বদলালো পরিচালক কিন্তু বদলালো না সিএমএসডি

0
ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা
করোনা দেশের স্বাস্থ্য খাতের অদক্ষতা অযোগ্যতা যতটা প্রকাশ করেছে, তার বহুগুণ প্রকাশ করেছে এই খাতে চলে আসা ভয়ঙ্কর দুর্নীতি। এই দুর্নীতি এতই ভয়ঙ্কর যে আমরা আসলে ব্যাধি না দুর্নীতি কোনটার বিরুদ্ধে লড়ছি- সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। মিডিয়ার যথেষ্ট মনোযোগ থাকার কারণে করোনার সময়ে স্বাস্থ্য বিভাগের একের পর এক দুর্নীতি উন্মোচিত হয়েছে। ফলে সরকারের উপরে প্রচণ্ড চাপ তৈরি হয়েছে। তাই সরকারকে অন্তত কিছু পদক্ষেপ নেয়ার ‘আইওয়াশ’ দিতে হয়েছে। সরকার কিছু পদে রদবদল করেছে এবং কিছু চুনোপুঁটিকে গ্রেপ্তার করেছে। পদক্ষেপগুলোকে ‘আইওয়াশ’ বলছি কারণ এর মাধ্যমে আসলে মৌলিক কোনো পরিবর্তনের সদিচ্ছা সরকারের ছিল না, পরিবর্তন হয়ওনি বরং স্বাস্থ্য খাতকে চলতে দেয়া হয়েছে একই রকম দুর্নীতিগ্রস্ত অদক্ষ সমন্বয়হীনভাবে।
স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটায় যেহেতু সিএমএসডি মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান, তাই এই প্রতিষ্ঠানটি সাম্প্রতিক সময়ে বেশ আলোচনায় থেকেছে। আমিও এই প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়ে আলোচনা করে এটুকু দেখাতে চাই আসলে মৌলিক পরিবর্তন কোনো কিছু হয়নি। বরং কিছু পরিবর্তন পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে নিয়ে গেছে। পরিচালক বদলেছে সিএমএসডি’র। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি রয়ে গেছে আগের মতো।? এটাও পুরো ঠিক কথা হলো না, এই প্রতিষ্ঠানে আগের ব্যাধি তো রয়েই গেছে বরং যুক্ত হয়েছে নতুন আরেকটি ব্যাধি। করোনা সংকট শুরুর সময় সিএমএসডি পরিচালক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহীদুল্লাহ। স্বাস্থ্য খাতে বহুল আলোচিত ‘মিঠু সিন্ডিকেট’ ও তার সহযোগীর দৌরাত্ম্যের বিষয় তুলে ধরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদুল্লাহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এক চিঠি দিয়েছেন। ওই চিঠিতে সিএমএসডিসহ স্বাস্থ্য খাতে ঠিকাদার চক্রের ইশারায় বদলি, পদায়নসহ নানা বিষয়ে তুলে ধরে গোটা স্বাস্থ্য খাতকে ‘সিন্ডিকেট বাণিজ্যমুক্ত’ করার অনুরোধ জানান। শুধু তাই না, তাকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্তের পর একটি টিভি চ্যানেলকে তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করার কারণেই তার এই পরিণতি হয়েছে।
স্বাস্থ্য খাতে নানা অনিয়মের ক্ষেত্রে মিঠু সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের কথা যখন করোনার শুরু থেকেই সবাই জানে, তখনো এই মিঠু সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দূরেই থাকুক কাজ পাওয়ার উদাহরণ আমরা দেখতে পাই সাম্প্রতিক সময়েও। সিএমএসডি’র পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামান গত ১৫ই জুন একটি কেনাকাটার কার্যপত্র স্বাক্ষর করেন। দরপত্র ছাড়াই সরাসরি এসব পণ্য কেনার কার্যাদেশ দিয়েছে সিএমএসডি। এর আওতায় দেশের স্বাস্থ্য খাতের মাফিয়া ডন হিসেবে পরিচিত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর সিন্ডিকেটভুক্ত একটি সহ মোট চারটি প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছিল। অন্য তিন প্রতিষ্ঠান হলো: ওভারসিজ মার্কেটিং করপোরেশন (ওএমসি), মাইশা রাও টেলসেট জেভি ও স্টার্লিং মাল্টি টেকনোলজিস লিমিটেড। এই তিন প্রতিষ্ঠানও স্বাস্থ্য বিভাগে একচেটিয়া কাজ করে আসছে।
দেখা যায়, মিঠুর প্রতিষ্ঠান মেসার্স জেরিন এন্টারপ্রাইজকে দেড় লাখ পিস পিসিআর টেস্ট কিট সরবরাহের নির্দেশ দেয়া হয়েছে প্রতি কিট ২৩শ’ টাকা মূল্যে। ওভারসিজ মার্কেটিং করপোরেশন-ওএমসিকে ২৩শ’ টাকা দরে ১ লাখ ৫০ হাজার টেস্ট কিটের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। মাইশা রাও টেলসেট জেভিকে ২৩শ’ টাকা ইউনিট মূল্যে ৫০ হাজার বায়োনির ব্র্যান্ডের টেস্ট কিট সরবরাহের আদেশ দেয়া হয়েছে। স্টার্লিং মাল্টি টেকনোলজিস লিমিটেডকে ২১শ’ টাকা ইউনিট মূল্যে ২৫ হাজার এন্যাটোলিয়া ব্র্যান্ডের টেস্ট কিটের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। কোম্পানিগুলোর টেস্টিং কিট এর দাম সব রকম খরচ সহ ৫০০ থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে হবে। অর্থাৎ এই কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি অংকে। উক্ত চারটি কার্যাদেশের মোট মূল্য ৮৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই কার্যাদেশেই লুটপাটের পরিকল্পনা ছিল অন্তত ৬০ কোটি টাকা। এই সকল তথ্যের উৎস ২০শে জুলাই ভোরের কাগজে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট। এই কেনাকাটার ফর্দ আর তার দাম শুনে আমার আপনার মনে যে কথা ভেসে উঠবে, রিপোর্টটির শিরোনামও ঠিক তাই, ‘কেলেঙ্কারির মধ্যেও হরিলুট’। বর্তমান পরিচালক আবু হেনার অধীনেই সিএমএসডি প্রতিটি ৯ লাখ টাকা দামে ৫০০টি ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা কেনার কার্যাদেশ দিয়েছিল, যার বাজারমূল্য সর্বোচ্চ ৪ লাখ টাকা। বাজারমূল্যে এই ক্যানুলা কিনলে খরচ হবার কথা ২০ কোটি টাকা। কিন্তু কেনার আদেশ দেয়া হয়েছিল ৪৫ কোটি টাকায়। অর্থাৎ এই খাতেও প্রায় ২৫ কোটি টাকা লুটপাটের পরিকল্পনা হয়েছিল। এই সংবাদের উৎস ১৪ জুলাই দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত ‘৪ লাখ টাকার ক্যানুলা কিনতে ৯ লাখ’- শিরোনামের একটি রিপোর্ট। প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার ক্রয়াদেশ বাতিল করা হয়। মজার ব্যাপার যিনি এই ক্রয়াদেশ পেয়েছিলেন, সেই সংসদ সদস্য শিশুতোষ ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, দাম বেশি বলে তিনি নাকি নিজ থেকেই কার্যাদেশ প্রত্যাহার করেছেন! স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটায় ‘শুদ্ধি অভিযান’ পরিচালনাকারী, সিএমএসডি’র পরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান এ ব্যাপারে কালের কণ্ঠের কাছে কিছু বলতে রাজি হননি। সৎ সাহস থাকলে তার কথা বলার কথা ছিল। এমন কি ভোরের কাগজ এত রিপোর্ট করার পরও হেনা সাহেবের কোন ব্যাখ্যা আমরা পাইনি। অথচ সিএমএসডি পরিচালক পদে আসার পর সিএমএসডি বেশ ঘটা করে জানিয়েছিল কেনাকাটার পদ্ধতিগত পরিবর্তন করে তারা নাকি রাষ্ট্রের প্রায় দেড়শ’ কোটি টাকা সাশ্রয় করেছেন এক মাসেই। আগের পরিচালকের সময়ের নিয়মকে ভুল দেখিয়ে বর্তমান পরিচালক অনেক কিছু করছেন, এমন একটা ইল্যুশন তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু না, এই প্রতিষ্ঠানটি একই রকম দুর্নীতির আখড়াই হয়ে থেকেছে। আগের পরিচালককে হয়তো অনেক ক্ষমতাবান কারো চাপে কার্যাদেশ দিতে হয়েছিল, কিন্তু তিনি যে অন্তত এদের বিরুদ্ধে লড়াইটা করার চেষ্টা করেছিলেন, সেটা জাতি জেনেছিল।
এবার আসা যাক নতুন পরিচালক এই প্রতিষ্ঠানে যে নতুন ব্যাধির আমদানি করেছেন, সেটির কথায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন সিএমএসডি পরিচালক পদটি উপসচিব মর্যাদার। এই পদে বর্তমানে রয়েছেন অতিরিক্ত সচিব মর্যাদার কর্মকর্তা আবু হেনা মোরশেদ জামান। একজন অতিরিক্ত সচিব কেন দুই ধাপ নিচের একটা পদে গেলেন? এর জবাব হতে পারে ২২শে আগস্ট দৈনিক কালের কণ্ঠ প্রকাশিত একটি রিপোর্টের শিরোনাম। শিরোনাম টি হলো- ‘তাঁরা সুযোগ-সুবিধার লোভে নিচু পদে?’
তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই তিনি কোনো সুযোগ-সুবিধার জন্য ওই পদে যাননি তিনি গেছেন করোনার এই সময়ে জাতিকে উদ্ধার করতে। কিন্তু উল্লিখিত রিপোর্ট আমাদের সামনে বর্তমান সিএমএসডি পরিচালকের এই পদে থাকা নিয়ে একটা গুরুতর সমস্যা তৈরির কথা আমাদের জানায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, সিএমএসডি’র বর্তমান পরিচালক একজন অতিরিক্ত সচিব। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন কাজের দায়িত্বে থাকা উপসচিব ও যুগ্ম সচিব মর্যাদার কর্মকর্তারা অনেক কমিটির আহ্বায়ক থাকেন। সেখানে সিএমএসডি’র পরিচালক থাকেন সদস্য। এখন সিএমএসডি’র পরিচালক একজন অতিরিক্ত সচিব হওয়ায় উপসচিব-যুগ্ম সচিব মর্যাদার কর্মকর্তাদের কেউ বৈঠক আহ্বান করলে তিনি যান না, প্রতিনিধি পাঠান। এতে কমিটির সঙ্গে পরিচালকের সরাসরি যোগাযোগ না হওয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কৌশল নির্ধারণে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ভুল-বোঝাবুঝিরও সৃষ্টি হচ্ছে। শুধুমাত্র উচ্চপদে আছেন এই ইগোর কারণে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং-এ বর্তমান পরিচালক অনুপস্থিত থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি করছেন। করোনার মতো এত ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্য সংকটেও তারই ব্যক্তিগত ইগো এই জাতির জন্য কতটা ক্ষতির কারণ হচ্ছে সেটা বোঝার জ্ঞান তার না থাকুক এই দেশের জনগণের সেটা আছে। কিন্তু জনগণের স্বার্থ না, জয়ী হয় তার ইগো। এই ভদ্রলোক?ই নাকি আমাদের স্বাস্থ্যের কেনাকাটার অনিয়ম দূর করবেন।
কোনো কিছুই আসলে পাল্টায়নি। বরং আরো খারাপ হয়েছে। সততার আইওয়াশ দিয়ে আসলে একই রকম দুর্নীতি চলছে স্বাস্থ্য খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে। আমি বিরোধীদলীয় এমপি তাই কেউ বলতেই পারেন আমি তো এভাবে বলবোই। তাই এই কলাম শেষ করছি স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান এর উক্তি দিয়ে। আমরা জানি নিশ্চয়ই জানি, চিকিৎসকদের এই প্রভাবশালী সংগঠনটির সদস্য ক্ষমতাসীন দলের চিকিৎসকগণ। নতুন সিএমএসডি পরিচালকের অধীনে কেনাকাটার ক্ষেত্রে লুটপাটের এই আয়োজন নিয়ে ভোরের কাগজ যখন জনাব আর্সলানকে প্রশ্ন করে, তখন তার জবাব- ‘স্বাস্থ্য খাতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্বৃত্তায়ন। কথায় আছে পুকুর চুরি হয়। স্বাস্থ্য খাতে পুকুর চুরি নয়, সাগর চুরি হচ্ছে’।