ইসি গঠনে বিশিষ্টজনরা চান ‘উচ্চকক্ষ’

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা বেশ জমে উঠেছে। সরকারি দল বলছে, গেলবারের মত এবারও ‘সার্চ কমিটি’র মাধ্যমেই ইসি গঠন হবে। বিরোধীরা এ পদ্ধতি প্রত্যাখ্যান করছেন৷ কেউ কেউ আবার ইসি গঠনে আইন প্রণয়নের দাবি তুলছেন। তবে বিশিষ্টজনেরা চাইছেন, এ সংকট উত্তরণে জাতীয় সংসদে ‘উচ্চকক্ষ’ গঠন হোক। এ পদ্ধতি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও আছে। শুক্রবার (৮ অক্টোবর) রাজধানীর পরীবাগে সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রে ‘নির্বাচন কমিশন গঠনে পূর্ণাঙ্গ আইনের প্রয়োজনীয়তা ও রূপরেখা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এমন দাবি উঠে এসেছে। অদলীয় রাজনৈতিক সামাজিক মঞ্চের ওই সভায় লিখিত বক্তব্যে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জাতীয় সংসদের একটি ভূমিকা থাকতে হবে। আইনে নির্বাচন কমিশনে সম্ভাব্য নিয়োগপ্রাপ্তদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার মাপকাঠি সুস্পষ্ট করতে হবে, যাতে সঠিক ব্যক্তিরা নিয়োগ পান। তিনি বলেন, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নির্বাচনকালীন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা সরকারের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।
উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশের নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া লিখিত বক্তব্যে তুলে ধরেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, ভারত ছাড়া নেপাল, ভুটান, পাকিস্তানে সংবিধানের আলোকে প্রণীত আইনের প্রতিষ্ঠিত কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। এ অঞ্চলের ছোট কিন্তু ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নতুন গণতান্ত্রিক দেশ ভুটানেও সব সাংবিধানিক পদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সংবিধানের আওতাধীন আইনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এসব সাংবিধানিক পদের মধ্যে নির্বাচন কমিশনার অন্যতম। এসব পদে নির্বাচনের জন্য একটি পর্ষদ রয়েছে। পর্ষদের নেতৃত্বে রয়েছেন সংসদের উচ্চকক্ষ ন্যাশনাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। পর্ষদের সদস্য হিসেবে থাকেন প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, নিম্নকক্ষের স্পিকার ও বিরোধী দলের নেতা। এই পর্ষদ প্রাপ্ত সব নাম পর্যালোচনা করে তাদের নির্বাচিত নামের তালিকা ‘ড্রুক গিলারপোর’ (ভুটানের রাজা) কাছে পাঠায়। রাজার মাধ্যমে নিয়োজিত হয় নির্বাচন কমিশন। এ নিয়োগ পদ্ধতি স্বচ্ছ বলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক ও অঙ্কুর প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সংসদের দুটি কক্ষ থাকবে। উচ্চকক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব পালন করবে। সেটিই কার্যকর থাকবে স্থায়ীভাবে, এটি একটি চমৎকার প্রস্তাব। এটি ভাবা যেতে পারে। উচ্চকক্ষের কথা আগে থেকেই বলা হচ্ছিল। সভাপতির বক্তব্যে সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক হুমায়ুন কবির হিরু বলেন, জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ থাকলে আজকে বাংলাদেশে অনেক প্রশ্ন উঠতো না। আমরা চাই বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে সে সংকটের সমাধান হোক। সবাই নিজ নিজ দলের কথা বলছেন। দলের কথায় নির্বাচন কমিশন করা, দলের কথায় এমপি বানানো- এগুলোর পাশাপাশি আমরা চাই, যেন শ্রম-কর্ম-পেশার প্রতিনিধিত্বশীল একটা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সংবিধানের মাধ্যমে সব ব্যবস্থাগুলোকে সমন্বয় করতে পারি। তিনি বলেন, দেশে যারা নীতি প্রণয়ন করেন তারা নীতি সঞ্চালন করেন না। নীতি প্রণয়ন ও সঞ্চালনকারীদের সমন্বয় করার জন্য জাতীয় সংসদের দুটি কক্ষ দরকার। সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মঞ্চের সদস্য সচিব অয়ন আমান। মূল প্রবন্ধে বলা হয়, শুধু শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দল ও অদলীয় রাজনৈতিক সামাজিক শক্তির মধ্যে সাংবিধানিক সমঝোতা, রাজনৈতিক সমঝোতা। রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি শ্রম-কর্ম-পেশার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন করা আবশ্যিক। এ প্রতিনিধিত্ব একাত্তরের সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাঙালিত্বকে আরো সুদৃঢ় ও বেগবান করবে। বাঙালির চলমান তৃতীয় জাগরণের এ পথচলা সভ্যতা নির্মাণের অগ্রযাত্রায় অংশীদার হবে। সংসদের উচ্চকক্ষ থেকে নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচন কমিশন গঠনের বিধানের মাধ্যমে এ সমস্যার স্থায়ী ও সাংবিধানিক সমাধান সম্ভব। এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচন কমিশনের উদাহরণ রয়েছে।
মূল প্রবন্ধে রূপরেখা হিসেবে ১৪টি দফা প্রস্তাব করা হয়। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে: অদলীয় শ্রম-কর্ম-পেশার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় সংসদের ‘উচ্চকক্ষ’ গঠন করতে হবে। নির্বাচন কমিশন হবে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন সংস্থা। সংসদের ‘উচ্চকক্ষ’ থেকে ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ ও ‘নির্বাচন কমিশন’ গঠিত হবে। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে; এই কমিশন সংসদে অনুমোদিত হতে হবে। প্রস্তাবে আরও বলা হয়, নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণভাবে সরকার নিয়ন্ত্রণমুক্ত সাংবিধানিক সত্তা নিয়ে স্থায়ীভাবে নিয়োজিত থাকবে। জেলা, মহানগর, পৌরসভা, শিল্প এলাকা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্বাচন কমিশনার থাকবে। নির্বাচন কমিশন একবার গঠিত হওয়ার পর স্বেচ্ছায় পদত্যাগ অথবা জাতীয় সংসদ কর্তৃক প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত নিয়োগপ্রাপ্ত সময়ের জন্য বহাল থাকবে। নির্বাচন কমিশন আধা-বিচার বিভাগীয় বলে গণ্য হবে। প্রস্তাবে বলা হয়, কেন্দ্র, মহানগর, পৌরসভা, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন এবং শিল্প এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব অফিস, কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকবে; এর জন্য পৃথক বাজেট বরাদ্দ থাকবে। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের অধীনে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থাকবে।
এতে বলা হয়, নির্বাচন সংক্রান্ত যে কোনো বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। জাতীয় সংসদ প্রণীত বিধি মোতাবেক নির্বাচন কমিশন পরিচালিত হবে। সব রাজনৈতিক দল এবং শ্রম-কর্ম-পেশার প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় পর্যায় থেকে সব স্তরে ‘ভোট পর্যবেক্ষক’ কমিটি থাকবে। নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল নির্বাচন সংক্রান্ত সব অভিযোগ নিষ্পত্তি করবে। মঞ্চের প্রধান সমন্বয়ক অধ্যাপক হুমায়ুন কবির হিরুর সভাপতিত্বে আলোচনায় আরও অংশ নেন অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব আব্দুস সালাম মিয়া, ব্যারিস্টার সাদিয়া আরমান, সামাজিক শক্তির আহ্বায়ক হাবীবুল্লাহ, অধ্যক্ষ বাকী উল্লাহ, তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারী সমন্বয় পরিষদের সভাপতি এম এ আউয়াল, মঞ্চের মোশাররফ হোসেন, মোশারেফ হোসেন মন্টু, সাকিল সৈকত ও রায়হান তানভীর প্রমুখ।