‘ক্রিকেট শুধু সাদা চামড়া’র মানুষের খেলা নয়’

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ আফ্রিকান দেশ নামিবিয়া। এই প্রথমবারেরমত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলতে এসেছে তারা। বিশ্বকাপে প্রথম এসেই বাজিমাত। আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডসের মত দেশকে পেছনে ফেলে বাছাই পর্ব শেষে সুপার টুয়েলভে খেলছে তারা। সুপার টুয়েলভেও চমক দেখিয়েছে তারা। বাংলাদেশকে হারানো স্কটল্যান্ডকে পরাজিত করেছে বিশ্বকাপে নবাগত দেশটি।
নামিবিয়া- আফ্রিকান দেশ, কথাগুলো শুনলেই যে কারো চোখের সামনে ভেসে উঠবে, একদল কালো মানুষের চেহারা। কিন্তু অবাক করে দেয়ার মত তথ্য হলো, নামিবিয়ান ক্রিকেট দলে একজনও কালো মানুষ নেই। সবই সাদা চামড়ার। কিভাবে আফ্রিকান দেশটিতে সবাই সাদা চামড়ার ক্রিকেটার? কিভাবে এতদুর এলো নামিবিয়ানরা, ভবিষ্যতের চিন্তাই বা কী- এসব নিয়ে ক্রিকইনফোর মুখোমুখি হয়েছিল নাবিমিয়া ক্রিকেট দলের অধিনায়ক গেরহার্ড ইরাসমাস। বিশ্বকাপ শুরুর আগে প্রস্তুতি ম্যাচে খেলতে গিয়ে ডান হাতের আঙ্গুলের আংটি ভেঙে গিয়েছিল ইরাসমাসের। আঙ্গুলে অনেক বড় চোটও পেয়েছিলেন তিনি। সুতরাং, বিশ্বকাপে তিনি রিস্ক নিয়ে খেলবেন নাকি ফিরে গিয়ে আঙ্গুলের চিকিৎসা করাবেন- দুটো অপশনই খোলা ছিল তার সামনে। কিন্তু ইরাসমান থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ঝুঁকি নিয়েই খেলার জন্য থেকে যান। ইরাসমান বলেন, ‘প্রাথমিক পরীক্ষা-নীরিক্ষায় যেটা উঠে এসেছে, তাতে বলা হয়েছে অপারেশন করতে হবে একটি এবং এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু আমি বেশ কয়েকটি পেইন কিলার ইনজেকশন নিলাম এবং খেলে যাচ্ছি। ব্যাটের গ্রিপ ধরার জন্য অন্য আঙ্গুলের ব্যবহার করি।’
এমন বিপদ সত্ত্বেও মানসিকভাবে বেশ শক্ত রয়েছেন ইরাসমাস। তিনি বলেন, ‘মানসিকভাবে আমি খুবই শক্তিশাল ছিলাম। যদিও ব্যাটিং কিংবা ফিল্ডিং করার সময় শারীরিকভাবে পুরোপুরি সুস্থবোধ করছি না। তবে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ হলে কোনোকিছুর দিকেই তাকানোর সুযোগ পাওযা যায় না। বিশ্বকাপের মত টুর্নামেন্টে এসে এটা গেরহার্ড ইরাসমাসের জন্য বড় একটি শিক্ষা। কারণ, নামিবিয়ার ক্রিকেট এখন তাদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছে। দুই বছর আগেও যাদের ওয়ানডে খেলার মর্যাদা ছিল না। যে কারণে, নামিবিয়ানরা বিশ্বকাপের মত আসরে কিভাবে আসবে, তা নিয়ে ছিল বড় ধরনের একটি সংশয়। নামিবিয়ার হয়ে এবারের বিশ্বকাপে খেলেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক ক্রিকেটার ডেভিড ওয়াইজ। জাতিগত কারণে দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে নামিবিয়ার নাগরিকত্ব নেন ওয়াইজ। যিনি পিএসএলের মত টুর্নামেন্টেও খেলেছেন। ক্রিকইনফোকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আইসিসির সহযোগী দেশগুলো যে পর্যায়ে রয়েছে, সেখান থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলতে পারার স্বপ্ন দেখাটা একটু কঠিনই। এ ধরনের টুর্নামেন্টে পেসাররা ১৪৫ প্লাস গতিতে বল করে, স্পিনাররা বলকে লাটিমের মত ঘোরায়। সহযোগী দেশগুলোর জন্য এসবের বিরুদ্ধে নিজেদের তৈরি করার চিন্তাটাও দুষ্কর। বিশেষকরে প্রথমবার যখন কেউ খেলতে আসে।’ ডেভিড ওয়াইজ জানিয়েছেন, তারা দলের মধ্যে এই মানসিকতারই পরিবর্তন ঘটিয়েছেন এবং যে করেই হোক সুপার টুয়েলভে খেলার লক্ষ্য নির্ধারণ করে নিয়েছিলেন। নামিবিয়ার অধিনায়ক এরাসমাস বলেন, ‘আমাদের মধ্যে এত বড় টুর্নামেন্টে খেলার জন্য এই ধরনের বিশ্বাস তৈরি করার ক্ষেত্রে তিনি (ডেভিড ওয়াইজ) অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছেন। নিজে থেকে অনেক চাপ নিয়েছেন এবং অন্যদেরকে ফ্রি-মাইন্ডে খেলার সুযোগ করে দিয়েছেন। তিনি আমাদের এভাবে বলে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছেন যে- তোমরা এখন বিশ্ব আসরে লড়াই করতে চলে এসেছো, কারণ এখানে আসার যোগ্যতা অর্জন করেছো তোমরা। সুতরাং, আমাদেরকে এই আত্মবিশ্বাস নিয়েই বাবর আজম, শাহিন আফ্রিদিদের বিপক্ষে লড়াই করতে হবে।’ গেরহার্ড এরাসমাস নিজেদের ক্রিকেটে উঠে আসার গল্প শোনাতে শোনাতে নামিবিয়ার কিছু ইতিহাসও শোনালেন। সাবেক ব্রিটিশ এবং জার্মান কলোনি ছিল নামিবিয়া। এরপর ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তারা শোষিত হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা দ্বারা। এই সময়ে নামিবিয়াকে ধরা হতো একটি বর্ণবিদ্বেষী রাষ্ট্র হিসেবে। দক্ষিণ আফ্রিকায় যে নিয়ম প্রচলিত ছিল, নামিবিয়াতেও ঠিক সেই নিয়ম প্রচলিত। দেশটিতে সর্বক্ষেত্রেই সাদাদের প্রাধান্য। দেশটির সম্পদের অধিকাংশের ওপর আধিপত্য সাদাদের। কৃষ্ণ বর্ণের মানুষদের খুবই নিচু শ্রেণির মনে করা হয়। এমনকি নামিবিয়া ক্রিকেট দলটিও এই নিয়মের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশ্বকাপে নামিবিয়ার ১৫ সদস্যের স্কোয়াডে মাত্র তিনজন রয়েছেন কালো রঙয়ের। পিক্কি ইয়া ফ্রান্স, জেন গ্রিন এবং বেন শিকোঙ্গো। রিজার্ভ বেঞ্চ মিলিয়ে দলটি ১৮ জনের। সেখানে আরও একজন রয়েছেন নিগ্রো। তিনি হলেন মৌরিতিয়াস এনগুপিতা। গেরহাড ইরাসমাস- এ বিষয়টা অবগত যে, অবশ্যই বিশ্ব আসরে তাদেরকে এই বর্ণবাদী আচরণের জন্য প্রশ্নের সম্মুখিত হতে হবে। তিনি বলেন, ‘১৬ বছর বয়স থেকেই নামিবিয়া ক্রিকেটের সঙ্গে একজন অধিনায়ক এবং একজন মানুষ হিসেবে জড়িত রয়েচেন পিক্কি ইয়া ফ্রান্স। যাকে দেখে আমরা খুব অনুপ্রাণিত হই।’
ইরাসমাস আরো বলেন, ‘তিনি (পিক্কি) দীর্ঘদিন ধরেই নামিবিয়া ক্রিকেটকে এগিয়ে নিচ্ছেন। তারপর আমরা আরও দুজন তরুণকে পেয়ে গেছি। তারা হলেন বেন এবং মাউরিতিয়াস। তারা সবাই যখন ঘরে ফিরবেন, তখন মানুষের কাছে নায়নে পরিণত হবেন।’ নামিবিয়ায় ক্রিকেটকে একটা ব্র্যান্ডে পরিণত করতে চান ইরাসমাস। তিনি বলেন, ‘আমাদের এ ধরনের ক্রিকেটার নিয়মিতই দরকার। তাহলে নিজেদের দেশে ক্রিকেটকে একটা ব্র্যান্ডে পরিণত করতে পারবো। যাতে মানুষ আরও বেশি ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত হয়। এভাবেই আমরা একটি ক্রিকেট সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চাচ্ছি। যদি আমরা ক্রিকেটকে ব্র্যান্ডে পরিণত করে সাধারণ মানুষের ভালবাসার জায়গায় পৌঁছাতে পারি, তখন আমরা অনেককেই পাবো, যারা ক্রিকেট খেলবে, খেলা পছন্দ করবে। যদি আমরা অনেক বেশি ক্রিকেটার পেয়ে যাই এভাবে, তাহলে নামিবিয়ায় ক্রিকেট আর সাদা মানুষের খেলা হিসেবে থাকবে না। ক্রিকেট হয়ে যাবে নামিবিয়ান খেলা (সাধারণ মানুষের খেলা)।’ তবে এসবের জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ আরো অনেক কিছু প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন গেরহার্ড ইরাসমাস।