৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের মামলা না নেওয়ার নির্দেশনা নেই লিখিত রায়ে

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ধর্ষণের মামলা ৭২ ঘণ্টা পর না নেওয়ার পর্যবেক্ষণের জন্য বিচারিক ক্ষমতা হারালেও লিখিত রায়ে তা আর রাখেননি বেগম মোছা. কামরুন্নাহার। গত ১১ নভেম্বর ঘোষিত এ মামলার রায়ে ঢাকার ৭ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহার আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদসহ ৫ আসামিকে বেকসুর খালাস দেন। সেদিন রায় ঘোষণার সময় মৌখিকভাবে ধর্ষণের ৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের আলামত নষ্ট হয়ে যায়, তাই ৭২ ঘণ্টা পর মামলা না নেওয়ার জন্য পুলিশকে পরামর্শ দেন। রায়ের এ নির্দেশনার খবর প্রকাশিত হলে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা। ব্যাপক সমালোচনার জেরে গত ১৪ নভেম্বর বিচারককে বিচারকাজ না করার নির্দেশনা প্রদান এবং বিচারিক ক্ষমতা সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করে তাকে প্রত্যাহার করে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করা হয়। পরে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়।এদিকে মৌখিকভাবে উচ্চারণকৃত রায়ের অংশ বিষয়ে লিখিত রায়ে না থাকাকে প্রশ্নবিদ্ধ মনে করছেন আইনজীবীরা।
এ সম্পর্কে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর সিনিয়র আইনজীবী এহেসানুল হক সমাজী বলেন, একটি মামলা লিখিত রায়ই বিচারক ঘোষণা করে থাকেন। ঘোষণার সময় যে কথাগুলো বলেন, তা রায়েরই অংশ। যদি ধর্ষণের মামলা ৭২ ঘণ্টা পর না নেওয়ার নির্দেশনা তিনি (বিচারক) রায় ঘোষণার সময় বলে থাকেন এবং পরবর্তীতে প্রকাশিত লিখিত রায় সে অংশ না পাওয়া যায় তবে সেটা প্রশ্নবিদ্ধ রায় বলতে হবে। তবে মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, উভয় পক্ষের আইনজীবী এবং সকল মিডিয়ার সামনেই ‘৭২ ঘণ্টা পর মামলা না নেওয়া’ বিষয়টি মৌখিকভাবে ঘোষণা করেন। আদালতের মুখে যেটা বলেন, এটাই রায় বা রায়ের অংশ। যদি ঘোষিত রায়ে কোন গুরুত্বপূর্ণ অংশ লিখিত রায়ে না পাওয়া যায় সেটা বিচারকের প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। তবে এ বিষয়ে আসামি নাঈম আশরাফের পক্ষে আইনজীবী খায়রুল ইসলাম লিটন বলেন, রায় ঘোষণার সময় তিনি (বিচারক) ৭২ ঘণ্টা পর মামলা নেওয়া ও না নেওয়ার বিষয়ে যে কথা আলোচনা করেছিলেন তা রায়ের অংশ ছিল না। তাই লিখিত রায়ে তা আসেনি। বিষয়টিতে দোষের কিছু নেই।
এদিকে ইংরেজিতে লেখা ৫৪ পৃষ্ঠার এ মামলার লিখিত রায়ে ‘৭২ ঘণ্টা পর মামলা না নেয়ার’ বিষয়ে রায়ে কিছু উল্লেখ না থাকলেও ধর্ষণের মামলা করার সময় যদি বিষয়টি দেখা হয়, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে যদি মেডিক্যাল পরীক্ষা করা হয় (যেমনটি বহু মামলায় চিকিৎসকেরা মতামত দিয়েছেন) এবং ফরেনসিক পরীক্ষায় যদি প্রমাণ পাওয়া যায়; তখন ধর্ষণ মামলায় তা গুরুত্বপূর্ণ নথি বলে গণ্য হয়। তখন ধর্ষণ মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচার নিশ্চিত করা যায় এবং ন্যায়বিচার সর্বোত্তমভাবে করা সম্ভব হয়। এই ট্রাইব্যুনাল বহু ধর্ষণ মামলা দেখেছেন। প্রাপ্তবয়স্ক ও যৌনজীবনে অভ্যস্ত নারী বিচারের জন্য আসেন, যেখানে কথিত অপরাধ সংঘটিত হওয়ার অনেক দিন পর তাদের মেডিক্যাল পরীক্ষা হয় এবং অনেক দিন পর মামলা হলে যৌন সহিংসতার প্রমাণ পাওয়া যায় না। রায়ে বিচারক বলেছেন, এই মামলায় প্রাপ্তবয়স্ক বাদীদের যদি ঘটনার পরপর বা দ্রুততম সময়ের মধ্যে ডাক্তারি পরীক্ষা হতো, তাহলে ধর্ষণের চিহ্ন বাদীদের পক্ষে যেত। এমনকি তারা যদি পরদিন অথবা ঘটনার পরপর মামলা করতেন, তাহলে পুলিশ যৌন সহিংসতার কারণে আঘাতের চিহ্ন তাদের মুখে; গালে বা শরীরের অন্য কোথাও পেত। মামলার ভিকটিমরা ৩৮ দিন পর মামলা করেন ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে এই ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। রায়ে বলা হয়- সাক্ষ্য-প্রমাণে দেখা যায়, ভিকটিমরা মামলা করতে যাননি; বরং আসামি সাফাতের সাবেক স্ত্রী ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসার তাদের সঙ্গে নিয়ে থানায় মামলা করতে যান। বিষয়টি এ মামলাকে সাজানো মামলায় পরিণত করেছে। বাদীপক্ষ যে সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করেছে, তা অসংগতি ও অসামঞ্জস্যতায় পূর্ণ এবং সাক্ষ্যপ্রমাণকে বিশ্বাসযোগ্য করে না। এমন সাক্ষ্যপ্রমাণ মূল্যহীন, যা মামলাটির শিকড়ে আঘাত করেছে। সংশয় তৈরি করেছে। বাদী পক্ষ সংশয়ের ঊর্ধ্বে মামলাটিকে প্রতিষ্ঠায় হতাশাজনকভাবে ব্যর্থ হয়েছেন।