শুক্রবারে শপথ, শনিবারে ডাকাতি

0

নুরুজ্জামান লাবু॥ ডাকাতির জন্য নির্দিষ্ট দিন ঠিক করে রাখতো তারা। সেটা ছিল সপ্তাহের প্রথম দিন শনিবার। এর আগে শুক্রবার তারা একসঙ্গে জড়ো হয়ে শপথ নিতো। যেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে সহযোগীদের নাম কেউ না বলে। এভাবেই পরিকল্পনা করে মাসের পর মাস ডাকাতি করে আসছিল এই গ্রুপ। তাদের টার্গেট ছিল মতিঝিলের ব্যাংকপাড়া। ব্যাংক বা মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান থেকে পরিমাণে বেশি টাকা বহন করছেন এমন ব্যক্তিদের পিছু নিতো। সুবিধাজনক জায়গায় অস্ত্রের মুখে ছিনিয়ে নিতো টার্গেটকৃত ব্যক্তির সর্বস্ব। বুধবার (২২ সেপ্টেম্বর) রাজধানী ঢাকা, সাভার ও যশোরে অভিযান চালিয়ে এই চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের রমনা জোনাল টিম। গ্রেফতারকৃতরা হলো—জলিল মোল্লা, রিয়াজ ও দীপু। তাদের কাছ থেকে ডাকাতি করা নগদ এক লাখ টাকা, ৫০ রাউন্ড গুলিসহ দুটি অত্যাধুনিক বিদেশি রিভলভার ও ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত দুটি মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের রমনা জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মিশু বিশ্বাস বলেন, ‘গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে আগের ডাকাতি মামলা ছাড়াও নতুন করে অস্ত্র আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ডাকাতি মামলায় তিন জনের মধ্যে জলিল মোল্লার তিন দিন ও বাকি দুই জনকে দুই দিন করে রিমান্ডে আনা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে সহযোগীদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে।’ গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, এই ডাকাতদের দলনেতা হলো জালাল মোল্লা। তারা গত মাসের ২৮ তারিখে মৌচাক ফ্লাইওভারে একজন মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীর গাড়ি আটকিয়ে ৬০ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় মুন্সি শিমুল হাসান নামে ওই ব্যবসায়ী রমনা থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় তিনি বলেন, ‘মতিঝিলের প্রাইড ও নিহন মানি এক্সচেঞ্জ থেকে তার ভাতিজা আবিদ ও গাড়িচালক টাকা নিয়ে প্রাইভেটকারে করে ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে গুলশানের দিকে যাচ্ছিলেন। মৌচাক ফ্লাইওভারের ওপর তার গাড়ির গতিরোধ করে হাতুড়ি দিয়ে গ্লাস ভেঙে অস্ত্রের মুখে টাকার ব্যাগটি নিয়ে চলে যায়। যাওয়ার সময় ডাকাত দলের সদস্যরা কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে। এতে এক পথচারী গুলিবিদ্ধ হন।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, মৌচাকের ঘটনার এক সপ্তাহ পর (৪ সেপ্টেম্বর, শনিবার) এই ডাকাত চক্রটি আরেকটি ঘটনা ঘটায়। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন নামে এক ব্যবসায়ী ৪ সেপ্টেম্বর মতিঝিল থেকে ২৫ লাখ টাকা নিয়ে এলাকায় ফিরছিলেন। সিদ্ধিরগঞ্জ সাইনবোর্ড এলাকায় দুটি মোটরসাইকেলে ডাকাত দলের সদস্যরা তার মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে অস্ত্রের মুখে ২৫ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, এই ডাকাত দলের সদস্যরা প্রতি শনিবার ডাকাতি করে থাকে। ডাকাতির আগের দিন শুক্রবারে তারা প্রত্যেকেই শপথ নেয়। এছাড়া দলে কোনও নতুন সদস্য যোগদান করলেও তাকে শপথ করানো হয়। আর শনিবারে ডাকাতির কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছে, বন্ধের দিন হলেও শনিবারে কিছু কিছু অফিস খোলা থাকে। ব্যাংকেও সীমিত সময়ের জন্য লেনদেন হয়। মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোতে লেনদেন হয়। এছাড়া শনিবারে রাস্তায় তুলনামূলক যানজট কম থাকার কারণে ডাকাতরা দ্রুত পালিয়ে যেতে পারে। এ জন্য ডাকাত দলের চক্রের একজন-দুজন মতিঝিলের বিভিন্ন মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঘোরাফেরা করে বেশি টাকা নিয়ে বের হওয়াদের অনুসরণ করে। মৌচাক ও সিদ্ধিরগঞ্জের দুটি ডাকাতির ঘটনাতেই ডাকাত দলের সদস্যরা মতিঝিল থেকেই তাদের অনুসরণ করেছিল বলে রিমান্ডের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে।
বিপুল সম্পত্তি, মামলা হবে মানি লন্ডারিংয়ের
গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, ডাকাত দলের সদস্যদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই আগে থেকেই একাধিক মামলা রয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, ডাকাতি করে তারা বিপুল সম্পত্তির মালিকও হয়েছে। ডাকাত চক্রের দলনেতা জালাল মোল্লার গ্রামের বাড়ি বরিশালে। ডাকাতি করা অর্থ দিয়ে তিনি ১০০ শতাংশ জমি কিনে সেখানে মাছের ঘের করেছেন। আরেক ডাকাত সদস্য দীপুর বাড়ি যশোরে। তিনিও ডাকাতির টাকায় এলাকায় অনেক সম্পত্তি কিনেছেন। তার স্ত্রী স্থানীয় একটি সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, এই ডাকাত চক্রের পলাতক আরেকজন সদস্য পটুয়াখালীতে মিষ্টির দোকান ও গরুর খামার গড়ে তুলেছেন। তারা যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেন তাও অনেক দামি। গ্রেফতারকৃত তিন ডাকাতের কাছ থেকে যে দুটি বিদেশি রিভলভার উদ্ধার করা হয়েছে, তার প্রত্যেকটির দাম ছয় লাখ টাকা করে। এছাড়া পলাতক ডাকাত সদস্যদের কাছেও আরও একাধিক অস্ত্র রয়েছে বলে তারা জানতে পেরেছেন। গোয়েন্দা পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, ডাকাত দলের অন্য সদস্যদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে। এ ডাকাত দলের সদস্যদের বিষয়ে মানি লন্ডারিংয়ের মামলা দায়েরের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের কাছে চিঠি পাঠানো হবে।