মহান বিজয় দিবস সংখ্যার একগুচ্ছ লেখা-১

0

অভিবাদন বাংলাদেশ, ৫০তম বিজয় দিবসে
সৈয়দ আবদাল আহমদ

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। বিজয়ের দিন ১৬ ডিসেম্বর। বহু রক্ত ও অশ্রুর বিনিময়ে পাওয়া এ বিজয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের এই দিনটিতে ‘বাংলাদেশ’ নামে নতুন এক দেশ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নেয়। সেই বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় স্বদেশ, প্রিয় জন্মভূমি। এই দেশের বিজয়ে, লাল-সবুজের পতাকার বিজয়ে সেদিন আমরা সম্মিলিতভাবে গেয়ে উঠি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান- ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’
শুভ জন্মদিন বাংলাদেশ। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জন্মদিন। এবার এ বিজয়ের ৫০তম দিবস আমরা পালন করছি। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে? কিছু দিন পরই ২৬ মার্চ আমরা পালন করব প্রিয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তি উৎসব। অভিবাদন প্রিয় বাংলাদেশ!
এবার আলো ঝলমল করে উদ্ভাসিত হবে বিজয়ের আনন্দের ১৬ ডিসেম্বরের দিনটি। কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ ‘১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১’ কবিতায় লিখেছিলেন-
পরিষ্কার মনে আছে সেই দিনটি।
টিয়ে পাখির মতো লাল-সবুজ পতাকায় পতাকায়
ভরে গিয়েছিল আমাদের শহর।’
একাত্তরে প্রথম বিজয় দিবস থেকে এবার ৫০তম বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বরে আমরা দেখতে পাবো টিয়ে পাখির মতো লাল-সবুজ পতাকায় পতাকায় ছেয়ে গেছে আমাদের দেশটা। আমরা গলা ছেড়ে গাইব শামসুর রাহমানের গান-
‘কোকিল, দোয়েল গান গেয়ে বলে,
আজ আমাদের বিজয় দিবস।
গোলাপ, বকুল বলে একসাথে
আজ আমাদের বিজয় দিবস।’
সত্যিই এই বিজয়ের কোনো তুলনা নেই। সৈয়দ শামসুল হকের কবিতার ভাষায়- ‘আমাদের এই বাংলাদেশ ধানের দেশ, গানের দেশ, বীরের দেশ, তেরো শত নদীর দেশ। আমাদের দেশ স্বাধীন দেশ, বাংলাদেশ।’
বাংলাদেশের তুলনাহীন এই বিজয় দিবস এমনি এমনি আসেনি। এই বিজয় রক্তে কেনা। ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধ করে এই বিজয় আমরা ছিনিয়ে এনেছি। একাত্তরের ২৫ মার্চ কালো রাত থেকে জাতির ওপর শুরু হয়েছিল মৃত্যু, ধ্বংসযজ্ঞ আর আর্তনাদের নারকীয় বর্বরতা।
কিন্তু এই ঘোরতর অমানিশা ভেদ করে ৯ মাসের মাথায় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এ দেশের আকাশে উদিত হয় স্বাধীনতার চির ভাস্বর সূর্য। পত পত করে উড়তে থাকে স্বাধীনতার পতাকা। এই পতাকা বিজয়ের পতাকা। নতুন দেশের উদয়ের সূর্য। স্বাধীন সূর্যোদয়। এই স্বাধীন দেশের নামই বাংলাদেশ।
৯ মাস যুদ্ধ করে আমরা বিজয় ছিনিয়ে এনেছি, স্বাধীনতা লাভ করেছি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তাই আমাদের সবচেয়ে গৌরবময় ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা। এই মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবচেয়ে আত্মোৎসর্গের ঘটনাও। বিজয় ছিনিয়ে আনতে গিয়ে লাখো প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। কত যে ত্যাগ, কত যে অশ্রু- তার কোনো হিসাব নেই। সাহস করে চোখের জলেই আমরা বীরগাথা রচনা করেছি। লাল-সবুজের পতাকা আমাদের সেই আত্মোৎসর্গের কথাই মনে করিয়ে দেয়। ত্যাগের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবচেয়ে উজ্জ্বল, আনন্দের ঘটনাও। মায়ের অশ্রু, বীরের রক্ত স্রোত- এ মাটির, এ জাতির গৌরব। চিরদিনের সম্পদ। আমাদের রক্তার্জিত পতাকা তাই চিরদিন বাংলার আকাশে উড়বে।
বিজয়ের মুহূর্ত
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের দিনটিতে ছিলাম ১০-১১ বছরের বালক। আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতার মতোই আমার স্মৃতিতেও উজ্জ্বল হয়ে আছে বিজয়ের সেই মুহূর্ত। হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাটের পীরের গাঁওয়ে বোনের বাড়িতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং বিবিসি বাংলার অনুষ্ঠান ও খবর বড়দের সাথে আমরা ছোটরাও দল বেঁধে শুনতাম। বেতারে বিজয়ের কথা অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে শুনে সেদিন আমরা বালকের দল আনন্দে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। এক নিভৃত পল্লীতে আমাদের কী যে আনন্দ! আপন মনেই সেদিন উল্লসিত হয়ে স্বাধীন বাংলা বেতারের সাড়াজাগানো গানগুলো সবাই মিলে গাইতে থাকি। মনে আছে, পতাকা নিয়ে সবুজ মাঠে দৌড়েছি। মনের আনন্দে হেসে কুটি কুটি হয়েছি। আনন্দে দল বেঁধে পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছি, সাঁতার কেটেছি। দুপুরের পর খবর পেলাম, পীরের গাঁওয়ের উত্তর দিকে ‘মাইঝের বাড়ি’তে মুক্তিযোদ্ধারা এসেছে। কী যে কৌতূহল! দৌড়ে গেলাম সেই বাড়িতে। আমাদের মতো অনেকেই এসেছে তাদের দেখতে। সম্ভবত চারজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। রণাঙ্গনের ক্লান্ত যোদ্ধারা তখন ‘স্টেনগান’ ও ‘রাইফেল’ পাশে রেখে ঘুমাচ্ছিলেন। অনেকক্ষণ তাদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। একপর্যায়ে আবেগ ধরে রাখতে না পেরে তাদের শরীর ছুঁয়ে দেখি। তখন মনে হয়েছিল, এরা সাধারণ মানুষ নন, এর চেয়েও বড় কিছু। সেই স্মৃতি এখনো চোখে ভাসছে।
বিজয়ের মুহূর্ত নিয়ে কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন মজার স্মৃতি। ‘জোছনা ও জননীর গল্পে’ তিনি লিখেছেন- ‘ঝিকাতলায় থাকতাম। আমার সাথে ঝিকাতলায় সেই একতলা টিনের ছাদের বাড়িতে ছিলেন আমার অতি প্রিয় বন্ধু আনিস সাবেত। তিনি বয়সে আমার চেয়ে দুই বছরের বড়। ১৬ ডিসেম্বর আমরা দু’জন কী করলাম একটু বলি। হঠাৎ মনে হলো আমাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। পৃথিবী উলট-পালট হয়ে গেছে। সারাক্ষণ কানে ঝিঁঝি পোকার মতো শব্দ হচ্ছে। আনিস সাবেত বাড়ির সামনের মাঠে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লেন। তিনি শব্দ করে কাঁদছেন। গড়াগড়ি করছেন। আমি তাকে টেনে তুললাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, চল রাস্তায় চল।’ একটু আগেই তিনি কাঁদছিলেন। এখন আবার হাসছেন। আমরা রাস্তায় নেমে পড়লাম এবং ফাঁকা রাস্তায় কোনো কারণ ছাড়াই দৌড়াতে শুরু করলাম। আনিস ভাই এক হাতে শক্ত করে আমাকে ধরে আছেন, আমরা দৌড়াচ্ছি। ঢাকা শহরের সব মানুষ ঘর ছেড়ে বের হয়ে পড়েছে। যার যা ইচ্ছা করছে। চিৎকার, হইচই, লাফালাফি, মাঝে মধ্যেই আকাশ কাঁপিয়ে সমবেত গর্জন- ‘জয়বাংলা’। প্রতিটি বাড়িতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়ছে। এই পতাকা সবাই এত দিন কোথায় লুকিয়ে রেখেছিল কে জানে? ঝিকাতলার মোড়ে আমরা দু’জনকে লোকজন আটকাল। তারা শঙ্কিত গলায় বলেন, রাস্তা পার হবেন না। খবরদার! কিছু আটকে পড়া বিহারি দোতলার জানালা থেকে ওই দিকে গুলি করছে। আমরা গুলির শব্দ শুনলাম। আনিস ভাই বললেন, দুত্তেরি গুলি। হুমায়ূন চল তো।’ আমরা গুলির ভেতর দিয়ে চলে এলাম। আমাদের দেখাদেখি অন্যরাও আসতে শুরু করল।
সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে এসে আনিস ভাই দুই প্যাকেট বিস্কুট কিনলেন (আমার হাত সে সময় শূন্য, কেনাকাটা যা করার আনিস ভাই করতেন)। আমরা সারা দিন কিছু খাইনি। প্রচণ্ড ক্ষিদে লেগেছে। আমি আনিস ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, আনিস ভাই, পোলাও খেতে ইচ্ছা করছে। তিনি বললেন, অবশ্যই পোলাও খাবো; পোলাও। আমরা দু’জন অর্ধউন্মাদের মতো ‘পোলাও পোলাও’ বলে চেঁচালাম। রাস্তার লোকজন আমাদের দেখছে। কেউ কিছু মনে করছে না। একটা রিকশাকে আসতে দেখলাম। রিকশার সিটের ওপর বিপজ্জনক ভঙ্গিতে মধ্যবয়স্ক এক লোক দাঁড়িয়ে। তিনি জিগিরের ভঙ্গিতে বলেই যাচ্ছেন- ‘জয় বাংলা। জয় বাংলা। জয় বাংলা।’ আনিস ভাই তার হাতের বিস্কুটের প্যাকেট গুঁড়া করে ফেললেন। আমিও করলাম। আমরা বিস্কুটের গুঁড়া ছড়িয়ে দিতে দিতে এগোচ্ছি। কোন দিকে যাচ্ছি, তাও জানি না। আজ আমাদের কোনো গন্তব্য নেই।’
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে ঢাকার রমনার রেসকোর্স ময়দানে পরাজিত পাকিস্তান সেনা বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান সেনাপতি গ্রুপ ক্যাপ্টেন (পরবর্তীতে এয়ার ভাইস মার্শাল) একে খোন্দকার বীর উত্তম। ‘বিজয়ের দিনে’ ও ‘ভেতরে বাইরে’ বইতে তিনি লিখেন- ‘আগরতলা থেকে হেলিকপ্টারে করে জেনারেল অরোরার সাথে আমি যখন ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করি, তখন আমার একটিমাত্র অনুভূতিই ছিল যে, আমি স্পর্শ করতে পেরেছি আমার স্বাধীন দেশের মাটি। আমরা যখন রমনা ময়দানের দিকে যেতে থাকি, তখন রাস্তার দুই পাশের বহু মানুষকে আক্ষরিক অর্থেই মুক্তির আনন্দে আকুলভাবে কাঁদতে দেখেছি। তাদের মুখে যে অভিব্যক্তি ছিল, সেটি মুক্তির। রমনার রেসকোর্স ময়দানে অসংখ্য লোকের সাথে আমাকে কোলাকুলি করতে হয়েছে। এর মধ্যে ছিল মানুষের অনাবিল আনন্দ ও স্বস্তির অভিব্যক্তি। বেশ ক’জন আমাকে সেদিন বলেছেন, ‘আজ রাত থেকে আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমাবো।’
‘আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান শেষ করে হেলিকপ্টারে করে আগরতলা ও পরে বিমানে করে কলকাতায় ফিরে আসার সময়টুকুতে দীর্ঘ ৯ মাসের স্মৃতিগুলো মনের আয়নায় ভেসে উঠছিল। বিমানটি যখন কুয়াশাচ্ছন্ন ধূসর মেঘরাশিকে ভেদ করে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তখন কল্পনায় প্রভাতের হাতছানি দিতে লাগল আগামীর প্রভাতের সূর্য। সেই নতুন সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত হবে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি, জনপদ ও মানুষ।’
কবি আসাদ চৌধুরী ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ বইতে লিখেছেন- ‘অবরুদ্ধ ৯ মাস পর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, ৪টা ২১ মিনিটে জেনারেল নিয়াজি রমনার রেসকোর্স ময়দানে জনতার ‘জয়বাংলা’ সেøাগানের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করলেন। এরপর সামরিক কায়দায় ধীরে ধীরে কোমর থেকে বেল্ট খুললেন, অস্ত্র সমর্পণ করলেন। পৃথিবীর মানচিত্রে বিশ্বের অষ্টম বৃহৎ রাষ্ট্রের নাম লেখা হলো ‘বাংলাদেশ’। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, শত শত মায়ের অশ্রু দিয়ে গড়া এই দেশ বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।’
মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নুরুল কাদের ‘একাত্তর আমার’ বইতে লিখেছেন, ‘১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ আনুমানিক সকাল ১০টা। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের দফতর। ফোনে কথা শেষ করে তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, ‘নুরুল কাদের, আজ আমরা স্বাধীন। বিকেল ৪টায় আত্মসমর্পণ। অফিসের লোকজনকে খবরটা জানিয়ে দাও।’ আমার কাছে এই নির্দেশ প্রচণ্ড ভারী মনে হলো। কারণ এত বড় সংবাদ ঘোষণার অধিকার রাখেন একমাত্র তাজউদ্দীন আহমদ। সবাইকে প্রধানমন্ত্রীর কক্ষের সামনে আসতে বললাম। কাউকেই ঘটনার কথা বলা হলো না। অফিসের ৩০-৩৫ জন এসে কক্ষের সামনে দাঁড়ালেন। তাজউদ্দীন আহমদ এগিয়ে এলেন। তিনি বললেন, ‘আজ থেকে আমরা স্বাধীন। অপরাহ্নে হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করছে।’ তখন আবেগে তার কণ্ঠ কাঁপছিল। সমস্বরে সবাই উল্লাসে স্লোগান দিলেন। সে এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য।’
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম ‘স্বাধীনতা ৭১’ বইয়ে লিখেছেন- ‘১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৫টা ৫ মিনিটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়াজি বিষণœ পাংশু মুখে কাঁপা হাতে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করলেন। তার কলমের কালিও সরছিল না। তাই তাকে অন্য একটি কলম দেয়া হলো। এই প্রথম তারা পূর্ব পাকিস্তানকে ‘বাংলাদেশ’ স্বীকার করে নিলো।’
মেজর (অব:) এম এ জলিল ‘বিজয় অভিযান’ নিবন্ধে লিখেছেন- ‘১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হলো। ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ খুলনা সার্কিট হাউজে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার হায়াতের নেতৃত্বে দলটি আত্মসমর্পণ করল। তখন হাজার হাজার মানুষ আনন্দে আত্মহারা। পরাজিত ব্রিগেডিয়ার হায়াত মাথা নুইয়ে কম্পিত হাতে আত্মসমর্পণ দলিলে সই করলেন। কোমর থেকে বেল্ট খুলে মিত্রবাহিনীর কাছে অর্পণ করলেন। উৎফুল্ল জনতার স্রোতে আমি হারিয়ে গেলাম। জনতার দিকে শূন্য দৃষ্টি মেলে দিয়ে আমার স্বাধীন বাংলাকে প্রাণভরে দেখলাম।’
কবি শামসুর রাহমান ‘কালের ধূলোয় লেখা’ বইয়ে উল্লেখ করেন- ‘১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের আকাঙিক্ষত স্বাধীনতার অপরূপ সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য হলো। বাংলাদেশ ঝলসে উঠল আনন্দধারায়। সেই মুহূর্তে স্বাধীনতার অপরূপ সূর্যোদয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে নেচে উঠেছিল হৃদয়, চোখ হয়েছিল অশ্রুভেজা। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান লিখেছেন- ‘সে মুহূর্তে মনে হয়েছে, আমার দেশে কার্পাস ফুল ফুটেছে।’
পঞ্চাশের বাংলাদেশে
বাংলাদেশের ৫০তম বিজয় দিবস এবং স্বাধীনতার ৫০ বছর এমন একসময়ে উপস্থিত, যখন পৃথিবী মোকাবেলা করছে এক মহামারী। এই করোনা মহামারীর ছোবলে বাংলাদেশে সাত হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। মহামারী সব কিছুই থমকে দিয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী যেভাবে উদযাপন করার কথা সেভাবে করা যাচ্ছে না। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীও একই সময়ে পড়েছে। বছরব্যাপী কর্মসূচি নিয়েও তা সেভাবে পালন করা যায়নি। করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের সুখবর আছে। কিন্তু বাংলাদেশ এই টিকা কখন পাবে, করোনা মহামারী থেকে মুক্তি কবে, সেটা কেউই জানে না।
তবে বাংলাদেশের ৫০তম বিজয় দিবসের আনন্দ মুহূর্তে দেশের মানুষের জন্য বড় সুখবর হয়ে এসেছে পদ্মা সেতুর স্বপ্নপূরণ। প্রমত্তা পদ্মার ওপর দেশের দীর্ঘতম ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের এই সেতুর সর্বশেষ স্প্যানটি বসেছে। জোড়া লেগেছে পদ্মার দুই পাড়- মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরা। দৃশ্যমান হয়েছে পদ্মা সেতু। আগামী দেড় বছরের মধ্যে এই সেতু চালু হবে। দক্ষিণাঞ্চলে রেল যোগাযোগ নেই। এই সেতুর ফলে যশোর পর্যন্ত রেল যোগাযোগও স্থাপিত হবে। এর আগে যমুনা নদীতে নির্মিত হয়েছে যমুনা সেতু।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্জন আছে। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। তলাবিহীন ঝুড়ির অপবাদ ঘুচেছে। রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট সারা দেশকে সুতোর মতো গেঁথে দিয়েছে। খাদ্যে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উচ্চ আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। কৃষি ক্ষেত্রেও উন্নতি উল্লেখযোগ্য। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশকে নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছেন। বাংলাদেশ ক্রিকেটের বিশ্বকাপে খেলছে। বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়া এখন আমাদের স্বপ্ন।
অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রত্যয়, গণতন্ত্র বাংলাদেশে বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। মাত্র ১০ বা ৫ শতাংশ ভোটেই নির্বাচন কমিশন সন্তুষ্ট হয়। আবার দেশে ভোটার ছাড়াও নির্বাচন হচ্ছে। দিনের ভোট রাতে হয়। অপরাজনীতি রাজনীতির পোশাক পরে আছে। লাইনচ্যুত ট্রেনের মতো রাজনীতি লক্ষ্যচ্যুত। জনগণ রাজনীতিবিমুখ হয়ে গেছে। সুশাসন অনেকটাই নির্বাসনে চলে গেছে। এখন প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক গণতন্ত্রে দেশ চলছে। মানুষের রাজনৈতিক অধিকার, নাগরিক অধিকার, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অধিকার সঙ্কুচিত। অনেকটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণই হোক ৫০তম বিজয় দিবসের ভাবনা ও অঙ্গীকার। দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক চেতনাবোধের যে দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, তাদের যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা রয়েছে, তা দেশকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনবে, সেটিই সবার চাওয়া।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, জাতীয় প্রেস ক্লাবের
সাবেক সাধারণ সম্পাদক
[সংকলিত]

সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ
সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা

সঙ্ঘবদ্ধ জীবনের ক্রমোন্নতির স্তরকেই ‘সভ্যতা’ বা সিভিলাইজেশন বলা হয়। সভ্যতা, নগরায়ন, সামাজিক স্তরবিন্যাস, যোগাযোগ প্রণালী, স্বতন্ত্র পরিচয় এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর নিয়ন্ত্রণের গুণাবলি দিয়ে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। সভ্যতায় ক্রমবিবর্তনমূলক জীবনপ্রণালী এবং রাজতন্ত্র বা নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গঠিত সরকারপদ্ধতি; ভাষা, ধর্ম, শিক্ষা ও সংস্কৃতিও ক্রিয়াশীল। সুমেরীয় ও মিসরীয় থেকে শুরু করে বিশ্বের সব সভ্যতারই নিজস্ব লিখনপদ্ধতি ছিল। এই লিখনপদ্ধতির মাধ্যমেই জ্ঞানের আহরণ, সঙ্কলন ও সংরক্ষণ করা হতো। মূলত এসবই হচ্ছে সভ্যতার শেকড়; ভিত্তিমূল।
সাধারণভাবে কোনো জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য ও জ্ঞানই হচ্ছে সংস্কৃতি। ভাষা, ধর্ম, খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক আচার-আচরণ, সঙ্গীত, চিত্রকলা ও শিল্পকলাও সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ অন ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাকুইজিশন’ সংস্কৃতির একটি অতি চমকপ্রদ সংজ্ঞা দিয়েছে। এ সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘সামাজিক আচরণ, মিথস্ক্রিয়ার ধরন, জ্ঞানীয় গঠন এবং সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে যে উপলব্ধি অর্জিত হয় তা-ই সংস্কৃতি।’
সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে একটা অলিখিত সখ্য রয়েছে। ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভারের মতে, ‘আমরা যা করি তাই আমাদের সংস্কৃতি, আর আমাদের যা আছে তাই আমাদের সভ্যতা। মূলত সংস্কৃতি হলো মানুষের স্বাভাবিক জীবনপ্রণালী এবং সভ্যতা হলো সে জীবনপ্রণালীর বাহ্যিক রূপ। আর সভ্যতা বিকাশের পূর্বশর্ত হলো সংস্কৃতি। সংস্কৃতির জন্ম ও টিকে থাকার মাধ্যমে একটি সভ্যতা পূর্ণতা লাভ করে এবং বিকশিত হয়।……..’।
মানবজীবনের ক্রমবিবর্তন যখন ইতিবাচক ধারায় সূচিত হয় তখনই তা সভ্যতা হয়ে ওঠে। আর এর বিপরীত দিকটাই হচ্ছে সভ্যতার সঙ্কট। যার বাস্তব প্রমাণ সাম্প্রতিক বিশ্ব। কারণ, ইদানীং যাদের সভ্যতার প্রতিভূ বলে মনে করা হয় তারাই এখন এর প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে মানবসভ্যতা স্বকীয়তা হারাতে বসেছে। বিশে^র শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোও পৃথিবীর সুস্থ, স্বাভাবিক, প্রগতিশীলতা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে খুব একটা সাফল্য দেখাতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইতালি, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও জাপান জি-সেভেন নামে যা করছে তা মানবসভ্যতার গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে। ন্যাটো বাহিনী ব্যবহৃত হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের গণহত্যা ও আগ্রাসী যুদ্ধের কাজে। বিশ্বের ক্ষমতাহীন রাষ্ট্রগুলোও উন্নত বিশ্বব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে ইতিবাচক নয় বরং অনাকাক্সিক্ষত লেজুড়বৃত্তির বৃত্তেই আটকা পড়েছে। সমাজপতি, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবী, সুশীলসমাজ, বৈজ্ঞানিক ও চিন্তাবিদরা এ ক্ষেত্রে সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। ফলে মানবসভ্যতা এখন খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে।
আর এই অনাক্সিক্ষত প্রবণতা থেকে আমরাও মুক্ত নই বরং ক্ষেত্র বিশেষে আমাদের অবস্থা আরো শোচনীয়। আমাদের রাষ্ট্রাচারের ক্রমবিবর্তন ইতিবাচক হিসেবে প্রচার পেলেও সার্বিক পরিস্থিতি মোটেই ইতিবাচক নয়। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি সর্বোপরি জাতীয় জীবনে। ফলে আমাদের ‘সংস্কৃতি’ এখন ‘অপসংস্কৃতি’তে রূপান্তরিত হয়েছে। রাজনৈতিক বিরোধ ও সমস্যার রাজনৈতিক সংস্কৃতি দিয়ে সমাধান করা হচ্ছে না। বরং শাসকগোষ্ঠী তথাকথিত সংস্কৃতি এবং নানা অপবিশেষণের ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের মোকাবেলা করার অঘোষিত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে সভ্যতা, ভব্যতা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। মূলত মাত্রাতিরিক্ত অবক্ষয় ও মূল্যবোধের অনুপস্থিতির কারণেই দেশে ধর্ষণের সংস্কৃতি, হত্যা, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের সংস্কৃতি, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সংস্কৃতি, সিন্ডিকেট সংস্কৃতি, জুলুম-জবরদস্তির সংস্কৃতি, মিথ্যাচারের সংস্কৃতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ঘুষ-দুর্নীতির সংস্কৃতি, ভোট চুরির সংস্কৃতি, স্বেচ্ছাচারিতার সংস্কৃতি, নারী নির্যাতনের সংস্কৃতি আমাদের জাতীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে।
মূলত সভ্যতার ক্রমবিকাশ এমন সব কাজের মধ্য দিয়ে হয়, যেগুলো ইতর প্রাণীর মধ্যে দেখা যায় না। যেমন আগুনের ব্যবহার, পানির ব্যবহার। মানুষ জলবায়ু ও প্রকৃতিকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগাতে সফলতা দেখিয়েছে। মানুষ পরিবার, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও রাষ্ট্র গঠন করে। তারা বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। রাষ্ট্রের আছে প্রশাসনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা। মানুষের আছে প্রগতিশীল জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য; সর্বোপরি রাজনীতি ও অর্থনীতি। এসবেরই মধ্যে আছে নৈতিক চেতনা, ভালো-মন্দ, সুন্দর-কুৎসিত ও ন্যায়-অন্যায়ের উপলব্ধি। মানুষের বিবেক আছে। বিবেক আর সত্য, ন্যায় ও সুন্দর হলো সভ্যতার মর্মগত অবলম্বন। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে আমাদের বিচ্যুতি রীতিমতো উদ্বেগজনক পর্যায়েই পৌঁছেছে।
সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের সূচনা মানুষের হাত ধরে হলেও তা কলঙ্কিত হচ্ছে আবার মানুষের কর্মের মাধ্যমেই। সে ধারাবাহিকতায় বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই সারা বিশ্বেই অনাকাক্সিক্ষতভাবেই যুদ্ধবিগ্রহ বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বিশ্বব্যবস্থার কল্যাণকামিতারও ঘটেছে বড় ধরনের বিচ্যুতি। আগুন-পানি ও প্রকৃতির ব্যবহার, বৃহৎ শক্তিগুলো এমনভাবে করে চলছে যে প্রকৃতি মানুষের প্রতিকূল হয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা এখন ক্রমবর্ধমান। সমুদ্রে পানির উচ্চতা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর স্থলভাগের এক-তৃতীয়াংশ পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। পরিবার, প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, রাষ্ট্রব্যবস্থার বিচ্যুতি ঘটছে প্রতিনিয়ত। কায়েমি স্বার্থে প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থার ইতিবাচক বৈশিষ্টগুলো নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের অপব্যবহার বর্বরতা ও ধ্বংসের পালেই হাওয়া দিচ্ছে। রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতি ব্যবহৃত হচ্ছে শ্রেণী, গোষ্ঠী ও ব্যক্তি স্বার্থে। সাধারণ মানুষ সবরকম অন্যায়-অবিচার, জুলুম-জবরদস্তি ও মিথ্যাচারকে মেনে নিয়েছে বা নিতে বাধ্য হচ্ছে। সঙ্গত কারণেই সমাজ-রাষ্ট্রে যারা কর্তৃত্ব করছে তারা অন্ধকারের শক্তি হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করেছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির অন্ধকার যুগের অবস্থায় ভিন্নতা রয়েছে। প্রত্যেক জাতির ইতিহাস এক ও অভিন্নও নয়। তবে কিছু বিষয়ে সব জাতির মধ্যে মিলও রয়েছে। তাই সভ্যতার সঙ্কট মোকাবেলায় বহুজাতিক ঐক্যের আবশ্যকতার বিষয়টিও অনস্বীকার্য। তবে সে ক্ষেত্রে কোনো জাতিরই নিজস্ব সঙ্কটকে পাশ কাটানোর সুযোগ নেই বা আন্তর্জাতিক কোনো শক্তির ওপর নির্ভরশীল থাকাও উচিত নয়। সে ক্ষেত্রে নিজ নিজ সমস্যা নিজ উদ্যোগেই সমাধান করে নেয়া উচিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় যে অবস্থা চলছে তাতে বিশ্বব্যাংক ও তার সহযোগী শক্তিগুলোকে দেখা যাচ্ছে বৈশ্বিক সরকারের ভূমিকা পালন করছে। এ ক্ষেত্রে জাতিসঙ্ঘের ভূমিকাও প্রশ্নাতীত থাকেনি। চীন ও রাশিয়া কখনো কখনো ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে ইতিবাচক কিছু করার চেষ্টা করছে। তবে তা পর্যাপ্ত মনে করার সুযোগ নেই।
সভ্যতার সঙ্কট ও বৈশ্বিক রাজনীতির কুপ্রভাব থেকে আমরাও মুক্ত নই। আমাদের দেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের ইতিবাচক পরিসরে গড়ে ওঠার যে সম্ভাবনা ছিল তাও আমরা ইতোমধ্যে হাতছাড়া করে ফেলেছি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দেশে শুরু হয়েছে বিরাজনীতিকীকরণ ও বিরাষ্ট্রকরণের কার্যক্রম। দেশকে কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা থেকে আমরা যোজন যোজন দূরেই অবস্থান করছি।
রাজনৈতিক শক্তিগুলো রাজনীতিকে করে ফেলেছে বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাস অভিমুখী, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দিষ্ট ডেস্ক অভিমুখী। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে গণমুখী করে গড়ে তোলা হয়নি। বিচারব্যবস্থার বিচ্যুতিও জনদুর্ভোগের কারণ হওয়ার অভিযোগও বেশ জোরালো। গণপ্রশাসন ঘুষ-দুর্নীতি ও লাগামহীন স্বেচ্ছাচারে নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়েছে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এসব কথা সংবিধানে লেখা আছে ঠিকই, কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলনটা খুবই গৌণ। অবস্থাটা ‘কাজীর গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই’ ঠিক এমনই।
’৮০-এর দশকের শুরু থেকে ক্রমাগত বলা হচ্ছে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা। এর মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অন্তর্র্বতীকালীন নির্দলীয় সরকার গেছে, গেছে জরুরি অবস্থাও। কিন্তু সার্বিক অবস্থার ক্রমাবনতিই হয়েছে বলতে হবে। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সব প্রতিষ্ঠান স্বকীয়তা হারিয়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোই এখন গণতন্ত্রের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশ ও জাতি আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার উপযোগী রাজনৈতিক শক্তির শূন্যতা বোধ করছে। রাষ্ট্রাচারের বিচ্যুতি ও অবক্ষয়ের জয়জয়কারের কারণেই পরিবারব্যবস্থা দারুণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। লাগামহীন বিয়েবিচ্ছেদ, পরকীয়া, স্বামী-স্ত্রীতে কলহ-সন্দেহ ও অবিশ্বাস, স্বামীর হাতে স্ত্রী হত্যা, স্ত্রীর হাতে স্বামী হত্যা এখন নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা মূল্যবোধহীন কথিত সভ্যতার বিষবৃক্ষের ফল হিসেবেই স্বীকৃত।
মূলত মূল্যবোধহীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতিই মানবসভ্যতা ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। বিশ্বে যতগুলো ফলপ্রসূ সভ্যতা ও বিপ্লব এসেছে তার সবই আদর্শ ও মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরেই। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, অষ্টাদশ শতকে ফরাসিদের মধ্যে যে দু’টি বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যেত, তা হলো- মূল্যবোধ ও ন্যায্যতা। ফলে তারা একটি সফল ও সার্থক বিপ্লব সাধনে সমর্থ হয়েছিল। সমসাময়িক ভারতীয় উপমহাদেশের অবস্থা ফরাসিদের সাথে তুলনীয় না হলেও সে সময় ভারতবর্ষে যে মূল্যবোধের চর্চা ছিল না, তা বলা যাবে না। তবে এক রূঢ় বাস্তবতায় মূল্যবোধ ও নায্যতার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের অবস্থা একেবারে প্রান্তিকতায় এসে ঠেকেছে। যা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র ও সভ্য সমাজের চরিত্র এবং বৈশিষ্ট্যকেই দুর্বল ও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
বস্তুত, মূল্যবোধ স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাগ্রত হয় না বরং রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও পারিবারিক পরিসরে এ জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা আবশ্যকতা দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে নৈতিক শিক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রই নাগরিকের সব কিছুই দেখভাল করে, তাই মূল্যবোধের লালন ও চর্চার পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্বও রাষ্ট্রের। তাই নাগরিকদের জন্য রাষ্ট্রের প্রথম কর্তব্য হবে নৈতিক শিক্ষা, মূলবোধের চর্চা ও সুস্থ ধারার সংস্কৃতি উৎসাহিত করা এবং সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া। তাহলেই সভ্যতার উৎকর্ষতাকে ইতিবাচক ধারায় ফিরে আনা সম্ভব।
এ ক্ষেত্রে সুশিক্ষাই কাঙ্ক্ষিত ও প্রত্যাশিত। কেউ যখন সুশিক্ষিত হয়ে ওঠে তখন তার মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সৃষ্টি হয়; ব্যক্তি হয়ে ওঠে সংস্কৃতিবান। তিনি অবক্ষয়মুক্ত থাকার চেষ্টা করেন। আর তা ফুলে-ফলে সুশোভিত করার জন্য প্রয়োজন হয় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অনুকূল পরিবেশ বা পৃষ্ঠপোষকতা। সুশিক্ষিত তিনিই যিনি তার শিক্ষাকে সৎ আর ন্যায়ের পথে নিয়োজিত করেন। যৌক্তিক বিষয়াদিকে যৌক্তিক বোঝার পর নিজ স্বার্থের দিকে নজর না দিয়ে, অযৌক্তিকতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে সুন্দরকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্রত গ্রহণ করেন।
সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের চর্চার সাথে রাজনীতির নিবিরতম সম্পর্ক রয়েছে। কারণ, রাজনীতির পরিসর খুবই বৃহৎ। রাজনীতি দেশ ও জনগণের আমূল কল্যাণের জন্য আবর্তিত হয়। এতে মূল্যবোধ আর ন্যায্যতার ভিত্তি মজবুত না থাকলে কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণই হয় বেশি। রাজনীতিকদের যদি মূল্যবোধের স্তর নি¤œমানের হয় তবে তা আর রাজনীতি থাকে না বরং অপরাজনীতি হিসেবে আখ্যা পায়। এর কুপ্রভাবে হাজারো মূল্যবোধ নষ্ট হয়। ব্যক্তির মূল্যবোধ নষ্ট হলে ক্ষতি শুধু একজনের কিন্তু শাসক শ্রেণীর মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
মূলত সভ্যতার সঙ্কট, সাংস্কৃতিক বিচ্যুতি ও অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে ধর্মবিমুখতা, ধর্মের অপব্যবহার ও ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা, অসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব এবং সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ের মতো আরো কিছু বিষয়। ধর্মের যথাযথ চর্চা ও অনুশীলন কখনোই ধর্মান্ধতা শেখায় না বরং ধর্মীয় আদর্শের মাধ্যমেই ধর্মান্ধতার অভিশাপ মুক্ত হওয়া সম্ভব। ধর্মই মানুষের জীবনপ্রণালী অন্যান্য ইতর প্রাণী থেকে আলাদা করেছে; মানুষকে সভ্য, সংবেদনশীল ও পরিশীলিত করেছে। সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে আমরা ধর্মকে মনে করি এগিয়ে চলার পথের প্রধান অন্তরায়। কিন্তু বাস্তবতা সে ধারণার অনুকূলে কথা বলে না।
মূলত প্রতিটি সভ্যতাই গড়ে উঠেছিল কোনো-না-কোনো ধর্মকে আশ্রয় করে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন একটি সভ্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেটি ধর্মকে বিসর্জন দিয়ে গড়ে উঠেছে। তাই একটি নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি সৃষ্টি ও অবক্ষয়হীন সমাজ বিনির্মাণ করতে হলে নাগরিকদের মধ্যে জবাবদিহির অনুভূতি সৃষ্টি, ধর্মীয় মূল্যবোধের সম্প্রসারণ, মূল্যবোধের লালন ও অনুশীলনের কোনো বিকল্প নেই। মনীষী সাইয়্যেদ কুতুবের ভাষায়, ‘যে সমাজে মানবীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রাধান্য থাকে সে সমাজই সভ্য সমাজ।’ মূলত মূল্যবোধের চর্চার মাধ্যমে মানবসভ্যতাকে গতিশীল ও সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চা সম্ভব। অন্যথায় সভ্যতার সঙ্কট ও সঙ্ঘাত মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না; বরং সভ্যতার অধঃপতনই অনিবার্য হয়ে উঠবে।

সমাজে অপরাধপ্রবণতা ভয়াবহ
সালাহউদ্দিন বাবর

প্রশাসন এখন রাজনীতি, ক্ষমতা, প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে যতটা ব্যস্ত ও তৎপর, ততটাই গাফেল তাদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা অন্যান্য বিষয় নিয়ে। নাগরিকদের স্বস্তি, শান্তি ও কল্যাণের জন্য দরকার একটি অপরাধমুক্ত সমাজ। অথচ বাংলাদেশে অপরাধপ্রবণতা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আর এসব অপরাধ সঙ্ঘটিত হওয়ার যে খবর আমরা সংবাদপত্র ও সমাজ নিয়ে গবেষণাপত্রে পাই তার মধ্যে রয়েছে- সন্ত্রাস, সহিংসতা, গুম, অপহরণ, হত্যা, ধর্ষণ আর কালো টাকার যথেচ্ছ ব্যবহার। এসব আইন ও সমাজবিরোধী অপকর্মের হোতাদের সীমাহীন দৌরাত্ম্যের পেছনে যারা অভয় ও আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে তারা হচ্ছেন- রাষ্ট্রক্ষমতার যত পার্শ্বচর।
তাদের তৎপরতার কারণে আজ সমাজের যে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা, তা থেকে পরিত্রাণ প্রতিকার পাওয়ার কোনো পথ রয়েছে বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না। সে কারণে হতাশা দেশের মানুষকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এমন অবস্থা সত্ত্বেও পর সমাজপতিদের গ্লানিবোধের কোনো নমুনা নজরে আসছে না। এমন দুর্বিষহ পরিবেশ সৃষ্টির পেছনে এসব সমাজপতির সহযোগীরা রয়েছে, তাই তারা নীরব ও নিষ্ক্রিয়। বস্তুত এসব অপকর্ম মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। মানবাধিকার কর্মীদের এ নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সীমা না থাকলেও তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠ কখনোই এ দেশের প্রশাসনের কানে পৌঁছে না।
অপরাধপ্রবণতার অনেক কারণ আছে। আমাদের যে ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থা তার যে বিন্যাস তাতেও অপরাধ বিস্তৃত হওয়ার সুযোগ বিদ্যমান। আসলে মানুষ যে সমাজে জন্ম ও বর্ধিত হয়, তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রভাব তার ওপর পড়তে বাধ্য। যে সমাজে সুনীতি ও সদাচার বিদ্যমান থাকে, সেখানে মূল্যবোধের চর্চা হয়। ন্যায় থেকে অন্যায় পৃথক করা হয়। আমাদের সমাজে কি এমন সুষ্ঠু বিন্যাস রয়েছে? মানুষ তো অনিয়ম অব্যবস্থা দেখে আসছে জীবনের সেই শুরু থেকে। তাই তাকেই সে গ্রহণ করে নেয়, সে ক্ষেত্রে শুদ্ধতার অনুশীলন সে করবে কেমন করে? প্রথমে শুদ্ধতার অনুশীলন হয় সমাজ থেকে; তারপর এ শিক্ষা পাওয়ার কথা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে।
আমাদের শিক্ষালয়গুলোর বর্তমান পাঠ্যক্রমে বৈষয়িক আর ১০টা বিষয় নিয়ে পাঠদান করা হয়। কিন্তু নীতি নৈতিকতার কোনো পাঠ্যসূচি নেই এ পাঠ্যক্রমে। তাই জাগতিক ভোগবিলাস অর্জন করার পথ-পদ্ধতি সমাজের মানুষ রপ্ত করে সহজেই। কিন্তু কোন পথে কিভাবে তা অর্জন করা উচিত, সেখানে আমাদের শিক্ষাপদ্ধতি নীরব। আর এই মৌনতা মূলত সম্মতির লক্ষণ, অর্থাৎ যেকোনো উপায়ে সমৃদ্ধি ও স্বাচ্ছন্দ্য অর্জনকে বৈধ মনে করা। এমন এক নীতিহীন প্রতিযোগিতার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়ে আছে মানুষ। তাই কারো অধিকার খর্ব করে নিজের সমৃদ্ধি আনতে কারো এতটুকু বাধছে না। আমাদের সমাজের বিন্যাসটা এভাবে ঘটায় লোভ ও লিপ্সার প্রসার ঘটছে। সেই অনুপাতে বাড়ছে অপরাধ। কিন্তু যারা এসবের সাথে জড়িত তাদের বিবেচনায় ‘অপরাধ’ বলে কিছু নেই। তারা যেভাবে যা অর্জন করছে তাকেই স্বাভাবিক বলে ভাবছে, সেখানে নীতিনৈতিকতা আর বিধিবিধানের কোনো বালাই নেই।
সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মুখ্য পরিচয় হচ্ছে যোগ্য ও নীতিবান মানুষ তৈরির সূতিকাগার। এই আদর্শ ধরে রাখতে না পারলে, সেখান থেকে যে মানুষ বেরিয়ে আসে, তার সংজ্ঞা হয় ভিন্ন। আজ যে সমাজবাস্তবতা, তার সাথে ‘লাগসই’ মানুষই এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসছে। বলা বাহুল্য, এরা মূল্যবোধহীন নীতি জ্ঞানশূন্য প্রাণী। তাদের হাতেই গিয়ে পড়ছে বিভিন্ন প্রশাসনের দায়িত্বভার। এমন সব ব্যক্তির হাতে যখন দায়িত্ব আসে, তখন সে ক্ষেত্রে তারা তাদের বোধবিবেচনার আলোকেই কার্য সমাধা করে। তাদের দেয়া সমাধানে সমাজ যা পেয়ে থাকে, সেখানে মানবিকতা, ন্যায়নিষ্ঠা ও কল্যাণচিন্তার কোনো স্পর্শ থাকে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসা এ শিষ্যদেরই কেবল কাঠগড়ায় দাঁড় করালেই চলবে না। তাদের যারা শিক্ষাগুরু তাদের অবস্থা আরো শোচনীয়। খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের যে কীর্তি কলাপ, তা অন্যায়ের সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।
যেমন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে বিরাট আর্থিক কেলেঙ্কারির বহু অভিযোগ। তার সব অনিয়ম ঢাকতে ছাত্রদের তিনি হাজার কোটি টাকার ঠিকাদারি দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলনকে শক্তি প্রয়োগ করে দমনের জন্য তার অনুসারী ছাত্র নামধারী পেটোয়াদের লেলিয়ে দিয়েছেন। ওরা আন্দোলনরত ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর চড়াও হয়ে প্রহার ও নির্যাতন করেছে। কী লজ্জার কথা যে, ভিসি এসব দুর্বৃত্তের সহিংসতার জন্য তাদের বাহবা দিয়ে প্রশংসা করেছেন। আরো দুঃখ ও ক্ষোভের বিষয় হলো, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন এমন অপরাধ ও অনিয়মকারীদের ব্যাপারে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেনি। অথচ উচিত হচ্ছে এর বিরুদ্ধে ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়া। কিন্তু এই লেখা পর্যন্ত সময়ে ভিসির ব্যাপারে কোনো রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। তবে এতে কি সাধারণের মধ্যেই এই বার্তা দেয়া হচ্ছে না যে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা নিছক ‘বাত কা বাত’ বা কথার কথা। পরে কী সিদ্ধান্ত হবে, তা জানি না। দেরিতে যে সিদ্ধান্তই নেয়া হোক, বিচার যদি সময়মতো না হয় তবে সেটা কার্যত না হওয়ারই নামান্তর।
ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রদের নিয়ে গঠিত সংগঠনের মধ্যে অপরাধ ও দুর্নীতির কারণে কিছুদিন আগে শীর্ষ নেতৃত্বে রদবদল হয়েছে। কোনো সংগঠনের শীর্ষে যদি এমন পচন ধরে, তবে শিরা-উপশিরায় এর সংক্রমণ ঘটাটাই স্বাভাবিক। তার নজির দেখা গেছে সারা দেশে। এখন এমন শত শত খবর রয়েছে যে, এ ধরনের সংগঠনের নেতাকর্মীরা দুর্নীতি অনিয়ম ও সন্ত্রাসের সাথে জড়িয়ে দেশব্যাপী এক অসহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করছে। এসব নেতাকর্মী বিভিন্ন স্থানে প্রশাসনের পাল্টা অবস্থান নিয়ে টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি করে নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছে। এদের অশুভ তৎপরতার কারণে জনজীবন অতিষ্ঠ। প্রচলিত নীতি-নৈতিকতা ও আইনকানুনের ব্যাপারে তাদের কোনো মান্যতা নেই; তারা নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে বলে মনে করে। ক্ষমতাসীনদের ভিত্তিমূলের হাল অবস্থা যদি এমন হয়, আর ওপর থেকে যদি কোনো ব্যবস্থা না নেয়া হয়, তবে এরা আশকারা পেয়ে মাথায় উঠবে। আজ দেশের প্রায় সর্বত্র ক্ষমতাসীনদের অঙ্গ ছাত্র সংগঠনের এমন দুরাচার প্রতিহত করতে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন অক্ষম। গোটা দেশের যে নাজুক অবস্থা, সেটা নিয়ন্ত্রণে আনতে তারা সক্ষম হবেন এমন আশা করাটা কল্পনামাত্র।
ক্ষমতাসীনরা দেশের অবকাঠামোগত অগ্রগতি নিয়ে অনেক কথাই বলে থাকেন। কিন্তু মানবিক অবস্থার দুর্গতি যেখানে দেউলিয়াত্বের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে; আর সেটা সব কিছু ধসিয়ে দিতে পারে, সে বোধ তাদের মধ্যে রয়েছে বলে মনে করা যায় না। বর্তমান যে মানবিক বিপর্যয় তাকে রুখে দেয়া সম্ভব না হলে, সে ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত অগ্রগতির চিন্তা নিছক বাতুলতামাত্র। তাই সমাজের মানবিক উন্নয়নের অপরিহার্যতা স্বীকার করে তাকে সত্যিকার অর্থে উন্নত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানে যে শুদ্ধি অভিযান চলছে তার লক্ষ্য এখনো সুস্পষ্ট নয়। এই অভিযানের মাধ্যমে এটা পরিষ্কার হয়েছে রাজনীতি মূল লক্ষ্য হারিয়ে তা লুটপাট ভোগের মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়েছে। সুনীতি ও নৈতিকতার আদর্শ বিসর্জন দেয়া এবং মানবকল্যাণের সর্বজনীন ধারণাকে পরিত্যাগ করা হয়েছে। এই অনৈতিকতার প্রভাব সমাজে পড়ে তাকে বিষিয়ে তুলেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনো যতটুকু নীতিবোধ জাগ্রত রয়েছে, তাও একসময় হারিয়ে যেতে পারে। সমাজ থেকে যদি নীতিবোধ হারিয়ে যায় তবে অপরাধ দুর্নীতি ও নানাবিধ স্খলনের বিষবাষ্পে সবার প্রাণ সংহার ঘটতে পারে।
নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে একটি মানবিক সমাজ গঠন করার জন্য বাংলাদেশের সংবিধানে ব্যাপক ধারণা ও নির্দেশনা সন্নিবেশিত রয়েছে। সংবিধান সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে, এ দেশে গণতান্ত্রিক চেতনার আলোকে সমাজ গঠিত হবে। কোনো বৈষম্য, অনাচার, কর্তৃত্ববাদিতার স্থান এ জনপদে হবে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃত জনপ্রতিনিধিরা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের নেতৃত্ব দেবেন। এমন প্রশাসন যৌথভাবে জবাবদিহি করবে অপর রাষ্ট্রীয় সংগঠন আইন সভার কাছে। কিন্তু এসব নির্দেশনা কেবলই কেতাবেই স্থান নিয়ে আছে। জবাবদিহিতার এই কালচার তথা সংস্কৃতির চর্চা না থাকায় অপরাধ অনিয়ম করে সবাই পার পেয়ে যাচ্ছে। যে সরকারি প্রতিষ্ঠান অপরাধ ও দুর্নীতি থেকে দূরে থাকতে মানুষকে ‘নসিহত’ করবে, সেই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজির কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে।
অথচ এখন পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, এই কর্মকর্তা নিয়োগ পেয়েছেন রাজনৈতিক বিবেচনায় এবং সে কারণেই তাকে নিয়ে আর তেমন ঘাঁটাঘাঁটি করা হচ্ছে না। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যদি এমন অনুরাগ-বিরাগের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয় তা হলে আইনের শাসন যাবে কোথায়? আর আইনের শাসন জারি হওয়ার ক্ষেত্রে এহেন ব্যত্যয়ের কারণেই আজকে দেশে এমন বেআইনি কার্যক্রমই সিদ্ধ বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। অথচ যারা এ দেশের স্থপতি, তারা এই জনপদের মানুষের পরম অভিপ্রায় ও অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে সংবিধান রচনা এবং তার আলোকে এই দেশকে বিনির্মাণের প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু আজ তাদের উত্তরসূরিরা যেভাবে এই আমানতের হেফাজত করছেন তাকে কোনোভাবেই শুদ্ধ ও সঠিক বলা যায় না।
অপরাধজনিত কারণে সমাজে যে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, বস্তুত তা রাষ্ট্রাচারের বড় ত্রুটি হিসেবেই ধরে নিতে হবে। আজকে যে শাসনব্যবস্থা কায়েম রয়েছে, তা আসলে প্রকৃত শাসন নয়। সুশৃঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন রয়েছে, যাকে প্রশাসনিক ভাষায় ‘সুশাসন’ বলা হয়ে থাকে। । যে রাষ্ট্র বা সমাজ যত বেশি সুশাসন দিয়ে পরিচালিত হয়, সে রাষ্ট্রের অগ্রগতি হয় তত বেশি। সেখানে নীতি ও রাষ্ট্রীয় বিধানের গুরুত্ব ও কার্যকারিতা তত বেশি পরিলক্ষিত হয়। সেই সাথে আরো লক্ষ করা যায় যে, কেউ এই নীতির লঙ্ঘন করে দুরাচারী হওয়ার সাহসী হয় না। কেননা তাতে শাস্তির ব্যবস্থাই কার্যকর হবে, কোনো প্রশ্রয় তাতে পাওয়া যাবে না।
সুশাসনের আরেকটি শর্ত হচ্ছে, সেখানে পুরস্কার ও তিরস্কারের ব্যবস্থা থাকবে। রাষ্ট্র তার সৎ শুদ্ধাচারী যোগ্য কর্মীদের পুরস্কৃত করবে, পক্ষান্তরে নীতিভ্রষ্টতার জন্য তিরস্কারের ব্যবস্থা থাকবে; যা কিনা সৎ কর্মে উৎসাহিত করবে এবং ভ্রষ্টতা থেকে দূরের থাকার প্রেরণা জোগাবে। আমাদের সংবিধান প্রশাসনকে সৎ নিষ্ঠাবান এবং দুরাচার থেকে দূরে থাকার একটি ব্যবস্থা রেখেছে। সেটা হলো ন্যায়পালের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই এই বিধানটি কার্যকর করেনি। তাই এর সরল অর্থ এটাই যে, অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত কোনো প্রশাসনই একটি পেশাদার আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উৎসাহী ছিল না।

স্বাধীন দেশের গর্ব আমাদের অবশ্যই ফিরে পেতে হবে
মইনুল হোসেন

জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের নির্বাচনী ব্যবস্থা বিলীন হওয়ার কারণে সরকারের ওপর এমনকি নিজেদের গন্তব্যের ওপর জনগণ তাদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। স্বাধীন দেশে জনগণ হচ্ছে তাদের ভাগ্যের নিয়ন্তা। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সে কথা বলা যাবে না। কারণ, জনগণের ভোটের নির্বাচনের অবর্তমানে জনগণ কিছু নয়। জনগণের কাছে সরকারেরও কোনো জবাবদিহি নেই। ক্ষমতাসীনদের কোনো জবাবদিহির বালাই নেই। নেতার ব্যক্তিগত আনুগত্যের ওপর নির্ভরশীল থাকা রাজনীতিতে আদর্শ বা নীতির কোনো বাঁধনও থাকে না। তাই সর্বত্র চলছে নীতিহীনদের বাড়াবাড়ি।
রাজনীতি নীতি-আদর্শহীন হতে পারে না। তাই বিরাজনীতিতে নেতাদের সাথে মন্ত্রী-মিনিস্টারদের সম্পর্ক চাকরিদাতা ও চাকরিজীবী সম্পর্কের মতো। ব্যক্তি হিসেবে কাউকে খুশি রাখা তো রাজনীতির কথা নয়। দেশে তাই চলছে রাজনীতিহীন বিরাজনীতি।
যারা বর্তমানে রাজনীতি করছেন, তারা তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলছেন। তারা দেশের জন্য কাজ করছেন, স্থানীয়ভাবে রাস্তাঘাট নির্মাণ করছেন; কিন্তু তারা মানুষের সুখ-শান্তির কথা বলবেন না। নীতি-চরিত্রের প্রশ্ন তো করা যাবেই না। তারা এটাও ভুলে যান, তারা যে রাস্তাঘাট বা বড় বড় প্রজেক্টের কথা বলছেন তা তো জনগণের টাকায়ই হচ্ছে। এসব তো কন্ট্রাক্টররা করবেন। তাদের কাজ শুধু কমিশন ভাগাভাগি করা।
স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের অতীতের রাজনৈতিক নেতাদের ঐতিহ্য, চরিত্র বা অবদানের কথা স্মরণেই রাখছেন না। রাস্তাঘাট তৈরির ‘ঠিকাদারি রাজনীতি’ করতে গিয়ে দেশটিতে চলছে নীতি-চরিত্রহীনতার ভয়াবহ খেলা। ক্ষমতায় থাকতেই হবে, বিত্তশালী হতেই হবে।
রাজনৈতিক আদর্শ কিংবা মূল্যবোধের প্রতি কোনো প্রকার রাজনৈতিক অঙ্গীকার নেতৃত্বের গুণাবলি বিচারের ক্ষেত্রে মোটেও গুরুত্ব পাচ্ছে না। আইনজীবী হতে হলে একজন আইনজীবীর কাছে যেতে হয়। বর্তমান বাংলাদেশে রাজনীতিবিদ হওয়ার জন্য গণতান্ত্রিক নীতি-আদর্শের খোঁজে কারো কাছে যেতে হয় না। চাকরি দেয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ব্যাপারটিই সব কিছু। এর ফলে রাজনৈতিক ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যক্তিগত লাভালাভের বিষয়। জনগণের নিঃস্বার্থ সেবা করার রাজনীতি বিদায় নিয়েছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কোনো মন্ত্রী-এমপিকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে, যিনি তার রাজনৈতিক অবস্থানকে বিপুল বিত্তবৈভব অর্জনে ব্যবহার করেননি। নীতি-আদর্শ ও মূল্যবোধহীন শাসনব্যবস্থায় বিত্তশালী হওয়ার মানসিকতা প্রাধান্য পাওয়াই তো ক্ষমতাসীনদের জন্য স্বাভাবিক। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ক্ষমতায় থেকে সম্পদ অর্জন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
সবচেয়ে বেদনার বিষয় হচ্ছে, যারা আমাদের পাবলিক সার্ভেন্টস তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালনের কোনো নামগন্ধ নেই। দেশের সংবিধান সংরক্ষণ করার দায়িত্বও তারা পালন করেন না। এমপি এবং মন্ত্রীদের কেউ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছেন না। জনগণের প্রতি তাদের কোনো দায়-দায়িত্বও নেই। আমরা স্বাধীন দেশের জনগণ, কিন্তু আমরা আমাদের নিজেদের সরকার নির্বাচন করতে পারি না। এর চেয়ে আর কত অথর্ব আমরা হতে চাই?
জনগণের সরকারের মূলে আঘাত করছে অনির্বাচিত সরকার। এর আর একটি অদ্ভুত চরিত্র হচ্ছে, জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে ব্যাপক দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। পাবলিক সার্ভেন্টস যেন ব্যক্তিগত কর্মচারী। তাদেরকে জনগণের বিরুদ্ধে কাজ করাতে অসুবিধা হচ্ছে না। জনগণের পুলিশ জনগণের পক্ষে থাকতে পারছে না। স্বাধীন দেশের জনগণের বিরুদ্ধে লাঠিয়াল হওয়া পুলিশের জন্যই অপমানজনক।
জনগণকে সর্বক্ষণ ভয়ভীতির মধ্যে অসহায় করে রাখার জন্য দেশব্যাপী দুর্নীতির দানবীয় শক্তির বিস্তার আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। সরকারের এমন কোনো বিভাগ নেই, যেখানে দুর্নীতি ঢোকেনি। সরকারি অর্থসম্পদ অবাধে ব্যয় করা হচ্ছে, যাতে সরকারের উচ্চপর্যায়ে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়।
এভাবে জনগণের ভোটাধিকারের ক্ষমতার জায়গাটি দখল করে নিয়েছে দুর্নীতির ক্ষমতা।
দুর্নীতি ও অপরাধের রাজনীতি সবচেয়ে অমানবিক রূপ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করার নিষ্ঠুর আচরণে। আবাসিক হলগুলোর মধ্যে ছাত্রদের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে ‘টর্চার সেল’। সম্প্রতি বুয়েটের একজন মেধাবী ছাত্রকে সহপাঠীরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। শুধু বুয়েটেই ছাত্রলীগের ৫০টির মতো নির্যাতন কেন্দ্র পাওয়া গেছে।
ব্যাপারটা এ রকম দাঁড়িয়েছে যে, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন কোনো উন্নয়ন নয়। তরুণদের জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য চাকরির সুযোগ সৃষ্টির কথা ভাবা হচ্ছে না। সরকারের কাছে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণের নামই হচ্ছে উন্নয়ন। এসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, কিন্তু সম্পন্ন করার প্রশ্ন নেই, যাতে অর্থের প্রবাহ সচল থাকে এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য যাদের সমর্থন দরকার তারা খুশি থাকে। তাই বছরের পর বছর ধরে প্রজেক্টের কাজ চলছে।
প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে আমলাদের কথা শুনে সরকার ভাবছে, দেশের উন্নয়ন হচ্ছে। তলিয়ে দেখছে না তাদের সরবরাহকৃত জিডিপি সম্পর্কিত তথ্য কতটা সঠিক। তারপর যা সত্য তা হলো, শুধু জিডিপিই জনজীবনে আর্থিক সচ্ছলতা আনে না। সরকারকে জনগণের আর্থিক দুর্গতি কিংবা দুঃখ-কষ্ট উপেক্ষা করেও দুশ্চিন্তায় পড়তে হচ্ছে না।
সরকারের উচিত হবে একই সাথে তুলনামূলক তথ্য সরবরাহ করা, যাতে তাদের কতজন কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন আর আমরা যারা জনগণ তারা কী পরিমাণ নিঃস্ব হয়েছি তা বোঝার জন্য। প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা মারাত্মক সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছে। সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতি মৃতপ্রায়। দুর্নীতির ভারে মানুষ শ^াসরুদ্ধ হয়ে পড়ছে। অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দলীয় লোকদের দুর্নীতি আর ফটকাবাজির রমরমা ব্যবসা চলছে। সরকার সম্পূর্ণভাবেই নিজের লোকদের জন্য।
সাধারণভাবে বলা যায়, জনগণের কল্যাণ, তাদের নিরাপত্তা কিংবা পুলিশের কাছে অসহায়ত্ব সরকারের কাছে মোটেই গুরুত্ব পাচ্ছে না এবং সরকারও সেসব সমস্যার সমাধান করার তাগিদ অনুভব করছে না। শিক্ষিত তরুণদের দুর্বৃত্ত হিসেবে ব্যবহার করেই খুশি।
আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের জীবন কঠিন করে তোলাই উন্নয়ন কর্মসূচিতে অগ্রাধিকার পেয়ে আসছে। যেহেতু সরকার জনগণের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না, তাই সর্বক্ষেত্রে আমলারাই সরকারের ক্ষমতার নির্ভরযোগ্য ভিত্তি। তারাই শক্তির উৎস। সুতরাং তাদেরকে অবশ্যই খুশি রাখতে হয়। জনগণের অর্থে জনগণের বিরুদ্ধে কাজে লাগা সরকারি কর্মচারীদের প্রধান কাজ। জনগণের সেবক হিসেবে তাদেরকে জনস্বার্থে কোনো কাজ করার তাগিদ নেই।
জনগণের ভোটের ক্ষমতা না থাকায় জনগণের সরকারের গোটা ধারণাই উল্টে গেছে। সরকার গঠনে জনগণের ভোটের প্রয়োজন হচ্ছে না বলেই জনগণ উপেক্ষিত হচ্ছে।
রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের অর্থ গোটা সরকারি ব্যবস্থার দুর্বৃত্তায়ন। আইনের অপব্যবহার বন্ধের ব্যবস্থা না থাকায় কঠিন আইন করার অর্থ আইনের অপব্যবহারের সুযোগ বৃদ্ধি করা। জনগণের জন্য অধিকতর বিপত্তি ডেকে আনা। পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার করা সম্ভব হলে পুলিশ নিজ স্বার্থেও তার ক্ষমতার যথেচ্ছ অপব্যবহার করবে। সরকারের নির্বাচনী জয়-পরাজয় নির্ধারণে যখন পুলিশি শক্তির ব্যবহার করা হয় তখন পুলিশও বুঝে যায় তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে পারবে। যখন সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর শক্তির উৎস হয়ে দাঁড়ায় তখন পুলিশও নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে মনে করতে পারে। তাই হচ্ছে দেশব্যাপী। সে জন্য পুলিশকে দোষী করাই যথেষ্ট হবে না। কারণ, বর্তমান শাসনব্যবস্থায় জনগণের অসহায়ত্ব নিশ্চিত করা হচ্ছে।
রাজনীতিতে নীতি-মূল্যবোধের গুরুত্ব না থাকলে যে কেউ নেতা হতে পারেন। ক্ষমতা দখল করলেই সরকার গঠন করতে পারেন। নেতা হতে পারেন, কিন্তু রাজনৈতিক নেতা রাজনৈতিক নীতি-আদর্শহীন হতে পারেন না।
দীর্ঘ দিনের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে সরকার একটা মুমূর্ষু অবস্থায় পৌঁছে গেছে অনেক আগেই এবং আমলাতান্ত্রিক নিষ্ক্রিয়তাও দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। বিরাট বিরাট সাফল্যের মিথ্যা কাহিনী অসার প্রমাণিত হচ্ছে। সরকার নিজেই আর্থিক সঙ্কটে আছে। আমাদের দুর্ভাগ্য রাজনীতি বিরাজনীতি হওয়ায় রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না। দেশে আন্দোলন হচ্ছে না তাই ক্ষমতাসীনরা বিপদ দেখেও দেখছেন না। তাদের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাই অবাধে চলবে। তবুও আমরা বলব, বর্তমান ব্যবস্থা কোনো টিকে থাকার ব্যবস্থা নয়। পরিবর্তন অনিবার্য, কিন্তু সে পরিবর্তন নৈরাজ্যিক এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ হতে না পারে, সেটি নিয়েই দুশ্চিন্তার বিষয়। সব কিছু নির্ভর করছে সরকারের সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবের ওপর। সমঝোতার ভেতর দিয়ে পরিবর্তনের সুযোগ রয়েছে। যদিও আমি সে ব্যাপারে আশাবাদী নই। শান্তিপূর্ণ প্রস্থানের জন্য দরকার হয় সাহস ও রাজনৈতিক উপলব্ধি। বিরাজনীতির সরকার তাই ব্ল্যাকহোলের ফাঁদে নিজেই বন্দী হয়ে পড়েছে। নিজেদের চেষ্টায় এ ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে না। ঐতিহাসিক নিয়মে যা ঘটার তা ঘটবে। কিন্তু এ দেশের ১৭ কোটি মানুষের করণীয় কিছু থাকবে না তা হয় না। আমরা সবাই দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতির অন্যায়-অবিচারের কাছে অসহায় থাকব, এটা মানতে পারছি না। স্বাধীন দেশে মান-মর্যাদা নিয়ে থাকার পরিস্থিতি নেই।
স্বাধীন দেশের গর্ব আমাদের অবশ্যই ফিরে পেতে হবে।
[সংকলিত]