ভারত থেকে আসছে অস্ত্র, যাচ্ছে বিভিন্ন জেলায় ধরা-ছোয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে গডফাদাররা

0

সুন্দর সাহা॥ যশোর জেলার বিভিন্ন সীমান্তের অবৈধ চোরাচালান ঘাট দিয়ে ভারত থেকে পাচার করে আনা হচ্ছে ছোট-বড় অস্ত্রের চালান। অস্ত্রের সিন্ডিকেটের হোতারা প্রকাশ্যে সক্রিয় থাকলেও থেকে যাচ্ছে ধরা-ছোয়ার বাইরে। ছোট-বড় অস্ত্রের চালান পাচার করে এনে দেশময় ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। দু-একটি চালান ধরা পড়লেও অধিকাংশ চলে যাচ্ছে গন্তব্যে। সংশ্লিষ্টদের সাথে রফা করেই এসব অস্ত্র পাচার সিন্ডিকেটের হোতারা থাকছে ধরা ছোয়ার বাইরে। সীমান্তের সূত্রগুলো বলছে ঘাট মালিক, তাদের ক্যাডার এবং সিন্ডিকেটের হোতারা সবাই ক্ষমতাসীনদের আশির্বাদপুষ্ট হওয়ায় তারা বাড়তি অনৈতিক সুবিধা পাচ্ছে। তারপরও কিছু কিছু চালান ধরা পড়ছে। ২১ ও ২২ ডিসেম্বর র‌্যাব ও বিজিবি পৃথক পৃথক অভিযান চালিয়ে ৫টি অস্ত্র, ৯টি ম্যাগজিন এবং ৪১ রাউন্ড গুলিসহ চারজনকে আটক করে। পুলিশ তাদের রিমান্ডেও নেয়। কিন্তু এই চক্রের গডফাদারদের আটকে পুলিশের কোন পদক্ষেপ চোখে পড়েনি সীমান্তবাসীর।
সীমান্তের সূত্রগুলো জানায়, গত ২১ ডিসেম্বর রাতে র‌্যাব-৬ সিপিসি-২ ঝিনাইদহ ক্যাম্পের একটি টিম গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বেনাপোলের দিঘিরপাড় এলাকার মেসার্স শাহজালাল ফিলিং স্টেশনের সামনে অভিযান চালায়। এ সময় সেখান থেকে ৪টি বিদেশি পিস্তল, ৮টি ম্যাগজিন ও ৩৪ রাউন্ড গুলিসহ অস্ত্র ব্যবসায়ী আব্দুল্লাহ ও আজিজুর রহমানকে আটক করে। এ ঘটনায় র‌্যাবের ডিএডি নায়েব সুবেদার মো. নুরুল আমীন ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইনে বেনাপোল পোর্ট থানায় একটি মামলা করেন। এই মামলায় আটক দুজনকে আদালতে সোপর্দ করে তাদের প্রত্যেকের ৫ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানান তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. রফিকুল ইসলাম। অপরদিকে, গত ২২ ডিসেম্বর বিজিবি সদস্যরা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শার্শা উপজেলার পুটখালীতে অভিযান চালান। এ সময় সেখান থেকে ১টি বিদেশি পিস্তল, ১টি ম্যাগজিন, ১টি ওয়ান শ্যুটারগান ও ৭ রাউন্ড গুলিসহ নাদিম ও শামীম রেজাকে আটক করে। এ ঘটনায় বিজিবি নায়েব সুবেদার জাকির হোসেন ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইনে বেনাপোল পোর্ট থানায় একটি মামলা করেন। এই মামলায় আটক দুজনকে আদালতে সোপর্দ করে তাদের প্রত্যেকের ৫ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা বেনাপোল পোর্ট থানার এসআই মো. রোকনুজ্জামান। পুলিশের করা আবেদনের শুনানি শেষে বিজ্ঞ বিচারক তাদের প্রত্যেকের ২ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তাদের রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কোর্টে সোপর্দ করে। এরপর কিন্তু এই চক্রের হোতাদের আটকে কোন প্রকার পুলিশি অ্যাকশন চোখে পড়েনি। সীমান্ত এলাকার সবাই জানে অস্ত্রবাজ ও অস্ত্রব্যবসায়ী আব্দুল্লাহ, আজিজুর রহমান নাদিম ও শামীম রেজা কার লোক। কোন সিন্ডিকেটের হয়ে তারা কাজ করেন তাও সকলের জানা। আর কে এই সিন্ডিকেটের হোতা তাও প্রশাসনের জানা। কিন্তু অদৃশ্য কারনে তার ব্যাপারে প্রশাসন দৃশ্যত নিরব-নির্বিকার। অভিযোগ রয়েছে রক্ষকরাই ভক্ষক হয়ে এই গডফাদারের বাড়িতে খানাপিনা করেন এবং নগদ সহ উপঢৌকনও নেন। যার পুরস্কারস্বরুপ অস্ত্রবাজ ও অস্ত্রব্যবসায়ী আব্দুল্লাহ, আজিজুর রহমান নাদিম ও শামীম রেজার গডফাদার সীমান্তের ডন থেকে যাচ্ছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এর আগে, ৮টি আধুনিক অস্ত্র, ৮ রাউন্ড গুলি এবং ১৬টি ম্যাগজিনসহ আবুল হোসাইন এবং তার চার পরীক্ষিত দোসরকে পুলিশ আটক করে। গ্রেফতার হওয়া অন্যরা হলেন- ইলিয়াস হোসেন, আবুল আজিম, ফজলুর রহমান ও ফারুক হোসেন। চক্রটির মূলহোতা আকুল হোসেন যশোরের শার্শা উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং যশোর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি। সংশ্লিষ্টদের কল্যাণে চাঞ্চল্যকর এই অস্ত্র মামলাও ধামা চাপা পড়তে চলেছে।
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে আপত্তি জানানো সূত্রগুলো আরও জানায়, ভারতের মুঙ্গের টাউন, কাশিম বাজার, মফস্বল, বারিয়ারপুরসহ কয়েকটি এলাকায় গড়ে ওঠা ৪৫/৫০টি কারখানা থেকে অস্ত্র, গুলি বাংলাদেশে পাচার হয়। এসব কারখানায় তৈরি দেশি বন্দুক, পিস্তল, ম্যাগজিন ও রিভলবারের মতো অস্ত্র তৈরি হচ্ছে। আমেরিকার তৈরি নাইন এমএম পিস্তলের অবিকল পিস্তলও তৈরি হয় এসব এলাকায়। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রথমে আগ্নেয়াস্ত্র আসে সীমান্ত শহর বনগাঁয়। বাংলাদেশে পাচারের জন্য শার্শা উপজেলার বিভিন্ন সীমান্ত ঘাটকে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবসায়ীরা। কারণ, এসব এলাকার বিপরীতে ভারতীয় সীমান্তে অনেক স্থানেই কাঁটাতারের বেড়া নেই। যশোরের শার্শা সীমান্তের ওপারে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা সীমান্তের আংরাইলসহ কয়েকটি গ্রাম। যার মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে ইছামতী নদী। ওপারের অস্ত্র কারবারিরা গোসল করতে নেমে প্লাস্টিকের ব্যাগে বিশেষভাবে ভরে অস্ত্রের চালান ভাসিয়ে দেয়। ভাসতে ভাসতে সেই অস্ত্রের চালান প্রবেশ করে বাংলাদেশের অংশে। গোসল করতে থাকা চক্রের হাতে। সেই অস্ত্র ছড়িয়ে দেয়া হয় সারা দেশে। সূত্র বলছেন, বর্তমানে ৭.৬৫ বোরের অস্ত্রের দাম ভারতে ২৫ থেকে ৩০ হাজার রুপি। দেশে এগুলো বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায়। ৯ এমএম ৩ ইঞ্চি ব্যারেলের ৫৭ হাজার রুপির পিস্তল বিক্রি হচ্ছে ৯০ হাজার এবং ৫ ইঞ্চির ৫২ হাজার রুপির পিস্তল বিক্রি হচ্ছে ৮০ হাজার থেকে ৮৫ হাজার টাকায়। ৭.৬৫-এর গুলি বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকায়। অভিযোগ আছে, যারা সীমান্তের ঘাট চালায় তার সব সময় লাইসেন্সবিহীন পিস্তল ও গুলি নিয়ে চলাফেরা করে। এসবই কর্মরত কর্মকর্তারা জানেন। অথচ, তারা দেখেও না দেখার ভান করেন। অস্ত্রবাজ ও অস্ত্রব্যবসায়ী আব্দুল্লাহ, আজিজুর রহমান, নাদিম ও শামীম রেজা কার লোক কারা এদের গডফাদার রিমান্ডে নিয়ে তাদের সম্পর্কে কিছু জানা গেছে কিনা এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বেনাপোল পোর্ট থানার ওসি মামুন খান লোকসমাজকে বলেন, কে এদের গডফাদার, কারা অস্ত্র এই অস্ত্র পাচার ও বিকিকিনি সিন্ডিকেটের হোতা এবং অস্ত্রের উৎস কি এসব খবর আমার জানা নেই।” তবে, ইতিপূর্বে ৮টি আধুনিক অস্ত্র, ৮টি গুলি এবং ১৬টি ম্যাগজিনসহ আকুল হোসাইন এবং তার চার পরীক্ষিত দোসরকে আটক করার পর ওসি মামুন খান বলেছিলেন, ‘আকুলের বিরুদ্ধে এই থানায় বিস্ফোরক আইনসহ কয়েকটি মামলা রয়েছে।’ এ চাঞ্চল্যকর আটক এই ঘটনার পরও কোনো পুলিশি তৎপরতা চোখে পড়েনি। যা জন্ম দিয়েছে অনেক প্রশ্নের।