স্বাস্থ্য সচিবের বাড়িতে হামলা : এলাকায় উত্তেজনা ওসি প্রত্যাহার, দুই মামলা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নানের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনকে কেন্দ্র করে তার বাড়িতে হামলা, অবরুদ্ধ করে রাখা, এসিল্যান্ডকে মারধর, নির্মাণাধীন কমিউনিটি ক্লিনিক ভাঙচুরের ঘটনার প্রেক্ষিতে কটিয়াদী মডেল থানার ওসি এমএ জলিলকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ বিপিএম (বার) বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান ওসি এমএ জলিলকে প্রত্যাহার করে ঢাকা রেঞ্জ অফিসে সংযুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে কটিয়াদী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আশরাফুল আলমকে পিটিয়ে আহত করা এবং কমিউনিটি ক্লিনিক ভাঙচুরের ঘটনায় পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। কটিয়াদী মডেল থানায় গত শনিবার দিবাগত রাত সোয়া ১২টার দিকে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আশরাফুল আলম বাদী হয়ে রিয়াদ, প্রিন্স, মেহেদী ও দেলোয়ার নামে চারজনের নামে ও অজ্ঞাত ১৫-২০ জনকে আসামি করে মামলা (নং-৬, তারিখ- ৭/২/২০২১) দায়ের করেছেন। এছাড়া গত শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান বাদী হয়ে অজ্ঞাত ২০-২৫ জনকে আসামি করে অপর মামলাটি (নং-৭, তারিখ- ৭/২/২০২১) দায়ের করেছেন। মামলার প্রেক্ষিতে পুলিশ রাতেই অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। ছাত্রলীগ নেতা মেহেদী হাসানকে এবং স্বাস্থ্য প্রকৌশলীর দায়ের করা মামলার আসামি হিসেবে কামাল হোসেন ও আতাউর রহমান মিন্টুকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদিকে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা এবং স্বাস্থ্য সচিব মো. আবদুল মান্নান এমপির বিরোধী তৎপরতা ও স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদে গতকাল কটিয়াদীতে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ।
দুপুরে কটিয়াদী কলেজ থেকে বের হওয়া বিক্ষোভ মিছিলটি বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশে মিলিত হয়। বিক্ষোভ মিছিল থেকে মামলা প্রত্যাহার ও স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দেয়া হয়। এছাড়া সমাবেশ থেকে স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নানকে কটিয়াদীতে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তাকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানানো হয় এবং সচিব পদ থেকে অব্যাহতি প্রদানের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়। সমাবেশে উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এডভোকেট দিলীপ কুমার ঘোষ, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন মিলন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার আহমেদ পাভেল, ড. জায়েদ মো. হাবিবুল্লাহ, ছিদ্দিকুর রহমান ভূঁইয়া, দুলাল বর্মন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। বক্তারা স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নানের বিরুদ্ধে এমপি নূর মোহাম্মদের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে ব্যবহারের অপচেষ্টা ও এমপির বিরুদ্ধে অপপ্রচারের অভিযোগ আনেন। এছাড়া এমপির সঙ্গে সমন্বয় না করে নিজের খেয়ালখুশি মতো এলাকায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে অরাজকতা সৃষ্টির অভিযোগও করেন তারা।
কটিয়াদী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আশরাফুল আলম বাদী হয়ে দায়ের করা মামলায় অভিযোগ করা হয়, গত শনিবার সকালে তিনি স্বাস্থ্য সচিবের প্রটোকল ডিউটি করার জন্য এবং গচিহাটা উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের জমির সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার জন্য স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নানের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার চান্দপুর গ্রামে যান। সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে বাড়িতে পৌঁছামাত্র তিনি শুনতে পান, সচিবের বাড়ির পিছনের প্রস্তাবিত কমিউনিটি ক্লিনিক ও কমিউনিটি ক্লিনিকে যাওয়ার রাস্তার কাজ করা নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যের লোকজনের সঙ্গে স্বাস্থ্য সচিবের বাকবিতণ্ডা হয়েছে। এ সময় তিনি এবং কিশোরগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মো. মুজিবুর রহমান বাড়ির আঙ্গিনায় অপেক্ষা করছিলেন। পরে স্বাস্থ্য সচিব লোক পাঠিয়ে তাদেরকে বাড়ির নিচতলায় বসার জন্য নিয়ে যান। তখন স্বাস্থ্য সচিব বাড়ির দোতলায় অবস্থান করছিলেন। কিছুক্ষণ পর বাইরে শোরগোল শুনে বের হয়ে তিনি দেখতে পান, উচ্ছৃঙ্খল ২০-২৫ জন লোক লোহার পাইপ, লোহার রড, লাঠি, রামদা ইত্যাদি মারাত্মক অস্ত্রসহ স্বাস্থ্য সচিবের বাড়ির দিকে দলবদ্ধভাবে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে আসছে। এ অবস্থায় ইউএনও’র ফোন পেয়ে স্পষ্ট কথা বোঝা ও নেটওয়ার্ক পাওয়ার সুবিধার্থে এসিল্যান্ড আশরাফুল সিভিল সার্জনকে সঙ্গে নিয়ে পুকুরপাড়ের দিকে যান। তখন অস্ত্রসহ ৮-১০ জন তাদেরকে ঘিরে ফেলে। তারা এসিল্যান্ড ও সিভিল সার্জনের ওপর চড়াও হয়ে এসিল্যান্ডকে রড দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করে। কয়েকজন তাকে ধাক্কাও দেয়। ধাক্কায় এসিল্যান্ডের হাত থেকে তার ফোন পাশের পুকুরে পড়ে যায়। তখন হামলাকারীরা এসিল্যান্ডকে মারতে উদ্যত হয়। ফলে আহত অবস্থায় এসিল্যান্ড ঘটনাস্থল ত্যাগ করে গাড়িতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে চিকিৎসা নেন।
এদিকে স্থানীয় রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নানের বাড়ি এবং কিশোরগঞ্জ-২ (কটিয়াদী-পাকুন্দিয়া) আসনের সংসদ সদস্য সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ একই ইউনিয়নের পাশাপাশি দুই গ্রামের। মো. আবদুল মান্নানের বাড়ি চান্দপুর পূর্বপাড়া এবং এমপি নূর মোহাম্মদের বাড়ি প্রায় এক কিলোমিটার দূরত্বের মিরেরপাড়া গ্রামে। গত বছরের ২৭শে জানুয়ারি মো. আবদুল মান্নান সচিব পদে পদোন্নতি পান। এরপর থেকে স্থানীয় নানা ইস্যুতে এমপি নূর মোহাম্মদের সঙ্গে সচিব মো. আবদুল মান্নানের মতবিরোধ দেখা দেয়। স্থানীয় অনেকেই এমপি নূর মোহাম্মদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সচিব মো. আবদুল মান্নানকে কল্পনা করেন এবং এ নিয়ে এলাকায় নানামুখী গুঞ্জন ও তৎপরতা শুরু হয়। এরকম পরিস্থিতিতে চান্দপুর পূর্বপাড়া গ্রামের বাড়িসংলগ্ন জায়গায় স্বাস্থ্য সচিবের সদ্য প্রয়াত স্ত্রী জেবুন্নেছা মান্নানের নামে একটি কমিউনিট ক্লিনিক ও কমিউনিটি ক্লিনিকে যাতায়াতের রাস্তা নির্মাণের উদ্যোগ নেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য হলেও সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদকে স্বাস্থ্য সচিব তার এই উদ্যোগ সম্পর্কে অবহিত না করে মাসখানেক আগে নিজের মতো করে কমিউনিটি ক্লিনিক ও রাস্তা নির্মাণকাজ শুরু করেন। এতে এমপি সমর্থক ও স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ হন। এ রকম পরিস্থিতিতে গত শুক্রবার সরকারি সফরে এসে চান্দপুর পূর্বপাড়ার নিজবাড়িতে রাত্রিযাপন করেন স্বাস্থ্য সচিব মো. আবদুল মান্নান। বাড়িতে তার অবস্থানের খবরে গত শনিবার সকাল থেকেই তৎপর হন এমপি সমর্থক ও বিক্ষুব্ধরা। এক পর্যায়ে স্বাস্থ্য সচিবের বাড়িতে প্রবেশ করে তাকে বাড়ি ত্যাগের আল্টিমেটাম দেয়া হয়। তাদের এই তাণ্ডবের মুখে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগর সচিব মো. আবদুল মান্নান নিজ বাড়িতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। এ সময় তার প্রটোকলে থাকা কটিয়াদী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আশরাফুল আলম ব্যাপক মারপিটের শিকার হন। সে সময় ঘটনাস্থলে থাকা কিশোরগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. মো. মুজিবুর রহমান আত্মরক্ষার্থে কোনোরকমে গাড়িতে ওঠে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। এছাড়া হামলায় নির্মাণাধীন কমিউনিটি ক্লিনিকের দায়িত্বরত প্রকৌশলীসহ অন্তত ১১ জন আহত হন। এ রকম পরিস্থিতিতে গতকাল পূর্ব নির্ধারিত কিশোরগঞ্জে জেলা পর্যায়ের ভ্যাকসিন প্রদান কার্যক্রম উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিতি বাতিল করে শনিবার বিকাল সাড়ে ৪টায় র‌্যাব ও পুলিশের কড়া প্রহরায় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। তবে স্বাস্থ্য সচিবের অভিযোগের জবাবে গত শনিবার সংসদ সদস্য সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেন, একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে সে ওয়াকফের জমি দখল করে, এলাকায় যা খুশি তা করে বেড়ায়। এমনকি অন্যের জমি দখল করে ও মাজারের জমি দখল করে সেখানে কমিউনিটি ক্লিনিক করছে। এসব ব্যাপারে লোকজন প্রশ্ন করলে কোনো উত্তর পায় না। এলাকার মানুষ তার অবজ্ঞা, তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হওয়ায় তারা রুখে দাঁড়িয়েছে। এর বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ঘটনাটি ঘটেছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ বিপিএম (বার) জানান, জেলা পুলিশের পক্ষ থেকেও ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়া হচ্ছে।