যশোরের কীর্তিমানেরা অবমূল্যায়িত যবিপ্রবিতে

0

তহীদ মনি॥ যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি)-এর পাঁচ ভবনের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। শুক্রবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ডের সভায় নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তীতে ভবনগুলোর নতুন নাম যশোর শহরে জানাজানি হওয়ার পর বিভিন্ন স্তরের মানুষ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। অনেকে বিস্মিত হয়েছেন। তাদের সকলেরই একটিই কথা যশোরের বিশ্ববিদ্যালয়ে যশোরের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের বীরশ্রেষ্ঠ, খ্যাতিমান কবি লেখক, বুদ্ধিজীবী, সমাজসেবক, বিজ্ঞানী, সাদামনের মানুষ, সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদসহ বহু শ্রদ্ধেয় মানুষ থাকতেও নতুন নামকরণে ঠাঁই পাননি এসব স্মরণীয়-বরণীয় মানুষেরা।

পতিত সরকারের আমলে রাজনৈতিক কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত ইতিহাস এবং এর প্রতিষ্ঠাতাদের নাম মুছে ফেলা হয়েছিল। নানা কারণে উপেক্ষিত ছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্যে সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলামসহ অন্যদের নাম। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উদ্বোধনের পরও আওয়াীলীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী আবার উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়, লেখা হয় নতুন ফলক। বিতর্কের পর বিতকের্র জন্ম দেওয়া হয় এবং এত দিন পর আবার ৫টি ভবনে নতুন নামকরণের সময় যশোর খ্যাতিমানদের উপেক্ষার মাধ্যমে আবার বিতর্কের জন্ম দেওয়া হলো বলেও অনেকের অভিমত।

শুক্রবারে রিজেন্ট বোর্ডের সভায় সিদ্ধান্ত অনুসারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাডেমিক ভবনের নতুন নাম কবি নজরুল একাডেমিক ভবন, শেখ হাসিনা ছাত্রী হলের নতুন নাম তাপসী রাবেয়া হল, শেখ রাসেল জিমনেসিয়ামের নতুন নাম বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান জিমনেসিয়াম, ড. এম.এ ওয়াজেদ মিয়া ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভ্যান্সড স্টাডিজ এর নতুন নাম ইনস্টিটিউট ফর হায়ার স্টাডিজ এন্ড রিচার্স এবং ভেটেরিনারি অনুষদের ছাত্র হলের নতুন নাম কবি গোলাম মোস্তফা হল রাখা হয়েছে।

এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের নোটিস বোর্ড ও ওয়েবসাইটে নাম প্রস্তাবনা চাওয়া হয়। ফেব্রুয়ারি মাসের ২৪ তারিখের মধ্যে এই নাম জমা দেওয়ার কথা ছিল। শিক্ষার্থীদের দেওয়া নামের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে রিজেন্ট বোর্ডের সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানিয়েছে।

শুক্রবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে রিজেন্ট বোর্ড সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. আব্দুল মজিদের সভাপতিত্বে অন লাইনে যুক্ত ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গণি। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. খ.ম কবিরুল ইসলাম, যবিপ্রবির ট্রেজারার প্রফেসর ড. হুসেন আল মামুন, প্রফেসর ড. রফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক নার্গিস বেগম, প্রফেসর ড. মাহমুদ হোসেন, প্রফেসের ড. আলতাপ হোসেন, এম.এম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মফিজুর রহমান, যশোর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. আহসান হাবীব, প্রফেসর ড. আসমা খাতুন, প্রফেসর ড. এইচ এম জাকির হোসেন এবং ভার্চ্যুয়ালি যুুক্ত ছিলেন যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর আসমা বেগম। সভার সাচিবিক কাজ সম্পাদন করেন যবিপ্রবি’র রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী আহসান হাবীব।

এদিকে যশোরের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের অভিমতে জানান, দেশের প্রথম জেলা যশোর। প্রাচীন এ জেলার নাম ঐতিহাসিক বিভিন্ন ঘটনার সাথে উল্লেখযোগ্যভাবে বর্ণিত রয়েছে। যেমন রাজনৈতিক, তেমনি সামাজিক, সাহিত্যিকসহ শিল্পকলার নানান কর্মকান্ডে এ জেলার মানুষের নাম শীর্ষে রয়েছে। রয়েছেন জ্যোতিষবিদ রাধা বর্মন, গ্রন্থ আন্দোলনের পথিকৃৎ অধ্যাপক শরীফ হোসেন, শিক্ষাবিদ ও কবি ড. মনিরুজ্জামান, বিজ্ঞানী ড. শমসের আলী, কবি আজীজুল হক, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ, বিজ্ঞানী রাধা বল্লভসহ মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ভাষা আন্দোলনকারী অসংখ্য গুণী ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, তাদের নাম আগে আসা দরকার ছিল। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ভাষা শহীদ হামিদা বেগম কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান থাকায় এখানে তাদের নাম দেওয়া না হলেও দুঃখ ছিল না। কিন্তু নতুন দেওয়া ৫টি নামের মধ্যে সকলেই শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব হলেও কেউই যশোরের মানুষ বা ব্যক্তিত্ব নন। এটা যশোরবাসী মানতে নারাজ। তারা অতি দ্রুত এটা সংশোধন করে যশোরের স্মরণীয় ব্যক্তিত্বদের নামে নামকরণ দাবি করেন।

তাদের অভিমত- বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গুণী ব্যক্তিদের নামে নামকরণের উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদেরকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে স্মরণী বা পরিচিত রাখা। সে ক্ষেত্রে যশোরের বিশ্ববিদ্যালয়ে যশোরের গুণী ব্যক্তিদের নাম থাকবে না- এটা বিস্ময়কর।

মানবাধিকার কর্মী ও রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, ৫টি নতুন নামের মধ্যে যশোরর কারো নাম স্থান পেলো না। যশোরের বহু মণিষী সারা দেশের জন্যে খ্যাতি বয়ে এনেছেন। অথচ যশোরের প্রতিষ্ঠানে তারা উপেক্ষিত! তিনি দ্রুত ্এ নাম পরিবর্তন চান।

দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি (দুপ্রক) যশোরের সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, সাধারণত যে এলাকায় প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয় সেখানকার স্মরণীয় ব্যক্তিদের নামে প্রতিষ্ঠান, ভবন, হলসহ বিভিন্ন নামকরণ করা হয়, এখানে তা যদি উপেক্ষিত হয় তবে সেটি যশোরবাসীর জন্যে দুর্ভাগ্যজনক কবে। এটা যশোরবাসীকে উপেক্ষা করার শামিল। তিনি দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এ ধরণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার অনুরোধ জানান।

যশোর সরকারি এম.এম কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ড. মুস্তাফিজুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, যশোর অসংখ্য সাদা ও গুণী মানুষের আলোয় আলোকিত। তাঁরা আলো ছড়িয়েছেন দেশ থেকে বিশ্বে। অথচ আজ যশোরের প্রতিষ্ঠানে কোথাও নামকরণে তাঁদের নাম আমরা কীভাবে বাদ দিতে পারি? এটা ঠিক কোনো বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি জেলার জন্যে নয়, তবে যারা অন্য জায়গা থেকে জ্ঞান আহরণ করতে এই প্রতিষ্ঠানে আসবেন তারা যদি এই এলাকার খ্যাতিমান ও আলোকিত মানুষের সাথে পরিচিত হতে না পারেন সেটা হবে দুর্ভাগ্যজনক। হল, ভবন বা প্রতিষ্ঠান কোনো না কোনো স্থাপনার নামকরণের মাধ্যমে যেমন গুণীদের প্রতি শ্রদ্ধা করা হয় তেমনি তাঁদের বার্তাটি ছড়িয়ে দেওয়া হয় সমাজের বিভিন্ন স্তরে। নামকরণ একটি উল্লেখযোগ্য মাধ্যম।

যবিপ্রবি‘র রেজিস্ট্রার প্রকৌশলঅ আহসান হাবীব এ বিষয়ে জানান, বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধু যশোরের না ভেবে সামগ্রিক ভাবা যেতে পারে। ইতোমধ্য্যে এখানে যশোরের অন্যতম গুণী ব্যক্তিত্ব মুন্সি মেহেরউল্লাহ এবং শহীদ মসিয়ূর রহমানের নামে দুটি হলের নাম করণ করা হয়েছে।