যশোর শিক্ষাবোর্ডে হরিলুট ! # আরও ২ কোটি ৪৩ লাখ টাকার চেক জালিয়াতির ঘটনা ফাঁস

0

স্টাফ রিপোর্টার ॥ যশোর শিক্ষাবোর্ড হরিলুটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। মাত্র ১৫ দিনের মাথায় আবারও ২ কোটি ৪৩ লাখ ৭ হাজার ৮৭৮ টাকার চেক জালিয়াতি ধরা পড়েছে। এর আগে ৭ অক্টোবর ৯টি চেকে আড়াই কোটি টাকার জালিয়াতি ধরা পড়ে। প্রথম ঘটনায় দুদক মামলা করেছে। এরপর গত ১১ অক্টোবরে আরও একটি চেকে ১৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকার জালিয়াতি ধরা পড়ে। গত বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) ধরা পড়ে ২ কোটি ৪৩ লাখ টাকার জালিয়াতি। এ জালিয়াতি হয়েছে ১৬টি চেকের মাধ্যমে। এ নিয়ে ৩ দফায় ২৬টি চেকের মাধ্যমে ৫ কোটি ১০ লক্ষাধিক টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়েছে। শিক্ষাবোর্ডের সচিব বরাবর উপপরিচালক (হিসাব ও নীরিক্ষা) এবং অডিট অফিসার কর্তৃক পাঠানো দুইটি লিখিত অভিযোগে এই চেক জালিয়াতির কথা উল্লেখ করা হয়। শিক্ষাবোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাধবচন্দ্র রুদ্র বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করেছেন।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০১৬-১৭, ১৭-১৮, ১৮-১৯ ও ১৯-২০ এই চার অর্থ বছরে ১১টি চেকে ১০ লাখ ১৫ হাজার ২৬৬ টাকার স্থলে জালিয়াতি করে ২ কোটি ২১ লাখ ৮ হাজার ৯৪৯ টাকা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, আগের চেক জালিয়াতিতে সংশ্লিষ্ট ও জালিয়াতির দায় স্বীকারকারী আব্দুস সালাম হিসাব প্রদান শাখায় বদলি হওয়ার আগে অডিট বিভাগে প্রায় ৫ বছর কর্মরত ছিলেন। সেখানে থাকাকালীন ব্যাংক স্টেটমেন্টের সাথে মুড়ি বইয়ের মিলকরণসহ অন্যান্য কাজ করতেন। এ কারণে অডিট অফিসার ও উপপরিচালক সন্দেহের জায়গা থেকে সে সময়ের আর্থিক লেনদেনের দিকগুলো পরীক্ষা করেন।
নিরীক্ষার সময় ১১টি চেকের জালিয়াতি ধরা পড়ে। এর মধ্যে একটি চেকে সালাম নিজের টিএ বিল বাবদ ৬ হাজার ১৯৬ টাকার জায়গায় ২৫ লাখ ৮০ হাজার ১০ টাকা উঠিয়ে নিয়েছেন। গত বছরের ৪ মার্চ এ ঘটনাটি ঘটে। ১০টি চেক বিজনেস আইটি, নূর এন্টারপ্রাইজ, খাজা প্রিন্টিং প্রেস, নিহার প্রিন্টিং প্রেস, সামিয়া ইলেক্ট্রনিক্স, মিম প্রিন্টিং প্রেস, শাহীলাল স্টোরের নামে এবং একটি চেক সেকশন অফিসার আবুল কালাম আজাদের নামে। সেকশন অফিসারের ৯৪ হাজার ৩১৬ টাকার বিলের স্থলে ৭.১০.২০১৯ তারিখে ৩০ লাখ ৯৮ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
এছাড়া উপপরিচালকের দফতর থেকে সচিবকে দেওয়া অপর অভিযোগে জানানো হয়েছে, বোর্ডের ২০২০-২২ অর্থ বছরের ব্যাংক স্টেটমেন্টের সাথে চেকের মুড়ি বই যাচাইকালে ৫টি চেক জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। ওই ৫টি চেকে বিভিন্ন বিল বাবদ ৪ লাখ ৫৬ হাজার ৭৬৪ টাকা ছিল। জালিয়াতির মাধ্যমে ২১ লাখ ৯৮ হাজার ৯২৯ টাকা ব্যাংক থেকে ওঠানো হয়েছে। চেকগুলো নূর এন্টারপ্রাইজ, শরিফ প্রিন্টিং প্রেস ও অর্পানেটকে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষাবোর্ডের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, অভিযোগে ১ ও ২ নম্বর (২০১৭ সালের) ক্রমিকে বর্ণিত চেক দুটি বর্তমান চেয়ারম্যান যখন সচিব ছিলেন সে সময়ের। ক্রমিকের ৩ ও ৪নম্বর চেক দুটি (২০১৯ সালের) স্বাক্ষরের সময় প্রফেসর মো. তবিবর রহমান সচিব ছিলেন। এ সময় বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রফেসর মোহাম্মদ আব্দুল আলীম। ৫নম্বর থেকে ১৬ নম্বর ক্রমিকের চেকে বর্তমান সচিব প্রফেসর এএমএইচ আলী আর রেজা সচিব ছিলেন। এ সময় দায়িত্ব পালন করেন দুজন চেয়ারম্যান। প্রফেসর মোহাম্মদ আব্দুল আলীম ও বর্তমান চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোল্লা আমীর হোসেন। বর্তমান চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোল্লা আমীর হোসেন ২০২০ এর জানুয়ারি থেকে চেয়ারম্যানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেণ। এর আগে তিনি বোর্ডের সচিব ছিলেন। সে সময় তার নামে নানাবিধ দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এক পর্যায়ে সচিব পদ থেকে তাকে অপসারণ করা হয়। পরে বিভিন্ন মহলে তদবিরের মাধ্যমে বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে ফিরে আসতে সক্ষম হন বলে প্রচার রয়েছে। সে সময় তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠানো হয়েছিল বলে জানা যায়।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বর্তমানের ১৬টি চেকের দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগটি বোর্ড সচিবের দফতরে জমা হলেও প্রকাশ্যে আসতে বিলম্ব হয়। রাত ১১টার দিকে প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের ওয়ালে এ তথ্যটি প্রকাশ পায়। ছুটি থাকায় শিক্ষাবোর্ডের দায়িত্বশীল কারো কাছ থেকে তথ্য জানা দুরূহ হয়। শুক্রবার বিকেলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সচিব এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাধবচন্দ্র রুদ্র মোবাইল ফোনে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তবে অফিস বন্ধ থাকায় তিনি বিস্তারিত জানাতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। আগামী কার্যদিবসে ফাইলগুলো দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে বলে তিনি জানান। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, গত ৯টি চেকের জালিয়াতি ও দুর্নীতির জন্যে ইতোমধ্যে দুদক যশোর কার্যালয়ে মামলার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
উল্লেখ্য, চলতি মাসে ৩ দফায় ২৬টি চেকে ৫ কোটি ১০ লাখ টাকার বেশি জালিয়াতি ও দুর্নীতির মাধ্যমে শিক্ষাবোর্ডের ব্যাংক হিসাব থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। এসব টাকার চেকে সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান সচিবের যেমন স্বাক্ষর রয়েছে তেমনি চেক প্রস্তুত ও জালিয়াতির সাথে বোর্ড কর্মচারী পলাতক আব্দুস সালামের নাম রয়েছে। প্রথম দফায় ধরা পড়া ৯টি চেকে জালিয়াতির জন্যে বর্তমান চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোল্লা আমীর হোসেন, সচিব প্রফেসর এএমএইচ আলী আর রেজা, হিসাব সহকারী আব্দুস সালাম, ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং এবং শাহীলাল স্টোরের মালিকদের নামে দুদক মামলা করেছে। এদিকে নতুন আরও ২ কোটি টাকার জালিয়াতি ধরা পড়ার পর শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দাবি জানিয়েছেন আরও তদন্ত করার। একই সাথে এসব জালিয়াতিতে জড়িতদের আটক ও চাকরি থেকে অব্যাহতিরও দাবি তাদের। শিক্ষাবোর্ডকে দুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি দিতে তারা সরকার ও শিক্ষামন্ত্রির হস্তক্ষেপ কামনা করেন।