নিশীথে কি আর জ্বলিবে প্রদীপ ভাতি

0

সালাহউদ্দিন বাবর ।। শৈশবে ফেলে আসা দিনগুলোর অনেক কথা মাঝে মধ্যেই মনে পড়ে। সেসব দিনে গুরুজনরা আমাদের ভেতর মূল্যবোধ তৈরির জন্য অনেক নীতি কথা বলতেন। বলতেন, এসব কথা কখনো ভুলো না। চর্চায় রেখো। কথাগুলো স্মরণ করবে জীবনাচরণের সাথে। যেমন, কবি কৃষ্ণ চন্দ্র মজমুদারের একটি কবিতার কয়েকটি চরণ আমাদের কাছে বারবার আবৃত্তি করে শোনাতেন। ‘যে জন দিবসে মনের হরষে/জ্বালায় মোমের বাতি/আশু গৃহে তার দেখিবে না আর/নিশীথে প্রদীপ ভাতি’; এই চরণ কয়টির অন্তর্নিহিত বাণী এতটাই সহজ-সরল যে, ব্যাখ্যা করে বোঝানোর দরকার পড়ে না। এতে কৃচ্ছ্র নয় বরং অপব্যয়ের পরিণতি সম্পর্কে মানুষকে সজাগ করা হয়েছে। তবে এ কথা ঠিক সব কথা আবার সবার ধাঁতে সয় না। যেমন এ ক্ষেত্রে চমৎকার একটা বাকধারা রয়েছে। তবে সেটা উচ্চারণ করা থেকে বিরত থাকতে হলো পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে এই মুহূর্তে আসলে অপব্যয়ের মতো বিলাসিতা করার কোনো সুযোগই নেই। তা ছাড়া এ দেশের সব সাধারণ মানুষের কৃষ্ণ চন্দ্র মজুমদারের সেই অমূল্য চরণগুলো সর্বদা স্মরণে থাকে। তবে এ দেশের মানুষ স্বভাবগতভাবেই মিতব্যয়ী। কখনো বেহিসাবিও ছিল না বা অপচয়কারী হিসাবে কেউ তাদের অপবাদ দিতে পারবেন না। জর্জ অলওয়েলের বিখ্যাত সৃষ্টি ‘এনিমেল ফার্ম’-এ একটা কথা আছে, “ All animals are equal,but some are more equal than others .” আমরা বলতে পারি, সব মানুষই সমান, তবে কেউ কেউ অন্যদের চেয়েও বেশি সমান। অরওয়েল ‘মোর ইকোয়েল’ কথাটা পরিহাস ছলে বললেও এর অন্তর্নিহিত অর্থ গভীরতর। আমাদের দেশে সব নাগরিক সমান বটে। তবে ‘অনেকেই আবার বেশি সমান’। তাদের জন্য সাত খুন মাফ হয়ে যায়।
এই সব মানুষের খরচ করার কোনো পরিসীমা নেই। তবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর পক্ষে এখন অপচয় অপব্যয় করার কোনো সুযোগ না থাকলেও, আমাদের সম্মানিত সংসদ সদস্যরা, বিশেষ করে ট্রেজারি বেঞ্চের মেম্বাররা এ ক্ষেত্রে ‘দরাজ দিল’। কথাগুলো আমরা হাওয়া থেকে তুলে আনিনি। একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর থেকেই এসব বিষয় নিয়ে সরাসরি কথা বলতে সাহস না থাকায়, ইনিয়ে বিনিয়ে বলছি। সেই জাতীয় দৈনিকের খবরটির শিরোনাম হচ্ছে, ‘প্রশংসার খরচ হচ্ছে শত কোটি টাকা।’ সে খবরের ভেতরে এভাবে বলা হয়েছে, ‘একাদশ জাতীয় সংসদে সরকার ও সরকারপ্রধানের প্রশংসায় ৬১ ঘণ্টা ২৬ মিনিট ব্যয় হয়েছে। এর আর্থিক মূল্য প্রায় ১০০ কোটি ৩৯ লাখ ৩৩ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা। আর সংসদ সদস্যরা নির্ধারিত সময়ে না আসায় সংসদের ২২টি অধিবেশনে কোরাম সঙ্কটের কারণে সংসদ কার্যক্রম শুরু হতে দেরি হয়। তাতে সংসদের ব্যয় হয়েছে ৫৪ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট। এর অর্থমূল্য প্রায় ৮৯ কোটি ২৮ লাখ ৮ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা। এটাকে অপচয় বলা যায় নাকি সবাইকে ভেবে দেখার জন্য আবেদন করছি।
দৈনিকটি কোথা থেকে এসব তথ্য পেয়েছে, সে সম্পর্কে বলা হয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) পার্লামেন্ট ওয়াচ : একাদশ জাতীয় সংসদ- প্রথম অধিবেশন থেকে ২২তম অধিবেশন (জানুয়ারি-২০১৯-এপ্রিল ২০২৩) শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনের এসব তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এই অপচয় বা অন্য যা কিছু বলি সেটা পাওয়া গেছে। এসব বিষয় নিয়ে কি কোনো কথা সংসদে হয়েছে? না, কেউ সংসদে এমন আলোচনা করেছে বলে সম্ভবত শোনেননি। তা ছাড়া সংসদে এসব নিয়ে তর্ক করেন সাধারণত বিরোধী দলের সদস্যরা। যারা এখন নিজেদের সংসদের সরকারের প্রতিপক্ষ বলে মিন মিন করে দাবি করেন। আসলে তারা কিন্তু সেটা বিশ্বাস করেন না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই দরিদ্র রাষ্ট্রে কঙ্কালসার মানুষের দেয়া করের টাকার শ্রাদ্ধ করার অধিকার এই প্রশ্নবিদ্ধ সংসদের সদস্যদের কে দিয়েছে।
আর যাদের অলওয়েল বলেছেন ‘সাম আর মোর ইকোয়েল’ এই সব সদস্যরাই আসলে সেই মোর ইকোয়েল। পাশাপাশি আর একটি খবরের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
সচিত্র সে খবরটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে অন্য একটি জাতীয় দৈনিকে যার শিরোনাম, ‘কিস্তি দিতে না পারায় দুধের শিশুসহ নারী থানা হাজতে’। রিপোর্টে বলা হয়েছে, কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলা সদরের উত্তরপাড়া গ্রামের আবদুল মোতালেবের স্ত্রী সুমি আক্তার তার ভাই দেলওয়ার হোসেনের নেয়া এনজিও ঋণের টাকার জিম্মাদার হয়েছিলেন। ভাই ঋণের টাকা শোধ না করতে পারায় জিম্মাদার বোন সুমি আক্তারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয় এনজিও। তারই ধারাবাহিকতায় সুমির বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট মুরাদনগর থানায় আসে। সুমিকে তার কোলের শিশুসহ পুলিশ আটক করে থানা হাজতে আটকে রাখে। এই সুমিরাই হচ্ছে ‘ইকোয়েল’, তাই ছুতা নাতায় তাদের জেলে যেতে হয়। সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশের প্রশাসন! সমাজে এখন কিভাবে প্রশ্রয় পায় এমন ‘মোর ইকোয়েলরা’ আর কেমন শাস্তি পেয়ে থাকে ‘ইকোয়েলরা’!
সম্প্রতি ঢাকার জাতীয় দৈনিকে খবর হয়েছে, ‘ধীরগতির শীর্ষে তিন শহর বাংলাদেশের’। এই খবরের সার নির্যাস হচ্ছে, ঢাকা শহরে সড়কে চলাচলকারী প্রায় সব মানুষেরই যানজট নিয়ে নিয়মিত ভোগান্তির অভিজ্ঞতা একই রকম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে কর্মঘণ্টা ও জ্বালানির অপচয় হচ্ছে বায়ু দূর্ষণও বাড়ছে আর্থিক ক্ষতির প্রভাব পড়ছে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি)। যানজটের কারণে ঢাকা বিশ্বের শীর্ষ ধীরগতির শহরে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের এক গবেষণায় ঢাকার বিষয়ে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশের অপর দু’টি ধীরগতির শহর হচ্ছে, ময়মনসিংহ নবম স্থানে রয়েছে আর চট্টগ্রাম মহানগরী ১২তম স্থানে রয়েছে। ১৫২টি দেশের এক হাজার ২০০ শহরের ওপর গবেষণা চালানোর মাধ্যমে এই তথ্য পাওয়া গেছে।
বিশ্ব ব্যাংকের অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে অসহনীয় যানজটে প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ৭৩টি মোড়ে আটকে যাচ্ছে যান। এতে প্রতিদিন আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৯৮ হাজার কোটি টাকা। আর জ্বালানি পুড়ছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার। একে অপচয় ছাড়া আর কী বলা যাবে? ঢাকায় কিছু ফ্লাইওভার ও একটি এ্যালিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে তৈরি হয়েছে বটে। কিন্তু তাতে যানজট কমেনি বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ ঢাকা শহরের সড়ক নেটওয়ার্ক এতটুকু বৃদ্ধি পায়নি। কোনো বাইপাস সড়ক তৈরি করা হয়নি। বিকল্প পথ হিসাবে পরিবহন বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত বিশেষজ্ঞদের মত হচ্ছে, ফ্লাইওভারের আগে বাইপাস সড়ক নির্মাণ করা ছিল বেশি জরুরি। প্রাপ্ত অপর এক তথ্য সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ বছরে ঢাকা শহরে সড়কের গতি ঘণ্টায় গড়ে মাত্র ১৬ কিলোমিটার। এভাবেই জাতিকে এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে হচ্ছে। এসবের কোনো বিহিত হয় না। স্মার্ট বাংলাদেশে ভবিষ্যতে চলতে হবে গরুর গাড়ির গতিতে।
যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়ালের (জিএফআই) এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, শুধু ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ৫০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। জিএফআই সূত্র আরো জানায়, গত ১০ বছরের বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে পাঁচ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। সূত্র আরো জানায়, প্রতি বছর এখান থেকে গড়ে পাচার হয়েছে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা। টাকা পাচারে বিশ্বে শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে আমাদের এই বাংলাদেশের নাম। অর্থনীতিবিদদের অভিমত হচ্ছে চরম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে পরিণত হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে এখন অর্থ পাচার করা খুব সহজ। বাংলাদেশ এখন আবারো তলাবিহীন ঝুড়ির দেশে পরিণত হয়েছে।
দেশে এখন ‘হরি লুটের’ রাজত্ব সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও তার প্রতিকারের কোনো সরকারি পদক্ষেপ লক্ষ করা যায় না। অথচ এখন দেশ চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে লাঠি ভর দিয়ে। অর্থনীতি চালানো হচ্ছে জোড়াতালি দিয়ে। আর দ্বারে দ্বারে ঘোরা হচ্ছে ঋণের জন্য। হাত পেতে চলছে ছোটাছুটি। অথচ ঋণ এলে সে অর্থ পাচার হয় কি না- তা বলবে কোন সে কর্তৃপক্ষ। সব চলছে ‘বেগায়ের হিসাব’। এর ফলে নিত্যদিন ঋণের বোঝা বাড়ছে আর দিন দিন জাতীয় অর্থনীতি কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে।
এই মুহূর্তে যে শিশুটি জন্ম নিচ্ছে, তার মাথার ওপর পড়বে এক লাখ পাঁচ হাজার ২৫২ টাকার ঋণের বোঝা। প্রতি বছরই এই বোঝা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। কবির ভাষায় বলতে হয়, অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আমাদের গৃহে ‘জ্বলিবে না আর নিশীথে প্রদীপ ভাতি।’