চীন নাকি কোরিয়া, কে বানাবে চট্টগ্রামের মেট্রোরেল?

0

মিজানুর রহমান॥ ২০১৬ সালের জুনে ঢাকায় দেশের প্রথম মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। এরপর বন্দরনগর চট্টগ্রামেও মেট্রোরেল করা নিয়ে শুরু হয় আলোচনা। পাঁচ বছর ধরে চলা সেই আলোচনা ছিল অনেকটাই গুঞ্জনের মতো। তবে এর মধ্যেই প্রকল্পটি পেতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজেদের মতো কাজ করে যাচ্ছিল। গত ৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে মেট্রোরেল করার ঘোষণা দেন। এরপর থেকে মেগা প্রকল্পটি পেতে প্রকাশ্যে আগ্রহ দেখাচ্ছে বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। চীনের চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এবং দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা (কোইকা) এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের উচ্চপর্যায়ে দেন-দরবার শুরু করেছে। চীন ও কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানের দরকষাকষিতে চট্টগ্রামের মেট্রোরেল প্রকল্প এখন আলোচনার তুঙ্গে। শেষ পর্যন্ত কার হাতে যাচ্ছে এ প্রকল্প, তা নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। দৈর্ঘ্যে প্রায় ৪০-৪৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থে এক থেকে দেড় কিলোমিটার জুড়ে এ স্মার্ট সিটি গড়ে তোলা হবে। সাগরের ডেড এন্ড (শেষপ্রান্ত) বিধায় এখানে উপশহর গড়ে উঠলে ক্ষতি হবে না। দেশে এটি নতুন কনসেপ্ট (ধারণা)।

চীনা প্রতিষ্ঠান বলছে, তারা মেট্রোরেল প্রকল্পটি বিনামূল্যে করে দেবে। বিনিময়ে তাদের মিরসরাই এলাকায় স্মার্ট সিটি প্রকল্প দিতে হবে। সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করে তারা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে লভ্যাংশ ভাগাভাগি করে নিতে চায়। কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান কোইকা তাদের প্রস্তাবনায় বলছে, কম খরচে এ প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি করবে তারা। একই সঙ্গে মেগা এ প্রকল্প বাস্তবায়নে তারা প্রয়োজনীয় অনুদান নিশ্চিত করবে।


সিটি করপোরেশন ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২১ সালের মাঝামাঝি চাইনিজ রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিআরসিসি) চট্টগ্রামে মেট্রোরেলের মেগা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রস্তাব দেয়। এটি তারা সম্পূর্ণ নিজেদের খরচে করে দিতে আগ্রহ দেখায়। এরপর তারা কিছু কাজও করে। চীন এখান থেকে আয় করে সরকারের সঙ্গে লভ্যাংশ ভাগ করবে। এটি তেমন জটিল কিছু নয়। হয়তো ২০ থেকে ২২ বছর তারা এখান থেকে আয় করবে। পরে পুরো প্রজেক্ট সরকারকে বুঝিয়ে দেবে তবে সম্প্রতি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) থেকে বলা হচ্ছে, চীনের চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি শুধু সম্ভাব্যতা যাচাই নয়, প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রকল্পটি বিনামূল্যে বাস্তবায়ন করতে সম্মত। একই প্রস্তাবে চীনা প্রতিষ্ঠান আরও একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চেয়েছে। সেটি হচ্ছে, চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনালের পর থেকে শুরু করে মিরসরাই বঙ্গোপসাগর উপকূলে স্মার্ট সিটি বানাতে চায় তারা। মাঝখানে বাদ যাবে সীতাকুণ্ডের জাহাজভাঙা শিল্প এলাকা। সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের উন্নত শহরের আদলে এ স্মার্ট সিটিতে থাকবে হোটেল-মোটেলসহ উন্নত সুযোগ-সুবিধা। স্মার্ট সিটি প্রকল্প থেকে যা আয় হবে, তা চীনা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ভাগাভাগি করে নেবে। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী হাসান বিন শামস বলেন, ‘চীনের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’
চীনের প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দৈর্ঘ্যে প্রায় ৪০-৪৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থে এক থেকে দেড় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এ স্মার্ট সিটি গড়ে তোলা হবে। সাগরের ডেড অ্যান্ড (শেষপ্রান্ত) বিধায় এখানে উপশহর গড়ে উঠলে ক্ষতি হবে না। দেশে এটি নতুন কনসেপ্ট (ধারণা)। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এভাবে সাগর উপকূলে শহর গড়ে তোলা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘চীন এখান থেকে আয় করে সরকারের সঙ্গে লভ্যাংশ ভাগ করবে। এটি তেমন জটিল কিছু নয়। হয়তো ২০-২২ বছর তারা এখান থেকে আয় করবে। পরে পুরো প্রজেক্ট সরকারকে বুঝিয়ে দেবে।’ চীনের এসব প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা (কোইকা) এ প্রকল্প বাস্তবায়নে জোর আগ্রহ দেখাচ্ছে। তারা লিখিতভাবে কোনো প্রস্তাব না দিলেও কোইকা মেট্রোরেল প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের খরচ ধরেছে ৭৭ কোটি টাকা। যেখানে বলা হয়েছে, সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে তারা ২৬ কোটি টাকা নেবে এবং বাকিটা অনুদান হিসেবে নিজেরা দেবে।
এদিকে ২০২১ সালের মে মাসে সিআরসিসির লিখিত প্রস্তাবনা পাওয়ার পর চট্টগ্রাম নগরে মেট্রোরেল চালুর লক্ষ্যে চসিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে মতবিনিময় করে। সিডিএ, চট্টগ্রাম চেম্বার, পরিবেশ অধিদপ্তর, ট্রাফিক বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা সভায় অংশ নিয়ে নিজেদের মতামত দেন। পরে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শহিদুল আলম সিআরসিসির দেওয়া প্রস্তাবের বিপরীতে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের অনুমতি চেয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন। চিঠি চালাচালির পর এ বছরের ১৯ জানুয়ারি চসিককে সিআরসিসির সঙ্গে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য একটি সমঝোতা সই (এমওইউ) করার বিষয়ে সম্মতি দিয়েছিল মন্ত্রণালয়। তবে এমওইউ সইয়ের আগে হঠাৎ দক্ষিণ কোরিয়ার উন্নয়ন সংস্থা কোইকা এ প্রকল্পে তাদের আগ্রহের কথা জানায়। এরপর বিভিন্ন জায়গা থেকে কোইকাকেও এ প্রকল্পের কাজ দিতে তোড়জোড় শুরু হয়। জানতে চাইলে চসিক মেয়র এম রেজাউল করিম বলেন, ‘তিন মাস আগে মেট্রোরেল বাস্তবায়নের বিষয়ে সরকারকে প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী মেট্রোরেল বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা চাই, যারা কাজ করলে চট্টগ্রামের জন্য ভালো হবে, তাদের দিয়ে কাজ করানো হোক। এটি নিয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কাজ করছে। তারা যে প্রতিষ্ঠানকে ভালো মনে করবেন, তাদের দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করবেন।’