আমলা-রাজনীতিক যোগসাজশ : সংসদের সাতকাহন

0

ড. আবদুল লতিফ মাসুম ॥আমলাতন্ত্র এবং রাজনৈতিক দল আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার দুই গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। উভয়ই সরকারের নির্বাহী কর্তৃত্বের মালিক-মোক্তার। তবে একটি স্থায়ী, অপরটি অস্থায়ী। আমলাতন্ত্র মেধা-মননের পরীক্ষা দিয়ে রাষ্ট্রের সেবায় নিয়োজিত হয়। আর রাজনৈতিক দল নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে শাসনের জন্য নির্বাচিত হয়। সুতরাং আমলা এবং রাজনীতিকরা কার্যপরম্পরায় রাষ্ট্রব্যবস্থায় একত্রিত, সমন্বিত এবং স্থিত হন। স্বার্থ ও কার্যক্রমের নিকট অবস্থান সত্ত্বেও কখনো কখনো একে অন্যের বৈরী হয়ে দাঁড়ান। তবে এই বৈপরীত্য সত্ত্বেও তারা রাষ্ট্রব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। তাদের পারস্পরিক সম্পর্কে বিন্যস্ত হয় রাষ্ট্রের কার্যক্রম। সেভাবেই নির্ণীত হয় সাফল্য-ব্যর্থতার দায়ভার। আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নৈর্ব্যক্তিক কর্তৃত্ব, ক্ষমতার বিভাজন, ধারাবাহিকতা, আইনের শাসন, বিশ্লেষিত ক্ষমতার সোপান এবং নিশ্চিত পেশাদারিত্ব। অপরদিকে রাজনৈতিক দল হচ্ছে- সমষ্টিগত স্বার্থজ্ঞাপক, সম্পদের কর্তৃত্বপূর্ণ বণ্টন অভিসারী, নিরন্তর জনসেবায় ব্রতী ও ক্ষমতায় আরোহণে অধীর। এরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে সঙ্ঘবদ্ধ এক জনসমষ্টি যারা জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে শাসনের জন্য প্রয়াস নেয়। এর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক নিয়মকানুন ও বিধি-বিধানের আলোকেই ক্ষমতার আয়োজন ও আন্দোলন করতে হয়।
আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক দল পরস্পর সম্পূরক হিসেবে কাজ করার কথা। তাদের উভয়ের সম্পর্ক হবে আনুষ্ঠানিক এবং আইনানুগ। সামাজিক এবং ন্যায়নির্ভর। এই নীতিগত অবস্থানের বাইরে এবং ব্যতিরেকে যে সম্পর্ক দৃষ্ট হয় তা অস্বাভাবিক, অযৌক্তিক ও অনিয়মতান্ত্রিক। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স বেভার বলেন, ‘আমলাতন্ত্র এবং রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক সমাজকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে’। বেভার আমলাতন্ত্রের নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য, নিরপেক্ষতা ও নৈর্ব্যক্তিকতার উপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি মনে করেন, তা না হলে রাষ্ট্রের কার্যব্যবস্থা ন্যায়ানুগ এবং নিয়মতান্ত্রিক না হওয়াই স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক দল সম্পর্কিত যেকোনো সমীক্ষায় মনীষী টেলকম পারসন নির্দেশিত ‘বিশেষ ও বৈশি^ক তত্ত্ব’ ব্যবহার করা হয়। বিশেষ বা স্বকীয় ধারাটি বিশেষত আমাদের মতো তৃতীয় বিশে^র ক্ষেত্রে অধিকতর প্রযোজ্য। আর বৈশি^ক তত্ত্বটি উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রায়োগিক। এ সম্পর্কিত গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র যেহেতু ‘আমাদের সৃষ্ট নয়’ বরং উত্তরাধিকার সূত্রে ব্রিটিশ উপনিবেশ সৃষ্ট- সেহেতু এটি স্বকীয় নয় বরং আরোপিত এবং পিতৃতান্ত্রিক।
এ তত্ত্বকথার অবতারণার কারণ হলো, আমলা এবং রাজনীতিকদের নিয়ে ইদানীং সংসদীয় বিতর্ক। গত ২৮ জুন সংসদ অধিবেশনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধীদলীয় সদস্যরা বলেছেন, দেশে এখন রাজনীতি নেই। দেশ চালাচ্ছেন আমলারা। সংসদ সদস্যদের অভিযোগ হলো, সংসদ সদস্যসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের চেয়ে সরকার আমলাদের গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। এ সমালোচনার প্রেক্ষাপটটি তৈরি হয়েছে গত এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অফিস আদেশ থেকে। সংসদীয় আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রবীণ রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘মাফ করবেন, কথা বলাটা কতটা যুক্তিসঙ্গত হবে জানি না, এখন আমাদের জেলায় জেলায় দেয়া হয়েছে প্রশাসনিক কর্মকর্তা, মানুষ মনে করে- আমরা যা দিই, এটি প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই দেন। অথচ তারা কর্মকর্তা, তারা কিন্তু যানই না। যাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে (তার এলাকায়) তিনি এখন পর্যন্ত যাননি। এটি একটি রাজনৈতিক সরকার এবং রাজনীতিবিদদের যে কর্তৃত্ব কাজে সেটা কিন্তু ম্লøান হয়ে যায়।’ তোফায়েলসহ জাতীয় পার্টির নেতা ফিরোজ রশিদ ও রুস্তম আলী ফরাজি একই রকম বক্তব্য দেন। ফিরোজ রশিদ বলেন, ‘প্রত্যেকটি জেলায় দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সচিবদের। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের সাথে কথা বলেন। আর এমপি সাহেবরা পাশাপাশি বসে থাকেন দূরে। তারপর বলেন, ডিসি সাহেব, আমি একটু কথা বলব প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে।’ এ অনির্ধারিত আলোচনায় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও অস্থিরতার বিষয়টি উল্লেখ করেন জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু।
রাজনীতিকদের এসব উচ্চারণ গণমাধ্যমে রীতিমতো ঝড় তোলে। প্রতিটি চ্যানেলে বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি দৈনিকে কলাম প্রকাশিত হয়। ক্ষমতাসীনদের পক্ষে ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীরা ব্যাকরণ বহির্ভূতভাবে সরকারের সাফাই গান। প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী জেলায় সচিবদের দায়িত্ব দেয়া প্রধানমন্ত্রীর যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বলে অভিহিত করেন। অবশ্য সরকারি দলে ভিন্নমত আছে। কয়েকদিন আগে সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী বলেছেন, ‘আমরা সংসদে আছি শুধু হ্যাঁ বা না বলার জন্য’। মনে পড়ে, ২০২০ সালের শেষের দিকে জাতীয় পার্টি প্রধান জি এম কাদের বলেছিলেন, ‘মাঠে খেলছেন আমলারা। রাজনীতিবিদরা সাইডলাইনে বসে খেলা দেখছেন’।
গণমাধ্যম যখন আমলা বনাম রাজনীতিকদের নিয়ে সরস আলোচনা করছে, তখন কাকতালীয়ভাবে একই সময়ে একই বিষয়ের ওপর একটি গবেষণাকর্ম সমাপ্তির প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সদস্য জাকির আল ফারুকী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের এই গবেষণাকর্ম পরিচালনা করেন। তার অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল- ‘নেক্সাস বিটুইন পলিটিক্যাল পার্টি অ্যান্ড ব্যুরোক্র্যাসি ইন বাংলাদেশ : এ পলিটিক্যাল স্টাডি’। গবেষক সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে বিষয়টি উপস্থাপন করেন। আমার তত্ত্বাবধানে কাজটি সম্পন্ন হয়। গণমাধ্যমের আলোচনার সূত্রে বিষয়টির প্রাসঙ্গিকতা অনুভূত হয়।
গবেষণার ফলাফল উত্থিত আলোচনার সাথে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ তা দেখা যাক। গবেষক এক্ষেত্রে তিনটি হাইপোথিসিস বা প্রকল্প অনুমান নির্ধারণ করেন। এগুলো হলো- ক. বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে বিরাজিত আমলা-রাজনীতিক সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ; খ. আমলা-রাজনীতিক সম্পর্কের প্রভাবকগুলো নির্ধারণ করা; গ. উভয় পক্ষের অনুঘটকদের মতামতের বাস্তবতা অনুসন্ধান।
গবেষক বিভিন্ন তত্ত্ব, তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, সবসময়ের ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদরা আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করেন। সবসময়ে সরকারি দল আমলাদের বাছাই বা নির্বাচন, পদোন্নতি ও পদায়নে প্রভাব রাখেন। তাদের আনুগত্য ষোলআনা নিশ্চিত হওয়ার জন্য শিক্ষাজীবনের রাজনৈতিক পরিচয় বা অংশগ্রহণের খোঁজ নেন। এ ছাড়া পারিবারিক পরিচয়, বৈবাহিক অবস্থান, আত্মীয়তা, সামাজিক সম্পর্ক ও জীবনপদ্ধতির খোঁজ নেয়া হয়। এর বিপরীতে আমলারা বা হবু আমলারা অনুকূল রাজনৈতিক দলের নৈকট্য অর্জনে সচেষ্ট হন। তারা স্থানীয় সাংসদ এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের শরণাপন্ন হন। এভাবে তারা তাদের সার্ভিস লাইফ নিশ্চিত, নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ করার চেষ্টা করেন। যেহেতু ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক পরিচয়কে মুখ্য করে তোলেন, তাই আমলারা অতীতে যাই করুন না কেন ক্ষমতাসীনদের সাথে আরো নৈকট্য হাসিলের চেষ্টায় লালায়িত থাকেন। তারা তাদের মতো করে কথা বলেন। এই গবেষণার সমর্থনে কয়েক মাস আগে কুষ্টিয়ার এক এসপির বক্তব্য উদাহরণ হিসেবে টানা যায়।
অনেক সময় শীর্ষস্থানীয় আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তারা রাজনীতির ভাষায় কথা বলেন। কর্মকর্তারা বিভিন্ন কৌশল ও কর্মসূচিতে ক্ষমতাসীনদের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে ধারণ করে আনুগত্যের প্রমাণ দিতে চান। তারা সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে পেশাগত উৎকর্ষতার বদলে দলীয় পরিচয়কে প্রাধান্য দেন। এভাবে আমলারা পেয়ে যান অবাঞ্ছিত সুযোগ। একইভাবে নিরপেক্ষতা, সততা ও সাহসিকতার জন্য বিরোধী কর্মকর্তারা পুরস্কৃত না হয়ে বরং তিরস্কৃত হন। চাকরিচ্যুতি, ওএসডি, হয়রানি ও মর্যাদাহীন পদায়ন করে তাদের অপমান ও অবমূল্যায়ন করা হয়। অনেকে পদত্যাগ করে আত্মসম্মান রক্ষার চেষ্টা করেন। এ ধরনের কার্যক্রমের মাধ্যমে পেশাগতভাবে আমলাতন্ত্রের দক্ষতা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও সম্মাননার অবসান ঘটে। এসব কারণে আমলাতন্ত্রে অসন্তোষ, ক্ষোভ ও হতাশার প্রসার ঘটে। ফলে সার্বিকভাবে জনপ্রশাসন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সৃষ্ট অন্যায়, অসমতা ও অবিচার মেধাবী শিক্ষার্থীদের জনপ্রশাসন সম্পর্কে বিপরীত ধারণা দেয়। সামগ্রিক বিশ্লেষণে গবেষক ফারুকী দেখিয়েছেন যে, এসব নেতিবাচক কারণে আমলাতন্ত্র তথা জনপ্রশাসনে কোন্দল, দলীয় মনোবৃত্তি, আঞ্চলিকতা, মেধার মর্যাদা হ্রাস, নিরপেক্ষতার অভাব, পেশাগত গুণাবলি হ্রাস এবং সর্বোপরি পেট্রন-ক্লায়েন্ট বা পোষ্য-পোষক সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। গবেষণায় এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে, ওইসব নেতিবাচক কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও মেধা, সাহস, সততা, নিষ্ঠা, কর্মকুশলতা ও সর্বজনীনতার প্রতি উভয়পক্ষের আস্থা বা সম্মানবোধ নীতিগতভাবে অক্ষুণ্ন রয়েছে। এসব বিষয়ে বিরোধ না থাকলেও উভয় পক্ষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি-রাজনৈতিক পরিচয়, আদর্শ, মতবাদ ও স্বার্থপরতা গোটা পরিবেশকে ক্লেদাক্ত করে তোলে। এভাবে সামগ্রিক দলীয়করণ সামগ্রিকভাবেই আমলাতন্ত্রকে দলীয় সঙ্কীর্ণতায় আচ্ছন্ন করে। মেধার সাথে আপস, সর্বজনীনতার অনুপস্থিতি, অযৌক্তিক কার্যক্রম, স্বার্থান্ধতা, তদবির সংস্কৃতি, ক্ষমতালোভ সর্বস্বতা এবং ভাগ-বিভাজন লোকপ্রশাসনে অবক্ষয় ও অপচয় ডেকে আনে। উপস্থাপিত গবেষণায় বিষয়গুলো নির্দিষ্ট উত্তরদাতার বয়ানে উঠে এসেছে গবেষক ফারুকীর উপসংহারে। গবেষণায় সারবস্তুই উল্লেখ করা হলো। এ পরিসরে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়, কাম্যও নয়।
সংসদে তীব্র বাগ্মিতার পরে পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে। সবাই ‘হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল’। এতে রয়েছেন সাংবাদিক, বিদ্বজ্জন, রাজনীতিক এবং সাবেক আমলা। তারা তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিষয়টির তাৎপর্য, ব্যাপকতা ও কারণ বিশ্লেষণ করেছেন। সাংবাদিক কামাল আহমেদ লিখেছেন, ‘গত তিন দশকে প্রধান দুটো দলই সৎ-অসৎ ব্যবসায়ী, সামরিক-বেসামরিক আমলা, ভাগ্যান্বেষী ও অযোগ্য সুবিধাবাদী পেশাজীবী এবং নানা ধরনের অপরাধে জড়িত দুর্বৃত্তদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। অবশ্যম্ভাব্যভাবে ক্ষমতাসীন দলেই এদের প্রধান্য ও দাপট বেড়েছে’। দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী ড. মাহবুব উল্লাহ সমস্যার গভীরে প্রবেশ করেছেন। তার বিশ্লেষণে, ‘রাজনীতিবিদদের অসহায়ত্বের একটি উৎস হলো শাসনব্যবস্থার গণতান্ত্রিক চরিত্র বিনষ্ট করে একে কর্তৃত্ববাদী করে তোলা। কর্তৃত্ববাদের অন্যতম প্রধান উৎস হলো- নষ্ট রাজনীতিবিদ এবং নষ্ট আমলাদের আনহোলি অ্যালায়েন্স’।
তার এ বক্তব্যে উপর্যুক্ত গবেষণার সারমর্ম প্রতিধ্বনিত হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলী রিয়াজের সমাজতাত্ত্বিক ভাষ্যে একই অনুরণন লক্ষ করা যায়। তার ভাষায়, বিরোধের উৎস হলো : ‘প্রথমত, নির্বাহী বিভাগের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণ। দ্বিতীয়ত, সমাজ ও রাজনীতির বিভিন্ন শক্তির মধ্যে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের উদ্ভব’। সাবেক শীর্ষ আমলা আলী ইমাম মজুমদার আরেকটু খোলাসা করে বলেছেন, ‘১৯৯১ সালে গণতন্ত্রায়নের পর থেকে সব রাজনৈতিক সরকার নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতিতে বরাবর ‘আমাদের লোক’ তত্ত্ব বহাল করেছে।
আর দিন দিন ভারী হচ্ছে তা। আমাদের লোক হওয়ার সুফল প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা টের পেয়ে গেছেন’। রাজনীতিবিদ ও জনপ্রিয় কলামিস্ট গোলাম মাওলা রনি সঙ্কটের রাজনৈতিক দিকটির ওপর আলোকপাত করেছেন। বিগত নির্বাচনগুলোর সরস বর্ণনা দিয়ে অবশেষে উপসংহারে বলেছেন, ‘যেখানে আইনের ব্যত্যয় ঘটে নীতি-নৈতিকতার কবর রচনা হয় এবং অবৈধ ও অন্যায়ভাবে কোনো পদ-পদবি সৃষ্টি হয় তখন সেসব পদাধিকারীরা সবসময়ই অপমান-লাঞ্ছনা বা গঞ্জনার শিকার হন’।
আলোচনার সূত্রপাত হয়েছিল আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে রাজনীতিকদের বিষোদ্গার থেকে। অথচ পুরো কলামে আমরা আমলা ও রাজনীতিকদের যোগসাজশের কথা বললাম। বিষয়টি আপাতবিরোধী মনে হতে পারে। দেখা গেছে, শীর্ষ পর্যায়ে আমলা-রাজনীতিক যে যোগসাজশ রয়েছে তার প্রতিবাদ করছেন এমন সব রাজনীতিক যারা এখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার বাইরে রয়েছেন। বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায় এটা প্রমাণিত হয়েছে, রাজনৈতিক ব্যাকরণ মোতাবেক আমলাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বে অধস্তন থাকার কথা। এখন তারা ঊর্ধ্বতন কর্তৃত্বের মতো আচরণ করছে। তাও আবার শীর্ষ নেতৃত্বের অনুমোদনক্রমে। সুতরাং সেখানে একটি রাজনৈতিক ভারসাম্যের অভাব লক্ষণীয়। অবশ্য শাসক আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রব্যবস্থায় ক্ষমতার স্বাতন্ত্র্যীকরণকে সেভাবে অনুসরণ করেনি। এর একটি কারণ হতে পারে, স্বাধিকার আন্দোলনের সময়ে আমলাদের সহযোগিতা তাদের নিতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আগরতলার ষড়যন্ত্রের মামলার কথা বলা যায়।
স্বাধীনতার পরপরই তারা আমলাতন্ত্রের দলীয়করণে প্রবৃত্ত হয়। ১৯৯৬ সালে আমলা মহিউদ্দীন খান আলমগীরের নেতৃত্বে আমলাদের একাংশ একটি প্রতিষ্ঠিত নিয়মতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে তথাকথিত জনতার মঞ্চ তৈরি করে। পরবর্তীকালে এই আমলা আওয়ামী লীগের আমলে যথেষ্টভাবে ক্ষমতায়িত হন। বিগত ১২ বছরে তাদের এই দলীয়করণ প্রবণতা দিনে দিনে এখন বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল বলছে, এখন আমলাদের ক্ষমতার দাপটে প্রশাসন স্থবির হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্র, সরকার ও দলের চিরায়ত সীমারেখার অবসান ঘটেছে। স্থায়ী নির্বাহী বিভাগের অধীন হয়ে পড়েছে অস্থায়ী নির্বাহী কর্তৃত্ব। বিচার বিভাগের নীতিগত বিভাজন যা হয়েছিল সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে, তার ছিটেফোঁটাও এখন আর অবশিষ্ট নেই।
২০০৯ সালের পর ক্রমশ প্রথাগত রাজনীতির বদলে অপ্রথাগত অস্বাভাবিক রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক বদল ঘটেছে। নির্বাচন ব্যবস্থা বিলুপ্ত হওয়ায় জননির্ভরতার পরিবর্তে আমলানির্ভরতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তোফায়েল আহমদের বয়ানে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ গত ১৭ বছরেও জিয়ার আমলাতান্ত্রিক উত্তরাধিকার অতিক্রম করতে পারেনি। রাজনীতির স্বাভাবিক গতিধারাকে ‘কোয়ার্সিভ পাওয়ার’ বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে যেভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে তার কুফল এখন আংশিক হলেও প্রদর্শিত হচ্ছে। আশঙ্কা রয়েছে, পরবর্তীকালে এর সম্পূর্ণতা এক পর্যায়ে ক্ষমতার ভিতকে নাড়িয়ে দেবে। ‘রাজনীতিকরা যে রাজনীতিতে ক্রমেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছেন সে বিষয়ে এখন ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে আর কোনো ভিন্নতা নেই’- আলোচনান্তে নিশ্চয়ই এটি স্পষ্ট হয়েছে। যে তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে সাম্প্রতিককালের সংসদগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানে জনগণের সংশ্লিষ্টতা না থাকার কারণে সংসদ সদস্যরা ‘কাগুজে বাঘে’ পরিণত হয়েছেন- এটাই স্বাভাবিক। সবারই অভিমত ‘ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেয়া এবং গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবনেই রয়েছে রাজনৈতিক সমাধান’।
আমলাতন্ত্র ও রাজনীতির যোগসাজশের বিষয়টি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যেভাবে গুরুত্বপূর্ণভাবে অধীত তেমনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও তাৎপর্যপূর্ণ। বিদ্যায়তনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ও জাতীয় নীতিনির্ধারকরা উপকৃত হবেন- এমনটি ভেবেই উল্লিখিত গবেষণা কর্মটি পরিচালিত হয়। ঘটনাক্রমে এই সময়ে বিষয়টি জাতীয়ভাবে আলোচিত-সমালোচিত হওয়ায় এর প্রাসঙ্গিকতা আবারো প্রমাণিত হলো। উত্থাপিত আলোচনা ও উপস্থাপিত অভিসন্দর্ভের আলোকে এটা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, বাংলাদেশে আমলা-রাজনীতিক সম্পর্ক নানা বৈপরীত্যে পরিপূর্ণ একটি অপ্রিয় সত্য। আমলাতন্ত্রের অস্তিত্ব যেমন অপরিহার্য তেমনি রাজনীতিকদের অবস্থানও অনিবার্য। তাই উপস্থাপিত অভিসন্দর্ভে গবেষক শব্দদ্বৈত ‘জেনুইন প্যারাডক্স’ বা নিখাদ কূটাভাস বলে আমলা-রাজনীতিক সম্পর্ককে বিশ্লেষণ করেছেন। এর ভারসাম্যপূর্ণ মিথস্ক্রিয়ার ওপরই জাতির ভবিষ্যৎ নিহিত।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ