র‌্যাবিস ভাইরাস প্রতিষেধক নেই সরকারি হাসপাতালে

আক্রান্তরা পৌরসভা আর ইপিআই সেন্টার ঘুরে ঘুরে হয়রান

0

বি এম আসাদ ॥ মঙ্গলবার বেলা ১১টায় যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের ইপিআই (সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি) বিভাগের চিত্র ছিল বিশৃঙ্খল। বিভাগের সুপারভাইজার মো. নুরুল হক নুরু যখন দাপ্তরিক কাজ সারছিলেন, তখন কুকুর ও বিড়ালের কামড়ে আক্রান্ত বিপুল সংখ্যক মানুষ র‌্যাবিস ভাইরাসের প্রতিষেধক এআরভি (অ্যান্টি-র‌্যাবিস ভ্যাকসিন) নেওয়ার জন্য তার কক্ষে ভিড় জমায়।

ভ্যাকসিন না পেয়ে আসা এই ভুক্তভোগীরা বিষণ্ন চিত্তে প্রশ্ন করেন, সরকারি হাসপাতালে অতি প্রয়োজনীয় এই ভ্যাকসিন কেন অনুপস্থিত?

জবাবে সুপারভাইজার নুরু জানান, সরকারি ভ্যাকসিনের সরবরাহ বর্তমানে নেই। যা মজুত ছিল, তা শেষ হয়ে গেছে। তিনি আক্রান্তদের পরামর্শ দেন যে, জরুরি প্রয়োজনে যশোর পৌরসভা অথবা বাজারের ফার্মেসি থেকে ভ্যাকসিন ক্রয় করে আনতে হবে। সেক্ষেত্রে হাসপাতালের ইপিআই বিভাগ থেকে সেটি পুশ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এই কথায় পুরোপুরি সন্তুষ্ট না হলেও জীবনের ঝুঁকি এড়াতে ফারহান আফরোজ, ওহিদুজ্জামানসহ অসংখ্য মানুষ ত্বরিত গতিতে ভ্যাকসিন সংগ্রহ করতে পৌরসভা বা বাজারের ফার্মেসির দিকে ছুটেন। গত কয়েকদিনে প্রায় ২০০-এরও বেশি কুকুর-বিড়ালে আক্রান্ত রোগী একই প্রক্রিয়ায় বাইরে থেকে ভ্যাকসিন কিনে এনে হাসপাতালের ইপিআই বিভাগের মাধ্যমে শরীরে পুশ করিয়েছেন।

গত শনিবার বেলা ১১টার দিকে যশোর পুলেরহাট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র সাব্বির হোসেনও অনুরূপ ভোগান্তির শিকার হয়। র‌্যাবিস প্রতিষেধক নিতে এসে সে জানায় তাকে কুকুরে কামড়েছে। ক্ষত স্থানে সাদা আঠালো দাগ দেখে সুপারভাইজার নুরুল ইসলাম নুরু তাকে জিজ্ঞাসা করেন, দাগটি সাদা কেন? সাব্বির জানায়, শুক্রবার বিকেলে কুকুরের কামড়ানোর পর ওইদিন সন্ধ্যায় যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গেলে চিকিৎসক তাকে পরের দিন ইপিআই বিভাগে যোগাযোগ করতে বলেন। তখন চিকিৎসা না নিয়ে বাড়িতে ফিরে সে ক্ষতস্থানে আকুন্দের আঠা লাগায়। পরে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী জরুরি চিকিৎসা শেষে নিয়মমাফিক ইপিআই বিভাগ থেকে এআরভি ভ্যাকসিন গ্রহণ করে। সাব্বির হোসেন পুলেরহাট কৃষ্ণবাটি গ্রামের লুৎফর রহমানের পুত্র।

সুপারভাইজার নুরুল ইসলাম নুরু নিশ্চিত করেছেন, প্রতিদিন প্রায় ২০০ জন লোক র‌্যাবিস ভাইরাসের ভ্যাকসিন নিতে হাসপাতালে আসছেন। এদের প্রায় সকলেই কুকুর ও বিড়ালের কামড়ে আক্রান্ত। মূলত শখের বশে বাসায় কুকুর-বিড়াল পোষার কারণে এবং তাদের আদর করতে গিয়েই তারা কামড়ের শিকার হচ্ছেন। আক্রান্তরা হাসপাতালে এলেও তাদের চাহিদা অনুযায়ী এআরভি ভ্যাকসিন দিতে পারছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। নুরু জানান, চাহিদার তুলনায় ভ্যাকসিনের সরবরাহ অত্যন্ত অপ্রতুল।

রোববার সদর উপজেলার সীতারামপুরের আকিমুদ্দিন, কচুয়া গ্রামের বিশ্বজিৎ এবং চৌগাছা উপজেলার জুয়েল রানা ভ্যাকসিন নিতে এসে সরকারি সরবরাহ না পেয়ে পৌরসভা থেকে ভ্যাকসিন কিনে এনে হাসপাতাল থেকে পুশ করিয়েছেন। শুধু এই তিনজন নন, শত শত ভুক্তভোগী একই প্রক্রিয়ায় হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

হাসপাতালের স্টোরকিপার গৌতম কুমার জানান, এআরভি ভ্যাকসিনের কোনো মজুত নেই। চাহিদা পাঠানো হলেও ঢাকা থেকে তা সরবরাহ করা যাচ্ছে না।

গত ১০ নভেম্বর থেকে হাসপাতালের ইপিআই বিভাগে এআরভি ভ্যাকসিনের সরবরাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রয়েছে। ফলে বাধ্য হয়ে ভুক্তভোগীরা চড়া মূল্যে বাজার থেকে ভ্যাকসিন কিনছেন। আক্রান্তদের মধ্যে শিশু-কিশোরদের সংখ্যাই সর্বাধিক, তবে বয়স্করাও রয়েছেন। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় তিনি বাসায় কুকুর-বিড়াল না পোষার জন্য জনগণের প্রতি পরামর্শ দেন। স্টোরকিপার গৌতম কুমার ঘোষ বলেন, ৫ হাজার ভ্যাকসিনের চাহিদার বিপরীতে তারা মাত্র ৪০০ ডোজ এআরভি পেয়েছেন, যা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য।

এদিকে পৌরসভা ভ্যাকসিন বিক্রি করলেও তাদের ১১ জন স্বাস্থ্যকর্মী তা পুশ করছেন না। ভ্যাকসিন পুশ করার জন্য রোগীদের হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে রোগীরা হাসপাতাল থেকেই ইপিআই বিভাগের মাধ্যমে তা পুশ করাচ্ছেন। ইপিআই সুপারভাইজার মো. নুরুল হক নুরু এই দ্বৈত নীতি নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, পৌরসভা ভ্যাকসিন বিক্রি করতে পারলেও রোগীর শরীরে তা পুশ করতে পারছে না। তিনি উল্লেখ করেন, ভ্যাকসিন পুশ করা নাগরিক সেবার আওতাভুক্ত।

এ বিষয়ে পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, পৌরসভার স্বাস্থ্যকর্মীদের ভ্যাকসিন দেওয়ার নিয়ম থাকলেও বর্তমানে তারা অন্য দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। তিনি জানান, কয়েকদিনের মধ্যে তারা আবারও এই কাজ শুরু করবেন।

বারবার চাহিদা দেওয়া সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন না পাওয়ায় কুকুর ও বিড়ালের কামড়ে আক্রান্ত শত শত মানুষের চিকিৎসা সেবায় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যশোর পৌরসভাতেও দীর্ঘ ৫ বছর কোনো ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হয়নি; সম্প্রতি তা শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিলাসিতার অংশ হিসেবে শখ করে কুকুর ও বিড়াল পোষার প্রবণতা থেকেই মূলত এই স্বাস্থ্য সমস্যার উৎপত্তি হচ্ছে। কুকুর-বিড়াল পোষার শখ এখন অনেক পরিবারের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিতে পরিণত হয়েছে।

সূত্র অনুযায়ী, চলতি বছরে (জানুয়ারি-অক্টোবর) কুকুর ও বিড়ালে আক্রান্তদের মোট ১৪,২১১ ডোজ এআরভি ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৫ হাজার ডোজের নতুন চাহিদা ঢাকা সিএমএসডি (সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরস ডিপো)-তে পাঠানো হলেও তা এখনো আসেনি। গত রোববার ৫ শতাধিক লোক ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছেন, যারা হাসপাতাল থেকে সরবরাহ না পেয়ে পৌরসভা থেকে প্রতি ভায়াল ৫৩০ টাকা মূল্যে কিনে এনেছিলেন।

স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান আসাদ জানান, যশোর পৌরসভা শহরবাসীর জনসেবার যথার্থ কেন্দ্র হলেও গত ৫ বছর ধরে এআরভি ভ্যাকসিন দেওয়া বন্ধ ছিল, যা এখন আবার শুরু হয়েছে। তিনি জানান, কুকুর-বিড়ালের কামড়ে আক্রান্ত রোগীরা র‌্যাবিস ভাইরাসে আক্রান্ত হন, যা একটি নিশ্চিত প্রাণঘাতী রোগ।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. হুসাইন শাফায়াত বলেন, বর্তমানে প্রায় ৮০ শতাংশ আক্রান্তই পোষা কুকুরের কামড়ে এবং ১০ শতাংশ পোষা বিড়ালের কামড়ে ভুক্তভোগী। বাকি ১০ শতাংশ পথঘাটের প্রাণীর কামড়ে আক্রান্ত। এমনকি গর্ভবতী মা-ও আক্রান্ত হচ্ছেন, যার ফলে মা’র দেহে থাকা র‌্যাবিস ভাইরাস রক্তের মাধ্যমে নবজাতকের দেহে প্রবেশ করে এবং জন্মের পর তার নিশ্চিত মৃত্যু হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিলাসিতা ও শখের বশে বাসাবাড়িতে কুকুর-বিড়াল পোষার কারণেই এই সংকট বেড়েছে। ডা. হুসাইন শাফায়াত বলেন, এসব প্রাণীর কামড়ে আক্রান্তরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসায় সরকারকে বিনামূল্যে ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে হচ্ছে। তবে ৫ হাজার চাহিদার বিপরীতে ৪শ ভ্যাকসিন সরবরাহ পাওয়ায় তিনি হতাশা প্রকাশ করে জানান, চাহিদার সঙ্গে প্রাপ্তির কোনো মিল নেই।

যশোরের সিভিল সার্জন ডা. মো. মাসুদ রানা জানান, কাঁচামালের ঘাটতির কারণে এআরভি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, আগামী বছরের শুরুতে এটি পাওয়া যাবে। পাশাপাশি তিনি জনগণকে সতর্ক করে বলেন, যে প্রাণী ক্ষতিকর এবং জীবনের জন্য হুমকি স্বরূপ, সে প্রাণী না পোষাই ভালো। তিনি মন্তব্য করেন, টাকা খরচ করে হাঁস-মুরগি পোষা বরং অনেক বেশি বুদ্ধিমানের কাজ।