তীব্র উষ্ণতায় দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির মুখে যশোরের সবজি ও মাছ চাষি

0

আকরামুজ্জামান ॥ তীব্র উষ্ণতায় সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে পড়েছে যশোরের সবজি ও মাছ চাষ। গত ৩০-৪০ বছর ধরে মাছ ও সবজি চাষে এ জেলার চাষিরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে আসলেও এ বছর বৈরী আবহাওয়া তাদের জন্যে নিয়ে এসেছে এক অশুভ বার্তা।
চলমান অতি তীব্র এ তাপপ্রবাহের কারণে তারা চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন। জেলার বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে পটল, বেগুন, ঢেঁড়স, করোলা, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, মিষ্টি কুমড়া, লাউ, লালশাক ও ডাটাশাক ও কাঁচা মরিচসহ বিভিন্ন সবজির আবাদ রোদে পুড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কয়েক শ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
সবজির পাশাপাশি অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে মাছ চাষে। গত ১০ থেকে ৫ মে পর্যন্ত হ্যাচারি মালিকদের ২০-২৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন জেলা হ্যাচারি মালিক সমিতির নেতারা। আর্থিক এ ক্ষতি আগামী কয়েক মৌসুমেও উঠবে না বলে তারা জনিয়েছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর সূত্রে জানা গেছে, দেশের মোট চাহিদার ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ সবজি ও মাছের উৎপাদন হয় যশোর জেলা থেকে। যে কারণে যশোর জেলা মাছ ও সবজি চাষের উদ্বৃত্ত এলাকা হিসেবে পরিচিত। চলতি মৌসুমে জেলায় ১৩ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে গ্রীষ্মকালীন সবজি চাষ করা হয়েছে। অন্যান্য বছরে এ সময়ে গ্রীষ্মকালীন এ সবজির সরবরাহে বাজার ভরপুর থাকে। তবে এ বছর ইতিহাসের টানা রেকর্ড অতি তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে বেশির ভাগ সবজি ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে বেড়েছে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ। এ অবস্থায় নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে সবজি চাষের সাথে যুক্ত কৃষকরা।
জেলার সদর উপজেলার তীরের হাট এলাকার সবজি চাষি কোহেলি হোসেন জানান, খরায় এ বছর আমাদের যে ক্ষতি করে দিয়ে গেলো তা কখনও পূরণ হওয়ার মতো নয়। বিগত ৩০-৩৫ বছর ধরে সবজি চাষ করে এসেছি। ঝড়-বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরার কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। তবে এমন পরিস্থিতিতে এর আগে আর কখনও পড়িনি।
একই এলাকার চাষি হজরত আলী বলেন, অন্যান্য বছরে খরা-অনাবৃষ্টির কবলে আমরা পড়লেও তখন অতিরিক্ত সেচ দিয়ে ক্ষেত রক্ষা করা গেলেও এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। দিনে রাতের তাপমাত্রার বিস্তর ফারাক থাকায় সেচ দিয়েও সবজি ক্ষেত রক্ষা করা যাচ্ছে না। তাপদাহের কারণে সবজির গাছ লালচে হয়ে গেছে, কুঁকড়ে যাচ্ছে সবজি গাছের পাতা, বেশিরভাগ ক্ষেতের ফুল ও ফল ঝড়ে পড়ে যাওয়ার পোকা-মাকড়ের আক্রমণে ফলন কমে গেছে। তিনি বলেন, সবজি সেক্টরের যে ক্ষতি হয়ে গেলো তা দেশের অর্থনীতির পাশাপাশি বাজারেও বড় প্রভাব ফেলবে।
মাঠ পর্যায়ের চাষিদের দাবি ইতোমধ্যে মোট আবাদের দুই তৃতীয়াংশ সবজি ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। তবে কৃষকদের এ দাবি সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. সুশান্ত কুমার তরফদার। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে মোট আবাদের ১৫ শতাংশ সবজি নষ্ট হতে পারে। তবে ক্ষতি থেকে রক্ষায় কৃষকদের সবজি ক্ষেতে বেশি বেশি সেচ দেয়াসহ নানা পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
সবজির পাশাপাশি তাপপ্রবাহের কবলে পড়ে দীর্ঘ মেয়াদী সংকটে পড়েছে দেশের অন্যতম যশোরের চাঁচড়া হ্যাচারিপল্লী। এই মৌসুমে জেলার চাহিদা মিটিয়ে অন্যান্য বছরে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ রেণু ও পোনা সরবরাহ হলেও সেটি এখন চরম হুমকির মুখে পড়েছে। কার্যত এখানকার উৎপাদন গত প্রায় এক মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। প্রচ- গরমের কারণে গত ২৫ দিনে রেণুপোনা উৎপাদন কমে ৫০ শতাংশে নেমেছে। অতি তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে পোনা মারা যাচ্ছে। এতে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা।
জেলা হ্যাচারি মালিক সমিতি সূত্রে জানা যায়, যশোরে সমিতিভুক্ত রেণুপোনা উৎপাদনের হ্যাচারি রয়েছে ৩৬টি। এর বাইরেও ১০-১৫টি আছে। এসব হ্যাচারিতে চলতি বছর দুই থেকে আড়াই লাখ কেজি রেণু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু গরমের কারণে চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার ২০ শতাংশও পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাপপ্রবাহে পুকুরের তলদেশে গ্যাস জমে পানি গরম হয়ে যাওয়ায় পুকুরের মাছ উৎপাদনেও ধস নেমেছে। কোনোভাবেই এখন রেণুপোনা উৎপাদন করা যাচ্ছে না।
হ্যাচারি মালিক সমিতির সভাপতি ফিরোজ খান বলেন, এমন পরিস্থিতি বিগত দিনে কখনও পড়েননি তারা। করোনাকালীন সময়েও তারা মাছ চাষে ক্ষতির মুখে পড়লেও পরবর্তীতে তারা ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নেন। তবে এবছর মৌসুম শেষ হতে চললেও তারা কোনো বেচাকেনা করতে পারছেন না। গরমে দেশের বাইরে থেকে তো দূরের কথা জেলার মাছ চাষিরাও পোনা কিনতে আসছেন না। চলমান পরিস্থিতিতে কয়েক শ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
প্রায় একই কথা বলেন, সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাতৃফিস হ্যাচারির মালিক জাহিদুর রহমান গোলদার। তিনি বলেন, চলমান দাবদাহ সবচেয়ে মৎস্য সেক্টরকে ক্ষতি করেছে। যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলো এ থেকে উত্তরণে আমাদের কয়েক বছর সময় লাগবে। তিনি বলেন, এই সময়ে অন্যান্য বছরে চাঁচড়া মৎস্যপল্লী ক্রেতা-বিক্রেতাদের উপস্থিতিতে প্রাণবন্ত থাকলেও এখন সেখানে সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। সামনে বৃষ্টি হলেও ক্ষতি কাটিয়ে উঠা সম্ভব নয় বলে তিনি দাবি করেন।