রাজারবাগ পীরের সম্পত্তি নিয়ে প্রতিবেদনে যা জানালো দুদক

0

বিশেষ সংবাদদাতা॥ রাজারবাগ পীর সিন্ডিকেটের দায়ের করা মামলা থেকে রেহাই পেতে উচ্চ আদালত হাইকোর্টে রিট করেছিলেন ভুক্তভোগীরা। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে রাজারবাগ দরবারের পীর সায়্যিদ মুহম্মদ দিল্লুর রহমান ও তার দরবারের সব সম্পত্তির হিসাব চেয়েছিলেন হাইকোর্ট। সেই আদেশের আলোকে তদন্তে নেমে রাজারবাগ পীর দিল্লুর রহমান এবং তার দরবারের (মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ) নামে বিপুল সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত কমিটি। হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্ত শেষে আদালতে আংশিক প্রতিবেদনও দাখিল করা হয়েছে। দুদকের দাখিল করা ওই প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে পীর দিল্লুর রহমান ও তার নানা প্রতিষ্ঠানের নামে রয়েছে ৩২ হাজার ২০৫.৯১ শতাংশ জমি। যার মধ্যে পার্বত্য বান্দরবানের লামায় লিজমূলে ১২টি রাবার বাগানের নামে রয়েছে ৩০ হাজার শতাংশ জমি। এর মধ্যে মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফের নামে দেখানো হয়েছে এক হাজার ৮১৯.৯১ শতাংশ। যার বেশিরভাগই দান হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আর নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে পৈত্রিক ও ক্রয় সূত্রে দেখানো হয়েছে ৩৮৬ শতাংশ জমির মালিকানা। এর বাইরে মতিঝিলে যৌথ সম্পত্তি দেখানো হয়েছে ৬৬.২৮ শতাংশ। যাতে ছয়তলা করে তিনটি বিশাল ভবন রয়েছে। যেখানে রয়েছে রাজারবাগ পীরের মূল আস্তানাও। এছাড়া তাদের দুটি পত্রিকার নামে রয়েছে কার্যালয়। এর মধ্যে হাসপাতালও আছে। মিলেছে পুরাতন ৫৬টি গাড়ি তথ্যও, যা দিয়ে তাদের উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য–দ্রব্য বিক্রি করা হয়। পীর দিল্লুর রহমানের আয়কর নথি এবং ব্যাংক–বিমাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে থাকা তথ্য থেকে সম্পদের এই বিবরণী প্রস্তুত করা হয়েছে বলেও দুদকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অনুসন্ধানকালে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফের (রাজারবাগ দরবার শরীফ) ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আয়কর বিভাগে দাখিল করা অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যায় যে– কক্সবাজার, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, গাজীপুর, চাঁপাইনবাগঞ্জ, জামালপুর, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, নওগাঁ, নিলফামারী, নেত্রকোনা, নরসিংদী, পাবনা, পঞ্চগড়, পিরোজপুর, বগুড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বরগুনা, ভোলা, মানিকগঞ্জ, মৌলভীবাজার, রংপুর, লক্ষীপুর, লালমনিরহাট, শেরপুর, সিরাজগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং খাগড়াছড়ির বিভিন্ন থানার বিভিন্ন মৌজায় ৯০টি দানপত্র দলিল মূলে মোট ১১৭৯.১৬ শতাংশ এবং ছয়টি দলিল মূলে ৬৩৯.৯৫ শতাংশ জমি ক্রয় সূত্রে মালিকানা অর্জিত হয়। যা ২০২১-২০২২ করবর্ষের দরবারের আয়কর রিটার্নে অডিট রিপোর্টসহ প্রদর্শিত বলে দেখা যায়। আদালতে জমা দেওয়া ওই প্রতিবেদেনে দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আলতাফ হোসেন, মো. সাইফুল ইসলাম ও মো. জাহাঙ্গীর আলম সই করেছেন। দুদকের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে দাখিল করা প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুসন্ধানকালে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি পাঠানোর পরিপ্রেক্ষিতে কিছু তথ্য ও রেকর্ডপত্র পাওয়া গেছে। তবে, পূর্ণাঙ্গ তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। অবশিষ্ট তথ্য ও রেকর্ডপত্র সংগ্রহের বিষয়টি চলমান। তাই আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আরও তিন মাস সময় চাওয়া হয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী মো. সাজ্জাদ হোসেন আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, দুদক কেবল আয়কর নথিসহ বিভিন্ন সংস্থার তথ্য দিয়েছে। নিজেদের তদন্ত আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব তথ্য পাওয়ার পর দুদক অবশ্যই নিজেদের মতো করে তদন্ত করবে। কারণ দুদক এই বিষয়ে সিরিয়াস।
এর আগে গত বছরের ৫ ডিসেম্বর রাজারবাগ দরবার শরীফের পীর দিল্লুর রহমানের বিষয়ে প্রতিবেদন দেয় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, পীর ও তার সঙ্গী-অনুসারীদের কার্যকলাপ এবং উদ্দেশ্য দেশের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। তাদের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত পত্রিকা, কয়েকটি বই এবং দরবারের অনুসারীদের বিরুদ্ধে করা মামলা পর্যালোচনা করে সিটিটিসি জানিয়েছে, রাজারবাগ দরবারের নেতারা ‘ধর্মভীরু’ লোকদের বিপথগামী করতে ইসলামের নামে পবিত্র কোরআন ও হাদিসের অপব্যাখ্যা করছে। তাদের প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে নানাভাবে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ, ধর্মীয় কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটছে। তাদের এসব কার্যক্রম সরাসরি সরকারি নীতিমালা, দেশের প্রচলিত আইন, সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরোধী। যদিও ওই প্রতিবেদনে উল্লিখিত অভিযোগের বিষয়ে আপত্তি তোলা হয় পীরের পক্ষ থেকে। রাজারবাগ পীরের বিষয়ে দুই দফা প্রতিবেদন জমা দিয়েছে সিআইডিও। গত ৪ জানুয়ারি দাখিল করা প্রতিবেদনে বলা হয়, সারাদেশে অসংখ্য খানকা, মাদরাসা, মসজিদসহ নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান খুলে সহজ সরল মানুষকে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে দরবারের অনুসারী করার চেষ্টা করা হয়। আর এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে তাদের মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করার যে অভিযোগ উঠেছে, তারও প্রাথমিক সত্যতা রয়েছে। ভিন্ন মতাবলম্বী ও ভিন্ন ধর্মের মানুষকে, তাদের ভাষায় মালাউনদের হত্যা করা ইমানি দায়িত্ব উল্লেখ করে ফতোয়া দেওয়ার প্রমাণও পাওয়া গেছে। যা মূলত নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবি ও আনসার আল ইসলামের ফতোয়ার অনুরূপ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর এক রিটের শুনানিতে অন্যের জায়গা-জমি দখলের জন্য রাজারবাগ দরবার শরিফের পীরের কাণ্ড নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। মুরিদদের দিয়ে নিরীহ এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৪৯টি মামলা দেওয়ার ঘটনায় সিআইডির তদন্ত রিপোর্ট দেখে আদালত এ বিস্ময় প্রকাশ করেন। পরে ১৬ সেপ্টেম্বর ভুয়া মামলার সিন্ডিকেট খুঁজতে রাজারবাগ পীর ও তার লালিত চক্রের (মুরিদদের) দেশব্যাপী দায়ের করা গায়েবি মামলার বিষয়ে অনুসন্ধানের নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদন করা হয়। পীরের মুরিদদের দায়ের করা মামলায় হয়রানির শিকার আট ব্যক্তির পক্ষে এ রিট দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রিট আবেদনে স্বরাষ্ট্রসচিব ও আইজিপিসহ ২০ জনকে বিবাদী করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯ সেপ্টেম্বর রাজারবাগ দরবারের পীর দিল্লুর রহমান ও তার দরবারের সব সম্পত্তির হিসাব চান হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল বেঞ্চ। একইসঙ্গে, এই দরবারের পীরের অনুসারীদের বিরুদ্ধে করা (রিটে উল্লিখিত আটটি) মামলা তদন্ত করারও নির্দেশ দেওয়া হয়। তদন্ত শেষে মামলার বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয় সিআইডিকে। সেই সঙ্গে আদালত রিট আবেদনকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও বলেন। এছাড়া সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব ৬০ দিনের মধ্যে তদন্ত করে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিলের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। আর তাদের সঙ্গে কোনো জঙ্গি সংগঠনের সম্পর্ক আছে কি না সেটিও খতিয়ে দেখার জন্য পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটকে (সিটিটিসি) নির্দেশ দেওয়া হয়। পীর ও তার মুরিদদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না তাও জানতে চান আদালত। হাইকোর্ট তার রুলে এই রিটের ভুক্তভোগীদের হয়রানি, অপদস্ত করতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ফৌজদারি মামলাকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তাও জানতে চেয়েছেন। স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (বিশেষ শাখা), অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপরাধ তদন্ত বিভাগ), ঢাকার জেলা প্রশাসক, ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) উপ-মহাপরিদর্শক, গোয়েন্দা শাখার যুগ্ম কমিশনার, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান, রাজারবাগ দরবারের পীর দিল্লুর রহমান ও হয়রানিমূলক মামলার বাদীসহ বিবাদীদের এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়।