কখনো বাদী কখনো আসামি পরীমনি

0

জাহাঙ্গীর আলম॥ ঘটনাবহুল ২০২১ শেষ হচ্ছে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের সতর্কবার্তা দিয়ে। বছরজুড়ে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তাণ্ডবে বহু মানুষের মৃত্যু দেখেছে দেশ। তবে মহামারির কালো ছায়া ছাপিয়ে মাদককাণ্ড ও ধর্ষণ-হত্যাচেষ্টা ইস্যুতে বছরের শেষভাগে তুমুল আলোচনায় ছিলেন চিত্রনায়িকা পরীমনি। এসব কর্মকাণ্ডে তার নামের পাশে সমানভাবে জড়িয়ে যায় ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও প্রযোজক-অভিনেতা নজরুল ইসলাম রাজের নামও। কখনো বাদী আবার কখনো আসামির ভূমিকায় পরীমনির উপস্থিতিতে ঢাকার আদালতপাড়ায়ও ছিল বাড়তি উত্তাপ। বছরের মাঝামাঝি সময়ে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে ব্যবসায়ী নাসিরের বিরুদ্ধে মামলা করেন পরীমনি। এর কিছুদিন পর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে পরীর বিরুদ্ধে মামলা করে র‌্যাব। এ দুই মামলায় নাসির-পরীমনি গ্রেফতার হন। তাদের একাধিকবার রিমান্ডেও নেওয়া হয়। জামিনও পান তারা। বর্তমানে নাসিরের বিরুদ্ধে করা মামলায় বাদী হিসেবে আদালতে হাজিরা দিতে আসেন পরীমনি। আবার মাদক মামলার আসামি হিসেবেও তাকে আদালতে আসতে হয়। বিদায়ী বছরে ঢাকার আদালতে যেসব আলোচিত মামলা ও মামলার রায় হয়েছে, তা নিয়ে পাঁচপর্বের সালতামামির আজ পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব।
ঢাকার বোট ক্লাবে পরীমনিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও তুহিন সিদ্দিকী অমিসহ তিনজনের বিরুদ্ধে চলতি বছরের ১৪ জুন রাজধানীর অদূরে সাভার থানায় মামলায় করেন পরীমনি। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় চারজনকে আসামি করা হয়। মামলা দায়েরের একদিন পরই ১৫ জুন নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও পরীর বন্ধু অমিসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ওইদিনই সাভার থানার পুলিশ পরিদর্শক কামাল হোসেন তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। তবে রাজধানীর বিমানবন্দর থানায় করা মাদক মামলায় নাসির-অমি সাতদিনের রিমান্ডে থাকায় সেদিন এ আবেদনের ওপর শুনানি হয়নি। মাদক মামলায় রিমান্ড শেষে পরীমনির ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার মামলায় নির্ধারিত দিনে পুলিশের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদনের শুনানি নিয়ে ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাজীব হাসান নাসির-অমির বিরুদ্ধে পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড শেষে ২৯ জুন দুই আসামিকে আদালতে হাজির করে মামলার তদন্তকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জামিন আবেদন করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শাহজাদী তাহমীদা নাসির-অমির জামিন আবেদন মঞ্জুর করে আদেশ দেন। এরপর গত ৬ সেপ্টেম্বর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সাভার থানার পুলিশ পরিদর্শক কামাল হোসেন ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নাসির-অমিসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেন। মামলার অপর আসামি হলেন শহীদুল আলম।
গত ১৩ ডিসেম্বর ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৯ এর বিচারক হেমায়েত উদ্দিন অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন। একইসঙ্গে আসামি শহীদুল আলম পলাতক থাকায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। পরীমনির মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ৮ জুন রাত সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর বনানীর বাসা থেকে কস্টিউম ডিজাইনার জিমি (৩০), অমি (৪০) ও বনিসহ (২০) দুটি গাড়িতে করে তারা উত্তরার উদ্দেশে রওয়ানা হন। পথে অমি বলেন- ঢাকা বোট ক্লাবে তার দুই মিনিটের কাজ আছে।
অমির কথামতো তারা সবাই রাত আনুমানিক ১২টা ২০ মিনিটের দিকে ঢাকা বোট ক্লাবের সামনে গিয়ে গাড়ি দাঁড় করান। কিন্তু বোট ক্লাব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অমি কোনো এক ব্যক্তির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। তখন ক্লাবটির সিকিউরিটি গার্ড গেট খুলে দেন। অমি ক্লাবের ভেতরে গিয়ে বলেন এখানকার পরিবেশ অনেক সুন্দর, তোমরা নামলে নামতে পারো। এজাহারে পরীমনি আরও উল্লেখ করেন, তখন আমার ছোট বোন বনি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বোট ক্লাবে প্রবেশ করে ও বারের কাছের টয়লেট ব্যবহার করে। টয়লেট থেকে বের হতেই এক নম্বর বিবাদী নাসির উদ্দিন মাহমুদ আমাদের ডেকে বারের ভেতরে বসার অনুরোধ করেন ও কফি খাওয়ার প্রস্তাব দেন। আমরা বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইলে অমিসহ এক নম্বর আসামি মদ্যপানের জন্য জোর করেন। আমি মদ্যপান করতে না চাইলে এক নম্বর আসামি জোর করে আমার মুখে মদের বোতল প্রবেশ করিয়ে মদ খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। এতে আমি সামনের দাঁতে ও ঠোঁটে আঘাত পাই। এক নম্বর আসামি (নাসির উদ্দিন মাহমুদ) আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন ও আমার শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে স্পর্শ করেন এবং আমাকে জোর করে ধর্ষণের চেষ্টা করেন। এজাহারে পরীমনি আরও বলেন, আমি প্রথমে জাতীয় জরুরি সেবা-৯৯৯ নম্বরে ফোন দিতে গেলে আমার ফোনটি কেড়ে নিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। এসময় দুই নম্বর আসামিসহ অজ্ঞাতনামা চারজন এক নম্বর আসামিকে ঘটনা ঘটাতে সহযোগিতা করেন। আমি অজ্ঞাতনামা আসামিদের দেখলে শনাক্ত করতে পারবো। তিনি আরও বলেন, দুই নম্বর আসামি অমি পরিকল্পিতভাবে আমাকে বর্তমান বাসা থেকে ঢাকা বোট ক্লাবে নিয়ে যান। তিনিসহ অজ্ঞাতনামা চারজন আসামি ও নাসির উদ্দিন মাহমুদ আমার শরীরের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে স্পর্শ করে ও জোরপূর্বক আমাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। আমি আমার সঙ্গীদের সহায়তায় ধর্ষকের হাত থেকে রক্ষা পাই।
গত ৪ আগস্ট ‘সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে’ অভিযান চালিয়ে পরীমনিকে তার বনানীর বাসা থেকে আটক করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। ওইদিনই রাত ৮টা ১০ মিনিটে পরীমনিকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে করে র‌্যাব সদরদপ্তরে নেওয়া হয়। সেখানে রাত ১২টা পর্যন্ত তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে র‌্যাব। পরদিন ৫ আগস্ট বিকেল ৫টা ১২ মিনিটে পরীমনি, চলচ্চিত্র প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ এবং তাদের দুই সহযোগী আশরাফুল ইসলাম দীপু ও সবুজ আলীকে কালো একটি মাইক্রোবাসে করে বনানী থানায় নেওয়া হয়। এরপর র‌্যাব বাদী হয়ে বনানী থানায় পরীমনি ও তার সহযোগী দীপুর বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করে। আলাদা মামলা হয় রাজ ও সবুজ আলীর বিরুদ্ধেও। ওইদিনই আলাদা মাদক মামলায় পরীমনি ও দীপুর সাতদিন এবং রাজ ও তার সহযোগী সবুজ আলীর সাতদিন রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। আদালত তাদের চারদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পরে মাদক মামলায় আরও দুই দফায় পরীমনিকে রিমান্ডে নেওয়া হয়। গত ৩১ আগস্ট ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশ পরীমনির জামিন মঞ্জুর করেন। মাদক মামলায় গ্রেফতার হওয়ার প্রায় এক মাস পর গত ১ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগার থেকে মুক্তি পান চিত্রনায়িকা পরীমনি। এর আগে গত ৪ অক্টোবর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক কাজী মোস্তফা কামাল আদালতে পরীমনিসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলার অপর দুই আসামি হলেন- আশরাফুল ইসলাম দিপু ও কবির হোসেন। আগামী ২ জানুয়ারি আলোচিত এ মামলার অভিযোগ গঠন শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। মামলা সূত্রে জানা যায়, পরীমনি ২০১৬ সাল থেকে মাদকসেবন করতেন। এজন্য বাসায় একটি ‘মিনিবার’ তৈরি করেন। সেখানে নিয়মিত ‘মদের পার্টি’ করতেন। চলচ্চিত্র প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজসহ আরও অনেকে তার বাসায় অ্যালকোহলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকের সরবরাহ করতেন ও পার্টিতে অংশ নিতেন। ২০১৪ সালে সিনেমায় ক্যারিয়ার শুরু করা পরীমনি এ পর্যন্ত প্রায় ৩০টি চলচ্চিত্র ও বেশ কয়েকটি টিভিসিতে অভিনয় করেছেন। পিরোজপুরের মেয়ে পরীমনিকে চলচ্চিত্র জগতে নিয়ে আসেন প্রযোজক রাজ।