ঝুলে আছে ২৬ হাজার মামলা, হচ্ছে আরও ৭ শ্রম আদালত

0

মাসুদ রানা॥ দেশের ১০টি শ্রম আদালতে প্রায় ২৫ হাজার ৭৭০টি মামলা ঝুলে আছে। নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না কোনো মামলাই। তাই শ্রমিকদের হয়রানি ও মামলাজট কমাতে পুরোনো জেলা শহরগুলোতে আরও সাতটি শ্রম আদালত গঠন করতে যাচ্ছে সরকার। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে এ তথ্য জানা গেছে। অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত, ন্যায্য পাওনা বঞ্চিত হওয়াসহ শ্রমক্ষেত্রে নানা সমস্যা বা জটিলতার সমাধান ট্রেড ইউনিয়ন বা অন্যভাবে মেটানো সম্ভব না হলে শ্রম আদালতে মামলা করেন শ্রমিকরা। শ্রম আইন অনুযায়ী ৬০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির বিধান থাকলেও বছরের পর বছর ঝুলে থাকে এসব মামলা। আদালতের সংখ্যা কম হওয়ায় মামলা পরিচালনা ও যাতায়াতের ক্ষেত্রেও শ্রমিকদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আদালতের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। নতুন সাতটির মধ্যে চারটি শ্রম আদালত গঠনের প্রক্রিয়া অনেকটাই এগিয়ে গেছে। কার্যক্রম শুরুর অপেক্ষায় আছে আরও তিনটি শ্রম আদালত। দেশে বর্তমানে ১০টি শ্রম আদালত আছে, পাশাপাশি একটি শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। শ্রম আদালতের মধ্যে ঢাকায় আছে তিনটি। ঝুলে থাকা মোট মামলার ৮০ শতাংশই ঢাকার তিনটি আদালতে।
এ বিষয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব মো. এহছানে এলাহী বলেন, শ্রম আদালতগুলোতে মামলা নিষ্পত্তির হার বৃদ্ধির প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে আমাদের পদক্ষেপ আছে। পুরোনো সাতটি জেলা শহরে নতুন শ্রম আদালত গঠনের জন্য শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল এবং আইন ও বিচার বিভাগের সম্মতি আমরা পেয়েছি। এখন এ বিষয়ে প্রক্রিয়া শুরু হবে। আদালতের সংখ্যা বাড়াতে পারলে শ্রমিকদের হয়রানি কমবে জানিয়ে সচিব বলেন, এখন একজন শ্রমিককে মামলা করতে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম আসতে হয়। কক্সবাজারে আদালত করতে পারলে তার ভোগান্তি কমবে। আমরা যদি সব জেলায় কিংবা বড় বড় জেলায় করতে পারি, তবে মানুষ স্বল্প খরচে, স্বল্প সময়ে সেবা পাবে। শ্রম আদালত বাড়ানোর পদেক্ষেপ আমাদের আছে। শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের সদস্য (সাবেক জেলা জজ) হোসনে আরা বেগম বলেন, আরও সাতটি শ্রম আদালত হচ্ছে। আমাদের থেকে যেটা করার সেটা আমরা করছি। তিনি বলেন, শ্রম আদালতগুলোতে অনেক মামলা রয়েছে। আমাদের আপিল টাইব্যুনালে আমরা প্রতি মাসে ১৫-২০টি করে মামলা নিষ্পত্তি করছি। আগামী মাসের মাঝামাঝি সময়ে সেমিনার হবে, সেখানে শ্রম আদালত, মামলাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। যেন সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে মামলা নিষ্পত্তিতে গতি আনা যায়।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (আদালত অধিশাখা) মোহাম্মদ আহম্মেদ আলী বলেন, শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল ও শ্রম আদালতগুলোতে গত সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ২৫ হাজার ৭৭০টি মামলা অনিষ্পন্ন রয়েছে। এর মধ্যে ২১ হাজার মামলাই ঢাকার তিনটি আদালতের। শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আছে এক হাজার ৩০০- এর মতো মামলা। সেপ্টেম্বর মাসে শ্রম আদালতগুলোতে ৬৭১টি মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং ৫১০টি মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। ময়মনসিংহ বিভাগসহ পুরোনো জেলা শহরে নতুন শ্রম আদালত গঠনের জন্য সংশ্লিষ্টদের সম্মতি পাওয়া গেছে জানিয়ে উপসচিব বলেন, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, বগুড়া, পাবনা ও নোয়াখালী জেলায় নতুন সাতটি শ্রম আদালত গঠন হবে। এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানোর জন্য নির্ধারিত চেকলিস্ট অনুযায়ী গত ১২ সেপ্টেম্বর শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সিলেট, বরিশাল ও রংপুরে নবগঠিত তিনটি আদালতে রেজিস্ট্রার পদে পদায়নের প্রজ্ঞাপন জারি করেছে পিএসসি (সরকারি কর্ম কমিশন)। এই আদালতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির আউটসোর্সিংয়ে সৃজিত পদে নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে এবং সরাসরি জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়াও চলছে।
গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও ফরিদপুর জেলায় নতুন চারটি শ্রম আদালত স্থাপনের প্রক্রিয়াও চলছে জানিয়ে আহম্মেদ আলী বলেন, এই চার জেলায় শ্রম আদালতের পদগুলো প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায় উত্থাপনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়। ফরিদপুর জেলায় মামলা কম থাকায় সেখানে শ্রম আদালত গঠন না করে সার্কিট বেঞ্চের (নির্দিষ্ট সময়ে কোর্ট বসিয়ে মামলা নিষ্পত্তি) মাধ্যমে নিষ্পত্তির জন্য অনুরোধ করা হয়। তবে পদ্মা সেতু হলে সেখানে শিল্পায়নসহ যৌক্তিকতা তুলে ধরে আদালত স্থাপনের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। অবশ্য শ্রম আদালতগুলোতে মামলা নিষ্পত্তিতে নির্ধারিত সময়ের কয়েকগুণ বেশি লাগছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) ‘টায়ার দেম আউট: চ্যালেঞ্জেস অব লিটিগেটিং কমপেনসেশান ক্লেইমস আন্ডার বাংলাদেশ লেবার অ্যাক্ট ২০০৬’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, শ্রম আদালত কর্মক্ষেত্রে আঘাত ও মৃত্যুর মামলাগুলোর রায় দেওয়ার জন্যে গড়ে ৬০১ দিন সময় নিয়েছে।
বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাহ আলম ভূঁইয়া বলেন, শ্রম আদালতের প্রতি আমি আস্থা হারিয়ে ফেলেছি। আমার সেক্টরের কোনো শ্রমিককে আমি শ্রম আদালতে মামলার করার পরামর্শ দেই না। তিনি বলেন, একজন শ্রমিক অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত হলে বা মালিকের মাধ্যমে কোনো অন্যায়ের শিকার হলে এর প্রতিকার পেতে চার থেকে ছয় বছর লেগে যায়। ততদিনে হয় শ্রমিক মারা যান, না হয় শ্রমিকের ওই মামলার পেছনে দৌঁড়াবার মতো সামর্থ্য থাকে না।
‘মালিকপক্ষ কোনো অন্যায় করলে আমরা সাংগঠনিকভাবে আলোচনা করে সেই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করি। তবে শ্রম আদালতের সবচেয়ে ভালো দিক হলো মামলায় শ্রমিকরাই জেতেন। কিন্তু খারাপ দিক হলো—আদালতের রায় হয়, বাস্তবায়ন হয় না।’ শাহ আলম ভূঁইয়া বলেন, আদালতে মলিককে হাজির করা যায় না। পুলিশ মালিক খুঁজে পায় না। এসব কারণে আমি শ্রম আদালতে যাই না। কোনো শ্রমিক বিপদে পড়ে এলেও আমি তাকে মামলায় যেতে বলি না।
কোন শ্রম আদালতের আওতায় কোন অঞ্চল
ঢাকার প্রথম শ্রম আদালতের আওতায় রয়েছে- মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর ও নরসিংদী জেলা। এছাড়াও রয়েছে কেরানীগঞ্জ, দোহার, সাভার, তেজগাঁও, নবাবগঞ্জ, ধামরাই, গুলশান, রমনা, বাড্ডা, শাহবাগ, শেরে বাংলানগর, পল্টন, কাফরুল, হাতিরঝিল ও বনানী থানা। ঢাকার দ্বিতীয় শ্রম আদালতের আওতায় রয়েছে- ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ ও গাজীপুর জেলা। এছাড়াও রাজধানীর সবুজবাগ, কোতয়ালি, মতিঝিল, সূত্রাপুর, ডেমরা, শ্যামপুর, খিলগাঁও, বংশাল, ওয়ারী, মুগদা ও কদমতলি থানা রয়েছে। ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের আওতায় রয়েছে- ময়মনসিংহ, শেরপুর, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও নারায়ণগঞ্জ জেলা। এছাড়াও রয়েছে- লালবাগ, মোহাম্মাদপুর, ধানমন্ডি, মিরপুর, পল্লবী, ক্যান্টনমেন্ট, উত্তরা, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর, আদাবর, কলাবাগান, দারুস সালাম ও বিমানবন্দর থানা। চট্টগ্রামের প্রথম শ্রম আদালতের অধীনে রয়েছে- চট্টগ্রাম জেলা (ডবলমুরিং, সদরঘাট, বাকলিয়া ও চাঁদগাঁও থানা ছাড়া), কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলা। বন্দর নগরীর ডবলমুরিং, সদরঘাট, বাকলিয়া, ও চাঁদগাঁও থানা এবং কুমিল্লা, ফেনী, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা রয়েছে চট্টগ্রামের দ্বিতীয় শ্রম আদালতের অধীনে। খুলনা বিভাগের সব জেলা নিয়ে খুলনা শ্রম আদালত, রাজশাহী বিভাগের সব জেলা নিয়ে রাজশাহী শ্রম আদালত, সিলেট বিভাগের সব জেলা নিয়ে সিলেট শ্রম আদালত, বরিশাল বিভাগের সব জেলা নিয়ে বরিশাল শ্রম আদালত এবং রংপুর বিভাগের সব জেলা নিয়ে রংপুর শ্রম আদালত রয়েছে।