তরিকুল ইসলামের স্মরণ সংখ্যার একগুচ্ছ লেখা-১

0

স্মৃতির মনিকোঠায় তরিকুল ভাই
খন্দকার মনিরুল আলম

দেখতে দেখতে তিন বছর হয়ে গেল, তরিকুল ইসলাম আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু তাঁর স্মৃতি আমাদেরকে ছেড়ে যায়নি। অতি সাধারণ সুতী সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী পরিহিত প্রাণবন্ত মানুষটি আমার হৃদয়ে যে জায়গা করে নিয়েছেন তা মুছে যাওয়ার নয়। যাবেও না কোনোদিন। হ্যাঁ, সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী। এর বাইরে তাকে অন্য কোনো পোশাকে কোনোদিন দেখিনি। শীতকালে গায়ে চাদর। এর বাইরে বড়জোর একটা সোয়েটার। গুরুর বিধ্বস্ত উত্তরাধিকারী। গুরু মওলানা ভাসানীর সারা জীবনের পরিধেয় ছিল খাটো লুঙ্গি-ফতুয়া আর মাথায় তালপাতার টুপি। শিষ্যও তাই। সুতী পাজামা-পাঞ্জাবী।
তরিকুল ইসলামের সাথে আমার মোটামুটি জানা শোনা ছিল পাকিস্তান আমলে। তিনি যশোর কলেজের ডাকসাইটে নেতা। আমি খুলনায় তার দলের অর্থাৎ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ কর্মী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে স্থানীয় এবং পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তরিকুল ইসলাম। পেশাগত কারণে মাঝে মধ্যে তাঁর সাথে দেখা হতো। ঘনিষ্ঠতা বাড়ে তাঁর সাথে যখন আমি সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা (পিআইও) পদে যোগ দেই। এ পদে যাব কি যাব না এ নিয়ে আমার দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছিল। আর তরিকুল ইসলামের আগ্রহ এবং ইচ্ছা ছিল আমাকে নেয়ার ব্যাপারে শতভাগেরও বেশি। যাহোক সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। ফিরে আসি সুিত সাদা পাজামা পাঞ্জাবীতে। অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান প্রায়ই বলতেন এই পাজামা-পাঞ্জাবীওয়ালাদের কারণে কিছু করা যায় না। সরকারে মওলানা ভাসানীর অনুসারী বেশ কিছু মন্ত্রী এবং এমপি ছিলেন। তারা কেবিনেট বৈঠক ছাড়াও অন্যান্য ফোরামে সাইফুর রহমান গংদের পুঁজিবাদী ধ্যান ধারণার বিরোধিতা করতেন। যদিও এরা জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাস করতেন, তবুও তাদের চিন্তা চেতনা মওলানা ভাসানীর রাজনীতি অর্থাৎ সাধারণ মানুষ এবং কৃষক শ্রমিকদের স্বার্থের বিষয়টি সব সময়ে সক্রিয় বিবেচনায় থাকতো। সাইফুর রহমান সাহেবদের মুক্তবাজার অর্থনীতির সাথে এরা তাল মিলিয়ে চললেও মৌলিক বিষয়ে প্রয়োজনবোধে বিরোধিতা করতেন। এদের নেতা আবদুল মান্নান ভূঁইয়া আপোষ করাটা রপ্ত করেছিলেন। কিন্তু তরিকুল ইসলাম তাঁর নীতিতে অনঢ় ছিলেন। এর জন্য তাকে অনেক খেসারতও দিতে হয়েছে। সে সময়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করছিলেন তারেক জিয়া এবং তাঁর সঙ্গীসাথীরা। এদের মধ্যে ভালোও যেমন ছিল মন্দ অর্থাৎ সুযোগ সন্ধানীদের সংখ্যাও নেহাত কম ছিল না। এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন হারিছ চৌধুরী। কৌশলে মোসাদ্দেক হোসেন ফালুকে বেগম খালেদা জিয়ার কাছ থেকে সরিয়ে দিয়ে হারিছ চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দোর্দন্ড প্রতাপে কাজ করতেন। সিনিয়র কয়েকজন মন্ত্রী ছাড়া অন্যান্যরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আসলে আগে যেতেন হারিছ চৌধুরীর কক্ষে। এটাই নিয়মে পরিণত হয়েছিল। পিআইও পদে থাকাকালীন সময়ে জরুরি প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করার জন্য তার কার্যালয়ে গিয়েছিলাম একদিন। পিএস ডিউকের রুমে বসেছিলাম প্রধানমন্ত্রীর ডাক পাওয়ার অপেক্ষায়। এর মধ্যে হারিছ চৌধুরী সেখানে উপস্থিত হয়ে আমাকে দেখে খানিকটা অবাক হয়ে বলেছিলেন, আপনি ম্যাডামের সাথে দেখা করতে এসেছেন তা আমাকে বলেননি কেন? উত্তরে বলেছিলাম, ম্যাডাম দেখা করতে বলেছেন তাই সরাসরি তাঁর অফিসেই এসেছি। হারিছ চৌধুরী বললেন, কাজ শেষে আমার রুমে এসে এক কাপ চা খেয়ে যাবেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে অফিসিয়াল কাজ শেষে হারিছ চৌধুরীর রুমে গেলাম। উনি চা অফার করলে বললাম, চা খেয়েছি। হারিছ চৌধুরী বললেন, মনির ভাই একটা কথা বলি। আপনার নেতা তরিকুল ভাই, বুড়ো হয়ে গেছেন। এখন তার অবসর নেয়া উচিত। আমি অবাক হয়ে গেলাম। বলে কি? উত্তরে বললাম, তরিকুল ইসলাম আপনারও নেতা। আমার একার নয়। অফিসে এসে তরিকুল ইসলামের রুমে গেলাম। তাকে সব খুলে বললাম। উনি ড্রয়ার থেকে একটা ফাইল বের করে আমাকে দিয়ে বললেন, পড়ে দেখুন। প্রায় পনেরো মিনিট ধরে পড়লাম। যা বুঝলাম, একটি বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি প্রকল্পের প্রস্তাব যা বাস্তবায়িত হলে দেশের ক্ষতি হবে এবং লাভবান হবে দেশের একটি প্রভাবশালী মহল। তরিকুল ভাই বললেন, এ চক্রের নেতা হচ্ছে হারিছ চৌধুরী। আমার সাথে সে কথা বলেছিল এবং প্রকল্পটি পাশ করার জন্য চাপ দিচ্ছিল। তিনি বললেন, দেশের ক্ষতি হবে এমন কোনো কাজ করবো না। তাতে যদি মন্ত্রীত্ব চলে যায় তো যাক। সে প্রকল্পটি তথ্য মন্ত্রণালয় হতে পাশ হয়নি। হারিছ চৌধুরীরা থেমে থাকেননি। সুযোগ পাওয়া মাত্র তরিকুল ইসলামকে তথ্য মন্ত্রণালয় হতে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়েছিল।
যাহোক, পাজামা-পাঞ্জাবীর প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ব্যাংককে তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগ দেয়ার জন্য বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী এবং মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বিদেশ ভ্রমণে ঘোরতর অনীহা ছিল তরিকুলের। আমাকে বললেন, এতো মহা মসিবত হয়ে গেল। কিন্তু না যেয়ে তো উপায় নেই। বাংলাদেশ দলের দলনেতা তথ্যমন্ত্রী এবং সদস্য পিআইবির মহাপরিচালক ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী। এ ধরনের আন্তর্জাতিক সেমিনারে তো তাঁর ব্রান্ড পাজামা-পাঞ্জাবী পরে যাওয়া যায় না। স্যুট, শার্ট ইত্যাদি জরুরি ভিত্তিতে তৈরি করা হলো। ব্যাংককে যাওয়ার আগের দিন রাতে তরিকুল ইসলামের টেলিফোন, ভাই আপনি তো অদ্ভুত লোক। স্যুট পরবো ঠিক আছে কিন্তু টাই তো নেই। আপনার তো অনেক টাই আছে ওখান থেকে দুই তিনটা দিয়ে যান। আমার বাসার কাছেই তথ্যমন্ত্রীর বাসা। সেখানে গেলাম কয়েকটা টাই নিয়ে। সব ঠিক আছে। দুপুরে তরিকুল ইসলামের ফ্লাইট। সকালে তার টেলিফোন। ভাই আমাকে মহা যন্ত্রণায় ফেললেন। টাই বাধতে তো পারিনি। গেলাম তার বাসায়। কয়েকটা টাইয়ের ‘নট’ বেধে দিলাম।
এই হচ্ছে তরিকুল ইসলাম। গুরু মওলানা ভাসানীর মতো সাদা সিধা জীবন যাপনে তিনি ছিলেন অভ্যস্ত। খাওয়া দাওয়ার প্রতি আগ্রহ ছিল সামান্যই। তবে হ্যা, চা এবং সিগারেটে তার আসক্তি ছিল প্রবল। অসুস্থ হয়ে বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়ও তিনি সিগারেট ছাড়েননি। কিছু বললে বলতেন, কয়দিনই বা আর বাঁচবো। এখন ছেড়ে আর লাভ কি।
যশোরকে তিনি ভালোবাসতেন মনে প্রাণে। বলতেন জীবনে যা কিছু পেয়েছি তার সব কিছুর ভিত্তি তো যশোর। প্রায় প্রতি সপ্তাহে তিনি যশোর চলে যেতেন। ঢাকায় জরুরি কাজ না থাকলে প্রতি উইকএন্ডে তরিকুলের গন্তব্য ছিল যশোর। ব্যস্ত রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে সন্ধ্যায় তার আড্ডা চলতো যশোরবাসীর সাথে। রাস্তায় চলাচলকারী লোকেরা তরিকুলের কাছে আসতো, কথা বলতো। প্রায় সবাইকে নামে চিনতেন। অনেকের হাড়ির খবরও তিনি জানতেন। এ অভ্যাস তার ছাত্র জীবন থেকে ছিল। শুধু যশোর কেন, পুরো দক্ষিণাঞ্চলের রাজনীতি ছিল তার নখদর্পনে। এখানে তিনি ছিলেন রাজা। তার হাত ধরে রাজনীতিতে এসে অনেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এদের কেউ কেউ পরবর্তীতে বেইমানীও করেছেন। তরিকুল এতে দুঃখ পেয়েছেন কিন্তু তাদের ক্ষমাও করে দিয়েছেন। অত্যন্ত বড়ো মনের মানুষ ছিলেন তিনি। মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে দলের সাধারণ কর্মীরাও আসতেন তার সাথে দেখা করতে। অনেকে অভাব অনটনের কথা বলতেন। দল ক্ষমতায় থাকলেও দুঃসময়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকা এসব কর্মীরা সব দিক থেকে বঞ্চিত ছিল। মন্ত্রী তরিকুল ধনী ছিলেন না। তার ‘ইল গটেন’ টাকাও ছিল না। তারপরেও এসব কর্মীদের তিনি খালি হাতে ফিরাতেন না। ধনী এবং বিত্তশালী বন্ধুদের কাছে এদের কাউকে কাউকে পাঠাতেন।
ছাত্র জীবনে তিনি বাম ঘরানার রাজনীতি করতেন। পরবর্তীতে বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত হলেও অবচেতন মনে তিনি বাম ধারার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। বাম রাজনীতি করেন এ রকম কেউ কেউ তার মন্ত্রণালয়ের কার্যালয়ে দেখা করতে আসতেন। একজন তো প্রায়ই আসতেন। তিনি সাম্যবাদী দলের নেতা কমরেড দিলীপ বড়–য়া। বিভিন্ন রকমের তদবির নিয়ে আসতেন তিনি। তরিকুল সাধ্য অনুযায়ী তাঁকে সাহায্য করতেন। সে সময়কার একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। তাইওয়ানের ঢাকায় অফিস খোলা নিয়ে চীনের সাথে বাংলাদেশের উত্তেজনাকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। তাইওয়ান প্রশ্নে চীন বিন্দুমাত্র ছাড় না দেয়ার নীতিতে অবিচল ছিল। বাংলাদেশও তাইওয়ানের ব্যাপারে ‘‘ওয়ান চায়না’’ নীতিতে বিশ্বাস করতো। এ রকম অবস্থায় পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হলো যে, তাইওয়ান ঢাকায় অফিস খুলতে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশ সে দেশে প্রচুর শ্রমিক পাঠাবে। তাইওয়ানের শ্রম বাজার ছিল খুবই আকর্ষণীয়। অভিবাসী শ্রমিকের মাইনে এবং সুযোগ সুবিধা ছিল আরব দেশের অভিবাসী শ্রমিকদের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। এ ব্যাপারে সরকারের এবং ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা প্রভাবশালী মহলের আগ্রহের সীমা পরিসীমা ছিল না। লোভী এই মহলটির কাছে দেশের স্বার্থের চাইতে ব্যক্তি স্বার্থ সব সময়ে প্রাধান্য পেতো। এ রকম পরিস্থিতিতে আমার অফিসে এসেছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত চাই শি। তার সাথে আগে হতেই আমার পরিচয় ছিল এবং তিনি একবার আমার বাসায় ডিনারের দাওয়াতে এসেছিলেন। রাষ্ট্রদূত বিশেষ করে চীনের মতো দেশের রাষ্ট্রদূত এভাবে কোনো ফর্মালিটি ছাড়া আমার অফিসে আসবেন তা ভাবতেও পারিনি। চীন কতটা ডেসপারেট হয়ে গিয়েছিল তা বুঝতে পেরেছিলাম। চাই শি বললেন যে তিনি তথ্যমন্ত্রী তরিকুল ইসলামের সাথে দেখা করতে চান। আমি সঙ্গে সঙ্গে রেড ফোনে তরিকুল ভাইকে বললাম যে চীনা রাষ্ট্রদূত এসেছেন এবং আপনার সাথে দেখা করতে চান। তিনি বললেন, ‘‘আমি এখনই আপনার অফিসে আসছি। মন্ত্রীর অফিসে চীনের এমবেসডর আসলে গুজবের ডালপালা গজাবে। আপনার রুমেই উনার সাথে কথা বলবো।’’ কয়েক মিনিটের মধ্যে তরিকুল ভাই আসলেন। চাই শি আবেকতাড়িত হয়ে কান্নাভেজা কণ্ঠে বললেন,ভাই আপনারা থাকতে এত বড় ঘটনা ঘটলো। তরিকুল ভাই আমার রেড ফোন থেকে মান্নান ভূঁইয়াকে ফোন করলেন। কি জবাব পেলেন তা জানি না। এরপরে একে একে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খান এবং আরো কয়েকজনকে ফোন করলেন এবং তাদেরকে ঘটনার গুরুত্ব বোঝার পরামর্শ দিলেন। রাষ্ট্রদূতকে বললেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করবো এবং আমার পক্ষে যা করার সব করব।’ চীনা রাষ্ট্রদূত তরিকুল ইসলামের ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন বলেই তার সাথে কথা বলার জন্য ছুটে এসেছিলেন। পরে তরিকুল ভাই আমাকে বলেছিলেন, ভাই আমি তো চীনাদের জানি, কয়েকটা লোভী মানুষের জন্য বিএনপি সরকারের যে ক্ষতি হলো তা আগামী দিনে হাড়ে হাড়ে আমরা বুঝতে পারবো। বিএনপির সাথে চীনের সব সময়ে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। এই ঘটনায় তাতে ফাটল ধরে। বিএনপির জায়গা দখল করে নেয় আওয়ামী লীগ। সে ধারা এখনো অব্যাহত আছে।
রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও অন্য দলের নেতাকর্মীদের সাথে তরিকুল ইসলাম সুসম্পর্ক রাখতেন। তবে এটাও ঠিক রাজনৈতিক প্রশ্নে তিনি কাউকে ছাড় দিতেন না। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক কমরেড ফরহাদের স্ত্রী রাশেদা বেগম তথ্য মন্ত্রণালয়ের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান পিআইডিতে তথ্য অফিসার পদে কাজ করতেন। রীনা খান নামে তিনি ছিলেন সুপরিচিত। এক সময়ের ডাকসাইটে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা রীনা খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। আমি তখন পিআইডিতে কর্মরত ছিলাম প্রধান তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে। একদিন কথা প্রসঙ্গে তরিকুল ভাইকে রীনা খানের কথা বললে তিনি বললেন, ভাই আমি ওনার সাথে কথা বলতে চাই। প্রয়াত কমরেড ফরহাদ ছাত্র জীবনে আমার নেতা ছিলেন। বললাম ঠিক আছে আমি তাকে আপনার কাছে নিয়ে আসব। তরিকুল ভাই বললেন, না ভাই সেটা ঠিক হবে না। তিনি আমার এক সময়ের নেতা ফরহাদ ভাইয়ের স্ত্রী। হতে পারে তিনি মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা। কিন্তু আমার রুমে আসলে সেটা খুব ফর্মাল হয়ে যাবে। আপনার অফিসে যেয়ে আমি ওনার সাথে দেখা করবো। দু’একদিন পরে আমার রুমে তথ্যমন্ত্রী তরিকুল ইসলাম আসলেন। এ কাজটা তিনি প্রায়ই করতেন। আমার রুমে সব সময়েই সাংবাদিকদের আনাগোনা লেগে থাকতো। তরিকুল ভাই তাদের সাথে খোশগল্প করতেন। যাহোক তিনি বললেন, ভাই আমি আজকে আমার প্রয়াত নেতার স্ত্রীর সাথে কথা বলতে চাই। আমি আমার পিএকে বললাম, রাশেদা বেগমকে আমার রুমে আসতে বলো। তিনি রুমে ঢুকতেই তথ্যমন্ত্রী তরিকুল ইসলাম চেয়ার হতে উঠে দরজার কাছে যেয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। তিনি তো হতবাক। খোদ মন্ত্রী তাঁকে সম্মান জানাচ্ছেন। রাশেদাকে বসতে দিয়ে তরিকুল বললেন, আপনি আমার মরহুম নেতার স্ত্রী। আমি জানতাম না যে আপনি এই মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন। জানলে আগেই আপনার সাথে দেখা করতাম। পুরনো দিনের অনেক স্মৃতি রোমন্থন হলো। তরিকুল বললেন, বুঝলেন ভাবী ফরহাদ ভাইয়ের উপরে আমার অভিমান আছে। ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পরে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে এসেছিলাম। কিন্তু নেতা ফরহাদ ভাই নির্দেশ দিয়ে ছিলেন রাজশাহী বিদ্যালয়ে পড়ার জন্য। নেতার আদেশ অমান্য করার সাহস আমাদের ছিল না। ঢাকায় থাকলে হয়তো রাজনীতিতে আরো উপরে উঠতে পারতাম। যশোরে তরিকুল, রাজু এবং টিটো তিন বন্ধু এক সময়ে একই রাজনীতি করতেন। পরে তিনজন তিন দলে চলে যান। কিন্তু তাদের বন্ধুত্বে কখনো ফাইল ধরেছে বলে শুনিনি। তরিকুলের কথা হলো, রাজনীতির জায়গায় রাজনীতি, ব্যক্তি জীবনে তার প্রভাব পড়বে কেন?
খন্দকার দেলোয়ার হোসেন ইন্তেকাল করার পরে বিএনপির মহাসচিব কে হবেন তা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছিল। তরিকুল ইসলামের নাম উচ্চারিত হচ্ছিল সব চাইতে বেশি। এ রকম সময়ে তরিকুল ভাই একদিন আমাকে ফোন করলেন তার শান্তিনগর বাসায় দেখার করার জন্য। অনেক কথার পরে দলের সম্ভাব্য মহাসচিব পদ নিয়ে কথা উঠলে তিনি বললেন, ম্যাডামকে (বেগম খালেদা জিয়া) বলেছি আমার শরীরের যে অবস্থা তাতে এ পদে আমি কাজ করতে পারবো না। তবে ভাই আপনাকে বলছি, শারীরিক কারণের চাইতে অন্য কারণ আছে। ‘জো হুজুর’ হয়ে রাজনীতি করা আমার পক্ষে সম্ভব না।
বিএনপি সরকারের শেষের দিকে তার মিন্টো রোডের বাসায় একদিন গিয়েছিলাম। খুব দুঃখ করে সেদিন তিনি বলেছিলেন, কয়েকটা হনুমান একটা সাজানো বাগান ধ্বংস করে দিল। তার এ কথা মর্মার্থ বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু করার কিছুই ছিল না।
সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব

মাথার উপর অভিভাবকের হাত
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

দক্ষিণ বাংলার অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন তরিকুল ইসলাম। তার সঙ্গে আমার কবে পরিচয় হয়েছিল মনে নেই। ১৯৬৯-৭০ এ হতে পারে, ১৯৭২-এও হতে পারে। তবে যতদূর মনে পড়ে ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সময় তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। মওলানা ভাসানীর রাজনীতি করতেন। আমি ছিলাম এই দলের চেলা। ঢাকা কিম্বা টাঙ্গাইল কিম্বা অন্য কোন শহরে মুঠিবদ্ধ হাত উর্ধ্বে তুলে মিছিলের আগে আগে দৌড়েছি। ফিলার বক্তা হিসেবে বক্তৃতা দিয়েছি। এখন হাসি পেলেও সে সময়ে তা ছিলো আগুন ঝরা বক্তব্য। রাজনৈতিক সহকর্মীরা পিঠ চাপড়ে দিয়েছে। অগ্রজেরা ডেকে প্রশংসা করেছে। সেটুকুই পাথেয় ছিল। সেই শক্তি নিয়ে অগ্রজদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। তখন খুবই কম বয়স ছিল আমার। ১৬ কি ১৭। কিন্তু অগ্রজেরা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেননি। বরং কাছে টেনে নিয়েছেন। উৎসাহ দিয়েছেন। অনেকে আবার বলেছেন খালি বক্তৃতা দিলেই কিন্তু হবে না, লেখাপড়াও শেষ করতে হবে। মনের মধ্যে সে ইচ্ছাও প্রবল ছিল। এই প্রক্রিয়ায় আরো অনেকের মত তরিকুল ভাইয়ের সঙ্গেও আমার সখ্যতা গড়ে ওঠে। তার সঙ্গে আমার বয়সের ব্যবধান ছিল ৭ বছর। কিন্তু বন্ধুত্ব দ্রুত জমে উঠলো। শেষে মনে হতে থাকলো এ অগ্রজ আমার মাথার উপর হাত দিয়ে রেখেছেন মাতৃজঠোর থেকে বের হওয়ার পর থেকেই। সব সময় একটা ¯েœহের দৃষ্টি আমাকে আগলে রেখেছে।
তারপর দীর্ঘ পথচলা। তরিকুল ভাই বারবার জেলে খেটেছেন। আইয়ুব আমলে, মুজিব আমলে, এরশাদ আমলে। যশোর গেলে তার আড্ডাস্থলে দীর্ঘ সময় ধরে আড্ডা দিয়েছি। তার জীবনের উত্থান পতনের কাহিনী শুনেছি। কী ধরনের নির্যাতনের তিনি স্বীকার হয়েছেন তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন। সিগারেট খেয়েছেন প্রচুর। আর গল্প। জীবনের গল্প। লড়াইয়ের গল্প। অত্যাচার-নির্যাতনের স্বীকার হওয়ার গল্প। মন্ত্র মুগ্ধের মত শুনেছি। দিন যত গেছে আমি ব্যক্তিগতভাবে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে এসেছি, জীবন জীবিকার তাগিদে। কিন্তু শহীদ জিয়াউর রহমান প্রবর্তিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনীতি অনুসরণ করেছি। তরিকুল ভাইও তাই। দেখা হলেই কথা বলেছেন। এমনকি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ কী সে বিষয়ে তাত্ত্বিক আলোচনাও করেছি। সেটা সম্ভব হয়েছিল কারণ তখন আমি বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে পিএইচডি গবেষণা করছিলাম। এদেশের মানুষের জাতিসত্তার পৃথক বিন্যাস বাংলা ভাষাভাষী হওয়া সত্বেও পূর্ব বাংলার মানুষের আলাদা জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার ধারাবাহিক ইতিহাস অনুসন্ধান করেছি। ফলে আমাদের আলোচনা জমতো ভালোই। তরিকুল ভাইয়ের গল্প শুনে মনে হতো কী ডেডিকেশন থাকলে একজন মানুষ বিভিন্ন সরকারের এত অত্যাচার-নির্যাতন সত্বেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। তার প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল। সম্পর্ক দৃঢ়তর হলো।
বিএনপির ১৯৯১-৯৬ শাসনকালে তরিকুল ভাই মন্ত্রী ছিলেন। আমি ছিলাম প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা লেখক। আমাদের রুমগুলো ধূমপায়ীদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। তরিকুল ভাই সিগারেট হাতে আমাদের রুমে গিয়ে হাজির হতেন। আয়েশ করে বসে বলতেন-এই একটা জায়গা যেখানে নিঃশ্বাস ফেলা যায়। তারপর আড্ডা। একসময় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে তার ডাক পড়তো। তিনি বলতেন আছেনতো! কথাটা সেরে আসি।
২০০১-০৬ সালে বিএনপি যখন আবার ক্ষমতায় এলো তার বছর খানেক পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আমার ডাক পড়লো। গিয়ে দেখি গাড়িবারান্দার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী সেলিমা রহমান। সেলিমা আপা আমার হাত ধরে বললেন-আপনাকে শিল্পকলার ডিজি হতে হবে; ব্যাপারটা ফাইনাল। আমি হাসাহাসি করছিলাম। আপা এক বছর কেউ খোঁজ নেয়নি আর আজকে ডেকেই শিল্পকলার ডিজি করে দিয়েছেন! তিনি বললেন-হ্যাঁ, ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলে এসেছি। আপনি থাকুন আমিনুল হক সাহেব চিঠি নিয়ে আসছেন। আমি সেখানে দাঁড়িয়েই ভাবছিলাম-যদি শিল্পকলার ডিজির দায়িত্ব নিতে হয় তাহলে কী করবা?ে কোথা থেকে শুরু করবো? শুরু করতে হবে নতুন স্টাইলে। সারাদেশে ঝাঁক ঝাঁক শিল্পী, গায়ক-গায়িকা, আবৃত্তিকার তৈরি করে দেবো; যারা বাংলাদেশী সংস্কৃতির জয়গান করবে ও এর বিকাশে কাজ করবে। তখনই তরিকুল ভাই এসে নামলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। আমার আর এক হাত ধরে বললেন-আপনার শিল্পকলায় যাওয়া হচ্ছে না। আমি বললাম তরিকুল ভাই, আপনাদের সরকার গঠনের বছর খানেক পরেই যাও একটা চাকরি পেলাম সেটাও শেষ! তিনি বললেন-আপনি শিল্পকলায় যাবেন তো তাহলে প্রেস ইনস্টিটিউট কে চালাবে? আমরা আলোচনা করে দেখেছি ওটি সঠিকভাবে চালাতে আপনার কোনো বিকল্প নেই। দুইজনে আমার দুই হাত ধরে রেখেছেন। তরিকুল ভাইকে আমি বললাম শিল্পকলার অর্ডারতো হয়ে গেছে। তিনি বললেন-ওটা ক্যান্সেল করে দেবো। আমরা প্রধানমন্ত্রীর অফিসে ঢুকলাম। সেলিম আপা প্রধানমন্ত্রীর ব্লকে, তরিকুল ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন প্রেস সেক্রেটারির রুমে। সেখানে গল্পগুজব চলছিল। ব্যারিস্টার আমিনুল হক সাহেবও এলেন। হাতে শিল্পকলার চিঠি। তরিকুল ভাই বললেন-এ চিঠি বদলে আনুন। রেজোয়ান প্রেস ইনস্টিটিউটে জয়েন করবে। আমি কোন দিশামিশা না পেয়ে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। যা হবার হবে। পরদিন প্রধানমন্ত্রীর সচিব আরিফ চৌধুরী বললেন-রেজোয়ান ভাই চলে আসেন। গিয়ে দেখলাম প্রেস ইনস্টিটিউটে নিয়োগের চিঠি। আমি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে থাকতে থাকতেই তরিকুল ভাই ফোন দিলেন। বললেন-সোজা সচিবালয়ে চলে আসেন। তিনি তখন তথ্যমন্ত্রী। বললেন- জয়েনিং লেটার দেন। তখন বিকেল ৪ টা বাজে। জয়েনিং লেটার দিলাম। তিনি একে ওকে দাবকিয়ে প্রেস ইনস্টিটিউটের গাড়ি সচিবালয়ে নিয়ে এলেন। বললেন- এবার প্রেস ইনিস্টিটিউটে গিয়ে যোগদান করে কর্মচারীদের সাথে কথাবার্তা বলে আবার চলে আসেন। আমি বললাম কালকে জয়েন করি। তিনি হাসতে হাসতে বললেন-আগে চেয়ার দখল করেন। বাংলাদেশে চেয়ার খালি থাকলে যে কেউ বসে পড়ার চেষ্টা করে। আমি জয়েন করে এলাম। দেখি তরিকুল ভাই মিষ্টি এনে রেখেছেন। উপস্থিত সবাই বসে মিষ্টি খেলাম।
লেখার কলেবর বড় হয়ে যাচ্ছে। আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করে আমার প্রতি তার স্নেহ-মমতা ভালোবাসার প্রমান দিতে চাই। মাঝেমধ্যেই কাজ শেষে সচিবালয়ে তরিকুল ভাইয়ের ওখানে আড্ডা দিতে গিয়েছি। আর রুম থেকে বেরিয়েই তিনি আমার কাধে হাত রেখে লিফটের দিকে নিয়ে গেছেন। একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আচ্ছা এই যে আপনাকে গলায় হাত দিয়ে নিয়ে আসি আপনি কি কিছু মনে করেন? আমি বললাম; না। এটাতো আমার অহংকার। তিনি বললেন-এর কিন্তু কারণ আছে। আমলারা যখন দেখবে মন্ত্রীর সঙ্গে এমন গলায় গলায় সম্পর্ক তখন সব বেটা আপনাকে সহযোগিতা করবে। নইলে পদে-পদে ঘাটানোর চেষ্টা করবে। এ ছিল আমার জীবনের আরও একটি বড় শিক্ষা। মহান আল্লাহ তাআলার কাছে কায়মনে বাক্যে প্রার্থনা করি-তিনি যেন তরিকুল ভাইকে জান্নাতবাসী করেন।

দৃঢ়চেতা আদর্শবাদী রাজনীতিক তরিকুল ইসলাম
এম আবদুল্লাহ

দিন-তারিখটা ঠিক স্মরণ নেই। যতটা মনে পড়ছে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি কোন একদিন হবে। দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)’র মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছি। সাংবাদিক ইউনিয়ন যশোরের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলাম বনেদী শহর যশোরে। নির্ধারিত কর্মসূচি শেষে জানতে পারলাম বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ, প্রিয় ও পছন্দের মানুষদের একজন তরিকুল ইসলাম যশোরের বাসায় আছেন। খুবই অসুস্থ। যশোরের সাংবাদিক নেতাদের নিয়ে তাঁর বাসায় হাজির হলাম। খবর পেয়ে বেরিয়ে আসলেন কয়েক মিনিটের মধ্যে। এ কি হাল! খুব দুর্বল হয়ে পড়েছেন। ভগ্ন শরীর। সালাম ও কুশল বিনিময়ের এক পর্যায়ে পাশে এসে বসলেন। আপ্যায়নের জন্য তাগিদ দিলেন বাড়ির লোকজনকে। নিষেধ করলাম। ফ্লাইট ধরতে হবে জানালাম। তার পরও নাছোড়।
নিজে খেতে পারেন না বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় ন্যুনতম খাবারও। কিন্তু কাউকে কাছে পেলে আপ্যায়ন না করে ছাড়েন না। রেড মিটসহ দুধ ও দুগ্ধজাত সবধরনের খাবারে তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে চিকিৎসক। পটাশিয়াম ও ফসফেট প্রধান ফলমূল এবং শাক-সবজি স্পর্শ করাও মানা। খাবারে নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে ডায়াবেটিস ও ফুসফুস ক্যান্সার ধরা পড়ার পর। সবচেয়ে জটিলতা হচ্ছিল তার পানি পান নিয়ে। চিকিৎসকরা বলে দিয়েছেন, ওষুধ সেবন, চা-কফি ও তরকারির ঝোলসহ সবমিলিয়ে প্রতিদিন লিটার খানেকের বেশি পানি পান করতে পারবেন না। তখন দিনে ১০-১২ রকমের অন্তত ৩০টির মতো ওষুধ সেবন করছিলেন। ফলে কঠিন হয়ে পড়ে পানি পানের বিধিনিষেধ সবসময় মেনে চলায়।
এটিই ছিল প্রিয় রাজনীতিকের সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাত ও আলাপচারিতা। দেখলাম এক অন্যরকম তরিকুল ইসলামকে। বার্ধক্যের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট, কিডনি জটিলতা কাবু করে ফেলেছে তার শরীর। কিডনি ডায়ালিসিস করতে হয় সপ্তাহে তিন দিন। দিনে তিন-চারবার নিতে হয় ডায়াবেটিসের ইনসুলিন।
তাঁর শরীরের যা অবস্থা তাতে হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যায় কিংবা অন্তত রাজধানীতে থাকার কথা। কিন্তু শিকড়ের টানে ছুটে যেতেন যশোরে। ঢাকার শান্তিনগর মোড়ে ইস্টার্ন পয়েন্টের একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন বরেণ্য রাজনীতিবিদ তরিকুল ইসলাম। এই বাসায়ই প্রথম সাক্ষাত তাঁর সঙ্গে। নিয়ে গিয়েছিলেন বন্ধু সাংবাদিক হারুনুর রশীদ (হারুন জামিল)। তখন ইনকিলাবে কাজ করি। কত গল্প, কত কথা। দৈনিক ইনকিলাবে ‘রাজনীতি’ নামে একটি বিশেষ পাতা প্রকাশিত হতো প্রতি শুক্রবার। শীর্ষ রাজনীতিকদের সাক্ষাতকার প্রকাশ করা হতো তাতে। রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় বিষয় ছাড়াও এতে অরাজনৈতিক ও পারিবারিক জীবন নিয়ে সাক্ষাতকার ছাপা হতো। ইনকিলাব তখন শীর্ষ প্রচার সংখ্যার দুই সংবাদপত্রের একটি। অপরটি ছিল ইত্তেফাক। জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থীদের মাঝে দৈনিক ইনকিলাবের সে কি জনপ্রিয়তা। ফলে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের খবর ও সাক্ষাতকার, প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশের জন্য মুখিয়ে থাকতেন এই ঘরানার রাজনীতিকরা। সে সময় বেশ কয়েকবার তরিকুল ভাইয়ের সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম। এছাড়া আন্দোলন-সংগ্রাম যখন তুঙ্গে উঠতো, তখন হঠাৎ খবর দিতেন যাওয়ার জন্য। আড্ডা আলোচনা জমতো। বয়সের ব্যবধান ভুলে সহপাঠি, বন্ধু হয়ে উঠতেন কিছু সময়ের জন্যে।
ক্ষমতায় গিয়ে মন্ত্রিপাড়ার বাসায় ওঠার পর যাতায়াত তেমন একটা করিনি। এটা আমার স্বভাব-বিরুদ্ধে। ক্ষমতার চৌহদ্দিতে ঘুরাঘুরি ভালো লাগেন না। বরং দূরত্ব বজায় রেখে ক্ষমতাধরদের ভুল-ত্রুটি খুঁজে রিপোর্ট করার নেশা ছিল। তবে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রির দায়িত্বে থাকার সময় একবার গিয়েছিলাম। বাসায় তখনকার সোনার হরিণ একটি ল্যান্ড টেলিফোন সংযোগ পাওয়ার জন্য তদবির করতে সেই হারুন ভাইকে সঙ্গী করে মিন্টু রোডের বাসায় এক সকালে গিয়েছিলাম বলে মনে পড়ে। সম্ভবতঃ ছুটির দিন ছিল। বাসায় সুনসান নীরবতা। তখনও ঘুম থেকে উঠেননি। আমাদের উপস্থিতির খবর পেয়ে দ্রুতই সাক্ষাত দিলেন। কুশল বিনিময় ও আপ্যায়নের পর বিদায় নিয়েছিলাম। তদবিরটা সফলকাম হয়নি। সংগত কারণ ছিল। টঙ্গীর টেলিফোন এক্সচেঞ্জের সীমাবদ্ধতা এবং আমি যেখানে বসবাস করি সেখানে ক্যাবল না থাকায় সংযোগ দেওয়া সম্ভব ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর অফিসের এক কর্মকর্তার সহযোগিতায় দু’টি ভিআইপি নম্বরসহ সংযোগ পেয়েছিলাম পরের মন্ত্রীর সময়ে।
আমার দেখা তরিকুল ইসলাম ছিলেন এক মজলুম জননেতা। আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’ গানের মর্মকথা ধারণের পাশাপাশি তার প্রথম ছিল রাজনীতি, শেষও রাজনীতি। এ রাজনীতি ছিল দেশের মানুষের জন্য, দেশের জন্য। তরিকুল ইসলাম বস্তুত: ব্যক্তি থেকে প্রায় প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলেন। ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে বাংলাদেশের রাজনীতির সাতচল্লিশ বছরে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মুখোমুখি হয়েও দলের নীতি, আদর্শ এবং সিদ্ধান্তের বাইরে তিনি কখনো যাননি। বলা যায়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে তরিকুল ইসলাম একটি বর্ণিল নাম।
দেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের গভীরতা ছিল অপরিসীম। জাতীয় পর্যায়ে শীর্ষ রাজনীতিরক হয়েও খুলনা-যশোরের মাটির গভীরে প্রোথিত শেকড়ের কথা তিনি এক মূহুর্তের জন্যও ভুলতে পারেননি। পেশা ও সাংবাদিক সংগঠনের দায়িত্বে থাকার কারণে আমাকে ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ জনপদ যশোরে যেতে হয়েছে বহুবার। মাড়িয়েছি বহু পথ। যেদিকে গিয়েছি, সেদিকেই পেয়েছি জননেতা তরিকুল ইসলামের উন্নয়নের স্মারক হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিষ্ঠান ও অবকাঠামোগুলো। প্রত্যন্ত গ্রামে গড়ে তোলা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় মাথা উচু করে জানান দিচ্ছে তাঁর অনবদ্য কীর্তি। তাঁর হাত দিয়ে গড়ে ওঠা যশোর মেডিকেল কলেজ, যশোর কারিগরি প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়, যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতাল ও করোনারি কেয়ার ইউনিট, বিভাগীয় কাস্টমস অফিস, বেনাপোল স্থল বন্দর, আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, যশোর মডেল পৌরসভা, আঞ্চলিক পাঠাগার, টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান দরদী রাজনীতিক তরিকুল ইসলামের জয়গান করছে।
রাজনীতির পাশাপাশি তিনিতো গণমাধ্যমেরই একজন ছিলেন। যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক লোকসমাজ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রকাশক তিনি। এ পত্রিকাটি যে কেবল দেশজুড়ে সুখ্যাতি কুড়িয়েছে তা নয়, সাংবাদিক তৈরীর কারখানা হিসেবেও ভূমিকা রেখেছে অসাধারণ। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে যত দক্ষ ও গুণী সাংবাদিক তৈরী হয়েছেন তাদের সিভি ঘাটলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘লোকসমাজ’ এর নাম পাওয়া যাবে। তথ্যমন্ত্রী হিসেবে দেশের গণমাধ্যমের জন্য তিনি অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছেন। মরহুম তরিকুল ইসলামকে যারা নির্মোহভাবে পাঠ করেছেন তারা অকপটে স্বীকার করবেন যে, ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে এরশাদের স্বৈরশাসনে নিষ্ঠুর নির্যাতন এবং এক-এগারোর ভয়ঙ্কর নিপীড়নেও তিনি ছিলেন সাহসী, দৃঢ়চিত্ত, নীতির প্রতি আপসহীন ও অবিচল দেশপ্রেমিক যোদ্ধা।
বয়স, শ্রেণী, পেশা নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে তিনি ছিলেন প্রাণখোলা মানুষ। যারা তার সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশেছে, তারা দেখেছেন তরিকুল ইসলামের হৃদয়ের বিশালতা। মন্ত্রীত্ব কিংবা দলের নীতিনির্ধারণী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য হওয়ার আগে যাদের সাথে যেভাবে মিশতেন, পরেও তেমনই ছিলেন। প্রটোকল না নিয়ে একা একাই গ্রামে গঞ্জে সাধারণ মানুষের সাথে মিশে যেতেন বলে শুনেছি যশোরের সাংবাদিক বন্ধুদের কাছে। গ্রামের চায়ের টুলে বসে সবার খোজখবর নিতেন।
আদর্শবাদী রাজনীতিই তরিকুল ইসলামের জীবনকে বারবার বিপন্ন করে তুলেছে। দেশপ্রেম ও নীতিতে অটল-অবিচল থাকার কারণে তরিকুল ইসলামের ওপর সবচেয়ে ভয়ানক ও বর্বরোচিত নির্যাতন নেমে আসে এরশাদ আমলে। গ্রেফতারের পর তিন মাস অজ্ঞাত স্থানে আটক ছিলেন তিনি। পরে তাকে এক ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। রাজনৈতিক জীবনে তিনি এমন মিথ্যা মামলা, নির্যাতন ও কারাভোগের শিকার হয়েছেন বারবার। যশোরে উদীচী হত্যা মামলা, রানার পত্রিকার সম্পাদক সাইফুল আলম মুকুল হত্যাকান্ডসহ বিভিন্ন মামলায় আসামির তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে তার নাম। ওয়ান-ইলেভেনের সময় কথিত মাইনাস ফর্মুলা ও সংস্কারে সায় না দেওয়ায় অন্য সিনিয়র রাজনীতিকদের মতো গ্রেফতার হন তরিকুল ইসলামও। কারাভোগ করেন দীর্ঘ দেড় বছর। মহাজোট সরকারের আমলেও নতুন নতুন মামলার আসামি হয়ে গ্রেফতার ও কারাভোগ করেছেন।
বিএনপির চরম ক্রান্তিকালে তরিকুল ইসলামের ভূমিকা ছিল কান্ডারীর। দলের চরম দুর্দিনে তিনি অকুতভয়ে নেতাকর্মীদের আগলে রেখেছেন। রাজনীতির সংকটকালে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করতেন না। জাতীয় রাজনীতিতে উঠে আসতে মাড়াতে হয়েছে কন্টকাকীর্ণ দুর্গম পথ। দৃঢ়চেতা এ নেতার ত্যাগ-তিতীক্ষা অতুলনীয়। বিএনপির রাজনীতিতে নেতাকর্মীদের কাছে অত্যন্ত আস্থা ও শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন তরিকুল ইসলাম। তাঁর রাজনীতির কেন্দ্রে ছিল আধিপত্যবাদবিরোধী লড়াই। বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা ছিল তাঁর রাজনীতির নিয়ামক। ফলে শীর্ষ নেতৃত্ব অনেক বিষয়ে ভ্রান্তিতে পড়লে তাঁর শরণাপন্ন হতেন বলে জেনেছি বিভিন্ন সময়ে। বিশেষত: জোটের রাজনীতিতে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। পেশাগত কারণে খুব কাছে থেকে তা দেখেছি। তরিকুল ইসলামের মত রাজনীতিকদের অভাব আজ প্রকট হয়ে উঠেছে। ফলে রাজনীতি আজ বিবর্ণ। গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে আজ স্মরণ করি তাঁকে। আল্লাহ ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমা করে চিরস্থায়ী ঠিকানায় তাঁকে ভালো রাখুন। জান্নাতবাসী করুন।
লেখক : এম আবদুল্লাহ, সিনিয়র সাংবাদিক, সভাপতি, বংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)।

তরিকুল ইসলামের জীবন ও রাজনীতি
এডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস

এক.
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তরিকুল ইসলাম এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। খুব বেশি বিশেষণ দেওয়ারও প্রয়োজন পড়েনা তাকে চিনতে এবং জানতে। একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্বের গুণে জাতীয় রাজনীতিতে তিনি একটা অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মানের জায়গা তৈরি করে নিয়ে ছিলেন।বাংলাদেশের রাজনীতিতে তরিকুল ইসলাম শুধু একজন ব্যক্তি নয়,একটা প্রতিষ্ঠান। সারাটা জীবন তিনি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে রাজপথে আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশভাগের পূর্বে ১৯৪৬ সালের ১৬ নবেম্বর যশোরে তাঁর জন্ম।পিতা আব্দুল আজিজ ছিলেন একজন ব্যবসায়ী,মাতা নুরজাহান বেগম ছিলেন একজন গৃহিণী।যশোর জেলা স্কুল থেকে ১৯৬১ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন।১৯৬৩ সালে মাইকেল মধুসূদন(এমএম) কলেজ থেকে তিনি কৃতিত্বের সাথে আইএ পাস করেন।তারপর তরিকুল ইসলাম পড়াশোনার জন্য চলে আসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বি.এ এবং ১৯৬৯ সালে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পাস করেন।
দুই.
তরিকুল ইসলামের রাজনৈতিক হাতেখড়ি হয়ে ছিল ছাত্র জীবনেই।তারুণ্যের সোনালী দিনগুলো তিনি উৎসর্গ করেছিলেন সমাজ পরিবর্তনের লক্ষে।যশোর এমএম কলেজে একটি শহিদ মিনার নির্মাণের তথাকথিত অপরাধে তিনি প্রথম গ্রেফতার ও কারাবরণ করেন।১৯৬৩-১৯৬৪ শিক্ষাবর্ষে তরিকুল ইসলাম যশোর এমএম কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন।তিনি বামপন্থী ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তরিকুল ইসলাম এমন এক সময়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন সারা দুনিয়ায় যখন সমাজতন্ত্র ও শোষণ মুক্তির লড়াই তুঙ্গে। ছাত্র সংগঠন হিসাবে ছাত্র রাজনীতির তিনি ছাত্র ইউনিয়নকেই বেছে নিয়েছিলেন।সমাজতান্ত্রিক সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে জীবনের একটা বড় অংশ তিনি ব্যয় করেছেন।
তরিকুল ইসলাম যশোর জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। তিনি সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্র ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেরও যুগ্ম আহবায়ক ছিলেন।একটি জেলা শহরে জন্ম নিয়ে একজন তরুণ স্বপ্ন দেখে ছিলেন সমাজ পরিবর্তনের।মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের।জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়েই কাজ করে গেছেন।
তিন.
ছাত্রনেতা হিসাবে তরিকুল ইসলাম আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে তরুণদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৬৮ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকায় তিনি যশোর ও রাজশাহী কারাগারে তিনি নয়মাস বন্দী ছিলেন।বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী ঘটনা প্রবাহের সাথে তরিকুল ইসলামের রাজনৈতিক জীবন গভীরভাবে জড়িত। তিনি ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে একজন ছাত্র নেতা হিসেবে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন।রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদের নেতৃত্ব দেওয়ায় তাকে গ্রেফতার হতে হয়।১৯৭০ সালে তিনি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি(ন্যাপ) এ যোগদান করেন।মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শন তরিকুল ইসলামকে প্রভাবিত করেছে।ছাত্র জীবনে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন সেই স্বপ্নকে এগিয়ে নিতেই মাওলানা ভাসানীর মতো একজন কিংবদন্তি রাজনীতিবিদের সহকর্মী হয়ে ছিলেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বামপন্থী রাজনীতির আবেদন শূন্যতা এবং বাংলাদেশের বামপন্থীদের রাজনৈতিক বাস্তবতা অনেকের মতো তরিকুল ইসলামকেও হতাশ করে।পরবর্তীতে জাগদল হয়ে তরিকুল ইসলাম ১৯৭৯ সালে শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপিতে যোগদান করেন।প্রতিষ্ঠাকালীন বিএনপির ৭৬ সদস্যের কমিটিতে তরিকুল ইসলাম একজন সম্মানিত সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
চার.
তরিকুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চে তরিকুল ইসলাম মানুষকে ভারতের আগ্রাসন বিরোধী লড়াইয়ে সংগঠিত করে নেতৃত্ব দিয়েছেন।আওয়ামী লীগ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি শন্তু লারমার মধ্যে তথাকথিত শান্তি চুক্তি হলে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠে। বিরোধী দলের শান্তিচুক্তি বিরোধী এক ঐতিহাসিক লংমার্চে তরিকুল ইসলাম বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে মানুষকে সংগঠিত করার দায়িত্ব পালন করেন।তিনি পর্যায়ক্রমে যশোর জেলা বিএনপির আহবায়ক এবং সভাপতি ছিলেন।১৯৮১ সালে ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে শহিদ হন।বিএনপির নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি আব্দুর সাত্তারকে বন্দুকের নলের মুখে পদত্যাগে বাধ্য করে সেনাপ্রধান জেনারেল এইচএম এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন।সামরিক শাসন জারি করে এরশাদ বিএনপিকে ভেঙ্গে নতুন দল গড়ার চক্রান্তে মেতে উঠলেন। অনেক রাজনৈতিক নেতা এরশাদের পাতানো খেলায় ফাঁদে পা দিলেও তরিকুল ইসলাম ছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের প্রতি আপোষহীন। তিনি সব সময়ই বিএনপির মূল ধারায় রাজনীতি করে গেছেন।কোনো চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের ধারে কাছে ছিলেন না।ওয়ান ইলেভেনের সেনাসমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় তরিকুল ইসলামকে দেড় বছর কারাগারে বন্দী জীবন যাপন করতে হয়েছে।কিন্তু দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্বের প্রতি তার আনুগত্যের কোনো অভাব ছিল না।নয় বছরের এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তরিকুল ইসলাম বেগম খালেদা জিয়ার একজন বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বিএনপি ও বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের প্রতি আপোষহীন মনোভাবের জন্য দল তাকে মূল্যায়ণ করতেও ভুল করেনি।তিনি বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, ভাইস চেয়ারম্যান এবং আমৃত্যু ২০০৯ সালের পর থেকে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সম্মানিত সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
পাঁচ.
রাজনৈতিক জীবনে তরিকুল ইসলাম অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছেন।তিনি যে পথ বেছে নিয়েছিলেন সেপথ কোনো সহজ পথ ছিল না। সব সময়ই দুঃসময়কে সঙ্গী করে চলেছেন তেমনটিও নয়।উদিচি হত্যা মামলা, অধুনালুপ্ত রানার পত্রিকার সম্পাদক সাইফুল আলম মুকুল হত্যা মামলা সহ অসংখ্য মিথ্যা ষড়যন্ত্র মূলক মামলায় আসামি হতে হয়েছে তাকে।তরিকুল ইসলাম ১৯৭৩ সালে প্রথম বারের মতো যশোর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তখন থেকেই মূলত তার ভোটের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ শুরু। ১৯৭৮ সালে তিনি একই পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে যশোর সদর আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন।১৯৮১ সালে তরিকুল ইসলাম সড়ক ও রেলপথ প্রতিমন্ত্রী,১৯৯১ সালে এমপি নির্বাচনে পরাজিত হলেও বেগম খালেদা জিয়া প্রথমে তাকে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ও পরে পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রধান করেন।১৯৯৪ সালে এক উপ নির্বাচনে তিনি বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর দায়িত্ব প্রাপ্ত হন।২০০১ সালে আওয়ামী লীগের আলী রেজা রাজুকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন এবং বিএনপি সরকার গঠন করে। সেই সরকারে তরিকুল ইসলাম যথাক্রমে খাদ্য, তথ্য ও বনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজনীতির বাইরে তরিকুল ইসলাম যশোরের আঞ্চলিক পত্রিকা লোকসমাজ এর প্রকাশক ছিলেন। তরিকুল ইসলাম বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেই সব রাজনীতিবিদের একজন যারা একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন।