নৌকাডুবি!

0

॥সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা॥
সহিংসতায় শেষ হলো স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে তৃণমূল স্তর – ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। সাত পর্বের সমাপ্ত এই ভোটেও ছিল রক্তের হোলি খেলা, ছিল অস্ত্রের ঝনঝনানি। শিরা ফুলিয়ে, আস্তিন গুটিয়ে, পেশি প্রদর্শন করে বাঙালি যে রাজনীতি করে তার চেয়েও বেশি কিছুর প্রদর্শন ছিল এবারের ইউপি নির্বাচনে। ছিল অ্যাকশন মুভির দৃশ্যের মতো আগ্নেয়াস্ত্রের শ্যুটিং দৃশ্য। মারামারি, সংঘাত–সহিংসতায় শেষ দিনের বিকেল পর্যন্ত ১০১ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটল এবার। শেষ দিনে চট্টগ্রামে অস্ত্র প্রদর্শনের যেসব ছবি এসেছে তা যে কোন হলিউড বা বলিউড সিনেমাকে হার মানাবে। পুলিশের চোখের সামনে এমন প্রকাশ্য অস্ত্রবাজির পরও নির্বাচন নিয়ে সন্তুষ্টি আছে নির্বাচন কমিশনের। সন্তুষ্টি নিশ্চয়ই আছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভেতরও। কিন্তু এবারের ইউপি নির্বাচন যে একটি খুন যখমের উৎসবে পরিণত হলো সে নিয়ে কোথাও কোন জিজ্ঞাসা নেই। এই নির্বাচন থেকে সংঘাত আর সহিংসতা, বিবাদ আর বিদ্বেষ ছাড়া আর কী পেয়েছে আওয়ামী লীগ সে প্রশ্ন উচ্চারিত হওয়ার কোন পরিবেশ দলের কোথাও আছে কিনা সেটাও কর্মীরা জানে না। আমরা জানলাম যে, নৌকা প্রতীক নিয়ে হেরে গেছে প্রায় দেড় হাজারের বেশি প্রার্থী।
রাজনীতি সম্ভাব্যতার শিল্প। শিল্প সহজলভ্য নয়, কঠিন সাধনার ফল। এতো যে মৃত্যু তাতে দেশবাসীর সান্ত্বনা কোথায়? ধমকধামক দিয়ে গণতন্ত্র চালু রাখবার তিক্ত প্রহসন আর কত দিন সইতে হবে নাগরিকদের সেই প্রশ্নের উত্তর প্রয়োজন। প্রশ্নটি নতুন নয়, কিন্তু দুশ্চিন্তা বাড়বার কারণ আছে। কারণ এবারের ইউপি নির্বাচন আইনশৃঙ্খলার অবয়ব একেবারে নগ্ন হয়ে উপস্থিত হলো আমাদের সামনে। অমানবিক অপরাধ আমরা কম দেখিনি। কিন্তু রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে এমন সুপরিকল্পিত নৃশংসতার নজির সত্যিই বিরল। অথচ নির্বাচন শুরুর আগে একটা ধারণা প্রচলিত ছিল যে, বিরোধী দল, বিশেষ করে বিএনপিহীন এই স্থানীয় নির্বাচনে যারা সরকারি দলের প্রতীক নৌকা পাবেন তাদের বিজয় অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যাবে। দলের ভেতর গণতন্ত্রের চর্চা থাকলে নিশ্চয়ই এগুলোর একটা বিশ্লেষণ হতো, নিশ্চয়ই যারা যারা সংশ্লিষ্ট ছিল তাদের জবাবদিহি করতে হতো। একটা কথা বলা হচ্ছে যে, প্রার্থী মনোনয়নে ভুল ছিল, ছিল মনোনয়ন বাণিজ্য। ফলে ফলাফলে প্রত্যাশা পূরণ হয় নি। তবে বলতেই হবে যে, এবারের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন শাসক দলের জন্য বড় বার্তা বয়ে এনেছে। আওয়ামী লীগ আত্মঘাতী হয়ে উঠেছে এবং দলের মধ্যকার বিশৃঙ্খলা কতটা উগ্র পর্যায়ে গিয়েছে তার এক নগ্ন প্রদর্শনী ছিল এই ইউপি নির্বাচন।
জেলায় জেলায় পাড়ায় পাড়ায় সহিংসতা ছাড়া মানুষ আসলে কী কোন নির্বাচন দেখেছে এবার? নাকি দেশটা এই সময়ে পরিণত হয়েছিল লাশকাটা ঘরে? জানি এসব প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। এক অবাস্তব হিংসার রাজনীতির বলি আমরা সবাই। এতগুলো মানুষ মারা গেল, কিন্তু কোথাও কোন সংবেদেনশীলতা নেই। কারণ এরা দরিদ্র মানুষ এবং শাসনপ্রণালীর কোন স্তরেই মানুষের জন্য কোন ভাবনা নেই। বিএনপি দলগতভাবে এই নির্বাচনে ছিল না। তাই ভোটের রাজনীতিতে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের লভ্যাংশ যা ছিল তা হলো নিজেদের কর্মীদের খুন আর যখম যা মানবজমিন থেকে অনেক অনেক দূরে। আমাদের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে মেরুকরণ স্পষ্ট। সমস্যা হচ্ছে ভোটে জেতার জন্য আওয়ামী লীগের ভেতরেই যখন সহিংসতার রাজনৈতিক চর্চা প্রাধান্য পায় তখন উন্নয়ন, শিল্পায়ন, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ সবই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। প্রায় সাড়ে চার হাজারের মতো ইউনিয়ন পরিষদের সাত দফার নির্বাচনে প্রায় ১৬০০’র বেশি ইউনিয়নে দলের প্রার্থীকে হারিয়ে চেয়ারম্যান হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, যাদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগেরই নেতা। এরা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে এমন কিছু এলাকা আছে যেসব এলাকাগুলো দীর্ঘকাল ধরেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত এলাকা হিসেবে রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচিত। একটা কথা স্পষ্ট যে স্থানীয় নেতা ও এমপিদের মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণেই এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এর চেয়েও বড় কোন বার্তা যদি এই নির্বাচন দিয়ে থাকে সেটা হলো প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে তৃণমূলকে অবহেলা করা। কিন্তু যদি বলি শাসক দল মানুষ থেকেই বিচ্ছিন্ন তবে কী বেশি বলা হবে? কিংবা দল আসলে নিজের থেকে নিজেই বিচ্ছিন্ন? এই বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্তির সন্ধানই হবে প্রকৃত রাজনৈতিক চর্চা। সেটাই সংঘাত ঘোচাতে পারে। কিন্তু আমরা জানি সেই চর্চা আর হবার নয়।
এ নির্বাচন রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভিতকে আহত করেছে, কারণ দলের প্রবল সাংগঠনিক সংকট স্পষ্ট করে দিয়েছে এই নির্বাচন। বলা হচ্ছে যারা নৌকাকে হারিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, কিন্তু কয়জনকে বিদ্রোহী হিসেবে বাদ দিতে পারবে দল? দলের মধ্যে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা রাজনীতির বোধটাই হয়তো ভুলিয়ে দিয়েছে। দলনেতাদের পড়াশোনার কিঞ্চিৎ ব্যাপ্তি ও গভীরতা থাকলে তারা হয়তো কিছুটা অনুধাবন করতে পারতেন যে ক্ষত কোথায় সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ১৩ বছরে ক্ষমতার ঘি মাখন সেটাও ভাবতে সহায়তা করছে না। রাজনীতি সম্ভাব্যতার শিল্প। শিল্প সহজলভ্য নয়, কঠিন সাধনার ফল। এতো যে মৃত্যু তাতে দেশবাসীর সান্ত্বনা কোথায়? ধমকধামক দিয়ে গণতন্ত্র চালু রাখবার তিক্ত প্রহসন আর কত দিন সইতে হবে নাগরিকদের সেই প্রশ্নের উত্তর প্রয়োজন। প্রশ্নটি নতুন নয়, কিন্তু দুশ্চিন্তা বাড়বার কারণ আছে। কারণ এবারের ইউপি নির্বাচন আইনশৃঙ্খলার অবয়ব একেবারে নগ্ন হয়ে উপস্থিত হলো আমাদের সামনে। অমানবিক অপরাধ আমরা কম দেখিনি। কিন্তু রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে এমন সুপরিকল্পিত নৃশংসতার নজির সত্যিই বিরল।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।