তরিকুল ইসলাম ও অসাম্প্রদায়িকতা

0

নার্গিস বেগম

‘সাম্প্রদায়িকতা’ কথাটি এখন বহুল ব্যবহৃত। সেই সাথে ‘অসাম্প্রদায়িক’ ও ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’। কাউকে গালি দিতে বা দেশদ্রোহী হিসাবে চিহ্নিত করতে চাইলে ‘সাম্প্রদায়িক’ ও ‘মৌলবাদী’ তকমাটি জুড়ে দিলেই হল। তার জীবন বরবাৎ হয়ে উঠবে, কেল্লাফতে। আমাদের ছাত্র-জীবনে, আমরা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গালি দিতাম ‘মোনায়েম খাঁ’ বলে। দেশের স্বার্থ-বিরোধী এবং ঐ নামটি সমার্থক ছিল। স্বাধীনতার পরে এলো ‘কোলাবরেটর’। এই দাগ লাগিয়ে নিজের বিপক্ষের ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে মেরেছে আওয়ামী লীগ। নব্বই এর পরে তারা নতুন বুলি ধরলেন ‘স্বাধীনতার চেতনা’। এবং নতুন গালি ‘রাজাকার’। এই নতুন বুলি ও গালি ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ বিরুদ্ধ মতের রাজনীতিকদের মামলায় জড়াচ্ছে, শাস্তি দিচ্ছে। এখন ঐ অস্ত্র সম্ভবতঃ ভোঁতা মনে হচ্ছে। সে কারণেই নতুন অস্ত্র। সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ। বলার অপেক্ষা রাখে না, সমস্ত অস্ত্রেরই লক্ষ্যবস্তু এদেশের জাতীয়তাবাদী শক্তি। বিশেষ করে বিএনপি।
কুমিল্লার নানুয়ার দীঘির পাড় পূজা মন্ডপে পবিত্র কোরান শরীফ অবমাননার ঘটনায় সমস্ত দেশে বিভিন্ন পূজা মন্ডপে হামলা ও প্রতিমা ভাংচুর, হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে হামলা ও লুটপাট হয়েছে। এবং বিভিন্ন অঞ্চলে হাজারো মানুষ এতে অংশ নিয়েছে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে গুলি চালিয়েছে। প্রাণহানি ঘটেছে। তদন্ত, মামলা, ধরপাকড়, রিমান্ড, সরকারী দল কর্তৃক বিএনপিকে নোংরা ভাষায় অভিযুক্তকরণ সবই চলছে। এ নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়। বলা যায়, সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এসব কিছুই ঘটতো না। বর্তমান সময়ে তরিকুল ইসলামের ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে এ কথাটাই বার বার মনে হচ্ছে। তিনি এবং তাঁর সরকার, যার বিরুদ্ধে সংবিধান পরিবর্তন করে ধর্ম নিরপেক্ষ বদলে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’ ও ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহ্তে বিশ্বাস’ সংযোজন করায় মৌলবাদের উত্থান হয়েছে বলে অভিযুক্ত করে আওয়ামী লীগ, সেই সরকারের আমলে সংখ্যালঘুরা কি এর চাইতে অনিরাপদ ছিল?
তরিকুল ইসলামের জন্ম ও বেড়ে উঠা যশোর শহরের একটি রক্ষণশীল, মধ্যবিত্ত, ব্যবসায়ী পরিবারে। রাজনীতির চর্চা ছিল না। সদ্য ভূমিষ্ট পাকিস্তানে তাঁর শৈশব কেটেছে। পঞ্চাশ এর দশকে নতুন রাষ্ট্র গড়ে উঠার সময়ই তাঁর বাল্য ও কৈশোর কাল। নতুন রাষ্ট্রের নরম পলিমাটিতে যে রাজনীতিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিচয় তৈরী হচ্ছিল, তাঁর বেড়ে উঠার বয়সই ছিল সেটা। সব কিছুই তাঁর চরিত্রে প্রভাব রেখেছে। যশোর ছিল চিরকালই সাংস্কৃতিকভাবে উন্নত। উচ্চবর্ণের শিক্ষিত হিন্দুদের বসবাস এবং প্রভাব ছিল এখানে। তাঁদের মধ্যে সঙ্গীত, সাহিত্য, নাট্যচর্চা ছিল। মুসলিম সম্প্রদায়ও পিছিয়ে ছিলেন না। সাংস্কৃতিক চর্চায় হিন্দু মুসলিম সমভাবে অংশ নিতেন। গানের স্কুল ছিল। ঘরে ঘরে সঙ্গীত চর্চা ছিল। সেই ৫০’এর দশকে মাইকেল মধুসূদন কলেজে ছাত্র সংসদ এর অনুষ্ঠানে মাহমুদুল এবং মঞ্জু আপা অভিনয় করেছেন। নারী চরিত্রে পুরুষরাই অভিনয় করতেন। নারীর অভিনয় তখন দুঃসাহস। কলেজে তখন ছাত্র রাজনীতির চর্চা শুরু হয়েছে। ভাষা আন্দোলনে যশোর সাহসী ভূমিকা পালন করে। তেমনি শুরু হয়েছে স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলন। যশোর জিলা স্কুলের ছাত্র হওয়ায়, এই রাজনীতিক ও সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের আবহ তাঁকে প্রভাবিত করেছে। তখন মহরমের জাঁকালো তাজিয়া মিছিল যেমন হতো, তেমনি শান শওকতের সাথে পালিত হতো দূর্গোৎসব। সকল সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েরাই পূজা উপলক্ষে আয়োজিত মেলায় যেত। বাচ্চাদের জন্য মেলার আলাদা বাজেট রাখতে হতো। দাঙ্গা কখনও হয়নি। উভয় ধর্মের লোকজন এ ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। তরিকুল ইসলামের পিতা মরহুম আবদুল আজিজ প্রথম জীবনে স্কুল ইন্সপেক্টর ছিলেন। পরে চাকরি ছেড়ে ব্যবসায়ে আসেন। তিনি অত্যন্ত ধর্মপরায়ন ব্যক্তি ছিলেন। ১৯৬৪ সালে পবিত্র হজ্জ্বব্রত পালন করেছিলেন। তখন জাহাজে করে যেতে হতো। ধর্মপালনে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান এই ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গী ছিল অত্যন্ত উদার। তাঁর বড় দু’পুত্র, মরহুম নূরুল ইসলাম ও মরহুম সিরাজুল ইসলামের বেশির ভাগ বন্ধুই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের। তাঁদের অবাধ যাতায়াত ছিল এ বাড়িতে, তাঁর মাতাও বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক ভাবেই নিতেন। ঈদের দিন তাঁদের আসার জন্য সবাই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতেন। তেমনি পূজা উপলক্ষে তাঁদের বাড়ির বিবাহ বা অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠানে এঁদের বাড়ির মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল খুবই স্বাভাবিক। সম্পর্কটা ছিল একেবারেই পরিবারিক। তাঁরা প্রয়াত হবার পরেও তাঁদের সন্তানেরা সম্পর্কটি অটুট রেখেছেন।
সুতরাং, তরিকুল ইসলামকে অসাম্প্রদায়িক হবার জন্য বিশেষ কোন চেষ্টা করতে হয়নি। বা তাঁর পরিচয়কে বিশেষ অভিধা দেবার প্রয়োজন হয়নি। এটি তাঁর চরিত্রের অংশ ছিল। তিনি মহান আল্লাহর একত্বে গভীর বিশ্বাসী ছিলেন। একই সাথে অন্য সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতাকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন। সম্প্রদায় হিসাবে নয়; মানুষ হিসাবে দেখেছেন সবাইকে।
সংকটে সহায়তা দিয়েছেন। ১৯৬৪ সালে ভারতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাধলে এখানকার অবাঙালিরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ভিতরে ভিতরে সংগঠিত হতে থাকে। বগচরে তখন অনেক হিন্দু বসতি ছিল। তাঁদের আক্রান্ত হবার আশংকা দেখা দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যরা ক্লাস ফেলে ছুটে গিয়েছিল তাদের রক্ষা করতে। তরিকুল ইসলাম তাদের অন্যতম ছিলেন।
কেশশ্রী সেলুনের সত্ত্বাধিকারী রাজকুমার দা’ বয়সে বড় হলেও তাঁর সাথে সর্ম্পকটি ছিল বন্ধুর মতো। চুল কাটাবার জন্য শুধুই নয়, মাঝে মাঝে গল্প করবার জন্যও যেতেন। ও বাড়ি ছিল তাঁর নিজের বাড়ি। স্বাধীনতার পরে রাজকুমার দা ১৬০০০ টাকায় একটি জমি ক্রয়ের বায়না করেন। কিন্তু পরে জমির মালিক ১৮০০০ টাকা না দিলে জমি রেজিস্ট্রি করতে অস্বীকার করেন। তিনি ছিলেন সরকার পক্ষের লোক। প্রভাবশালী। তরিকুল ইসলাম তখন যশোর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান। সময় ১৯৭৩/৭৪। বন্ধুর পাশে দাড়ালেন এবং মালিককে ওই ১৬০০০ টাকায় রেজিস্ট্রি করে দিতে বাধ্য করলেন। ওই জমির সনাক্তকারীও হলেন তিনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে বার্ধক্যকবলিত রাজকুমার দা’র অনুভূতি জানতে চাইলে বলেন, ‘শূণ্যতা অনুভব করছি। অনেক নেতাই আসতেন এখানে, কিন্তু তিনি ছিলেন অন্যরকম।’
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে, যখন ভারত ফেরত তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে হাতে অস্ত্র, দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সারা শহর, সেই সময় তরিকুল ইসলামের একজন হিন্দু বন্ধু ক্রন্দনরত অবস্থায় ছুটে এসে জানালো, তার বাড়িতে অস্ত্রধারী একজন তরুণ তার বোনকে অপদস্থ করছে। আড্ডা ফেলে তিনি ছুটলেন, খালি হাতে। দেখলেন, দ্রৌপদীর বস্ত্র হরনের পুরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে। বিছানার উপরে স্টেনগান। মেয়েটি অসহায়ভাবে দয়া ভিক্ষা করছে। পূর্বাপর না ভেবেই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন ছেলেটির উপর। জামার কলার ধরে টেনে তুলে জোরে মারলেন এক চড় এবং ঘুষি। সঙ্গে গালাগাল। ছেলেটি তড়িতে উঠে, ভাই! বলে বেরিয়ে গেল। পরে তিনি বলেছিলেন, ‘ঐ অস্ত্রটি সুযোগ পেয়েও কেন ব্যবহার করেনি সেটিই অবাক ব্যাপার।’ এরকম অনেক ঘটনাই আছে। যেটি তিনি ফলাও করে কখনও বলেননি। জানা গেছে, উপকারভোগী বা অন্য কারো নিকট থেকে।
১৯৯২ সালে ভারতে বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার ঘটনায় দাঙ্গা শুরু হলে সারাদেশের মুসলিমরা ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন। প্রতিবাদে সর্বত্র মিছিল হয়। যশোরেও উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। তরিকুল ইসলাম তখন মন্ত্রী। আইন শৃংখলা রক্ষা কমিটির মিটিংয়ে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করে পুলিশকে নির্দেশ দেন সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে। এবং হিন্দু বসতিপূর্ণ এলাকায় পাহারার ব্যবস্থা করেন। তাঁরা নিরাপদ ছিলেন। এখনও তাঁর সেই ভূমিকার কথা হিন্দু সম্প্রদায় শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় তিনি অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু এটি নয় যে কোন জাতীয় সংকটে যেমন উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার পরে তিনি সেই গভীর রাতে হাসপাতালে ছুটে যান এবং আহতদের চিকিৎসা দেন। নিজের গাড়িতে করে আহতদের উন্নত চিকিৎসার্থে খুলনায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। তেমনি রিকসাওয়ালাদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হলে পুলিশ গুলি চালিয়ে কয়েকজনকে হত্যা করে। শহরময় আতঙ্ক, হরতাল, পুলিশের তান্ডব। তরিকুল ইসলাম এগিয়ে গেলেন। প্রশাসনের সাথে আলোচনায় বসলেন। অবস্থা শান্ত হয়ে এলে। অথচ এই দুইটি ঘটনার সময়ই কিন্তু তিনি ছিলেন বিরোধী দলে। প্রথমটির সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, দ্বিতীয় ঘটনার সময় স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন্য রাজনীতিবিদ। একই সাথে সমাজসচেতন মানবদরদী। তাঁর কর্মকান্ডের মূল লক্ষ্য ছিল মানুষের কল্যাণ, দেশ ও জাতির কল্যাণ। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর বন্ধু এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মরহুম খালেদুর রহমান টিটো বলেছিলেন, ‘যশোরের মানুষ এখন বুঝতে পারবে, তারা কি হারালো?’
তাঁর মুত্যুর পরে জানাযা’য় মানুষের ঢল নেমেছিল। মানুষের কত আপন ছিলেন তিনি সংখ্যাতীত শোকার্ত মানুষের উপস্থিতি তার প্রমাণ দেয়। তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক। দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বকীয়তা রক্ষায় তাঁর ভূমিকা ছিল স্পষ্ট, আপোষহীন। তাঁর মতো নেতার প্রয়োজন বেশি করে অনুভূত হবে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটে।
মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন, তার কাজকে কবুল করুন।

নার্গিস বেগম
সম্পাদক
দৈনিক লোকসমাজ