সৃষ্টি ও ধ্বংসের দিন ১০ মহররম

0

আজ রবিবার। পবিত্র আশুরা তথা হিজরী নববর্ষের প্রথম মাস মহররমের ১০ তারিখ। স্বৈরাচার, মিথ্যাবাদী ও জালেম ফেরাউনী শাসকের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক বিপ্লবের দিন। ৬১ হিজরীর এই দিনে অত্যাচারী শাসক ইয়াজিদের অন্যায়, অত্যাচার ও ধর্ম সম্পর্কে প্রচারের প্রতিবাদ করতে গিয়ে স্ব-পরিবারে কারবালার ময়দানে শাহাদাত বরণ করেছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.)।
ঐতিহাসিক বর্ণনায় জানা যায়, ইয়াজিদ অন্যায়ভাবে মতায় আরোহণের পর তার শাসন মতা পাকাপোক্ত করতে নিজের মন মতো হাদীস ও ফতোয়া তৈরি করেন। তিনি এক শ্রেণির আলেম নামধারী ব্যক্তিদেরকেও নানা পদ পদবীর লোভ দেখিয়ে তার শাসন মতার পে ব্যবহার করেন। নিজের মতা টিকিয়ে রাখতে জাল হাদীস তৈরি করে প্রচার করতে থাকে। সত্য প্রিয় মানুষের ওপর অন্যায়ভাবে জুলুম নির্যাতন চালাতে থাকে। ইয়াজিদের অবৈধ শাসনের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করলেই তাকে গ্রেফতার করা হতো, নির্যাতন চালানো হতো, অবশেষে হত্যা করা হতো। এসব অন্যায় জুলুমের প্রতিবাদে নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.) স্বোচ্চার ভূমিকা পালন করেন। তিনি জনগণকে ইয়াজিদের মিথ্যাচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদী ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) তাঁর পরিবারের সদস্যসহ সঙ্গী সাথীদের নিয়ে ইয়াজিদের অন্যায়ের প্রতিবাদে এগিয়ে আসেন। কুফার কারবালা নামক স্থানে আসলেই তাকে বাধা দেয়া হয়। তিনি এখানেই তাবু স্থাপন করেন। ইয়াজিদের নিযুক্ত কুফার গভর্নর ইবনে জিয়াদ ৯ মহররম ইমাম হোসাইন (রা.)’র ছোট্ট শিবিরের ওপর অবরোধ জোরদারের ও হামলার নির্দেশ দেয়। এর আগেই আরোপ করা হয়েছিল অমানবিক পানি-অবরোধ। পশু-পাখি ও অন্য সবার জন্য ফোরাত নদীর পানি ব্যবহার বৈধ হলেও এ অবরোধের কারণে কেবল নবী-পরিবারের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় এই নদীর পানি। ইয়াজিদ বাহিনীর সেনা সংখ্যাও ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং দশই মহররমের দিনে তা প্রাায় বিশ বা ত্রিশ হাজারে উন্নীত হয়। আর পান্তরে ইমাম হোসাইন রা. এর বাহিনীতে সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র একশ’। ইয়াজিদের মতার পে সমর্থন দেয়ার জন্য গর্ভনর ইবনে জিয়াদ বার বার ইমাম হোসাইন রা. এর নিকট প্রস্তাব দেন। কিন্তু ইমাম হোসাইন রা. অন্যায়ের সাথে আপস না করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন।
পবিত্র আশুরার দিন শুধু ইমাম হোসাইন রা. শাহাদাত বরণের দিন নয়, এ দিন পৃথিবী সৃষ্টি থেকে কেয়ামত পর্যন্ত অসংখ্য ঘটনার দিন। শুধু মুসলমান নয় সকল মানুষের কাছে দিনটি স্মরণীয়। ইতিহাসে বিশাল জায়গা দখল করে আছে পবিত্র আশুরা দিবস। মহান আল্লাহ তায়ালা এ দিনেই আরশ, কুরছি, লওহ, কলম আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন এবং এ দিনেই আদম (আ.)কে সৃষ্টি করে তাকে বেহেশতে স্থান দিয়েছেন। পরবর্তীতে শয়তানের প্ররোচণায় ভুলের কারণে এ দিনেই তাঁকে দুনিয়াতে পাঠিয়ে আল্লাহ প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছেন। হযরত নূহ (আঃ) সাড়ে নয়শত বছর ধরে তাওহীদের বাণী প্রচারের পর যখন সে যুগের মানুষ আল্লাহর বিধি নিষেধ পালনে অস্বীকৃতি জানায়, তখন নেমে আসে আল্লাহর গজব। ফলে হযরত নূহ (আ.) এর সম্প্রদায় ধ্বংস হয়েছে। শুধু রা পেয়েছে তাওহীদে বিশ্বাসী নূহ (আঃ) এর অনুসারীবৃন্দ। পবিত্র আশুরার দিনে মহাপ্লাবনের সময় হযরত নূহ (আ.) এর নৌকা তার অনুসারীদের নিয়ে জুদি পাহাড়ের পাদদেশে এসে থেমেছিল। আজো তার কিছু নির্দশন সেখানে পাওয়া যায়। পবিত্র আশুরার দিনেই হযরত ইব্রাহীম (আ.) শত বিধি নিষেধের মধ্য দিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন। পরবর্তীতে তিনি নমরুদের অগ্নিকান্ড থেকে উদ্ধার লাভ করেন এবং নিজের প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)কে আল্লাহর নামে জবেহ করতে উদ্যত হলে খলিলুল্লাহ বা আল্লাহর বন্ধু হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছিলেন পবিত্র আশুরার দিনে। এদিনেই হযরত আইউব (আঃ) কঠিন রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন, হযরত ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং কাফেরদের ষড়যন্ত্রে শিকার হলে আল্লাহ তাকে চতুর্থ আসমানে উঠিয়ে নেন। এদিনেই হযরত দাউদ (আ.) আল্লাহর কাছ থেকে মা লাভ করেছিলেন, হযরত সোলেমান (আ.) তার হারানো রাজত্ব পুনরুদ্ধারে সম হয়েছিলেন, হযরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি লাভ করেছিলেন, হযরত ইয়াকুব (আ.) তার হারানো পুত্র হযরত ইউসূফ (আ.)কে চল্লিশ বছর পর ফিরে পেয়েছিলেন। পবিত্র আশুরার দিনে ফেরাউনের স্ত্রী বিবি আছিয়া শিশু মুসাকে গ্রহণ করেছিলেন। আবার স্বীয় কওমের লোকজনসহ হযরত মূসা (আঃ) নীল নদ অতিক্রম করে ফেরাউনের জুলুম থেকে মুক্তি লাভ করেন। পন্তরে ফেরাউন সদলবলে নীল নদে ডুবে মারা যায়। পবিত্র আশুরা সমগ্র জগৎ সৃষ্টির দিন হিসেবে যেমনি স্বীকৃত তেমনি এদিন কেয়ামত অনুষ্ঠিত হয়ে জগৎ ধ্বংস প্রাপ্ত হবে। এদিনে এমনি আরো বহু ঘটনা সংঘটিত হয়েছে এবং আরো হবে। এসব কারণেই আশুরার দিনের ফল রোজা অন্যসব রোজার চেয়ে সেরা। এদিন রোজা রেখে ইবাদত করলে বিগত বছরের ছোট ছোট সব গুনাহ ক্ষমার কথা বলা হয়েছে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কারবালার ময়দানে
ইমাম হোসাইন রা. তার সঙ্গী সাথীসহ সবাইকে নিয়ে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করলেন। তবু ইয়াজিদের শাসনমতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেননি। ইয়াজিদ প্রায় ৫ সহস্রাধিক সেনাবাহিনী নিয়ে মতার দম্ভ দেখিয়ে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর ুদ্র ঈমানদার ১শ’ জন সাহাবীকে শহীদ করে তার মতা সাময়িকভাবে রা করতে পেরেছিলেন। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় চিরদিনের জন্য তিনি ইসলাম ও মুসলমানদের তথা সত্যপ্রেমীদের শত্রুতে পরিণত হয়েছেন। আর ইমাম হোসাইন রা. অন্যায়ের প্রতিবাদ করে জীবন দিয়ে শাহাদাত বরণ করে ইহ-কাল ও পরকালে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। আজো যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনগণের সমর্থন না নিয়ে মতা দখল করে অন্যায় নির্যাতন, খুন, গুম চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের জন্য এ ঘটনা অবশ্যই শিণীয়। আমরা আশা করবো, বিশ্বের সব জুলুমবাজ, মিথ্যাবাদী শাসকরা আশুরার শিক্ষা নিয়ে সংশোধন হবেন।