রাজনীতির দেবদূত

0

মারুফ কামাল খান
সৃজনশীল রচনার ক্ষেত্রে আমি আগে মনে মনে একটা মুসাবিদা করে নিই। তারপর লিখতে শুরু করি। আবার কখনো প্রথমেই ঠিক করি লেখার শিরোনাম। বাংলাদেশের মাটি-মানুষ সংলগ্ন একজন রাজনীতিবিদ তরিকুল ইসলাম। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এই লেখাটি শুরুর আগে ভাবনা এলো, শিরোনাম কী দেব? মাথায় ঘুরতে লাগলো একটি শব্দবন্ধ : ‘রাজনীতির দেবদূত’।
দেবদূত কেন? এর মানে তো অ্যাঞ্জেল – ফেরেশতা – বার্তাবাহক। তরিকুল ইসলাম তো কোনও ঐশীবাণী বয়ে আনেননি। তা’ ঠিক। তবে রাজনীতির ক্ষেত্রে যারা একটি মেসেজ নিয়ে আসেন, বাংলাদেশের সেই সব মুষ্টিমেয় রাজনীতিবিদের মধ্যে তরিকুল ইসলাম ছিলেন একজন। সে দিক থেকে তিনি এদেশের রাজনীতির একজন অ্যাঞ্জেল বা দেবদূত।
রাজনীতিতে তাঁর বার্তাটি কী ছিল? তিনি রাজনীতি করেছেন দেশের জন্য, মানুষের জন্য। কখনো নিজের জন্য নয়। রাজনীতিই ছিল তাঁর জীবনের ধ্যানজ্ঞান, মোক্ষ ও লক্ষ্য। আর যা’ কিছুই করেছেন তার প্রায় সবটাই ছিল রাজনীতিকেন্দ্রিক। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে এদেশের মাটি-মানুষ ঘনিষ্ঠ সর্বশেষ রাজনীতিকটি কি বিদায় নিয়ে গেছেন? কথাটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। তবে খুব নিরাপদে একথা বলাই চলে যে, অপসৃয়মান শেষ কাফেলার বাকি অল্প ক’জন মানুষের একজন ছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ব্রতচারী রাজনীতির একটি অধ্যায় প্রায় ফুরিয়ে এসেছে।
তরিকুল ইসলাম প্রথমে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং পরে জিয়াউর রহমানকে তাঁর রাজনীতির নেতা হিসেবে বরণ করেছিলেন। এটা কেবল আনুষ্ঠানিকতা কিংবা কথার কথা ছিল না। তাঁদের আদর্শ তো বটেই, জীবনাচরণেরও একনিষ্ঠ অনুসারী ছিলেন তিনি। নিজের জীবনযাত্রায় কখনো আড়ম্বর বা কৃত্রিমতার ছোঁয়া লাগতে দেননি। খুব সাদাসিধে থাকাটাই তরিকুল ইসলামকে দিয়েছিল এক অনন্য বিশিষ্টতা। তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিশ-একুশ শতকের বাংলাদেশে লোকায়ত রাজনীতির অন্যতম নক্ষত্র।
আমি তো বাল্যকাল থেকেই তাঁর নাম শুনে এসেছি। আমি যে রাজনৈতিক আদর্শে আবিষ্ট হয়েছিলাম, তিনি ছিলেন সে ধারার অন্যতম নেতা। তরিকুল ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম মুখোমুখি দেখা হয়েছিল কবে? কবে আমাদের মধ্যে আলাপ-পরিচয় হয়েছিল, তিনি আমায় চিনেছিলেন, তার কুষ্ঠি-ঠিকুজি কিছুই মনে নেই আমার। কিন্তু সে যখনই হোক, তিনি তাঁর সহজাত গুণে বয়স ও অবস্থানের দূরত্ব দূর করে আমাকে তাঁর নৈকট্য লাভের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ত্বরিত হয়ে উঠেছিলেন আমার পরম সুহৃদ, আপনজন।
জাতীয়তাবাদী দল – বিএনপির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে সেনাপতি এইচ. এম এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে অনেক রাজনীতিবিদের সঙ্গে তরিকুল ভাইও গ্রেফতার হন। সে সময় তাঁর ওপর অবর্ণনীয় যে দৈহিক নির্যাতন চলে সে করুণ কাহিনী সারা দেশে ছড়িয়েছিল মানুষের মুখে মুখে। কারামুক্তির পর তিনি হয়ে ওঠেন এরশাদের স্বৈরশাসন-বিরোধী আন্দোলনের এক অগ্নিমশাল। সে আন্দোলনের আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আস্থা ও ভরসার স্থলও ছিলেন তিনি। মাঝে মাঝেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হতো তাঁকে। আন্দোলনকে শাণিত করার স্বার্থে তখন তাঁকে ঢাকায় এসে থাকতে হতো। সে সুবাদে সাংবাদিকদের সঙ্গে একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। তরুণ একজন সংবাদকর্মী হিসেবে সম্ভবত একই সময়ে তাঁর সঙ্গে আমারও ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।
’নব্বইয়ের ছাত্রগণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতন-পরবর্তী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। তরিকুল ভাই তখন মন্ত্রী হন। প্রবল কর্মব্যস্ততার মধ্যেও তিনি আমাকে ভোলেননি। তাঁর কাছে আমার গুরুত্ব কমে যায়নি। বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আ.লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের মিলিত সহিংস আন্দোলন নৈরাজ্যের দিকে মোড় নিলে তরিকুল ভাই আমাকে আরো বেশি বেশি ডাকতেন। তিনি বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে বৈরী শিবিরের লাগাতার প্রোপাগান্ডা এবং এর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না থাকায় হতাশা বোধ করতেন। স্থায়ী মিডিয়ার অভাবে পাল্টা প্রচারণার জন্য তিনি মাঝে মাঝে কিছু অনিয়মিত বুলেটিন বের করার জন্য আমাদের কয়েকজনকে দায়িত্ব দেন। এর সমুদয় ব্যয় তিনি নিজের পকেট থেকে করতেন।
তরিকুল ভাই তাঁর জনঘনিষ্ঠতা, সাহস ও সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে প্রতিপক্ষের আতঙ্কের কারণ ছিলেন। সরকার পরিবর্তন হলেই তিনি মিথ্যা মামলা ও হেনস্তার শিকার হয়েছেন। গ্রেফতার হওয়াটা তাঁর জন্য ডালভাত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জেলবার্ড তরিকুল ইসলামের জন্য কারাগার ছিল বিকল্প বাসস্থান।
হাসিনার প্রথম দফা ক্ষমতার কালে যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে জঙ্গীদের পাতা বোমার বিস্ফোরণে অনেকে হতাহত হন। তরিকুল ভাই তখন শহরের বাসায়ই ছিলেন। খবর পেয়ে দ্রুত তিনি ঘটনাস্থলে যান। আহতদের হাসপাতালে নেয়া, চিকিৎসা ও রক্তদানে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। অথচ মানবদরদী এই মানুষটিকে প্রতিহিংসাপরায়ণ হাসিনা হামলার জন্য দায়ী করে মিথ্যা মামলায় কারাগারে নিক্ষেপ করেন।
২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ের পর বিএনপি ফের সরকার গঠন করলে তরিকুল ভাই আবারও মন্ত্রী হন। সে সময় আমি প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা-বিবৃতি লেখার দায়িত্ব নিয়ে প্রেস উইংয়ে চুক্তিভিত্তিতে নিয়োজিত হই। তরিকুল ভাই প্রধানমন্ত্রীর অফিসে এলে সিগারেট খাবার ছুতায় আমার কক্ষে এসে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে যেতেন। তাঁর সরকারি বাসা ও সচিবালয়ের অফিসেও মাঝে মাঝে ডেকে নিতেন আমাকে। প্রধানমন্ত্রী অফিসের স্টাফ প্যাটার্ন, সেটআপ ও পারফরম্যান্স এবং সরকার ও দলীয় রাজনীতির আরো কিছু বিষয় নিয়ে তিনি অসন্তুষ্ট ছিলেন। সত্য কথা অকপটে বলতে পিছপা হতেন না তরিকুল ভাই। আমি শুনেছি, তিনি অপারেশন ক্লিনহার্টের এবং বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরাবার উদ্যোগের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই নিঃসঙ্গ আওয়াজে কেউ কান দেয়নি। তিনি একটা বিপর্যয় অপরিহার্য বলে আশঙ্কা করতেন। তাঁর প্রতিটি কথা ও আশঙ্কা পরে অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল।
ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দীনের তথাকথিত এক-এগারো অ্যাডভেঞ্চারের পরেও তরিকুল ভাই যথারীতি গ্রেফতার হন। কারাবন্দীরা তখন নামাজ-বন্দেগি ও কোরান তেলাওয়াতে বেশি মগ্ন থাকতেন। অনেকে কান্নাকাটিও করতেন। তাঁর সহবন্দীদের কাছ থেকে পরে শুনেছি, তরিকুল ভাইয়ের তখন বেশিরভাগ সময় কাটতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সংবাদপত্র পাঠ করে। কান্নাকাটিতে বিরক্ত হতেন তিনি। বলতেন : ‘অহেতুক কাঁদাকাটি করবেন না সাহেব। দু’বছরের আগে কেউ ছাড়া পাবেন না। আর দু’বছর পর জোর করে থাকতে চাইলেও আপনাদের কাউকে জেলখানায় থাকতে দেবে না। এখন তো খুব কোরান পড়ছেন দিনমান। মুক্তির আদেশ পেলে কোরান ফেলেই চলে যাবেন সবাই।’ তরিকুল ভাইয়ের এই ভবিষ্যদ্বাণীরও অন্যথা হয়নি।
২০১২ সালের শেষের দিকে বিরোধীদলের নেত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার ভারত সফরের ব্যবস্থা হলো। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আমন্ত্রণে সপ্তাহব্যাপী এই সফর চূড়ান্ত হলে অতি করিৎকর্মা সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শমসের মবিন চৌধুরী ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বেগম জিয়ার আলোচনার একটা টকিং পয়েন্টস তৈরি করে আনেন। তিনি সেটি ম্যাডামকে পড়ে শোনালেন। আমারও মুখে কিছু আটকায় না। আচানক বলে ফেললাম : ‘এটা কিছুই হয়নি’।
বেদনার্ত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে শমসের ভাই জিজ্ঞেস করলেন : ‘কেন কিছুই হয়নি’? আমি বললাম : ‘বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান যোগসূত্র হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। অথচ আপনার লেখা টকিং পয়েন্টস-এ মুক্তিযুদ্ধ কথাটাই নেই।’ শমসের ভাই বললেন : ‘আচ্ছা ওটা অন্তর্ভুক্ত করে দিলে হবে তো?’ আমি বললাম : ‘জ্বী-না, তাতেও হবেনা। আপনার পয়েন্টসগুলো খুবই গতানুগতিক। ইন্ডিয়ার ঝানু রাজনীতিবিদ, চৌকশ আমলা ও দক্ষ কূটনীতিকরা জানেন ম্যাডাম এই কথাগুলো বলতে পারেন। তারা এই কথাগুলো মোকাবিলার উপযোগী তীর তূণে সাজিয়ে নিয়ে বসে থাকবেন। কাজেই এসব নয়। ম্যাডামকে বলতে হবে এমন কথা, যা তাদের ধারণার বাইরে। এতে ওরা চমকে যাবে, এলোমেলো হয়ে যাবে। পালটা ছক সাজাতে তাদের সময় লাগবে।’ আমার কথা শুনে ম্যাডাম বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি একটা ড্রাফট তৈরি করে আনুন।
দু’-তিন দিনের কসরতে আমার যোগ্যতা অনুযায়ী জীবনের সেরা একটা টকিং পয়েন্টস তৈরির চেষ্টা করলাম। এর কপি ম্যাডামের হাতে দিলাম। তিনি আমাকে পড়ে শোনাতে বললেন। আমি পড়ার পর তিনি বললেন : ‘ওটা আপনার কাছেই থাকুক। আর কাউকে দেখাবার দরকার নেই। দিল্লি যাবার পর বৈঠকের ঠিক আগ মুহূর্তে আমাকে দেবেন’। বেরিয়ে আসার সময় ম্যাডাম পেছন থেকে বললেন, তরিকুল সাহেব আমাদের সঙ্গে যাবেন। উনাকে জানান, রেডি হতে বলেন।
আমরা নয়াদিল্লি পৌঁছার পরপরই ভারতের ক্যাবিনেট রিশাফল হয়ে নয়া মন্ত্রিসভা শপথ নিলো। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের আগের সন্ধ্যায় আমাদের একটা নিমন্ত্রণ ছিল। শমসের ভাই বললেন, তিনি যেতে পারবেন না। তার কাজ আছে। পরদিনের বৈঠকের ব্যাপার চূড়ান্ত করতে তাকে যেতে হবে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিব শংকর মেননের সঙ্গে কথা বলতে। শমসের ভাই মি. মেননকে সগৌরবে তার বন্ধু বলে পরিচয় দিতেন। তিনি চলে গেলেন তার বন্ধু সন্দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ আলাপ সারতে।
পরদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার আনুষ্ঠানিক বৈঠক। বৈঠকের পর বেগম জিয়ার সম্মানে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর মধ্যাহ্নভোজ। আমরা যথাসময়ে তখনকার ঠিকানা ৭ নম্বর রেসকোর্স রোডের বাসভবনে পৌঁছলাম। ম্যাডামের সঙ্গে তরিকুল ভাই, রিয়াজ রহমান, ম্যাডামের লেডি এসিস্ট্যান্ট হিসেবে মৌলভীবাজারের সাবেক সংসদ সদস্য খালেদা রব্বানী, শমসের ভাই, সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূত সাবিহ্উদ্দিন আহমেদ ও আমি। পৌঁছার পর সমশের ভাই আমার কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বললেন : ‘একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। মিটিং রুমে অ্যাকোমোডেশনের সমস্যা তাই দু’পক্ষেই ওয়ান প্লাস ফাইভ টিম বসার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওদের ফরেন মিনিস্টারের সঙ্গে ম্যাডামের আলাদা মিটিং আছে বলে তাঁকেও এই বৈঠকে রাখা হচ্ছে না। আপনি আর সকল ইভেন্টেই থাকবেন, কেবল এই বৈঠকটাতে বসতে পারবেন না। কাল সন্ধ্যায় আমি মেননের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম শুধু আরেকজন বাড়াবার অনুরোধ নিয়ে কিন্তু স্যরি, সম্ভব হোলো না।’
আমি বললাম : ‘কোনো সমস্যা নেই, আমি বাইরে থাকবো বৈঠক সফল হোক’। সবাই ভেতরে গিয়ে আসন নিলেন। আমি ম্যাডামের হাতে টকিং পয়েন্টস-এর কপিটা তুলে দিয়ে মিটিং রুমের বাইরের মস্ত ওয়েটিং রুমে বসে রইলাম। ততক্ষণে ভারতের বিদেশমন্ত্রী সালমান খুরশিদ এসে পড়েছেন। এলেন বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি। তাকে দেখেই শশব্যস্ত হয়ে এগিয়ে গিয়ে খুরশিদ সাহেব হাত ধরে এনে তাজিমের সাথে বসালেন। এলেন বরকত গনি খান চৌধুরীর ছোটভাই, নতুন প্রতিমন্ত্রী আবু হাসেম খান চৌধুরী, প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সির স্ত্রী, নয়া প্রতিমন্ত্রী দীপা দাসমুন্সি ও আরো অনেকে। আমার সদ্য পরিচিত খুরশিদ সাহেব তাদের সকলের সঙ্গে আমাকে আলাপ-পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমাদের গল্পগুজব জমে উঠলো। ওদিকে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের জন্য নির্ধারিত বৈঠক টানা দু’ঘন্টা ছাড়িয়ে শেষ হলো।
বৈঠক শেষে সবার আগে শমসের ভাই বেরিয়ে এসে জানতে চাইলেন টকিং পয়েন্টস-এর ছোট টাইপের কোনো কপি আমার কাছে আছে কিনা। ম্যাডামের কপি তো বেশ বড় হরফে প্রিন্ট করা। এখন ওদের প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি, ফরেন সেক্রেটারি সবাই এক কপি করে চাইছে।
ছোট হরফে প্রিন্ট করা একটি কপি আমার কাছে ছিল। সেটি শমসের ভাইকে দিলাম। ফটোকপি করার জন্য স্টাফদের অফিসের দিকে লাঠি ভর করে পা টেনে টেনে ছুটলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা।
এরপর ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দেয়া লাঞ্চ সেরে আমরা ৭ রেসকোর্স রোডের মিশন শেষ করলাম। প্রধানমন্ত্রী সিংজী পরম সৌজন্যবোধের পরিচয় দিয়ে গাড়িবারান্দা পর্যন্ত হেঁটে এসে ম্যাডামকে বিদায় জানালেন। হোটেলে ফিরে ম্যাডামের স্যুটের বসার কামরায় সংক্ষিপ্ত একটি পর্যালোচনা বৈঠক। বসেই তরিকুল ভাই বললেন : ‘আজকের হিরো তো মারুফ কামাল। ওর টকিং পয়েন্টস-এ তো আপনি কিস্তি মাত করে ফেলেছেন ম্যাডাম। কী রিয়াজ সাহেব, কথা বলেন না কেন’? প্রবীণ কূটনীতিক রিয়াজ রহমান বললেন : ‘সারা জীবন ফরেন সার্ভিসে কাজ করায় আমাদের মধ্যে যে মাইন্ড সেট তৈরি হয়েছে, তাতে আমরা একটা নির্দিষ্ট ফরম্যাটের বাইরে যেতে পারিনা। মারুফ যা করেছে সেটা আমাদের কারো পক্ষে সম্ভব ছিল না। ইট ওয়াজ রিয়্যালি এক্সিলেন্ট।’ শমসের ভাই বললেন : ‘কিন্তু মারুফকে আমরা আনফরচুনেটলি মিটিংয়ে নিতে পারলাম না’। তরিকুল ভাই বলে উঠলেন : ‘আপনারা ডিপ্লোম্যাট ছিলেন। অনেক স্মার্ট ভাবেন নিজেদেরকে। আমরা যারা রাজনীতি করি তারা মূর্খ হতে পারি, বোকা নই। আমাদের সঙ্গে গাঁড় চালাকি করবেন না’। শমসের ভাই মুখটা কালো করে ‘ম্যাডাম আসি’ বলে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলেন। আমরাও যে-যার রুমে চলে গেলাম বিশ্রাম নিতে।
ইন্ডিয়া সফরে তরিকুল ভাইয়ের সঙ্গে অনেক স্মৃতির মধ্যে একটি ঘটনা কখনো ভুলবো না। কী যে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম! তাজ প্যালেস হোটেলে বিভিন্ন রকমের কুজিনের বিরাট চারটি রেস্তোরাঁ আমাদের জন্য ফ্রি ছিল। আমরা ঘুরে ঘুরে খেতাম। কিন্তু তরিকুল ভাই রেস্তোরাঁয় যাবেন না। অজস্র রকমারি খাবার এড়িয়ে তিনি তাঁর স্যুটে বসে বেশিরভাগ সময় ফরমায়েশ দিতেন মোরগ পোলাওয়ের। আর সিগারেট খেয়ে ধোঁয়ায় রুম অন্ধকার করে রাখতেন। এক রাতে তরিকুল ভাইয়ের সঙ্গে বসে ঢাকার দু’জন রিপোর্টার গল্প করছিল। আমি ডিনার করে সবে রুমে এসেছি। এ সময় এক রিপোর্টারের ফোন। তরিকুল ভাই অজ্ঞান হয়ে গেছেন। আমি দ্রুত ছুটে গেলাম তাঁর স্যুটে। ঘটনা সত্য। ইন্ডিয়ান ফরেন অফিসের একজন প্রটোকল অফিসার রাউন্ড দ্য ক্লক হোটেলে থাকতো আমাদের প্রটোকল ডিউটিতে। তাকে খবর দিলাম। ভদ্রলোক এসে হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললেন। চারদিকে ফোন করে তিনি তার ঊর্ধ্বতনদের জানাতে লাগলেন এবং তাদের কাছ থেকে নির্দেশনা নিতে শুরু করলেন। হোটেলের সব কর্মকর্তাদের এনে জড়ো করলেন। মেশিন আনিয়ে জানালা খুলে ধোঁয়া বের করার ব্যবস্থা করলেন। অ্যাম্বুল্যান্স এনে হাজির করলেন। হাসপাতালে ফোন টোন করে ভর্তির সব ব্যবস্থা করলেন।
আমাদের দুই রিপোর্টার তরিকুল ভাইয়ের অবিরত শুশ্রুষা করে যাচ্ছিল। তাদের একজন আকুপ্রেসারবিদ। দেহের নানাস্থানে চাপ দিয়ে সে জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা করছিল। তাঁকে হাসপাতালে নেয়ার সমস্ত আয়োজন যখন সম্পন্ন তখন হুট করেই তরিকুল ভাই চোখ মেলে হাত-পা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলেন। বললেন : ‘কী হয়েছে? এতো লোক কেন?’ তাঁকে সব খুলে বলা হলো। তিনি বললেন, ‘হাসপাতালে কেন যাব? মাঝে মাঝে আমার এ রকম হয়। এখন ঠিক হয়ে গেছে। যাও সবাই যারা যার রুমে গিয়ে ঘুমাও।’ আমি নাছোড়বান্দা হয়ে দুই রিপোর্টারকেই উনার মেঝেতে বিছানা করে শোয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে চলে এলাম। বলে এলাম, কোনো সমস্যা হলেই আমাকে ডাকবে।
অনেক রাত অব্দি এইসব তৎপরতা ও আতঙ্কে সহজে ঘুমাতে পারিনি। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকাল আটটার দিকে ডোরবেলের শব্দে ঘুম ভাঙলো। উঠে দরোজা খুলেই দেখি ক্লিন শেভ করে, গোসল সেরে, সুবেশধারী তরিকুল ভাই দাঁড়ানো। ‘কি এখনো ঘুম ভাংগে নাই? নাশতা করবে কখোন?’ বললাম : ‘ভাই আপনি সেরে নিন। আমার তো ফ্রেশ হতে একটু সময় লাগবে।’ তরিকুল ভাই বললেন : ‘আচ্ছা, আমি গেলাম তবে। আর শোনো, কাল রাতের ব্যাপারে ম্যাডামকে কিছু বলার দরকার নাই’। আমরা না জানালেও ম্যাডাম কিন্তু ঘটনা জেনে ফেলেন। তিনি আমাদের সবাইকে ডেকে বলেন, আপনারা সবাই মিলে তরিকুল সাহেবের সিগারেট খাওয়াটা বন্ধ করাতে পারেন না। এভাবে করলে তো উনি বাঁচবেন না।
একটা সার্জারির জন্য একবার আমাকে সিঙ্গাপুর যেতে হয়েছিল। আমি দেশেই করাতে চাইছিলাম। ম্যাডাম নিজে থেকে জোর করে কিছু টাকা আমাকে দিয়ে বললেন : ‘না, সিঙ্গাপুরেই যান’। সিঙ্গাপুরে যে সার্ভিস এপার্টমেন্টে উঠেছিলাম তার মালিক বাংলাদেশি। তার গণযোগাযোগ খুব ভালো। আমাদের দেশের অনেকেই সেখানে গিয়ে ওঠেন। উনি আমাকে বললেন যে, তরিকুল ভাই ফোন করে আমার খোঁজ-খবর নিয়েছেন। দু’দিন পরেই ভদ্রলোক আমার হাতে দু’হাজার ডলার তুলে দিয়ে জানালেন, তরিকুল ভাই এটা পাঠিয়েছেন। বলেছেন, আমার যেন কোনো অর্থকষ্ট না হয়। যদি সমস্যা হয় আমার বিল আপনি দিয়েন না। ওটা তরিকুল ভাই নিজেই দিয়ে দেবেন।
আমার এতো টাকা লাগেই নি। সব সেরে দেশে ফেরার পরও প্রায় তিন হাজার ডলার বেচে গিয়েছিল। আমি একদিন তরিকুল ভাইকে বললাম, ‘আপনি কেন টাকা পাঠাতে গেলেন’? উনি রেগে বললেন : ‘তাতে তোমার কি? অ্যাহ্! তার জন্য কি তোমার কাছে আমার কৈফিয়ত দিতে হবে? তোমার অবস্থা আমি কিছু জানিনা মনে করো’?
রাজনীতিবিদের আড়ালে ব্যক্তিমানুষটি কিন্তু হারিয়ে যায়। আমরা রাজনীতির ইতিহাস লিখি। ব্যক্তিমানুষটির ভেতরকার মানবিকতা ও ভালোবাসার দ্যুতিগুলো সে ইতিহাসে ঠাঁই পায় না। আমি এ লেখায় তরিকুল ভাইয়ের অসামান্য রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে তেমন কিছু লিখলাম না। কেবল তাঁকে নিয়ে আমার জীবনের স্মৃতি থেকে অল্প কিছু কথাই লিখলাম। স্মৃতির সাগরের এ কয়েকবিন্দু জল মাত্র। ভালোবাসা ও অশ্রুতে মাখা এসব স্মৃতি কি কখনো ভোলা যায়?