ফাঁসির খবর না জেনেই আপিলে আইনজীবী, ভুলের দায় নিয়ে ‘ধাক্কাধাক্কি’

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার হত্যার ঘটনায় আসামি মোকিম ও ঝড়ুর করা নিয়মিত আপিল আবেদনটির শুনানি আজ অনুষ্ঠিত হয়েছে। যেটিতে গত বুধবার (৩ নভেম্বর) তাদের পক্ষের আইনজীবীদের দাবি ছিল হত্যার ঘটনায় আসামি মোকিম ও ঝড়ুর আপিল নিষ্পত্তির আগেই তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। শুনানিতে সেইসব বিষয় আলোচনায় এসেছে।
আজ শুনানিতে নিশ্চিত হলো- জেল আপিল করার পর সেটি নিষ্পত্তি করে নিয়ম অনুযায়ী দুইজনের ফাঁসি কার্যকরের পরও আসামির নিয়মিত আপিল শুনানির তালিকায় উঠেছিল। সেটি নিয়ে গণমাধ্যমকে আইনজীবীর জানানো এবং সেই ভুলের দায় নিয়ে আদালতে ‘ধাক্কাধাক্কি’ হয়েছে। আসামির আইনজীবী বলছিলেন, এ ঘটনায় কারা কর্তৃপক্ষের দায় থাকতে পারে। আবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বলছেন, ২০১৬ সালের ১৫ অক্টোবর ওই আসামিদের করা জেল আপিল নিষ্পত্তির পরে নিয়ম অনুযায়ী তাদের মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করা হয়েছিল। সেখানে কর্তৃপক্ষের দায় কীভাবে থাকে? যদিও আসামিপক্ষের আইনজীবীর দাবি ছিল, ভুক্তভোগীর পরিবারের পক্ষ থেকে করা আপিল আবেদনটি শুনানির জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার পর তারা স্বজনদের কাছ থেকে জানতে পারেন, চার বছর আগে ২০১৭ সালে দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। গণমাধ্যমকেও জানান এমন তথ্য। তবে সব নিয়ম মেনেই রায় কার্যকর হয়েছে এবং বিষয়টি নিয়ে আইনজীবীর আরও খোঁজ-খবর নেওয়া উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
এমন প্রেক্ষাপটে আদালত আপিল আবেদনকারী আইনজীবীদের দিকেই প্রশ্ন তুলেছেন। আদালত বলেন, জেল আপিল থাকার পরে নিয়মিত আপিল আবেদন করার পর তো সেটি কনভার্সন করে নিতে হয়। আদালতকে জানানো যে, আমরা রেগুলার (নিয়মিত) আপিল করছি, আমাদের এটা জেল আপিলের সঙ্গে কনভার্সন করে নেন। জেল আপিল তো মেরিটে শুনানি হয়েছে। তখন আইনজীবী বলেন, ঠিক আছে, তবে দুটি ট্যাগ হওয়া উচিত ছিল। নির্ধারিত দিনে রোববার (৮ নভেম্বর) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ভার্চুয়াল বেঞ্চে বিষয়টি শুনানিতে এমন মন্তব্য করা হয়। এর পরে শুনানি ও আদেশের জন্য মঙ্গলবার (৯ নভেম্বর) দিন ঠিক করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আদালতে আজ রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। তার সঙ্গে ছিলেন ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ, ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ। অন্যদিকে আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. আসিফ হাসান, অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড সুফিয়া খাতুন। আপিল বিভাগের তালিকায় থাকা ২৬ নম্বর আইটেমটি কল করলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন আদালতকে বলেন, এই মামলাটা তালিকায় আসার পর পত্র-পত্রিকায় দেখলাম, আপিল পেন্ডিং থাকা অবস্থায় ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এটা শোনার পরে আমরা খোঁজ নিয়ে দেখলাম, তারা জেল আপিল ফাইল করেছি। আমরা সেই রায়ের সার্টিফাইড কপি দেখলাম। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, জেল আপিলে অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড ছিলেন নাহিদ সুলতানা। এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, এখানে আপিলকারি প্রথমজনের নাম কী? জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ঝড়ু। তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, এ মামলার জেল আপিল নম্বর ০৩/২০১৬। শুধু তাই নয়, এ মামলার পেপারবুক তৈরি হয়েছে কোর্টের মাধ্যমে। এর পরে ২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর শুনানিও হয়েছে। পরে ওই দিনই রায় দেওয়া হয়। সেখানে ১৪ পৃষ্ঠার রায় ঘোষণা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন আসামির আপিল দায়েরকারী অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড সুফিয়া খাতুনকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনি কি এটা জানেন না? যখন জেল আপিল করে তখন একটা আবেদন দিয়ে দুটি (জেল আপিল ও নিয়মিত) আপিল এক সঙ্গে কনভার্সন করে নিতে হয়। আদালতে জানানো যে, আমরা রেগুলার (নিয়মিত) আপিল করছি, আমাদের এটা জেল আপিলের সঙ্গে কনভার্ট করে নেন। তখন আইনজীবী সুফিয়া খাতুন বলেন, এ মামলায় ক্লায়েন্ট আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি। কোনো ফাইলও দেয়নি। মামলা যিনি দিয়েছেন তাকে যথা সময়ে জানিয়েছি। কিন্তু তারপর আর কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। ওই সময় আইনজীবী রুহুল আমিন তুহিন তিনি এ মামলার আইনজীবী বলে জানিয়েছিলেন। তিনি ছাড়া আর কোনো ক্লায়েন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। আসামির পরিবারের কারোর সঙ্গেও যোগাযোগ হয়নি। তাছাড়া দুটি আপিল হলে তো সেকশনই যোগ করে দেয়।
প্রধান বিচারপতি বলেন, সেকশন তো যোগ করে না। আমাদের এখানে তো ডিজিটাল সিস্টেম না। বরং আপিলকারী আইনজীবী এসে বলেন, যে এটা ওইটার সঙ্গে ট্যাগ করেন। মামলায় ক্লায়েন্টদের যখন যোগাযোগ থাকে তখনই আমরা এলার্ট হই। তখন জেল আপিলে অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড নাহিদ সুলতানা কীভাবে হলেন প্রশ্ন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল। এসময় প্রধান বিচারপতি বলেন, এটা হয়তো কোর্ট থেকে নিয়োগ দিয়েছে। সুফিয়া খাতুন বলেন, এটা তাহলে নাহিদ সুলতানারও দায়িত্ব ছিল আপিলের বিষয়টি বলে দেওয়া। এই পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল জেল আপিলে আইনজীবী নাহিদ সুলতানা কী বক্তব্য আদালতে দিয়েছিলেন সেটা পড়ে শোনান। ওই সময়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. আসিফ হাসান আদালতে যুক্ত হন। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, মামলায় আপিল বিভাগের রায় হয়েছে ২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর। এর পরে ২০১৭ সালের ২২ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি ক্ষমা প্রত্যাখ্যান করেছেন। আর কারা কর্তৃপক্ষ তার পরিবারকে দেখা করার জন্য চিঠি দেয় ২০১৭ সালের ১২ নভেম্বর। চিঠির পর তাদের পরিবারের সদস্যরা সাক্ষাতও করেছেন। জড়ুর পরিবারের ৯ জন এবং মোকিমের পরিবারের পাঁজন দেখা করেছে। এরপরে রায় কার্যকর হলো ১৭ নভেম্বর। রায়ের এক বছর পরে কারা কর্তৃপক্ষ তাদের চিঠি দেয়। এই এক বছর পর্যন্ত আসামিপক্ষের আইনজীবীরা কিছুই করলেন না। এতটা সময় পেলো তারপরও তার কোনো আইনজীবী কিছুই জানায়নি। এসময় আসামিপক্ষের আইনজীবী আসিফ হাসান বলেন, গত দুই সপ্তাহ আগে আইনজীবী হুমায়ন কবির আমাকে এই মামলায় যুক্ত করেন। তিনি এ মামলাটি করে দিতে বলেছিলেন। পরে আমি বললাম তুমি মামলায় আসামিদের পরিবারের খোঁজ নাও। আমি একটু পড়ে দেখি। এরপর মামলাটি নিয়ে আমি প্রস্তুত হলাম। আইনজীবী আসিফ বলেন, ওই দিন রাত ১১ টার দিকে আইনজীবী হুমায়ন কবির আমাকে জানান, এ মামলায় আসামিদের সাজা কার্যকর হয়ে গেছে। আইনজীবী হুমায়ুন কবির ওই এলাকার বাসিন্দা। তিনি আপিলে অ্যানরোল না থাকায় ২০১৩ সালে আইনজীবী নওয়াব আলী সাহেবকে দিয়ে ফাইল করেছিলেন। তিনি তো নাই (মারা গেছেন)।
‘ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টি শুনে আমি বললাম অসম্ভব, এটাতো হতে পারে না। আপিল পেন্ডিং থাকা অবস্থায় এটা কীভাবে কার্যকর হয়। তখন আমি আইনজীবী হুমায়ুন কবিরকে বললাম, তুমি আরও খোঁজ নাও। তারপর তিনি বার বার খোঁজ নেওয়ার পরে নিশ্চিত হলেন আসামিদের ফাঁসি কার্যকর হয়ে গেছে।তখন আমি তাকে বললাম ঠিক আছে আমি কোর্টকে জানাই। এটা তো হতে পারে না। শত বছরেও এমনটি হয় না। পরবর্তীতে পত্র-পত্রিকা ও অ্যাটর্নি জেনারেল থেকে জানলাম এটাতে জেল আপিল দায়ের করা হয়েছিল। আসামির পরিবারের সদস্যরা অশিক্ষিত, অজপাড়াগায়ের। তারা জেল আপিল কী তাও মনে হয় বোঝে না। তারা নাকি জেলখানায় গিয়েছিল দেখা করে কান্না করতে করতে বাড়ি চলে গেছে।’ এ সময় আপিল বিভাগের অপর বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, মিস্টার আসিফ বলেন তো দেখি এখানে প্রসিডিউটর মেইনটেইন হয়ে কি না? জবাবে আইনজীবী আসিফ বলেন, একটু ইয়ে আছে। যেহেতু আমাদের কোর্টের একটা রুলস আছে। বিচারপতি বলেন, আপিল শুনানি শেষে রায়, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সব কিছু হয়েছে কি না? আইনজীবী বলেন, এগুলো হয়েছে। তবে কারাকর্তৃপক্ষের আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। কারণ, সুপ্রিম কোর্ট রুলস অনুযায়ী বর্তমান আপিলের নোটিশটা অবশ্যই জেলখানায় গেছে। ২০১৩ সাল থেকে ফাঁসি কার্যকর পর্যন্ত চার বছরে এটা পৌঁছাবে না এটা অসম্ভব ব্যাপার। এটা তো অবশ্যই গেছে। তাদের উচিত ছিল, যেখানে একজন মানুষের জীবন নিচ্ছে তাদের সতর্ক হওয়া। তখন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, তাদের যেমন উচিত ছিল, অ্যাডভোকেটের কি উচিত ছিল না? যখন জেল আপিল নিষ্পত্তি হয়ে গেলো। এটা তো আমরা জানতে পারিনি। কেউ জানায়নি। এসময় আপিল বিভাগের বিচারপতি নূরুজ্জামান বলেন, আপিলটা ফাইল করেই তো আপনার একটা দরখাস্ত করবেন স্টে নেওয়ার জন্য। আইনজীবী বলেন, মাই লর্ড আমরা ফাইল করলেই ধরে নেই যে ইনফর্ম হয়ে গেছে। বিচারপতি বলেন, তাহলে স্টে করার বিষয়টি কেন আসে? প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনার অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড আইনজীবী বক্তব্য হলো তার সঙ্গে কেউ যোগাযোগই করেনি।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, গতকাল একটা মামলায় রাষ্ট্রপতি এরই মধ্যে তার ক্ষমার আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন। তারপরও আইনজীবী যখন বিষয়টি আপিল বিভাগে জানালেন আমরা কিন্তু তখন ফাঁসি কার্যকর স্থগিতের আদেশ দিয়েছি, রিভিউ দেখবো বলে। তিনি বলেন, একটা মানুষের ফাঁসি হয়ে যাবে, আমরাই হয়তো আদেশ দিয়েছি। কিন্তু শেষ চেষ্টা তাকে করতে দেওয়া উচিত। প্রধান বিচারপতি বলেন, আপিল বিভাগে অ্যানরোল না হয়েও যখন অন্য একজনকে দিয়ে মামলা ফাইল করেছেন তখন তিনি যদি আপিলের পদ্ধতি না জানেন তখন মহামুশকিলের কথা। তখন আইনজীবী আসিফ বলেন, আমরা যখন আপিল ফাইল করি তখন অটোমেটিক্যালি ফাঁসির কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। এটা অর্ডার ২৪ রুলস ৫ এ আছে। আইনজীবী বলেন, মানুষের ভুল হতেই পারে। পৃথিবীতে এমন কেউ নাই যার ভুল হয় না। এটা হতেই পারে। কিন্তু আমাদের চাওয়া হচ্ছে জেল কর্তৃপক্ষ আরও সতর্ক হোক। তাদের আরও একটু যাচাই বাছাই করা উচিত ছিল। প্রধান বিচারপতি বলেন, জেল আপিল তো মেরিটে শুনানি হয়েছে। আইনজীবী বলেন, ঠিক আছে, তবে দুটি ট্যাগ হওয়া উচিত ছিল। প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা যখন আইজীবী ছিলাম জেল আপিল যখন থাকে আমরা তখন সেটি কনভার্সন করেছি। এই প্র্যাক্টিস তো এখন টোটাল বন্ধ হয়ে গেছে। আইনজীবী বলেন, এটা এখনো করছি। যখন জানতে পারি জেল আপিল আছে তখন সেটি ট্যাগ করে দেয়। সময়মতো আমাদের আপিলটা ফাইল হয়েছে তারপরও কেন এমনটি হলো। তারপরও কষ্ট হচ্ছে মানুষের জন্য কিছু করতে পারলাম না। আমরা দুজন মানুষের জন্য চেষ্টা করতাম। জেল আপিলের আমরা কিছুই পাইনি। তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ বলেন, এটা রিপোর্টেড রায়। রায়টি ৫৯ ডিএলআরে আছে। আইনজীবী বলেন, মাই লর্ড এ বিষয়ে একটা গাইডলাইন দিয়ে দেন। সঙ্গে সঙ্গে এই গরিবদের জন্য যদি কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায়। বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, এই ক্ষতিপূরণ কিসের জন্য?বিচারপতি নূরুজ্জামান বলেন, যে আইনজীবী ভুল করেছেন তাকে বলেন। তিনি কিছু দিয়ে দিক। এটা তো কথা না। তখন বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী আইনজীবী আসিফ হাসানের কাছে জানতে চান, জেল কর্তৃপক্ষের দোষটা কোথায়? আপিল বিভাগ থেকে অন ম্যারিটে জাজমেন্ট হয়েছে, সেটা কমিউনিকেশন হইছে। মাহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রর্থানা খারিজও হয়েছে, পরে রায় কার্যকর করা হয়েছে। আইনজীবী আসিফ হাসান তখন বলেন, আইনগত কোনো ভুল নাই।
বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী তখন বলেন, তাহলে জেল কর্তৃপক্ষকে দায়ী করছেন কেন? আইনজীবী আসিফ হাসান বলেন, দেশে এই ধরনের মানুষের জন্য ঘটনাটি সামনে আনা উচিত। এরা অশিক্ষিত, মুর্খ। বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, যেহেতু মামলা লিস্টে (কার্যতালিকায়) আসছে, শুনানি হয়েছে, উচিত ছিল অ্যাপিয়ার করা। জেল আপিলের সঙ্গে এটা ট্যাগ করে দিতে পারতেন। আপনারা দোষটা স্বীকার করেন না কেন? আসিফ হাসান বলেন, এমন একটা মক্কেল, এমনিই মুর্খ এবং গরিব মানুষ এরা, আইনজীবীকে জানায়ওনি যে কখনো জেল আপিল হয়েছে বা করেছে তারা। আদৌ তারা জেল আপিল বোঝে কি না সন্দেহ আছে। বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, এটা তো কোনো ব্যাখ্যা না। জেল আপিল হয়েছে, শুনানি হয়েছে, রিপোর্টেড হয়েছে। আসিফ হাসান বলেন, আইনগতভাবে সবই ঠিক আছে। বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, রায় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই আপিলটা (ফৌজদারি আপিল) ইনফেকচ্যুয়াস (অকার্যকর) হয়ে গেছে। অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, আপিল বিভাগে এরা তিনজনই আছে। বিচারপতি ওবায়দুল হাসান আইনজীবী আসিফ হাসানকে উদ্দেশ্য করে বলেন, যে কথাটা বলেছেন, উনি সিনিয়ির মানুষ। আমরা সবাই আইনজীবী থেকে এখানে এসেছি। প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে সবাই আইনজীবী ছিলেন। যার অবহেলা (ফাঁসি কর্যকর হওয়া ব্যক্তির ফৌজদারি আপিল কার্যতালিকায় আসার ক্ষেত্রে) সে আইনজীবী।
বিচারপতি আরও বলেন, যার জীবন গেলো সে অভিযুক্ত এবং দণ্ডিত। নিচের (বিচারিক) আদালতে দণ্ডিত, আপিল বিভাগেও দণ্ডিত সব ধরনের প্রক্রিয়ায়। জেলখানায় তাদের স্বজনরা দেখা করলো, সবকিছুই হলো, পত্রিকায় যেভাবে নিউজটা আসলো আপনাদের এগিয়ে আসা উচিত ছিল। এগিয়ে এসে বলা উচিত ছিল ঘটনাটা ওই রকম না এরকম। আইনজীবী আসিফ হাসান এসময় বলেন, সেইটা বলার জন্যই আমি অপেক্ষা করছি। বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, আপনারা কিছুই করেননি। আমরাও অ্যাডভোকেট ছিলাম। আজকে আপনি বলছেন, জেলখানা কর্তৃপক্ষকে দায়ী করা, তাদের সতর্ক করা। তারা যথেষ্ট সতর্ক থাকে, তারা কিন্তু বিষয়গুলোকে ফলো করে এবং তাদের রেকর্ড ঠিক থাকে।তিনি বলেন, দেখেছি, রেকর্ডে খুব একটা ভুল হয় না। আমাদের ভুলের কারণে, আমাদের বলতে অ্যাডভোকেটদের ভুলের কারণে অনেক সময় এরকমটা হয়। আমরা (বিচারপতিরা) কোর্টে বসে থাকি, আডভোকেট অন রেকর্ডরা আসেন না। বারবার বলা হচ্ছে, অ্যাডভোকেট অন রেকর্ডরা আসেন না। কী ধরনের দায়িত্ব বলেন? আইনজীবী আসিফ হাসান বিচারপতির কথায় সমর্থন জানিয়ে বলেন, এরকম হচ্ছে। তখন বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী আইনজীবী আসিফ হাসানের কাছে জানতে চান জেল কর্তৃপক্ষের দোষটা কোথায়? অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বিচারপতিদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনারা অন্তত রায়টা (আপিল বিভাগের) তো দেখেছেন, অ্যাডজাস্টিং জাজমেন্ট (সমন্বিত রায়)। জবানবন্দি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এসময় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, আচ্ছা, এখন এটা থাকুক। এসময় বেঞ্চের বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, আমাকে বাদ দিয়ে দেন, যেহেতু আমি এ মামলার ফাইলিং লইয়ার ছিলাম। প্রধান বিচারপতি বলেন, বলা হয়েছে যে, আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল সাহেব খবর নিলেন, আমার এখানে আসলেন রাতে।
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘আমি সঙ্গে সঙ্গে জেল কর্তৃপক্ষের ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। উনারা আমাকে একদম চার্জশিট পাঠাইছে, নম্বর পাঠাইছে, আপনাদের আদেশ দেখছি, দেখলাম যে, না এটা (অভিযোগ) ঠিক না যেভাবে আসছে এটা ঠিক না। সাংবাদিকদের প্রপার ইনফরমেশন দেওয়া হয় নাই।’ এ সময় বিচারপতি নূরুজ্জামান বলেন, এক মানুষ এটা (আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় আসামির ফাঁসি কার্যকরের খবর) পত্রিকায় দেখে আমাদেরকে, কোর্টকে কত সমালোচনা করেছে। তারা কি ভেতরের এসব ঘটনা জানে? টকশোতে কত কথা বলা হচ্ছে। বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, কেন করবে না, টকশো তো হয়েছে। আইনজীবী আসিফ হাসান বলেন, এসব (জেল আপিল নিষ্পত্তির পর রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন নাকচের পর ফাঁসি কার্যকর করার কথা) কারোরই জানা ছিল না। বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল সাহেব আপনার কলিগরা, অ্যাডভোকেট সাহেবরা, তারা কমেন্ট করছেন। তারা কোনো কিছু না দেখে কমেন্ট করছেন, এটা কি ঠিক হলো? বিচারপতি নুরুজ্জামান বলেন, অ্যাডভোকেট শিশির মনির কি আপিল বিভাগে তালিকাভূক্ত? সে যেভাবে মন্তব্য করেছে যে, সবাই দোষী। অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস, কোর্ট, বিচারক, এক্সিকিউট যারা করেছে তারা সবাই দোষী। উনি কিছু না দেখে কেন এরকম মন্তব্য করলেন? আমাদের সবারই মনে রাখতে হবে আমরা কেউ প্রিজাডিং অফিসার, কেউ কোর্ট অফিসার। তিনি বলেন, এরকমভাবে কোর্টকে অ্যাটাক করা, এটা তো খুব খারাপ স্ট্যান্ড। প্রয়োজনে তো সবাই কোর্টে আসে, সবাই রিলিফ নেয়, সবাই রিলিফ পায়। কোর্টের কোনো সামান্যতম ত্রুটি হইলেই এরকম করে অ্যাটাক করা, এটা তো খুবই দুঃখজনক। আমরা তো কোনো অ্যাডভোকেট সাহেবকে এরকমভাবে অ্যাটাক করি না, পানিশমেন্ট দেই না। আমরা তো চেষ্টা করি কোনো একটা ভুল হলে ভুলটা শুধরিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়।
মামলার বিবরণে জানা গেছে, আসামি মোকিম ও ঝড়ুর বাড়ি চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায়। ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন একই এলাকার সাবেক মেম্বার মো. মনোয়ার হোসেন খুন হন। ওই ঘটনায় তার চাচাতো ভাই মো. অহিমউদ্দিন বাদী হয়ে ২৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার এজাহারে মোকিম ও ঝড়ুর নাম আসে। পরে ২০০৮ সালের ১৭ এপ্রিল এ মামলার বিচারে তিনজনের মৃত্যুদণ্ড, দুইজনকে যাবজ্জীবন ও অপর আসামিদের খালাস দেন চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত-২। মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রাপ্তরা হলেন- একই ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ, মোকিম ও ঝড়ু। এরপর বিচারিক আদালতের রায়ের পর নিয়ম অনুসারে আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য মামলাটি হাইকোর্টে আসে। মামলার ডেথ রেফারেন্স নম্বর ছিল ৩৯/২০০৮। শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট মোকিম ও ঝড়ুর মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে ২০১৩ সালের ৭ জুলাই ও ৮ জুলাই মামলার রায় ঘোষণা করেন। বাকি আসামিদের খালাস দেন হাইকোর্ট। পরে মোকিম ও ঝড়ু সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেন। আইনজীবী হুমায়ুন কবীর বলেন, মোকিমের পরিবার জানায়, ২০১৭ সালে মোকিমের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এমনকি অপর আসামি ঝড়ুর মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর হয়েছে। যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ সুপার মো. কামাল হোসেন সই করা এক ডকুমেন্টে জানা যায়, ২০১৬ সালের ২৬ অক্টোবর মামলায় বিচারিক আদালত, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের আলোকে একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন। এরপর যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর রাতে আসামি দুজনের ফাঁসি হয়। এদিকে যশোর কারা কর্তৃপক্ষ থেকে জেলার তুহিন কান্তি খান সাংবাদিকদের জানান, খুলনা অঞ্চলের আওতাধীন যশোর কারাগারে ফাঁসি কার্যকর হয়েছিল। কারাগার থেকে আরও জানানো হয়, হাইকোর্ট মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের পর মোকিম ও ঝড়ু জেল থেকে আপিল করেছিল। সেটি খারিজ করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর দুজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ তাদের আপিল নিষ্পত্তি করে রায় দেন। বেঞ্চের অপর সদস্য বিচারপতি হলেন- বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন (বর্তমান প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।