চট্টগ্রাম বন্দরে মাশুল ‘বাড়ানোর’ উদ্যোগ, ব্যবহারকারীদের ‘না’

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ বিভিন্ন সেবার বিপরীতে মাশুল (ট্যারিফ) পুনর্নির্ধারণের উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষ। এবিষয়ে মতামত জানতে এরই মধ্যে বন্দর ব্যবহারকারীদের চিঠি দিয়েছে তারা। এছাড়া বিষয়টির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য গঠন করা হয়েছে একটি ‘পরামর্শক টিম’। মতামত জানতে তারা বন্দর ব্যবহারকারীদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছেন। তবে করোনা মহামারির এ সময়ে কোনো ধরনের মাশুল বাড়ানোর পক্ষে নন ব্যবহারকারীরা।
বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, বর্তমানে বিভিন্ন সেবার বিপরীতে যে মাশুল নেওয়া হচ্ছে তা ১৯৮৬ সালে নির্ধারিত হয়েছিল। তারপর থেকে আর কোনো মাশুল বাড়ানো হয়নি। সর্বশেষ ২০১৯ সালে একবার মাশুল পুনর্নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখনো ব্যবহারকারীরা এর বিরোধিতা করেছিলেন। এরপর সেই সময়ে বিষয়টি মন্ত্রণালয় পর্যন্ত গড়ায়। তবে মন্ত্রণালয়ের ‘গ্রিন সিগনাল’ পাওয়ার পরও নানা জটিলতায় সেবারও মাশুল হালনাগাদ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এরপর দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হয়। তবে সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় লকডাউন শেষে এখন মাশুল হালনাগাদ করতে চায় বন্দর কর্তৃপক্ষ।
মাশুল বাড়ানোর বিষয়ে বন্দর আমাদের কাছে মতামত চেয়েছিল। আমরা স্পষ্ট না বলে দিয়েছি। কারণ চট্টগ্রাম বন্দরের ফি এমনিতেই আশপাশের অন্যান্য বন্দরের তুলনায় বেশি। নতুন করে আর বাড়ানোর সুযোগ নেই। বন্দর বলছে তাদের সেবা-সক্ষমতা বেড়েছে। সুতরাং তাদের মুনাফাও বেড়েছে। বন্দরের উচিত, ট্যারিফ না বাড়িয়ে প্রযুক্তির মাধ্যমে অপারেশনাল কাজে গতি আনা
জানা গেছে, ২০১৯ সালের মতো এবারও বন্দর ব্যবহারে ১৫টি সেবার বিপরীতে বিভিন্ন উপখাতে মাশুল ৩৩ থেকে ৪৮৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে চায় কর্তৃপক্ষ। সেগুলো হচ্ছে- পোর্ট ডিউজ, পাইলটেজ ফি, বার্থিং-আনবার্থিং ফি, বার্থে অবস্থান, মুরিংয়ে অবস্থান, পানি সরবরাহ চার্জ, রিভার ডিউজ (প্রথাগত) ও ল্যান্ডিং অথবা শিপিং চার্জ (প্রথাগত), বন্দরের স্থান ব্যবহার ভাড়া (স্পেস রেন্ট), কনটেইনার বোঝাই ও খালাসকরণ, রিফার কনটেইনারসেবা, রিভার ডিউজ (কনটেনারাইজড), লিফট অন/লিফট অফ চার্জ (চট্টগ্রাম বন্দর), লিফট অন/লিফট অফ চার্জ (ঢাকা আইসিডি) ও ঢাকার আইসিডিতে কনটেইনারের স্টোরেজ ভাড়া।
এছাড়া নতুন করে পাঁচটি সেবায় মাশুল আরোপ করার প্রস্তাব করেছে বন্দর। সেগুলো হলো- হ্যাচ কভার হ্যান্ডলিং চার্জ, মোবাইল হারবার ক্রেন ব্যবহার করে পণ্য ওঠানো-নামানো চার্জ, হারবার ক্রেন ভাড়া, খালি কনটেইনার অপসারণ ও মোবাইল স্ক্যানার চার্জ।
ট্যারিফ হালনাগাদ করার জন্য আন্তর্জাতিক পরামর্শক টিম নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা ব্যবহারকারীদের সঙ্গে কথা বলছেন এবং তাদের মতামত নিচ্ছেন। বন্দরে বর্তমানে যে মাশুল নেওয়া হচ্ছে, তা ১৯৮৬ সালে নির্ধারণ করা। এর মধ্যে বন্দরে বিভিন্ন সেবার মান বেড়েছে, বিভিন্ন প্রযুক্তি সংযোজন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে বন্দরে সক্ষমতা বেড়েছে। সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে
বন্দর কর্তৃপক্ষের মাশুল বাড়ানোর উদ্যোগের বিষয়ে ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে দেশে দীর্ঘদিন লকডাউন ছিল। এ কারণে তারা এমনিতেই ক্ষতিগ্রস্ত। আবার গত ৩ নভেম্বর রাতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় ডিজেল-কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। এরপর থেকে বাড়তে থাকে বন্দর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধরনের ব্যয়। দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে ধর্মঘটের পরিপ্রেক্ষিতে শুরুতে পণ্য পরিবহনের ব্যয় বাড়ে।
এরপর হলেজ চার্জ, লিফট অন-অফ চার্জ, ইমপোর্ট হ্যান্ডলিং প্যাকেজ চার্জ, এক্সপোর্ট স্টাফিং প্যাকেজ চার্জ ও ভিজিএম চার্জসহ মোট পাঁচ ধরনের সেবায় ২৩ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশন (বিকডা)। ৪ নভেম্বর থেকে এটি কার্যকর ধরা হয়। বেসরকারি এসব আইসিডি হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের ৩৭ ধরনের আমদানি পণ্য ও প্রায় ৯০ শতাংশ কনটেইনারজাত রপ্তানি পণ্য হ্যান্ডলিং হয়।
অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ ও কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি বৈঠকে লাইটার জাহাজের ভাড়া ১৫ শতাংশ হারে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে মাদার ভেসেলে আসা পণ্য বহির্নোঙরে খালাস হয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট লাইটার জাহাজে দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। চট্টগ্রাম থেকে দেশের প্রায় ৩২টি রুটে এসব লাইটার জাহাজ চলাচল করে।
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, এসব ফি বাড়ানোর কারণে এমনিতে তাদের আমদানি-রপ্তানি ব্যয় অনেকাংশে বেড়ে গেছে। নতুন করে বন্দরের মাশুল যদি বাড়ানো হয়, তাদের অনেকের পক্ষে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে যাবে। যার প্রভাব পড়বে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে। পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে যাবে। দেশের অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
ব্যবসায়ীদের দাবি, চট্টগ্রাম বন্দরের অনেক ফি অন্যান্য দেশের বন্দরের তুলনায় বেশি। আবার বন্দর সরকারি প্রতিষ্ঠান। মাশুল বাড়িয়ে এটিকে এত বেশি লাভজনক করার দরকার নেই।
জানতে চাইলে বন্দর ব্যবহারকারী ফোরাম ও চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট মাহবুব আলম বলেন, মাশুল বাড়ানোর বিষয়ে বন্দর আমাদের কাছে মতামত চেয়েছিল। আমরা স্পষ্ট না বলে দিয়েছি। কারণ চট্টগ্রাম বন্দরের ফি এমনিতেই আশপাশের অন্যান্য বন্দরের তুলনায় বেশি। নতুন করে আর বাড়ানোর সুযোগ নেই। বন্দর বলছে তাদের সেবা-সক্ষমতা বেড়েছে। সুতরাং তাদের মুনাফাও বেড়েছে। বন্দরের উচিত, ট্যারিফ না বাড়িয়ে প্রযুক্তির মাধ্যমে অপারেশনাল কাজে গতি আনা।
তৈরি পোশাক কারখানা মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, সবদিকে শুধু বাড়ছে। এভাবে হলে তো ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়বে। কয়েকদিন আগে পণ্য পরিবহন, বেসরকারি আইসিডি ও লাইটার জাহাজের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এখন বন্দর মাশুল বাড়াতে চায়। এটা এখন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আমরা বলছি না, মাশুল একদম বাড়ানো যাবে না। এটার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষকে অন্তত দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে। এরপর তারা একটি সিদ্ধান্তে যেতে পারবে। তাছাড়া বন্দর সরকারি প্রতিষ্ঠান। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য স্বাভাবিক রাখতে তাদের ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করতে হবে। বন্দর চাইলে এখন উল্টো কিছু মাশুল কমিয়ে দিতে পারে।
বিভিন্ন সেবার খরচ বাড়ায় এখনই মাশুল বাড়ালে ব্যবসা করা কঠিন যাবে, বলছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ট্যারিফ হালনাগাদ করার জন্য আন্তর্জাতিক পরামর্শক টিম নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা ব্যবহারকারীদের সঙ্গে কথা বলছেন এবং তাদের মতামত নিচ্ছেন। বন্দরে বর্তমানে যে মাশুল নেওয়া হচ্ছে, তা ১৯৮৬ সালে নির্ধারণ করা। এর মধ্যে বন্দরে বিভিন্ন সেবার মান বেড়েছে, বিভিন্ন প্রযুক্তি সংযোজন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে বন্দরে সক্ষমতা বেড়েছে। সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের আমদানি ও রপ্তানির ৯২ শতাংশেরও বেশি পণ্য এবং ৯৮ শতাংশ কনটেইনারজাত পণ্য হ্যান্ডলিং করে। বন্দরে প্রতিদিন গড়ে প্রায় সাত হাজার কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়। আর রাজস্ব আদায় হয় দৈনিক হাজার কোটি টাকা।