সড়কে আর কত মৃত্যু দেখতে হবে

0

সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না। বেপরোয়া বাস-ট্রাকের ধাক্কায় বা চাপায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। করোনকারণে গত বছরের অন্তত ন’মাস যান চলাচল স্বাভাবিক ছিল না। এখনো স্বাভাবিক নয়। কিন্তু দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা কমেনি বরং বেড়েছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য, গত বছরের ডিসেম্বরে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪০২টি। তাতে মৃত্যু হয়েছে ৪৬৪ জনের। আগের মাসে অর্থাৎ নভেম্বরে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪১৭টি। তাতে মৃত্যু হয়েছে ৪৩৯ জনের। দু’মাসের এই পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, নভেম্বরে দুর্ঘটনার সংখ্যা ডিসেম্বরের চেয়ে কিছুটা বেশি হলেও মুত্যুর সংখ্যা ডিসেম্বরের তুলনায় কম। আর ডিসেম্বরে দুর্ঘটনার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হলেও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। এই ধারা নতুন বছরেও অব্যাহত আছে। বছরের প্রথম তিন দিনে দুর্ঘটনা ঘটেছে সর্বমোট ১৬টি। তাতে মৃত্যু হয়েছে ২৯ জনের। দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। কারণ, সব দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর খবরই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয় না। দেখা যাচ্ছে, তিন দিনের প্রতিদিনে গড়ে প্রায় ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আবার দুর্ঘটনার হিসাবে প্রতি দুর্ঘটনায় প্রায় দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতি বছর এভাবে কয়েক হাজার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে এবং তাতে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। একই সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ আহত হয়। দুর্ঘটনা ও মৃত্যু-দুই-ই মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক। এর মধ্যে এমন কিছু দুর্ঘটনা ও মৃত্যু ঘটতে দেখা যায়, যা মানুষকে অধিক মাত্রায় মর্মাহত ও বেদনার্ত করে। এমন ও দেখা যায়, দুর্ঘটনায় একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তি কিংবা পরিবারের সকলেরই মৃত্যু ঘটে। এ ধরনের মৃত্যু মানুষকে হতবিহব্বল এবং গভীর শোকের মধ্যে নিক্ষেপ করে। চলতি বছরের প্রথম ও তৃতীয় দিনে এরূপ দুটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রথম দিনের ঘটা দুর্ঘটনায় একই সঙ্গে তিন বোন মারা গেছে। তৃতীয় দিনের দুর্ঘটনায় একই পরিবারের ছয় জন মারা গেছে।
তিন বোনের মৃত্যুর দুর্ঘটনাটি ঘটেছে নরসিংদীর জঙ্গুয়া এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে। তাদের বহনকারী প্রাইভেটকারের সঙ্গে একটি বাসের মুখামুখী সংঘর্ষ হলে তারা তিনজনসহ চালক নিহত হয়। অপর যাত্রী গুরুতর আহত হয়। ওই তিনকন্যা পিতৃহীন। মা’ই তাদের লালন-পালন করেছেন। প্রথমজন একটি চাকরি করে এবং তার টাকাতেই সংসার চলে। এক ভাই আগেই মারা গেছে। অরেক ভাই প্রতিবন্দী। মা এখন পাগলপারা। গ্রাম জুড়ে শোকের ছায়া। তৃতীয় দিনের দুর্ঘটনাটি ঘটেছে ময়মনসিংহের গাছতলা এলাকায় নেত্রকোনা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে। বাস ও অটোরিকশার মুখোমুখী সংঘর্ষে একই পরিবারের ছয় জন চালকসহ ঘটনাস্থলেই মারা যায়। নিহতদের একজন ছিল সদ্য প্রসূত। হাসপাতাল থেকে তাকে নিয়ে বাড়ি আসার পথে ঘটে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। তিন দিন আগে যার জন্ম, দুর্ঘটনা তাকে স্বজনসহ নিয়ে গেছে মৃত্যুর ওপারে যেখানে একবার গেলে কেউ ফিরে আসেনা। সড়ক দুর্ঘটনায় এরকম পরিবারের একাধিক সদস্যের মৃত্যু বা পরিবারহানীর ঘটনা, বলা বাহুল্য, মোটেই নতুন নয়। গত বছরও এমন বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। আগেও ঘটতে দেখা গেছে। প্রাইভেটকার, সিএনজি- এধরনের ছোট যানের সঙ্গে বাস-ট্রাকের মুখোমুখী সংঘর্ষ হয়েছে। তাতেই মৃত্যু হয়েছে যাত্রীদের। বাস-ট্রাক রাস্তা-ঘাটে যেভাবে চলাচল তাতে যে কোনো সময় প্রাণহানীকর দুর্ঘটনা ঘটার আশংকা থাকে। কখনো কখনো এ আশংকা সত্যে পরিণত হয়। চালকরা এতটাই বেপরোয়া যে, কোনো কিছুতেই তারা তোয়াক্কা করে না। একথা সকলেরই জানা, সড়ক দুর্ঘটনার অধিকাংশের জন্য দায়ী বেপরোয়া চালক। তাদের এই পরোয়াহীন আচরণ ও প্রবণতা কোনো কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। চালকদের একটি বড় অংশ প্রশিক্ষিত ও দক্ষ নয় এবং তাদের বৈধ লাইসেন্সও নেই। তারাই বেশিরভাগ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। কয়েক লাখ এমন যানবাহন রয়েছে, যাদের ফিটনেস নেই। লাইসেন্স বিহীন চালক ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন বন্ধ করতে পারলে দুর্ঘটনা অনেক কমে যেতে পারে। চালকের লাইসেন্স দেয়া ও যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয়ার কর্তৃপক্ষ আছে। তাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এই অভিযোগের প্রতিকার এবং তাদের কাজের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায়নি।
সড়ক ও সেতুবিষয়ক মন্ত্রণালয় আছে। তার যিনি মন্ত্রী, তিনি সরকারি দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি। তার মন্ত্রণালয় থেকে এ পর্যন্ত যত নিদের্শনা দেয়া হয়েছে সেগুলোর বেশির ভাগই সংশ্লিষ্টরা প্রতিপালন করেনি। কেন এই অমান্যতা ও ব্যত্যয়, তার কোনো জবাব নেই। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মন্ত্রণালয়ের নিদের্শনা যথাযথভাব বাস্তবায়তি হলে সড়কে শৃংখলা, যাতায়াতসহজতা ও নিরাপত্তা অনেক বেশি নিশ্চিত হতো। দুর্ঘটনাও কমতো। মন্ত্রী অনেক বিষয়েই কথা বলেন, অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি তার মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত বিষয়ও থাকে। তিনি ক্ষেত্র বিশেষ হুমকি- ধমকিও দেন। কিন্তু তার কথা ও হুমকি-ধমকির প্রভাব কার্যক্ষেত্রে প্রতিফলিত হতে কমই দেখা যায়। মহাসড়কে ধীরগতির যান যেমন, অটোরিকশা, নসিমন, করিমন, ভটভটি ইত্যাদির চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ এসব যানবাহন দিব্যি চলাচল করছে এবং কখনো কখনো মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কারন হচ্ছে। এদের চলাচল বন্ধ করা যায়নি। সড়কশৃংখলা ও নিরাপত্তা বিধানে পুলিশ আছে বটে, কিন্তুতাদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে তেমন দেখা যায় না। সড়ককে সুশৃংখল, বাধামুক্ত ও নিরাপদ করতে হবে। এব্যাপারে অনুসরণ করতে হবে শূন্য সহিষ্ণুতার নীতি। যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের ছোটবড় সকলকে দায়িত্বশীল হতে হবে। জবাবদিহির সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আইন করে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু রোধ করা যাবে না, যদি আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা থাকে এবং আইনের প্রতি অবজ্ঞা করার প্রবণতা থাকে। আইন যানবাহনমালিক, চালক, পথচারি, যাত্রী, পুলিশ- সবাইকে জানাতে হবে। তাদের তা জানতে হবে এবং মানতে হবে। কারো ক্ষেত্রে অমান্যতা লক্ষ করা গেলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।