ধৈর্য ধারণের পরামর্শ সর্বমহলের

0

তহীদ মনি

হঠাৎ করেই পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সভাপতি পলাতক শেখ হাসিনা নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের ভেরিফাইড ফেসবুকে লাইভ ভাষণ দেবেন এমন খবরে গত বুধবার থেকে পাল্টে যায় দেশের স্থিতিশীল পরিবেশ। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে পালিয়ে যাওয়ার পর এটাই ছিল তার সরাসরি বক্তব্য প্রচারের ঘোষণা। এ নিয়ে সারা দেশে হৈ-চৈ পড়ে যায়।। তীব্র প্রতিক্রিয়ায় ফেটে পড়ে জুলাই বিপ্লবের কর্ণধাররা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র অন্দোলনের নায়করা দেশ থেকে ফ্যাসিবাদের চিহ্ন উপড়ে ফেলার ঘোষণা দেন। বুধবার রাতে ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বর থেকে শুরু হওয়া ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে জেলায় জেলায়। যশোরও বাদ যায়নি। ক্ষোভ প্রকাশের এ কর্মযজ্ঞকে কেউ ভালো বলছেন, আবার কেউ সতর্ক পদক্ষেপের কথা বলছেন। দ্রুত নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলেছেন কেউ কেউ। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ দৈনিক লোকসমাজের কাছে তাদের মতামত তুলে ধরেন।
যশোর শহরের দুইজন দোকানি জানান, বিগত সময়ে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছিল এই মূর্তি-ম্যুরাল তৈরিতে। এটা না করে মানুষের জন্য কাজ করতে পারতো সরকার। তা না করে দেশের টাকা ও সম্পদের ক্ষতি করেছেন। এখন তারা পালিয়েছে, মানুুষের রাগ-ক্ষোভ আছে তাই করছে। তবে এতে ক্ষতি হচ্ছে দেশের সম্পদের। সম্পদ রক্ষা করে কাজ করলে ভালো হতো।

যশোরের গরীব শাহ সড়কে শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল বৃহস্পতিবার ভাঙচুর করা হয়

রিকশাচালক দেয়াড়া গ্রামের বাসিন্দা জমির আলী বলেন, মানুষের বুকে অনেক কষ্ট চাপা রয়েছে। ব্যাথা খুব বেশি। বছরের পর বছর মানুষ কথা বলতে পারেনি। আবার তারা ফিরে আসার হুমকি দিচ্ছে। মানুষ তো ক্ষেপবে। তারা এ কয় বছর যেভাবে চালিয়েছে তা তো মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। তারপরও সবাই যদি হিংসা প্রতিহিংসা নিয়ে চলে, তাহলে তো সমস্যা বাড়বে।
একই রকম কথা বলেন রিকশাচালক রূপদিয়ার তরিকুল ইসলাম, তার মতে ‘রাতে টেলিভিশন দেখলাম, যারা ভাঙচুরে অংশ নিচ্ছে তারা জানিয়েছে, পালিয়ে গিয়ে আবার ছাত্রদের দোষ দিচ্ছে, বিদেশে বসে সমস্যা বাধাচ্ছে। এটা চলতে দেয়া যায় না’। তিনি আরও বলেন, ১৫ বছর দেশের মানুষ মেরে, জিনিসের দাম বাড়িয়ে, বিদেশে টাকা পাঠিয়ে খুব ক্ষতি করেছে। এখন যদি তারা আবার আসে তাহলে তো সব শেষ করে দেবে।
কলেজ শিক্ষক এনামুল হক বলেন, তারা খালেদা জিয়ার বাড়ি ভাঙচুর করেছিল এখন তাদের বাড়ি ও ম্যুরাল ভাঙচুর হচ্ছে। এভাবে চলতে পারে না। নিঃসন্ধেহে তারা অন্যায় করেছে, ফ্যাসিবাদ চালু করেছে। দেশের সম্পদ -টাকা পাচার করেছে, অর্থনীতি পঙ্গু করেছে, অভাবী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, মানুষ ভিক্ষা করে খেয়েছে এতে শেখ হাসিনার কোনো মাথা ব্যাথা হয়নি। তিনি তার পিতার চির স্মরণীয় করতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেছেন। দেশের মানুষের টাকায় তৈরি স্থাপনা পরিবারের লোকজনের নামে দিয়েছেন। এক কথায় যা ইচ্ছে তাই করেছেন। তারপরও ৫ আগস্টের পর যা হয়েছে তা ওই সময় মেনে নেয়া যায়। কিন্তু নতুন করে এই ভাঙচুর ঠিক হচ্ছে না এটা তো আমাদের দেশের সম্পদ।
সাংবাদিক ইউনিয়ন যশোরের সভাপতি আকরামুজ্জামান বলেন, ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার সরকার দেশ থেকে উৎখাত হয়েছে। ধীরে ধীরে দেশটা শান্ত হচ্ছিল। কিন্তু এত বড় একটা গণঅভ্যুত্থান হলো, হাজার হাজার মানুষ রক্ত দিল, পঙ্গু হলো, গুলি করে মারা হলো, সমস্ত দেশময় অরাজকতা করে শেষ পর্যন্ত তাকে পালাতে হলো। এরপরও আওয়ামী লীগের কোন শিক্ষা হয়নি। কোনো অনুসূচনাও নেই, ভুল স্বীকার নেই। বরং পতিত শেখ হাসিনা নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের ফেসবুকে লাইভ ভাষণ দিে আস্ফালন দেখালেন। এরজন্যে তো এত রক্ত, এত জীবন উৎসর্গ করেনি এ দেশের ছাত্র জনতা। ফলে ৫ তারিখ রাত থেকে ফ্যাসিবাদের আতুড় ঘরসহ তাদের দোসরদের স্থাপনা, শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ভাঙচুর যা হচ্ছে তাকে খারাপ বলা যায় না। বরং এটা তাদের জন্যে একটা মেসেজ দেয়া হচ্ছে যেনো আগামীতে আর বাড়াবাড়ি না করে। ভাঙচুরে অংশ নেয়া সকলের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, তারা যেনো সাধারণ ও নিরাপরাধ মানুষের জানমালের ক্ষতি না করেন।
যশোর প্রাচ্যসংঘের প্রতিষ্ঠাতা ও গবেষক বেনজিন খান বলেন, এটা মূলত শেখ হাসিনা বক্তব্য দিতে যাওয়ার প্রতিক্রিয়া। এত অন্যায় অবিচার করে দেশের মানুষ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলো আবার এ সব কথা বলবে তা মানুষ মেনে নেবে কেনো? এটা তার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ মানুষের প্রতিক্রিয়া। তিনি যত কথা বলবেন ততই এ ধরনের প্রতিক্রিয়া বাড়তে থাকবে। এমন ঘটনা ঘটবে। তিনি আরও বলেন, পতিত শেখ হাসিনা যত কথা বলবেন ততই সমস্যা ও এ জাতীয় ভাঙচুর, প্রতিক্রিয়া বাড়তেই থাকবে। যে ক্ষেত্রে দেশবাসী জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিৎ ছিল, তা না করে তিনি দম্ভ দেখিয়েছেন। তার দাম্ভিকতার কারণেই মানুষ বেশি ক্ষিপ্ত হচ্ছে। এ সব স্থাপনা মূলত অবিচার অন্যায়ের প্রতীক ছিল। সে প্রততীক এ সমাজ থেকে দূর করতে ভাঙ্গা হবে এটা স্বাভাবিক।
এ ক্ষেত্রে সরকারের করণীয় কী এমন প্রশ্নের জবাবে বেনজিন খান জানান, সরকার আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য দায়বদ্ধ। তবে বর্তমান সরকার বিপ্লব বা গণভ্যুত্থান পরবর্তী সরকার। সরকার জুলাই বিপ্লবের ‘স্প্রিট’ নিয়ে গঠিত। ফলে তার দায়িত্ব সে ‘স্প্রিট’ ধরে রেখে গণহত্যাসহ ফ্যাসিবাদ কায়েমে যে অন্যায় হয়েছে তার বিচার করা।
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু সংগঠিত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে প্রতিক্রিয়ায় বলেন, দেশে স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরে আসা দরকার। সবাইকে সংযত আচরণ করতে হবে এবং ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার কতটুকু দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে তা জনগণই বিচার করবে তবে, সবাইকেই স্থিতিশীল অবস্থার জন্যে ধৈর্য ধরতে হবে, বিশৃঙ্খলা কোনো সমাধান নয়। গণতান্ত্রিক অবস্থায় ফিরে আসার জন্যে সবাইকে সচেতন হবে।
জুলাই গণহত্যার বিচার করলে এমন অবস্থা সৃষ্টি হতো কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জুলাই বিপ¬বের বিচার অবশ্যই হতে হবে তবে বর্তমান সরকার কোনো রাজনৈতিক সরকার না, রাজনৈতিক দল যে বিচেনায় এ সব কাজ করতে পারে তা করতে হলে দ্রুত নির্বাচন দিয়ে জনগণের সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর দরকার। আমরা সে জন্যে দ্রুত নির্বাচনের কথাও বলছি।
বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড ইকবাল কবির জাহিদ এ প্রসঙ্গে বলেন, যখন দেশে সংস্কার এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া চলছে সে সময় এ জাতীয় ঘটনা গ্রহণযোগ্য না। শেখ হাসিনা ইন্ডিয়ায় কী বলছে তা নিয়ে এ দেশে এ ধরণের কাজ করা ঠিক না। বর্তমান সরকারের আমলের ধংসাত্মক কর্মকান্ড গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্যে ক্ষতিকারক। প্রশাসনের উপস্থিতিতে এ ঘটনার দায় সরকার এড়াতে পারে না। সরকারকে এ সব বন্ধ করতে হবে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে।
তিনি আরো জানান, খুনিদের এখনো সরকার বিচার করতে পারেনি, বিচার না করে এ সব ধরনের কাজ করছে। এ ধরনের কাজ চলতে থাকলে বিশৃঙ্খলা শুধু বাড়তেই থাকবে।