প্রকৃত আসামি শনাক্তে ডাটাবেজ: অগ্রগতি জানতে চান হাইকোর্ট

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ প্রকৃত আসামি শনাক্ত করতে দেশের সব কারাগারের কয়েদিদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও আইরিশ স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে বায়োমেট্রিক ডাটা পদ্ধতি চালু করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। তারই পরিপ্রেক্ষিতে কারা কর্তৃপক্ষ হাইকোর্টে একটি প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, কারাগারে ডাটাবেজ সংরক্ষণ করা হয়। একই সঙ্গে কয়েকটি কারাগারে পাইলট প্রকল্প চালু করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি হাইকোর্টে আসার বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। এরপর কারাগারে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালু করা নিয়ে অগ্রগতি জানতে চান হাইকোর্ট। আগামী ১২ জানুয়ারির মধ্যে এ বিষয়ে সুরক্ষাসেবা ও জন নিরাপত্তা বিভাগের সচিব এবং কারা মহাপরিদর্শককে জানাতে হবে।
হাইকোর্টে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রকৃত আসামি শনাক্তকরণে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের সহযোগিতায় বন্দিদের ডাটাবেজ সংরক্ষণ করছে কারা কর্তৃপক্ষ। পাইলট প্রজেক্ট রয়েছে কাশিমপুর, কেরানীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ কারাগারে। শিশির মনির জানান, ১৮ নভেম্বর বিবাদীরা এ বিষয়ে আদালতে ব্যাখ্যাসহ প্রতিবেদন দাখিল করেন। সেখানে বলা হয়, এ বিষয়ে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) এবং কারা অধিদপ্তরের মধ্যে ডাটাবেজ ও তথ্য ব্যবহারের বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়। স্মারকে উল্লেখ করা হয়, ইতোমধ্যে ৪৫টি কারাগারের তথ্য সংগৃহীত হয়েছে। চলতি বছরের ৫ সেপ্টেম্বর কেরানীগঞ্জ, কাশিমপুর ও নারায়ণগঞ্জ কারাগারে এনটিএমসির পাইলট প্রজেক্ট চালু করা হয়। এই প্রতিবেদনের বিষয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে শুনানি শেষে এই আদেশ দেন।
আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী। এর আগে গত ২৮ জুন প্রকৃত আসামি চিহ্নিত করতে দেশের সব কারাগারের কয়েদিদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও আইরিশ স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে বায়োমেট্রিক ডাটা পদ্ধতি চালু করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। দুই সপ্তাহের মধ্যে স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব ও কারা মহাপরিদর্শককে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়। হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট ভার্চুয়াল বেঞ্চ সেদিন এ আদেশ দেন। চট্টগ্রামে একটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত এক নারী আসামির পরিবর্তে অপর একজনের কারাগারে যাওয়ার ঘটনায় মামলা সংক্রান্ত শুনানি নিয়ে এই আদেশ দেওয়া হয়। আদালতে ওই নারীর পক্ষে শুনানি করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মুহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ড. মো. বশির উল্লাহ। আর ওই মামলার তিন আইনজীবীর পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। এর আগে গত ৭ জুন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি কুলসুম আক্তার ওরফে কুলসুমীর পরিবর্তে জেল খাটা মিনুকে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এর পরে কারামুক্তি পান মিনু। পাশাপাশি এ ঘটনায় চট্টগ্রামের নারী শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২-এর স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর এম এ নাছের, আইনজীবী নুরুল আনোয়ার, আইনজীবী বিবেকানন্দ চৌধুরী ও আইনজীবী সহকারী সৌরভকে আদালতে হাজির হতে বলা হয়েছিল। আদালতের নির্দেশে তারা আদালতে উপস্থিত হন। সেদিন শুনানির সময় আইনজীবী শিশির মনির আদালতকে বলেন, গত দুই বছরে আমাদের দেশে এমন ২৬টি ঘটনা ঘটেছে। যেখানে একজনের নামে আরেকজন জেলে থাকে। এসময় শিশির মনির এ ধরনের ঘটনা রোধে দেশের জেলগুলোতে বিদেশের মতো বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালু করতে নির্দেশনা চান। আদালত রাষ্ট্রপক্ষের কথা শুনে এ বিষয়ে রুল দেন।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০০৬ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানায় রহমতগঞ্জ এলাকায় কোহিনুর আক্তার ওরফে বেবী নামে এক নারী খুন হন। এ ঘটনায় কোতোয়ালী থানায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে একটি খুনের মামলা করা হয়। ওই মামলায় কুলসুম আক্তার ওরফে কুলসুমী নামে এক নারী গ্রেফতার হন। ২০০৮ সালে এ মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা। ২০০৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কুলসুম আক্তার জামিন লাভ করেন। এ মামলায় ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত কুলসুমীকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। রায়ের দিন আসামি কুলসুম আক্তার ওরফে কুলসুমী আদালতে অনুপস্থিত থাকায় তার বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানাসহ গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। এরপর ২০১৮ সালের ১২ জুন মিনু নামে এক নারীকে সাজাপ্রাপ্ত আসামি কুলসুম আক্তার ওরফে কুলসুমী সাজিয়ে আত্মসমর্পণ করানো হয়। তখন আদালত মিনুকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠান। এরমধ্যে ২০১৯ সালের ২৩ এপ্রিল কুলসুম আক্তার হাইকোর্টে আপিল করেন। একই সঙ্গে জামিনের আবেদন করেন। এদিকে চলতি বছরের ২১ মার্চ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে একটি আবেদন করেন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার। আবেদনে তিনি বলেন, ২০১৮ সালের ১২ জুন কারাগারে পাঠানো আসামি প্রকৃত সাজাপ্রাপ্ত আসামি কুলসুম আক্তার ওরফে কুলসুমী নয়।
এ আবেদনের শুনানি শেষে কারাগারে থাকা মিনুকে আদালতের হাজির করে তার জবানবন্দি গ্রহণ করেন। তখন তিনি জানান, তার নাম মিনু, তিনি কুলসুম নন। তিনি বলেন, মর্জিনা নামে এক নারী তাকে চাল, ডাল দেবে বলে জেলে ঢুকায়। প্রকৃত আসামি কুলসুম আক্তারকে তিনি চেনেন না। কারাগারের রেজিস্ট্রার দেখে আসামি কুলসুমী এবং সাজাভোগকারী আসামির চেহারায় অমিল খুঁজে পান আদালত। তখন আদালত কারাগারের রেজিস্ট্রারসহ একটি উপনথি (কাগজপত্র) হাইকোর্ট বিভাগে আপিল নথির সঙ্গে পাঠিয়ে দেন। এ ঘটনাটি তখন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ঘটনাটির বিস্তারিত সংগ্রহ করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট এক বেঞ্চের নজরে আনেন। হাইকোর্ট বিষয়টি আমলে নিয়ে লিখিত আকারে বিষয়টি জানাতে নির্দেশ দিয়ে শুনানির দিন ঠিক করেন। কিন্তু এরই মধ্যে লকডাউন শুরু হলে আদালতের এখতিয়ার পরিবর্তন হয়ে যায়। পরে বিষয়টি নিয়ে বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চে উত্থাপন করেন আইনজীবী শিশির। শুনানিতে তিনি বলেন, আসল আসামি শনাক্তে অনেক পদ্ধতি আছে। আইবলিং পদ্ধতি আছে এতে শনাক্ত করলে কোনো ভুল হবে না। এ বিষয়ে আমি আরও লিখিতভাবে আদালতকে জানাবো। তবে মিনুর ঘটনার পেছনে একটি চক্র কাজ করছে সেটি তদন্তে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশনা দাবি করেন।
এ সময় আদালত বলেন, আমরা মনে করি এভাবে যদি আসল দোষী অর্থের বিনিময়ে হোক অথবা বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে নিজেকে বাঁচিয়ে অন্য নিরপরাধ লোককে জেলের মধ্যে আটক রাখে সেটা দুর্ভাগ্যজনক। যদিও অন্যের হয়ে তিন বছর কারাভোগ শেষে মুক্তি পাওয়া মিনু আক্তার গত ২৮ জুন রাতে চট্টগ্রাম মহানগরীর বায়েজিদ সংযোগ সড়কে দুর্ঘটনায় নিহত হন। সেই সময় পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় ময়নাতদন্ত শেষে তাকে দাফন করে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম। পরে তদন্ত শেষে জানা যায়, তিনি সেই আলোচিত মিনু আক্তার। ৪ জুলাই বায়েজিদ বোস্তামী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান জাগো নিউজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।