপার-ওপারের পার্থক্যে, ঘটি-বাঙালের চিরন্তন তর্কে নাই বা গেলাম। আপনি ‘কাঁচালঙ্কা’ খাবেন না ‘কাঁচামরিচ’, ‘অভ্যাস’ বদলাবেন না ‘অভ্যেস’, সে এক অম্লমধুর তর্ক। তার জন্য বাংলা ভাষার প্রতি ঘটি আর বাঙাল উভয়েরই ভালোবাসায় কোন ঘাটতি পড়ে না।
এই যে যাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাংলা ভাষা মিশে আছে, তাদের একটা বিরাট অংশ হলেন তারা, যারা মনের দিক থেকে বাংলার কাছাকাছি থাকলেও, ভৌগোলিক ভাবে অনেক অনেক দূরে থাকেন। পরিযায়ী জীবনে দানা খুঁটে খাওয়া কবুতরের মতো তারা ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়ান আংশ দ্রাঘিমাংশের হিসেব মিলিয়ে। সে উড়ানে রঙ লাগায় কত ছবি, কত গান; পৃথিবীর হাজারো ভাষায়। তবে দিন শেষে ুদ্র খোপে ফিরে বাকবাকুম করেন ঐ সেই বাংলা ভাষাতেই।
প্রবাসের বাংলা পাড়ায় তারা শুধু ডাল ভাত খেতে বা চানাচুর কিনতে যান না, আরো দশজন অতীব সাধারণ “দ্যাশের” মানুষের মুখের বাংলা বুলি শুনতে যান। বাংলা নিয়ে তাদের চাওয়া পাওয়া খুবই সামান্য। এই যেমন আমাদের পুত্রদ্বয়ের কাছে আমাদের চাওয়া, সাহিত্যিক হতে হবে না; শুধু নিজ ভাষাটাকে বাঁচিয়ে রাখো। বাংলা ভাষা তোমার সত্ত্বার অংশ। তাকে তুমি অস্বীকার করতে পারো না। চৌকাঠ ডিঙিয়ে ঘরে ঢুকলেই কিন্তু তুমি বাঙালি। তাদের পিতামহী আরো সরস করে তার ভাষা সংক্রান্ত মতামত জানিয়ে দেন। পৌত্র তার হাউমাউ করে ইংরেজিতে কথা বলে কাঁদলে তিনি বলবেন, “এই, খবরদার, ইংরেজিতে কাঁদবে না, বাংলায় কাঁদো। এতে পুত্র মহাশয়ের কান্নার বেগ প্রশমিত না হলেও, তার মায়ের একখানা আকর্ণবিস্তৃত হাসি দেখা যায়। আদরে আহাদে মা যখন তাদের নিয়ে ছড়া কাটে

ইতুল বিতুল ইলতু পিতুল
তেঁতুল গাছের তল,
ইলতু বুড়া দাদার সাথে
খেলছে শুধু বল।
অথবা,
হুতুম হাতুম আর বাবা মা,
এক বাড়িতে থাকে
যখন ঘুমায় তখন তাদের
নাকটি সবার ডাকে।
হুতুম হাতুম দুজনেই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে, ‘নাক ডাকে’, দ্য নোজ কলস! এই নির্মল আনন্দের ষোল আনাই বাংলা ভাষার মাহাত্ম্য। এ যে মায়ের হাস্যকর কাব্য প্রতিভা নয়, সে কথা বলার অপো রাখে না।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনটাতেও রাঙা প্রত্যুষে, যখন সূর্যটাও হাই তুলে পাশ ফিরে শোয়, আমরা তখন ছুটেছি বাংলা স্কুলে। শত অনুযোগ করেও ছেলেটা আমার বাংলা পড়া ছাড়েনি কিন্তু। বরং প্রবাস জীবনের প্রথম ভাষা দিবসে, যখন সে জীবনের ষষ্ঠ বর্ষেও পদার্পণ করেনি, স্কুল যাবার আগে আমাকে বলে যায়, “মা, এখানে তো শহীদ মিনার নেই; তুমি লেগো দিয়ে একটা শহীদ মিনার বানিয়ে রেখ। আমি স্কুল থেকে এসে ফুল দেব। ” আর এর বছর দুয়েক পরেই সে মা-কে নিয়ে বাংলাতে গল্প লেখে। সাহিত্যমূল্য যাই হোক না কেন, বাংলা ভাষায়, বাংলা হরফে লেখা সেই গল্প বাবা মায়ের মনে কর্মব্যস্ত দিনের শেষে প্রশান্ত এক সন্ধ্যা নামায়।
অনেকেই অবাক হয়েছে যে আমার ছেলেটা আন্তর্জাতিক স্কুলে পড়ে বাংলা স্কুলে কেন যাচ্ছে। পরীা তো দিতে হবে না, নম্বরও যোগ হবে না, তবে কি লাভ? আসলে আমাদের প্রবাসীদের বাংলা জানা, শেখা লাভ-লোকসানের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকে না। আমাদের লাভের গুড় আমরাই খাই, পিঁপড়েতে না। বিশেষ করে যখন আত্মজ, আত্মজাকে বাংলায় শুধু কথা বলতে শুনি আমার সব লাভের খতিয়ান মিলে যায়। তারা হয়তো পরিশীলিত, ব্যাকরণ সমৃদ্ধ বাংলা বলে না। “মা, গাড়ি ডেকবে (গাড়ি ডাকবে)? অথবা “আজকে একদম ঘেমিনি, (খেলতে গিয়ে ঘেমেছ? এর উত্তরে)”, “নতুন টিচার অনেক ভালো, মিসটেক বানালেও কিছু বলে না (কারণ, ইউ মেক মিসটেক ইন ইংলিশ), মাঝে মাঝে এসব ‘অদ্ভুতুড়ে’ এবং ‘হাঁসজারু’ মার্কা বাক্য শুনতে পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে আবার ‘পাগল’ এর স্ত্রী লিঙ্গ ‘পাগলিনী’ হলে, ‘ছাগল’ এর স্ত্রী লিঙ্গ কেন ‘ছাগলিনী’ হবে না? কেন শিকিা কেটে দিয়ে ‘ছাগী’ লিখতে বললেন, তার সদুত্তর দিতে গলদঘর্ম হতে হয়।
তারপর আবার তারাই যখন ক্রিকেট খেলায় বাংলাদেশ জিতলে “সাবাস বাংলাদেশ” লিখে পোস্টার নিয়ে ঘোরে, আত্মতৃপ্তির পারদ আরো খানিকটা ওপরে ওঠে। অনেক বন্ধুদের তাই দেখি প্রবাস জীবনে শত ব্যস্ততার মাঝেও সন্তানের সাথে বাংলায় চর্চা করতে।
ছানাপোনাদের মুখে এহেন ভুলে ভরা বাংলা শুনে আমার বন্ধুরা অনেকেই হা-হুতাশ করে। তাদের প্রতিনিয়ত মনে হয়, এই যে সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের খোঁজে ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়ানো, এর মাশুল দিতেই বুঝি এসব আধিভৌতিক বাংলা শুনতে হয় তাদের। আমার অবশ্য এরকম মনে হয় না; আমি মনে করি বাংলা ভাষা যদি হৃদয়ে থাকে, ভৌগলিক দূরত্ব তাকে মুছে ফেলতে পারে না। অনেক প্রবাসী বন্ধু এবং তাদের সন্তানদের কথা জানি যারা শুদ্ধ সুন্দর বাংলা ভাষা বলেন এবং লেখেন। আবার এমন অনেক অনেক বাঙালি দেশেই আছেন যারা সেই হাঁসজারু মার্কা বাংলা ভাষায় কথা বলেন।
বাংলা ভাষার বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপ সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। নোয়াখালি, সিলেট বা বরিশাল-পটুয়াখালির ভাষা, যাতেই আপনি কথা বলুন না কেন, তার প্রত্যেকটি কিন্তু একটি সম্পূর্ণ সমৃদ্ধ ভাষা, যা সম্পূর্ণ ভাবে বক্তার মনের ভাব প্রকাশের যোগ্য। আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা তাই কখনই দোষণীয় নয়, বরং, আমি বলব এর চেয়ে স্বাভাবিক আর কিছুই হতে পারে না। আমি বাংলা ভাষার যে রূপের কথা বলছি, তার যথার্থ নাম আমি নিজেও জানি না। তবে আমার মনে হয় বাংলা ভাষার উৎপত্তি যেমন সংস্কৃত থেকে এবং মাগধী পালি ও প্রকৃতের মাধ্যমে বিবর্তিত হয়ে আজকের এ রূপে এসেছে, তেমনি এই ভাষার মোড় ঘুরেছে ৯০’ দশকে আরজে এবং ভিজেদের হাত ধরে এবং ছড়িয়ে পড়েছে আজকের ফেসবুকে এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। আপনি কি ভাবছেন যে আমি বাংলা ভাষায় পরিবর্তনের বিপ?ে
না, ব্যপারটা সেরকম নয় কিন্তু। ভাষার ধর্মই হল যে সে সতত বহমান। তার পরিবর্তন ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। যদি সাহিত্যের ভাষার কথা বলি, যা বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল ইসলাম লিখে গেছেন, আজকের কবি সাহিত্যিক সে বাংলা ভাষায় লেখেন না। ঠিক যেমন শেকসপিয়র যে ইংরেজিতে সাহিত্য চর্চা করেছেন, এখন আর সে ভাষা চলে না। আর সময়ের সাথে সাথে যেখানে সংস্কৃতি, ইতিহাস এমনকি একটি সমাজের চিত্র বদলে যায়, সেখানে আমদের প্রাত্যহিক জীবনের ভাষা তো বদলে যাবেই।
“সুন্দর লাগছে” হয়ে যাবে “ঝাকাস”; দারুণ হয়ে যাবে ওয়াও, “সমস্যা” হয়ে যাবে “প্যারা” এটাই স্বাভাবিক। এই আমার মতো পুরনো বাংলা ভাষা-ভাষীকে একটু বুঝে নিতে হয় আরকি! নতুন শব্দ ব্যবহার ঠিক আছে, তাই বলে বাংলা ভাষার মূল কাঠামোও কি ঠিক রাখা দুষ্কর? ইংরেজি হরফে বাংলা লেখা দেখতে দেখতে “গেবন” (পড়ুন জীবন) “ভাগা ভাগা” (অর্থাৎ ভাজা ভাজা ) হয়ে গেল। নিজেকে তাই বলি “অরা পাগলি মুরাদ টাকলা সিকা না” (পড়ুন, ওরে পাগলি, মুরোদ থাকলে শিখে নে)। এহেন ভাষাচর্চাও হয়তো স্বাভাবিক, কারণ ইংরেজি না জানলে আপনি যেমন ‘্যাত’, বাংলা না জানলে আপনি ‘কুল’। কাজেই ভুল বানানে অশুদ্ধ উচ্চারণের বাংলা লিখে আপনি কোনভাবেই ভাষাদূষণ ঘটাচ্ছেন না। তবে এই ইংরেজি হরফের বাংলা লেখার ব্যাপারটা যদিও বা না দেখার ভান করা যায়, বাংলা হরফের বাংলা ভাষা লেখা এবং ত্রেবিশেষে শোনা, সত্যিই গাত্রদাহের উদ্রেক করে। “বন্দু তুমি আমারে ট্যাগাইলানা কেনো”? এ জাতীয় বাক্য দেখে তার মর্মোদ্ধারের জন্য অভিধান হাতড়াতে হয়।
মুদ্রার উল্টো পিঠে থাকা আমাদের বন্ধুদের তাই এই নব্য ভাষায় বলি, “চাপ নেবেন না বস! পোলাপানকেও প্যারা দেবেন না ঝাকানাকা ভাষা ছেড়ে আপনার মত ঝাকাস নাকি আজাইরা বাংলা বলবার জন্য”। গৌরচন্দ্রিকায় যে গল্প বলেছিলাম, সে গল্প কিন্তু ঐ বিদূষকের একার নয়, আমাদের সবার। আপনি শুধু বাংলা বলে যান আপনার শিশুটির সাথে। হোঁচট খেয়ে পড়লে সে নিশ্চিত বলে উঠবে, “উফ, মাগো! মরে গেলাম। চোখের মাথা খেয়েছি”।

ভাষা হিসেবে বাংলা কতটা প্রভাবশালী
আব্দুল্লাহ শহীদ

ভাষা মনন ও বস্তুজগতে প্রভাবশালী। আমরা মনে ভাব তৈরি করে তা ভাষায় প্রকাশ করি। তবে সেই মনের জগতকে ভাষা নিজেই প্রভাবিত করতে পারে। তাই ব্রিটিশরা উপনিবেশ গুটানোর পরেও তাদের ভাষা ইংরেজির প্রসার এখনো কলোনিগুলাতে উপনিবেশিক প্রভাবের উপস্থিতি হিসেবেই ভাবা হয়। সব ভাষা টিকে থাকে না, কালের গর্ভে হারিয়ে যায়; সাথে হারায় সেই ভাষার মানুষের সংস্কৃতি ও ইতিহাস। পৃথিবীতে ৬,০০০ এরও বেশি কথ্য ভাষা থাকলেও কিছু ভাষার ভাষাভাষীর সংখ্যা একেবারে কম। প্রায় দুই হাজার ভাষা আছে যা এক হাজার এর চেয়ে কম সংখ্যক মানুষ বলতে পারে (সুত্র: চেন, “পাওয়ার লেংগুয়েজ ইন্ডেক্স”)। ফেব্রুয়ারি আমাদের গৌরবের মাস; ভাষার জন্য রক্তয়ের মাস। আমাদের বিবেচনার সময় এসেছে ভাষা হিসেবে আমাদের বাংলা কতটুকু প্রভাবশালী। ভাষার প্রভাবই বা আমরা কীভাবে নির্ণয় করব? আমরা নিজেদের ভাষা অন্যদের উপরে চাপাতে চাই না; তবে নিজেরা য়ে যেতে চাই না।
ভাষার প্রভাব বিভিন্নভাবে পরিমাপ করা যায়। ফ্রান্সের প্রভাবশালী ব্যবসা বিদ্যালয় ইনসিয়াডের ডিস্টিংগুউইশড ফেলো জনাব কাই এল চেন ভাষার প্রভাবের বিভিন্ন মাপকাঠিকে এক জায়গায় করে “পাওয়ার ল্যাংগুয়েজ ইন্ডেক্স” বানিয়েছেন। এটা ইন্ডেক্স বা সূচকের আলোকে ভাষার প্রভাব সংখ্যায় প্রকাশের চেষ্টা করা হয়েছে। যদিও সূচকের নিজস্ব কিছু দুর্বলতা রয়েই যায়; তবে চেন সাহেবের সূচক দিয়ে মোটামুটিরকম ভাষার প্রভাবের ধারণা পাওয়া। তা আলোচনা করছি; তার প্রেেিত বাংলা কেমন আছে এবং কীভাবে সর্বতোভাবে প্রয়োজনীয় কিছু েেত্র প্রভাব বিস্তার করতে পারে তাও তুলে ধরছি।
উল্লেখিত সূচকে ভাষার প্রভাবের বলয়কে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি ভাগের পরিমাপযোগ্য কিছু মাপকাঠিসহ গুরুত্ব ইনডেক্সে কেমন তার শতকরা ভাগ ব্র্যাকেটে উল্লেখ করা হোল। (১) ভুগোল (২২.৫%): ভাষা ব্যবহার করে কেমন ভ্রমণ করা যায়? এটা পরিমাপ করা হয়েছে তিনটি সংখ্যা দিয়ে, ‘ভাষা কয়টি দেশে চালু আছে’, ‘ওই দেশগুলোর আয়তন কত’, ‘ওই দেশগুলোতে ইনবাউন্ড বা আগত পরিব্রাজকের সংখ্যা কত’। (২) অর্থনীতি (২২.৫%): ভাষা ব্যবহার করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কতটুকু অংশগ্রহণ করা যায়? এ প্রশ্নের উত্তরে কিছু অর্থনীতির মাপজোক আমলে নেয়া হয়েছে; জিডিপি (পিপিপি), মাথা পিছু জিডিপি(পিপিপি), রফতানি, ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেট, ‘স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস’ কম্পোজিশন বা ভাষার প্রধান দেশের মুদ্রা আইএমএফ (ইন্টারন্যশনাল মনিটারি ফান্ড) এর মুদ্রা সঞ্চয় তহবিলের শতকরা কত ভাগ । (৩) যোগাযোগ (২২.৫%): ভাষা ব্যবহার করে আলাপ আলোচনার ব্যপ্তি কেমন? এটা পরিমাপ করা হয়েছে চারভাবে: নেটিভ বা দেশীয় ভাষাভাষীর সংখ্যা, কত মানুষের কাছে এই ভাষা দ্বিতীয় ভাষা, পরিবারের গড়পড়তা সদস্য সংখ্যা, এবং আউটবাউন্ড ট্যুরিস্ট বা বাইরে গমনকারী পরিব্রাজকের সংখ্যা। (৪) জ্ঞান ও মিডিয়া (২২.৫%): ভাষা জানলে জ্ঞান আহরণ ও মিডিয়া ব্যবহার কতটুকু করা যায়? এটা মাপা হয়েছে ভাষায় ‘ইন্টারনেট কন্টেন্ট’, ‘ফিচার ফিল্মের সংখ্যা’, ‘প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভাষার ব্যবহার’ ও ‘একাডেমিক জার্নালের সংখ্যা’। (৫) কূটনীতি (১০%): ভাষা আন্তর্জাতিক সম্পর্কে কেমন কাজে দেয়? এটা মাপা হয়েছে, “আইএমএফ”, “ওয়ার্ল্ড ব্যাংক”, “ইউনাইটেড নেশন্স” (জাতিসংঘ) ও “প্রথম দশটি বহুজাতিক সংগঠনে” ভাষার ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে। এসব মাপজোক এক জায়গায় করে সূচকের মাধ্যমে প্রতিটি ভাষাকে একটা স্কোর দেয়া হয়।
সূচকে সবচেয়ে বেশি স্কোর পেয়েছে ‘ইংরেজি’। সূচকে উল্লেখিত সব দিক দিয়েই ইংরেজি এগিয়ে আছে। এর পরে ক্রমানুসারে প্রভাবশালী হলো ম্যান্ডারিন, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, অ্যারাবিক, রাশিয়ান, জার্মান, হিন্দি, জাপানিজ ও পর্তুগিজ। বাংলা ৩০তম স্থান পায়। বাংলার উপরে হিন্দি ছাড়াও দণি এশিয়ার ভাষার মধ্যে আছে তামিল (২৯তম)। জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলা ভাষাভাষী অনেক হওয়ার কারণে বাংলা স্কোর বেশি পায় ভৌগলিকে; সেই স্কোর অনুযায়ী বাংলা ষষ্ঠ স্থান দখল করে আছে। কিন্তু বাংলা পিছিয়ে গেছে সূচকের ‘অর্থনৈতিক’, ‘যোগাযোগ’, ‘মিডিয়া’, ও কূটনীতি’’ দিক থেকে। কুটনীতির েেত্র অবশ্য প্রথম কয়েকটি ভাষা ছাড়া (যেমন, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ প্রথম স্থানে; স্প্যানিশ দ্বিতীয়; অ্যারাবিক তৃতীয়; রাশিয়ান পঞ্চম, ম্যান্ডারিন ষষ্ট, জাপানিজ সপ্তম, ও রাশিয়ান অষ্টম) বাকীদের তেমন উল্লেখযোগ্য প্রভাব নেই। তবে সূচকের অন্যান্য েেত্র ভাষাগুলোর স্তর বিন্যাস ও দূরত্ব আছে বেশ। অর্থনীতির েেত্র বাংলা ৭৩ স্থানে, বেশ দুঃখের বিষয়; আরো পরিতাপের বিষয় হলো ‘জ্ঞান ও মিডিয়ার’ েেত্র বাংলা ৩৬তম অবস্থানে। যোগাযোগের েেত্র ২৬তম আছে বাংলা। এই সূচকে অর্থনীতির উন্নতির উপরে বেশ জোর দেওয়ার কারণে অর্থনৈতিক অবস্থার দিক থেকে বাংলা কম স্কোর পেয়েছে। দেশ এগিয়ে গেলে এবং আয়ের বৈষম্য কমে আসলে বাংলা এগিয়ে যাবে, তা সময়সাপে একটা ব্যপার। তবে আমি মনে করি, জ্ঞান ও মিডিয়ার েেত্র বাংলা পিছিয়ে থাকা আমাদের স্বল্প, দীর্ঘ, উভয় মেয়াদের খামখেয়ালীর বহিঃপ্রকাশ। এেেত্র যথেষ্ট উৎকর্ষ সাধনের সুযোগ আছে; সেটা বিশ্বায়নের সাথে বাংলাকে দূরে রেখে নয়। নিম্নে এরকম কিছু বিষয় ও তাদের নায্যতা তুলে ধরলাম।
বহুভাষা এক বিশেষ দতা: বিজ্ঞান বলে, বিভিন্ন ভাষায় দতা ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধি করে। আমাদের শিা প্রতিষ্ঠান ও অফিস আদালতে বিভিন্ন ব্যপ্তিতে বাংলা ও ইংরেজি উভয়েরই প্রচলন আছে। কিন্তু অনেক বিষয়ে আন্ডারগ্রাজুয়েট স্তরে এসে দেখা যায় বাংলার গুরুত্ব কমে যায়। ফলে শিার্থীদের বাংলার প্রায়োগিক দতা কমে আসে। এেেত্র, আন্ডারগ্রাজুয়েট (পাস ও অনার্স) স্তরে ন্যুনতম বাংলা দতা নিশ্চিত করার পদপে নিতে হবে। শুধুমাত্র ইংরেজি নয়, বাংলায় ভালো দতা সরকারি বেসরকারি উভয় কাজের েেত্রই ব্যক্তিকে উন্নত মানব সম্পদে পরিণত করতে পারে। এক ভাষায় অর্জিত দতা যে অন্য ভাষায় দতা অর্জনে সহায়তা করে, এ বিষয়ে সর্বব্যপী আলোচনা ও জাগরণ দরকার।
বাংলায় ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট: গণ্যমান্য ব্যক্তিরা অনেকেই আজ সামাজিক মাধ্যমে বাংলায় লিখছেন। তা বাংলায় ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট বা ডাটা উৎপাদন করতে বেশ সহায়তা করছে। দেশীয় বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও ওয়েব কন্টেন্ট বাংলায় রাখতে উৎসাহিত করা উচিত। তাছাড়া বাংলায় লেখা বিভিন্ন আর্কাইভ ও ঐতিহাসিক দলিল, ডকুমেন্টস ইত্যাদি মেশিন রিডেবল করে ওয়েবে ছেড়ে দেয়া যায়।
ডিজিটাল হিউম্যানিটিজ ও কম্পুটেশনাল সমাজ বিজ্ঞান: আগে হিউম্যানিটিজ বা মানবিক বিষয় সংক্রান্ত গবেষণায় গবেষক নিজে পড়ে ইন্টারপ্রেটিভ আলোচনা করার একটা প্রধান আংগিক ছিল।
তবে আজকাল কম্পিউটার একসাথে অনেক লেখা কম সময়ে বিশ্লেষণ করতে পারে। শুধুমাত্র লেখা নয়, ভাব প্রকাশের অন্যান্য মাধ্যম, যেমন, অডিও এবং ভিডিও মাধ্যমের প্রকাশভঙ্গি কম্পিউটারে নানাভাবে বিশ্লেষণ করে প্যটার্ন বের করা যায়। এভাবে, কম্পিউটার ভিত্তিক, মানবিক আঙ্গিকে প্রকাশের বিশ্লেষণ “ডিজিটাল হিউম্যানিটিজ” নামক আলাদা একাডেমিক ত্রে হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানীরাও কিন্তু মানুষ ও সমাজের আচরণ বুঝতে অনেক বেশি ডাটা কম সময়ে, আরো বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণের জন্য মেশিন রিডেবল ডাটা ও ডকুমেন্টস কম্পিউটারের মাধ্যমে বিশেষণ করছেন – এটাকে নতুন একাডেমিক ফিল্ডে ভাবা হচ্ছে যার সংপে হলো “কম্পিউটেশনাল সোশ্যাল সায়েন্স”। এসব নতুন একাডেমিক েেত্র গবেষকের থাকতে হবে বহুমুখী জ্ঞান ও পদ্ধতিগত দতা: কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, প্রোপট, এবং সামাজিক আচরণ। লাইব্রেরিয়ানরাও এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন। তাদেরকেও এই নতুন নতুন েেত্র গবেষকদের সহায়ক শক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই, বাংলায় তৈরি হওয়া ডিজিটাল ডেটা ব্যাপক আলোচনা ও বিশেষণের সুযোগ পাবে; বাংলা এগিয়ে যাবে, সাথে আগাবে মানবজাতির জ্ঞানভাণ্ডার।
একাডেমিক জার্নাল বাংলায়: প্রাইভেট সেক্টরের সক্রিয় ভুমিকায় বাংলাদেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। অনেকে এসব প্রতিষ্ঠানের ঢালাওভাবে সমালোচনা করেন। তবে তারা ভুলে যান এক বিশাল অবকাঠামো তৈরি হয়েছে। এখন বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার বা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট শ্রেণিদের দায়িত্ব সক্রিয় সহায়তা করে মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখা। প্রাইভেট ও সরকারি সব উচ্চ শিা প্রতিষ্ঠানে সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান তৈরিতে পড়ানোর পাশাপাশি জার্নাল প্রকাশের জন্য সরাসরি বেতন ও কাজের সময় ভিত্তিক প্রণোদনা দিতে হবে। এেেত্র বিভিন্ন বিষয়ে বাংলায় জার্নাল প্রকাশ করা উৎসাহিত করা যায়। এতে শিকেরা তাদের নিজ নিজ বিষয়ে বাংলায় আলোচনা ও লেখায় উৎসাহী হবেন। তবে ফলপ্রসূ হওয়ার জন্য শিকের সংখ্যা বাড়িয়ে ছাত্র শিক অনুপাত কমাতে হবে, শিকের পাঠদানের সময় কমাতে হবে।
ভাষা গতিময়। তার নিজের প্রকাশের সীমানা আছে। তবে, ব্যাপক ব্যবহার ভাষার সীমানাকে প্রসারিত করবে, নতুন গতির সঞ্চার করবে। আসুন, ভাষার মাসে শপথ নেই বাংলার নিয়মিত ব্যবহারের। বাংলা ভাষাভাষীদের প্রচার ও প্রসার বিভিন্ন জাগতিক জ্ঞানেরও উৎকর্ষ সাধন করবে।

নতুন প্রজন্মের ইংরেজি প্রীতি, বাংলা ভাষার বিকৃতি ও ভবিষ্যৎ
চিররঞ্জন সরকার

পৃথিবীর প্রায় ২৮ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে বাংলা ভাষার স্থান সপ্তম। বাংলা ভাষার ঐতিহ্য এবং সাহিত্যসম্ভারও বিপুল। অথচ নতুন প্রজন্ম বাংলাভাষার প্রতি উৎসাহী ও মনোযোগী নয়। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে এই বিষয়টি নতুন করে পীড়া দিয়ে যায়। একটি ভাষার বেড়ে ওঠা, প্রচার-প্রসারের পেছনে বহু ত্যাগ থাকে, থাকে সীমাহীন শ্রম, সাধনা। বাংলা ভাষার জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি বিবর্তন সেই সাীই বহন করে। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা ভাষার মর্যাদা রার জন্য জীবন দিয়েছে। সালাম, বকরত, রফিক, শফিউর, জব্বারের সঙ্গে কিশোর অহিউল্লাহও শহিদ হয়েছেন। এরপর দীর্ঘদিনের সংগ্রামের পথ ধরে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছে। আর জাতিসংঘ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাভাষা আমাদের অত্যন্ত আবেগ ও মর্যাদার ধন। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলাভাষা ক্রমেই মর্যাদা হারাচ্ছে। একটু আর্থিক সঙ্গতিসম্পন্ন পরিবার তাদের সন্তানকে বাংলা মাধ্যম স্কুলে বর্তমানে ভর্তি করান না। শহরে-নগরে তো বটেই, শহরতলি এমনকি গ্রামে-গঞ্জে পর্যন্ত বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলি শিার্থীসংকটে ভুগছে। মফস্বলে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থাবা বসিয়েছে। গরিব, প্রান্তিক পরিবারের সন্তানেরা শুধু এখন বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়ে। অর্থনৈতিক সঙ্গতিসম্পন্ন ও অভিজাত বাঙালি পরিবারে বাঙালিয়ানা আস্তে আস্তে উধাও হয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে ইংরেজির দাপট। এমনকি, রেডিও-টেলিভিশন, নাটক, টকশো, সভা-সেমিনারে বর্তমানে ইংরেজির দাপট বাড়ছে। বাংলা ক্রমেই হয়ে পড়েছে গরিবের ভাষা।
আমাদের মানসিকতা, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের অভাব তো আছেই, পাশাপাশি এর প্রধান কারণ চাকরি। এখন ভালো ইংরেজি না জানলে চাকরি পাওয়া যায় না। সরকারি চাকরির বাজার ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। উদার অর্থনীতির এই যুগে বিভিন্ন দেশি বিদেশি কোম্পানি ভিড় জমাচ্ছে। জীবিকার প্রয়োজনে সচেতন বাঙালি অভিভাবক সমাজ তাঁদের সন্তানদের আর বাংলা মাধ্যমের স্কুলে পড়াতে বিশেষ আগ্রহী নন। বহু ছেলেমেয়েরই এখন প্রধান ভাষা বাংলা নয় ইংরেজি। ফলে বহু বাঙালি ছেলেমেয়েই এখন বাংলা বললেও লিখতে-পড়তে পারে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরা বাংলা লিখে রোমান হরফে। যা সত্যিই এক বিস্ময়কর প্রয়াস! অথচ এমনটি হওয়ার তো কথা ছিল না। কোনও একটি ভাষায় বিশেষ পারদর্শী হতে গেলে অন্য ভাষাকে অবহেলার প্রয়োজন নেই। আমাদের দেশে এখনও বহু মানুষ আছেন যারা বাংলা, ইংরেজি, দুটোই ভালো জানেন। তারপরও আমাদের দেশে মাতৃভাষা চর্চা নিয়ে এক ধরনের উন্নাসিকতা রয়েছে। বর্তমানে বাংলা চর্চার যে অবস্থা তাতে, বাংলা ভাষা অস্তিত্বের সঙ্কটে না পড়লেও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠার যথেষ্ট কারণ আছে। দুটি দিক থেকে বিপদ তৈরি হয়েছে। এক দিকে, সমাজের মতাবান শ্রেণির বাংলাচর্চা পরিত্যাগ ও প্রায় একক ভাষা হিসাবে ইংরেজি চর্চা ও ব্যবহারের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে। দ্বিতীয় দিকটি হচ্ছে, বাংলা ভাষা ক্রমেই এক ধরনের বিকৃতি ও একটি য়ের পর্ব অতিক্রম করছে। কথ্য বাংলা একদিকে আঞ্চলিকতায় পীড়িত, অন্যদিকে, ইংরেজি শব্দের অপপ্রয়োগে ভারাক্রান্ত। পাশাপাশি চলছে বিকৃতি। এফএম রেডিওর হাত ধরে এই বিকৃতি শুরু হলেও এখন তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, এমনকি টেলিভিশনেও ছড়িয়ে পড়েছে। ভাষার প্রতি অনীহা এবং অশ্রদ্ধা থেকেই এই বিকৃতি। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সবচেয়ে বেশি বিকৃতি দেখা যায় ‘র’ এবং ‘ড়’ ব্যবহারের েেত্র। আমরাকে ‘আমড়া’, বাড়িকে ‘বারি’, পরাকে ‘পড়া’, ঝড়কে ‘ঝর’, ঝরছে-কে ‘ঝড়ছে’। এছাড়া ভার্চুয়াল জগৎ থেকে যেন ‘ছ’ নামের বর্ণটি হারাতে বসেছে। বলছে হচ্ছে ‘বলসে’, খেয়েছে বা খাচ্ছে-কে খাইতাসে, আসছে-কে বলা হচ্ছে আইসে, যাচ্ছে যাইতাসে। শব্দের সংপ্তিকরণ করতে গিয়েও বিকৃতি। ঘটছে। ‘মন চায়’ লেখা হয় ‘মুঞ্চায়’, আমাকে হয়ে গেছে ‘আম্রে’। এছাড়া পোস্ট করা বা লেখাকে পোস্টানো, প্লাসকে পিলাস ইত্যাদি তো আছেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা নিরর-অর্ধ শিতিদের ব্যঙ্গ করতে গিয়ে এখন নিজেরাই উপহাসের পাত্রে পরিণত হতে চলেছে। তারা বেশ আনন্দ চিত্তে মজা করেই লিখে থাকে ফডু, খিচ্চা, গেবনে, হপে, খিচাইছে এমন সব উদ্ভট শব্দ। মাইন্ড খাইস না, সেইরাম ব্যাপুক বিনুদুন, কাইলকা পরীা, কিছুই পড়িনাইক্যা, আমারে তুইল্যা নাও, নয়তো উপ্রে থেইক্যা দড়ি ফেলাও, তুমি আবার ভাব মারাস, বেসম্ভব, নাইচ, কিন্যা, গেসে, দ্যাশ, ভাল্যাগসে, মাইরালা প্রভৃতি। আজিব, কুল, মাম্মা, আবার জিগায়, দূরে গিয়া মর, জিনিস, বিন্দাস, রক্স, অসাম, বেইল নাই, অফ যা, ধরে দেবানি, এইডা কিছু হইল, মজা লস, কেউ আমারে মাইরালা, পুরাই অস্থির, ঠিকাসসসে ভায়াআআ, লোল, ওয়াও, ক্র্যাশ, উরাধুরা, পুরাই টাশকি, প্যারা নাই, ফাঁপর লয় ইত্যাদি বিকৃত, দুর্বোধ্য এবং অবোধ্য শব্দের ব্যবহার বাড়ছে। এই বাংলা শব্দ ও বাক্যগুলোকে মজার ছলে বা নিজের অজান্তেই ব্যবহার করছেন অনেকেই। ফলে সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলা ভাষার এমন বিকৃত রূপ প্রায় নিয়মে এসে দাঁড়িয়েছে। এটি শুধু বাড়ছেই না। বরং নতুন নতুন ঢঙে বিকৃত হচ্ছে মৌলিক বাংলা শব্দগুলো। ভাষার এই বিকৃতি যদি অব্যাহত থাকে তাহলে হয়তো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধরেই নেবে যে এটাই বাংলা ভাষা!
শুধু শিার্থীরাই নয়, শিকরাও অবয়গ্রস্ত হয়ে পড়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, এক সময় প্রত্যন্ত গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিকেরাও বাংলা ইংরিজি সংস্কৃত ভাষায় সমান দ ছিলেন। ছাত্র গড়তে তাঁরা ছিলেন দিকপাল। বিজ্ঞান বা অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করলেও ভাষাচর্চা তখন ছিল বাধ্যতামূলক। এখন শিাদানে শুধু নয়, শিা পদ্ধতিতেও ঘটে গেছে বিরাট বিবর্তন। তৈরি হয়েছে দুটো শ্রেণি-ইংরেজি স্কুলে পড়া বাংলা লিখতে পড়তে না জানা ‘স্মার্ট’ প্রজন্ম এবং বাংলা মাধ্যমে পড়া ইংরেজিতে দুর্বল লজ্জিত, কুণ্ঠিত প্রজন্ম। মার্কেটে, প্রযুক্তিতে, দতায় ইংরেজি জানা প্রজন্ম এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাওয়ালারা পিছিয়ে পড়ছে। এর কারণ বাংলা ভাষায় জ্ঞানচর্চার কোনও ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতা সৃষ্টি হয়নি। অনেকের প্রশ্ন, আমাদের বাংলা ভাষা এখন যে অবস্থায় আছে তাতে পৃথিবীর জ্ঞানচর্চার অনায়াস বাহনে রূপান্তর কী সম্ভব? না কি এই ভাষার যা মতা তাতে সাম্প্রতিক জ্ঞানচর্চার এক ভাসা-ভাসা তরলীকৃত আভাসমাত্র দেওয়া যেতে পারে? বিশেষজ্ঞদের মত হলো, বাংলায় জ্ঞানচর্চার ভাষার অস্তিত্ব যেটুকু আছে তা নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই। এই ভাষায় পৃথিবীর সাম্প্রতিকতম জ্ঞানচর্চার কোনও ধারণা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। সামান্য কিছু আভাসমাত্র পাওয়া যেতে পারে। একজন প্রাবন্ধিক যথার্থই বলেছেন, ‘‘যে ভাষায় জ্ঞানচর্চা সম্ভব নয়, সেই ভাষা-গোষ্ঠীর মানুষদের জীবন ও চিন্তা, যে-ভাষায় এটা সম্ভব তাদের চেয়ে ভিন্ন হবে। জ্ঞানচর্চার ভাষার দৈন্য প্রতিফলিত হবে চিন্তার েেত্রও, দেখা যাবে চিন্তার দৈন্য। যে চিন্তার ভাষা নেই, সেই চিন্তাও সম্ভব নয়। বাংলাভাষাভাষী মানুষদের েেত্র এই চিন্তার দৈন্য অত্যন্ত প্রকট। বাঙালি লেখক হিসেবে কাব্য, উপন্যাস লিখতে যতটা আগ্রহী, নিজের ভাষায় মৌলিক চিন্তাসমৃদ্ধ জ্ঞানচর্চায় ততটাই অনাগ্রহী। এত পরিশ্রমও বাঙালির ধাতে সয় না। তাই বাংলা ভাষায় জ্ঞানচর্চার েেত্র কোনও রকম ধারাবাহিকতাই খুঁজে পাওয়া শক্ত। কারণ এখানে জ্ঞানচর্চার কোনও ভাষাই তৈরি হয়নি। আরও সঠিক ভাবে বলতে গেলে জ্ঞানচর্চার ভাষার যে অস্তিত্ব আছে, তা অত্যন্ত অপর্যাপ্ত ও প্রাথমিক স্তরের। সুতরাং চিন্তার েেত্রও এর প্রতিফলন হতে বাধ্য। বাংলা ভাষাভাষীদের চিন্তার গুণগত মান প্রাথমিক স্তরেই থেকে যাবে।” সত্য কথাটা হল, জ্ঞানচর্চার েেত্র শুধু বাংলা ভাষাকে অবলম্বন করে যে খুব একটা এগোনো যাবে না, এটা মোটামুটি সকলের জানা হয়ে গেছে। জ্ঞানচর্চা করতে হলে বাঙালিকে আরও একটি ভাষা ভালোভাবে জানতে হবে, এটাই সকলে মেনে নিয়েছেন। বাংলা ভাষা যাঁদের একমাত্র অবলম্বন তাঁদের যে গাড্ডায় পড়ে থাকতে হবে এ ব্যাপারেও আর কোনো সন্দেহ নেই। তাহলে মাতৃভাষা বাংলা হওয়ায় কী লাভ হলো আমাদের?
মাতৃভাষা নিয়ে আমাদের সামগ্রিক হতাশার মধ্যে এ বছরের অস্কার পুরস্কার আশাবাদী করে তুলেছে। গত ৯ ফেব্রুয়ারি লস অ্যাঞ্জেলসে অনুষ্ঠিত হয়েছে পৃথিবীর সবথেকে বড় অ্যাওয়ার্ড শো, ৯২ তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড অর্থাৎ অস্কার। যেখানে সারা বিশ্বকে চমকে দিয়ে শ্রেষ্ঠ পরিচালক, অরিজিনাল স্ক্রিনপে এবং এই বছরের শ্রেষ্ঠ ছবির তকমা পেয়েছে কোরিয়ান ছবি প্যারাসাইট। এই প্রথমবার ইংরেজি ভাষা ছাড়া, কোনো অন্য ভাষার ছবি বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসে এতটা সম্মানিত হয়েছে। এই ছবির সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তিই কোরিয়ান ছাড়া কোনো ভাষাতেই স্বচ্ছন্দ নন। সেই কারণেই মঞ্চে তাদের জন্য সর্বণ উপস্থিত ছিলেন একজন অনুবাদক বা দোভাষী। সুতরাং, এমন একটি গৌরবের মুহূর্তকে আপন করার পর তাদের কণ্ঠে ঝরে পড়া কৃতজ্ঞতা এবং আনন্দের ভাষা বুঝতেও কারোর কোনো অসুবিধা হয়নি, কোনো বাধা ছিল না। আদতে, বাধাটা কোথাওই নেই। আছে আমাদের মনে। আমাদের চিন্তায়, মানসিকতায়, হীনমন্যতায়। এই হীনমন্যতাটা বাঙালি জাতির মধ্যেই সবচেয়ে বেশি জোরালো। এই মানসিক সংকট কাটিয়ে উঠতে হবে। বর্তমান যুগে সকল দ্বার রুদ্ধ করে বাঁচা সম্ভব নয়। তার প্রয়োজনও নেই। শুধু দরকার একটু মেলবন্ধনের। ইংরেজি ভাষা শেখার প্রয়োজন কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, তার দরকারও নেই। ইংরেজি থাকুক কাজের ভাষা হিসেবে, অর্থ উপার্জনের ভাষা হিসেবে। সঙ্গে বাংলা ভাষা থাকুক আমাদের সকলের আন্তরিক চর্চায় —আমাদের খুব ভালোবাসার, আবেগের ভাষা হয়ে।

মাতৃভাষা শিক্ষা নাকি মাতৃভাষায় শিক্ষা
প্রশান্ত ত্রিপুরা

শিরোনামে যে প্রশ্নটি রয়েছে, তা সীমিত আকারে উঠেছিল ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের সময়। গৃহীত শিক্ষানীতিতে বলা আছে, আদিবাসী শিশুদের জন্য স্ব স্ব মাতৃভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। আগে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচিত হত ‘মাতৃভাষায় শিা’র কথা। সেটির বদলে ‘মাতৃভাষা শিক্ষা’ কেন বসানো হল, তা নিয়ে আসলে ব্যাপক পরিসরে তেমন কোনো আলোচনা বা বিতর্ক হয়নি। আদিবাসী পরিচয়ের স্বীকৃতি আদায়ের ল্েয যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের সবাই শিানীতিতে ‘আদিবাসী’ শব্দটি দেখে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন, কিন্তু অন্তস্থ-য় বিহীন ‘মাতৃভাষা শিা’ কথাটি অনেকে হয়তো-বা খেয়ালই করেননি। যাঁরা করেছিলেন, তাঁরা হয়তো-বা ধরে নিয়েছিলেন, এটি ছিল স্রেফ ছাপার ভুল বা ভেবেছিলেন, একটা ‘সামান্য’ প্রত্যয়ের থাকা না থাকা নিয়ে মাথা ঘামানোর তেমন কিছু নেই। ‘মাতৃভাষায় শিা’র বদলে ‘মাতৃভাষা শিা’র কথা কেন শিানীতিতে ঢোকানো হল, এ প্রশ্ন নিয়ে অন্যরা যদি তেমন মাথা না ঘামিয়েও থাকে, আমি ব্যক্তিগতভাবে তা তুলেছিলাম কয়েক জায়গায় এবং অন্তত একবার সুযোগ পেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবেই তা উঠিয়েছিলাম এতদ্সংশিষ্ট একটি সরকারি সভায়, শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও নীতিনির্ধারকদের উপস্থিতিতে। এসব অভিজ্ঞতার আলোকে একটা ব্যাপারে আগেই নিশ্চিত হয়েছিলাম যে, ‘মাতৃভাষা শিা’ কথাটি চালু হওয়ার পেছনে যে কারণই থেকে থাকুক না কেন, মুদ্রণ প্রমাদের কোনো ভূমিকা ছিল না।
এদিকে ‘মাতৃভাষা শিা’ কথাটি নতুন করে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে জাতীয় শিা আইন ২০১৩-এর খসড়ায়, যা সম্প্রতি বিলি করা হয়েছে জনমত যাচাইয়ের ল্েয। উলেখ্য, আইনটি প্রণয়ন করা হচ্ছে জাতীয় শিানীতি ২০১০-এর আদলেই, সেটাকে বাস্তবায়নের ল্েয। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে জাতীয় শিানীতিতে অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন ল্য-উদ্দেশ্য ও ধ্যান-ধারণাই মূলত প্রতিফলিত হয়েছে। খসড়া শিা আইন ২০১৩-এর ৫ ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে, “প্রাথমিক স্তরে ুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও সকল ুদ্র-জাতিসত্তার জন্য স্ব স্ব মাতৃভাষা শিার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।” আমরা ধরে নিতে পারি, ‘ুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ ও ‘ুদ্র জাতিসত্তা’ বলতে তাদেরকেই বোঝানো হয়েছে, যাদেরকে জাতীয় শিানীতিতে ‘আদিবাসী’ বলা হয়েছিল। সরকারিভাবে ‘আদিবাসী’ শব্দটাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে একটা কথা শোনা যায়, সে কারণেই হোক বা সংবিধানে শুধু ‘উপজাতি, ুদ্র জাতিসত্তা ও নৃ-গোষ্ঠী’ (হাইফেনসমেত) শব্দগুলি ব্যবহার করা হয়েছে বলেই হোক, ‘আদিবাসী’ শব্দটি জাতীয় শিানীতির বিভিন্ন জায়গায় থাকলেও খসড়া শিা আইনের কোথাও আর খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রস্তাবিত শিা আইনে ‘আদিবাসী’ শব্দটি কেন বাদ দেওয়া হল, এ নিয়ে আলাদা করে প্রশ্ন ওঠানোর মানে হয় না, যেহেতু সমস্যাটির সার্বিক প্রোপট আরও বড়। তবে আলোচ্য প্রেেিত অন্তত এটুকু নিশ্চয়ই আশা করা যায়, যে, ‘ুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ আর ‘ুদ্র জাতিসত্তা’ বলতে ঠিক কাদের বোঝানো হয়েছে, নৃ-গোষ্ঠী আর জাতিসত্তা সমার্থক কি না বা উভয় পদ দিয়েই শিানীতিতে যাদেরকে ‘আদিবাসী’ বলা হয়েছে তাদেরকেই বোঝানো হচ্ছে কিনা, এগুলি প্রস্তাবিত আইনে স্পষ্ট করা হোক।
‘মাতৃভাষা শিা’ কথাটি কেন সমস্যাজনক
মাতৃভাষা বলতে বোঝায় জন্মের পর মায়ের কাছ থেকে বা পরিবারে সবার সঙ্গে বেড়ে ওঠার সময় শিশুরা যে ভাষা শেখে– সেটিকে। এ অর্থে মাতৃভাষা শেখার কাজ প্রাতিষ্ঠানিক শিার অনেক আগেই শুরু হয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিার বাইরেও সকল সময়, সকল সমাজে চালু ছিল, রয়েছে, থাকবে। যেসব ভাষার লিখিতরূপে চর্চা নেই বা থাকলেও খুব সীমিত আকারে রয়েছে, সেসব ভাষাও শিশুরা পরিবারে ও সমাজে সাবলীলভাবেই বলতে শেখে। পান্তরে প্রাতিষ্ঠানিক শিা ভিন্ন একটি বিষয়– সেখানে ‘মাতৃভাষা’ শেখানো অপরিহার্য নয়। কিন্তু অরজ্ঞান, সংখ্যাজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস ইত্যাদি শেখানো অবশ্যই প্রত্যাশিত। সেটা করার েেত্র ‘মাতৃভাষা’র ভূমিকা কী হবে তা হল একটা পদ্ধতিগত প্রশ্ন, যা সকল শিশুর েেত্রই প্রযোজ্য, যদিও আদিবাসী শিশুদের বেলায় এ প্রশ্নের একটা বাড়তি তাৎপর্য রয়েছে। বিশেষ করে যেসব আদিবাসী শিশু প্রত্যন্ত এলাকায় বাস করে, যারা বাংলা একেবারেই বোঝে না বা খুব কম বোঝে, প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ে তাদেরকে শিাদানের েেত্র তাদের মাতৃভাষার একটা ভূমিকা থাকবে, এটা অবশ্যই কাম্য। তবে সেটার মাত্রা বা ধরন কী হবে তার সর্বজনীন মাপকাঠি নেই, যদিও ন্যূনতমভাবে এটা প্রত্যাশিত যে শিক ও শিার্থীদের মধ্যে ‘যোগাযোগের মাধ্যম’ হিসাবে মাতৃভাষা ব্যবহৃত হবে।নীতিগতভাবে ‘মাতৃভাষায় শিা’র অধিকার সকল শিশুরই রয়েছে এবং অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায়, যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হলে শিার ল্য অর্জনেও এটি সর্বাধিক কার্যকর একটি পন্থা। তবে ব্যবহারিক েেত্র ‘মাতৃভাষায় শিা’র নীতির প্রয়োগের মাত্রা ও ধরনে বিভিন্নতা দেখা যেতে পারে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বিদ্যমান বিভিন্ন বাস্তবতার আলোকে।অন্যদিকে একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়, এ নীতির ভুল ব্যাখ্যা হলে বা সেটা প্রয়োগের বেলায় শিশুর স্বার্থের চাইতে জাতীয়তাবাদ বা বড়দের বিভিন্ন পপাত প্রাধান্য পেলে, সেসব বিষয় শিশুঅধিকার ও শিার প্রকৃত ল্য-উদ্দেশ্যের পরিপন্থী হয়ে উঠতে পারে।উলেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা পরিষদের জন্য প্রণীত আইনসমূহে সুস্পষ্টভাবেই ‘মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিা’র কথা বলা হয়েছে, কিন্তু প্রস্তাবিত আইনে ‘মাতৃভাষা শিা’ সন্নিবেশিত হলে তা বিভ্রান্তি ও আইনি জটিলতা তৈরি করবে। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে পরিচালিত কিছু প্রকল্পসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ‘মাতৃভাষার মাধ্যমে শিা’র যেসব উদ্যোগ চালু রয়েছে, সেগুলির আইনগত ভিত্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কারণ, প্রস্তাবিত শিা আইনের খসড়ায় সুস্পষ্টভাবেই বলা আছে, ‘আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের বিধানাবলী প্রাধান্য পাইবে।’
সমস্যার গভীরে কেন যাওয়া চাই
‘মাতৃভাষা শিা’ কথাটা যে গোলমেলে, এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে যে একটা সর্বজনগ্রাহ্য মীমাংসায় আসা উচিত, এটা উপরের আলোচনায় তুলে ধরতে পেরেছি বলে আশা করি। তবে আমার মনে হয়, এমন হওয়া অসম্ভব নয় যে আলোচ্য বিষয় আসলে গভীরতর ও ব্যাপকতর কোনো সমস্যার একটা লণ মাত্র। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে এখানে শুধু কিছু ইঙ্গিত দেব। প্রথমত, ‘ুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে, ‘মাতৃভাষা শিা’র ধারণাই-বা কীভাবে এল, এসব বিষয় স্পষ্ট না থাকাতে ‘ুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য মাতৃভাষা শিা’ কথাটার একটা বিশেষ অর্থ দাঁড় করানো যায় যা আরোপিত হলেও অপ্রাসঙ্গিক নয়। এদেশে ইংরেজি মাধ্যমের বিভিন্ন শিাপ্রতিষ্ঠানে প্রচুর ছেলেমেয়ে পড়ে। কিন্তু সারাদেশের প্রেেিত তারা এখনও ‘সংখ্যালঘু’ই রয়ে গেছে। এ প্রেেিত সমাজের যেসব অংশ থেকে এ শিার্থীরা এসেছে, তাদেরকেও কিন্তু ‘ুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বলা যায়! আর তাদের বেলায় ‘মাতৃভাষা শিা’ যে জরুরি, তা নিয়েও খুব একটা বিতর্কের অবকাশ নেই। যদি বলা হয়, আদিবাসী শিশুদের জন্য ‘মাতৃভাষা শিা’র ব্যবস্থা করার চিন্তা এমন ভাবনা থেকেই এসেছে, খুব কি ভুল হবে? দ্বিতীয়ত, এটা কি হতে পারে যে, ‘মাতৃভাষায় শিা’কে শিশুদের একটা অধিকার হিসাবে দেখা হচ্ছে না এ কারণে যে নীতিনির্ধারকরা নিজেরাও নিজেদের শিশুদেরকে পাঠাচ্ছেন এমন সব স্কুলে যেখানে মাতৃভাষায় শেখানো নিষেধ? সেসব স্কুল থেকে অভিভাবকদের পর্যন্ত বলে দেওয়া হয়, ‘বাসায় বাংলা বলবেন না!’ তবে একটা বিষয় হিসাবে বাংলা পড়ানো হয় এবং অভিভাবকদের অনেককে গর্বের সঙ্গে আফসোস করতে শোনা যায়, ‘আমারটা বাংলায় খুব দুর্বল’। এসব স্কুলে ইদানিং ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ নামে একটা বিষয়ও ঢোকানো হয়েছে, যা আসলে সব ধরনের শিা প্রতিষ্ঠানের জন্য মাধ্যমিক স্তরে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিষয়ের নাম ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ কেন হবে আর বাংলাদেশে বসে এ নামের একটা বিষয়– যা আসলে অন্য অনেক বিষয়ের মধ্যেই মিশে থাকার কথা ছিল– বাধ্যতামূলক করার চিন্তা এল কেন? প্রশান্ত ত্রিপুরা: মুক্ত গবেষক; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক।

বিজ্ঞানচর্চায় মাতৃভাষা
গাজী তানজিয়া

বিশ্ববিখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর পিতা ভগবান চন্দ্র বসু ছিলেন অদ্ভুত মানুষ। ইংরেজি শিার প্রবল যুগে পুত্র জগদীশ চন্দ্র বসুকে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ইংরেজি স্কুলে পাঠাননি। নিজে কিন্তু ইংরেজি শিার প্রথম যুগে ঠিকই ইংরেজি শিখেছিলেন এবং সরাসরি ঔপনিবেশিক ইংরেজ সরকারের চাকরিতে ঢুকেছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে। অথচ তিনি তার ছেলেকে পড়তে পাঠিয়েছিলেন একেবারে গ্রামের পাঠশালায়। ভগবান চন্দ্র বসু মনে করতেন, তার ছেলে যদি ইংরেজি স্কুলে পড়তে যায় তাহলে সে শুধু শিখবে কী করে পশ্চিমকে অনুকরণ করতে হয়। অনুকৃতি যে শিা নয় এই বিচণ বোধ তার ছিল। ভগবান চন্দ্র বসুর এই পাশ্চাত্য বিরোধিতা রণশীল মানসিকতার প্রকাশ নয়। কারণ বড় হয়ে জগদীশ ঠিকই ইংরেজি স্কুলে এবং বিদেশে পড়তে গিয়েছিলেন। তবে প্রাক-শৈশবে গ্রামের স্কুলে মাতৃভাষায় শিা গ্রহণ করে জগদীশের যে লাভ হয়েছিল, তা হলো তার বৈজ্ঞানিক দার্শনিক চিন্তার মধ্যে পাশ্চাত্যের বিপরীতে এই দেশীয় চিন্তার যে প্রাবল্য পরবর্তীকালে ল করা যায় তার বীজটা বোধ হয় এই সময়টায়ই পাকাপোক্ত হয়েছিল। কলকাতা তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় প্রধান নগরী। কিন্তু তখনকার ভারতবর্ষেই বিজ্ঞান গবেষণার কোনো ঐতিহ্য ছিল না। জগদীশ চন্দ্র বসুর বৈজ্ঞানিক প্রতিভার অসামান্যতা এবং অসীম আত্মবিশ্বাসের ফলে তার বিজ্ঞান গবেষণা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের সঙ্গে সমানতালে চালিয়ে নিতে সম হন এবং একই সঙ্গে তিনি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার চেষ্টাও চালিয়েছিলেন। বর্তমানে বাঙালির এক বিরাট সংকট মূলত ভাষার আগ্রাসন নিয়ে। বিশ্বায়নের যুগে কর্মেেত্র ভিন্ন ভাষার প্রায়োগিক প্রয়োজনীয়তা মুখ্য হয়ে উঠেছে। আমরা যেখানে উচ্চশিা এবং আদালতের ভাষা হিসেবেও এখন পর্যন্ত বাংলা চালু করতে পারিনি, সেখানে বিশ্বায়নের কারণে আরও একটা ভাষা শেখা প্রায় অনিবার্য হয়ে উঠেছে। বিশ্বায়ন মানে যেখানে রাষ্ট্রগুলোর সীমারেখা আর খুব বড় কথা নয়। বৈশ্বিক অর্থনীতি অর্থনৈতিক উদারীকরণের নামে এবং এর সঙ্গে সঙ্গে বহুজাতিক সংস্থাগুলোর আগ্রাসন মিলে এই ‘বিশ্বায়ন’ এখন রাষ্ট্রের কর্তৃত্বকে তছনছ করে দিচ্ছে। ফলে প্রাথমিক থেকে সর্বস্তরের শিায় একটি ‘বিশ্বভাষা’ হিসেবে ইংরেজি ভাষার ভূমিকা ক্রমশ আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। যার ফলে অনেকের ভেতরে এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হচ্ছে যে ভাষাটা বেশি শক্তিশালী সেটাকে আমরা বেশি প্রাধান্য দেব। নিজের ভাষাটা কম শক্তিশালী তাই একে ততটা গুরুত্ব না দিলেও চলবে। বিশ্বায়ন এসে এই ব্যবস্থাকে আরও পাকাপোক্ত করে যাচ্ছে। যা আদতে আমাদের একটা প্রাতিষ্ঠানিক শিা দিলেও প্রকৃত শিতি বা জ্ঞানী করতে পারছে না। আরিক অর্থে বাঙালি ইংরেজি শিখেও কেরানিই থেকে যাচ্ছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো থেকে শুরু করে ঠাণ্ডার দেশেও উচ্চপদগুলো তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে। ‘বাংলা ভাষা-পরিচয়’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ভাষার কাঠামোকে কোঠাবাড়ির সঙ্গে তুলনা করেছেন। বিষয়টি এ রকম : “কোঠাবাড়ির প্রধান মসলা ইট, তার পরে চুন-সুরকির নানা বাঁধন। ধ্বনি দিয়ে আঁটবাঁধা শব্দই ভাষার ইট, বাংলায় তাকে বলি ‘কথা’। নানা রকম শব্দচিহ্নের গ্রন্থি দিয়ে এই কথাগুলোকে গেঁথে গেঁথে হয় ভাষা।” সময়ের পরিবর্তনে ও মানুষের জীবনাচরণের নিত্যনতুন বৈচিত্র্যে ভাষার বিভিন্ন উপাদানের পরিবর্তন অব্যাহত থাকে। কিন্তু মূল কাঠামোটা আবহমান ধারাকে অনুসরণ করে চলে।
১৯৫৩ সাল থেকে ইউনেসকো এ বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে প্রাথমিক শিাস্তর থেকে মাতৃভাষা প্রয়োগের কথা বলে আসছে। বিষয়টির সুবিধা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে কোসনেন পর্যবেণ করেন, মাতৃভাষায় শিাব্যবস্থা গড়ে তোলা হলে এতে শিার্থীদের বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সংখ্যা যেমন বাড়ে, তেমনি শিার্থীদের সফল হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি থাকে।বাংলা ভাষা এমনই একটি সমৃদ্ধ ভাষা, যেটির নিজস্ব স্বকীয়তা যেমন রয়েছে, তেমনি এর শব্দবৈচিত্র্য এই ভাষাকে বিশ্বজনীন রূপ দিয়েছে। তবে যেভাবে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা হওয়ার কথা ছিল, তা হচ্ছে না। এখনো এ েেত্র ইংরেজি ভাষার আগ্রাসন আমাদের প্রভাবিত করছে। আমরা এখন যে সময়ে বাস করছি, সেখানে বিজ্ঞানচর্চার বিষয়টা খুব বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। বিজ্ঞানের চর্চা কীভাবে হলে মানুষ তার প্রতি আকৃষ্ট হবে, সেটি নিয়ে ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। এ েেত্র ভাষার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। আর শিার ভাষা হিসেবে মাতৃভাষা বেশি কার্যকর এবং তা সহজে মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। অন্যভাবে বলা যায়, যে মাতৃভাষা ভালো বলতে ও লিখতে পারে না, তার অন্য ভাষায় দতা যেভাবে গড়ে ওঠার কথা, সেভাবে গড়ে উঠে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা করা সম্ভব কি না আর এর ফলাফল ইতিবাচক হবে কি না। বাংলা ভাষার প্রতি আবেগের জায়গা থেকে শুধু নয়, যৌক্তিকতার দিক থেকেও বিষয়টি অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। বিষয়টা অদ্ভুত মনে হতে পারে; কিন্তু গবেষণা ও তথ্য-উপাত্ত বলছে যে, মাতৃভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পায়। এর কারণ হলো মাতৃভাষার মাধ্যমে যখন কোনো একটি দেশ বিজ্ঞানচর্চা করে, তখন সে দেশের মানুষের উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ ঘটে। এই উদ্ভাবনী শক্তি প্রয়োগ করে সে দেশ প্রযুক্তিগত েেত্র উৎকর্ষতা অর্জনে সমর্থ হয়। ফলে প্রযুক্তির হাত ধরে বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠে, যা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রত্য ভূমিকা রাখে। চীনের েেত্র শুধু চীনা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা করার ফলে চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ভারতের চেয়ে বেশি। জাপান, জার্মান বা হাঙ্গেরি যাই বলি না কেন, ফলাফল একই। আমাদের দেশের সব মানুষের কথা বলা ও লেখার মাধ্যম হলো বাংলা। ফলে আমরাও চীন, জাপানের মতো মাতৃভাষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে রাষ্ট্রের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে পারি। আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতি যত অগ্রসর হবে, ভাষার পরিবর্তনশীলতা তত বেশি গতিশীল হবে। এর ফলে ভাষার শব্দের ভান্ডার যেমন বাড়বে, তেমনি ভাষার গুণগত মান সমৃদ্ধ হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক