সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির প্রস্তাব

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥বিদ্যুতের সঞ্চালন, বিতরণ ও দেশীয় উৎস থেকে গ্যাস আহরণের ওপর গত অর্থবছরের মতো এ বছরও জোর দেয়া হয়েছে। এজন্য আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ২৮ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন বাজেটে খাতটিতে গতবারের চেয়েও ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এদিকে বরাবরের মতো এবারো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, আগামী অর্থবছরে এ ভর্তুকির পরিমাণ প্রস্তাব করা হয়েছে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেটে বরাদ্দের যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তার মধ্যে ২৬ হাজার ১১৮ কোটি টাকা পাবে বিদ্যুৎ বিভাগ। আর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ পাবে ২ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ বিভাগের ৭৩টি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য এ অর্থ দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ২৫ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা দেবে অর্থ মন্ত্রণালয়। বাকি ৭৭০ কোটি টাকা আসবে বিদ্যুৎ বিভাগের নিজস্ব অর্থায়ন থেকে। এছাড়া জ্বালানি বিভাগের ২৮টি প্রকল্প বাস্তবায়নে ২ হাজার ২৭ কোটি টাকা দেবে অর্থ মন্ত্রণালয়। বাকি ৮৩৩ কোটি টাকা থাকবে জ্বালানি বিভাগের নিজস্ব অর্থায়নে। তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা জ্বালানি অনুসন্ধান ও উত্তোলনে আরো বেশি বরাদ্দ প্রস্তাবের পরামর্শ দিচ্ছেন।
সম্প্রতি বিদ্যুৎ খাতের বাজেট নিয়ে এক সেমিনারে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছিলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে যে বরাদ্দ থাকবে সেখানে সঞ্চালন, বিতরণ ও সম্প্রসারণকে গুরুত্ব দেয়া হতে পারে। এছাড়া বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শতভাগ বিদ্যুতায়নের অংশ হিসেবে দ্রুতগতিতে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগের নানা প্রকল্প। এ লক্ষ্যে দেশে নির্মাণাধীন বিদ্যুতের মেগা প্রকল্পের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিচ্ছে সরকার। এজন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থায় জোর দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে, দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও আমদানীকৃত জ্বালানি দিয়ে জ্বালানি সক্ষমতা অর্জনেরও লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে আসন্ন বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে সরকার।
গত অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুতের সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থায় আধুনিকায়ন, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বিদ্যুতের জেনারেশনে উন্নয়ন হলেও সঞ্চালন ব্যবস্থায় তেমন কোনো আধুনিকায়ন হয়নি। ফলে তার প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। সঞ্চালন লাইন নির্মাণ না হওয়ার কারণে পুরোদমে উৎপাদনে যেতে পারছে না ১৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতা সম্পন্ন পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। অন্যদিকে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চললেও এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন ব্যবস্থায় ধীরগতি দেখা গেছে।
বাজেটে বরাবরের মতো এবারো বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম সমন্বয় করতে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, শুরুতে বিদ্যুৎ, জ্বালানিতে ভর্তুকির জন্য ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয়েছিল, এখন সেটি বাড়িয়ে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে এ টাকা দিয়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম সমন্বয় করা হবে।
বিদ্যুতের মতো জ্বালানি খাতকেও এগিয়ে নিতে আসন্ন বাজেটে ২ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। যার মধ্যে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ) থেকে ১৫৩ কোটি টাকা ও নিজস্ব খাত থেকে খরচ করা হবে ৬৭৯ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। জ্বালানি উৎপাদন ও সরবরাহ প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা, বিপিসি এবং জিএসবি থেকে নেয়া মোট ২৮টি প্রকল্পের জন্য এ অর্থ দেয়া হচ্ছে। গত অর্থবছরে জ্বালানি বিভাগের বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ গতবারের চেয়ে এ অর্থবছরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিসুর রহমান বলেন, দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান, উত্তোলন ও আমদানির বিষয়টি পরিকল্পনায় রেখে আমরা বরাদ্দ চেয়েছিলাম। সে অনুযায়ী বাজেট বরাদ্দের প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে। এতে আগামী অর্থবছরে জ্বালানি খাতের উন্নয়ন বিষয়টি আরো গুরুত্ব পাবে।
তবে বরাবরের মতো বাজেটে বিদ্যুৎ খাতকে গুরুত্ব দিয়ে জ্বালানি খাতকে পিছিয়ে রাখা হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এ কারণেই দেশে বিদ্যুতের উন্নয়ন হলেও তুলনামূলকভাবে জ্বালানি খাত সে পরিমাণ এগিয়ে যায়নি। জ্বালানি অনুসন্ধান, উত্তোলনেও বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম এ বিষয়ে বলেন, বিদ্যুৎ খাতে প্রতি বছর বাজেট বরাদ্দ বেশি রাখায় তার সুফল আমরা পাচ্ছি। অন্যদিকে জ্বালানি খাতে বরাদ্দ কম দেয়ায় তার সংকটও দৃশ্যমান। দেশীয় অনুসন্ধান কার্যক্রমে যেমন কোনো উদ্যোগ নেই, তেমনি নেই উত্তোলনেও। ফলে দিনের পর দিন অবহেলিত থাকা এ খাত পিছিয়ে যাচ্ছে।
জ্বালানি খাতের আরেক বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম মনে করেন বিদ্যুতের মতো সমান গুরুত্ব জ্বালানি বিভাগের। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে মূল উৎস যেখানে জ্বালানি, সেখানে এ খাতে কম বরাদ্দের প্রস্তাব অর্থই হলো জ্বালানি খাতকে উপেক্ষিত রাখা। জ্বালানিতে অতিমাত্রায় আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তবে কভিড মহামারীর কারণে যদি এ বছর জ্বালানি খাতের বরাদ্দ কম হয়, তাহলে সেটি ভিন্ন কথা। অন্যথায় জ্বালানিকে গুরুত্ব কম দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।
২০৪১ সালকে সামনে রেখে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৬০ হাজার মেগাওয়াট। এরই মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। বাকি বিদ্যুৎ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নে সরকার প্রতি বছর বাজেটে সিংহভাগই বরাদ্দ দিচ্ছে বিদ্যুৎ খাতে।
প্রসঙ্গত, আগামী ৩ জুন জাতীয় সংসদে ৬ লাখ ৩ হাজার ৩৫০ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আসন্ন বাজেটে রাজস্বপ্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৭৮ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের মূল বাজেটের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ৮৪ শতাংশ বেশি।