জনগণ ও রাজনীতি : তরিকুল ইসলাম স্মরণে

0

পাভেল চৌধুরী

রাজনীতি যাদের পেশা তাদের কাছে জনগণই হচ্ছে সার কথা। জনগণই তাদের আশ্রয়, জনগণই শক্তি। জনগণ সাথে না থাকলে তাদের কিছু নেই, যার পেছনে জনগণ যত, রাজনৈতিক দাপটও তার তত। কিন্তু জনগণ পেছনে থাকে কখন? যখন জনগণ আস্থা পায়। তার জন্য জ্ঞান গরিমার খুব দরকার হয় না, দরকার হয় না ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তারও; যেটা একেবারে প্রাথমিক শর্ত হিসেবে দরকার সেটা হলো জনগণের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা। যদিও কি ভাবে জনগণকে ভালবাসা যায় তার কোনো বাধানো পথ নেই। বিষয়টা একেবারেই ব্যক্তিগত উপলদ্ধির ব্যাপার। রাজনৈতিক মত পথ একটা থাকে সত্যি কিন্তু রাজনীতির বাইরেও জনগণের ভালবাসা পাওয়া বা জনগণের মধ্যে অবস্থান গড়ে তোলা অসম্ভব না। যাহোক, জনগণ একটা সমষ্টিগত ব্যাপার, বহুজনের সমষ্টি। দু’চারজন মানুষকে কলাকৌশলে বোঝানো বা দলে ভেড়ানো যায় কিন্ত যখন বহুজন, তখন তাদেরকে আর যেন-তেন ভাবে বোঝানো বা দলে ভেড়ানো সম্ভব হয় না। বাংলাদেশের জনগণকে অসচেতন বলে অবজ্ঞা করার একটা রেওয়াজ চালু আছে। এই অভিধার কোনো ঐতিহাসিক সত্যতা নেই। দেখা যাবে রাজনৈতিক-সামাজিক প্রশ্নে জনগণের কাছ থেকে যখন যে ধরনের ভূমিকা আশা করা হয়েছে, জনগণ সেই ধরনের ভূমিকায় সাড়া দিতে কখনও পিছপা হয়নি। তবে বাংলাদেশের জনগণ অশিক্ষিত তাতে সন্দেহ। তার থেকে বড় কথা বাংলাদেশের জনগণ দরিদ্র। দরিদ্র মানুষের প্রতি অবজ্ঞা বা অনুকম্পা দেখিয়ে আতœতৃপ্তি পাওয়া বা আতœম্ভরিতা প্রদর্শন তথাকথিত শিক্ষিত সুবিধাভোগী মানুষ আর নাটুকে বুদ্ধিজীবীদের এক ধরনের ফ্যাশন। তা না হলে নির্দ্বিধায় বলা যায় পৃথিবীর সব দেশের জনগণের চরিত্র সাধারণ ভাবে একই। সম্প্রতি যে কোভিড-১৯ এর আক্রমণ সারা দুনিয়ার মানুষকে তট¯’ করে তুলেছে, সেখানে ইউরোপের শিক্ষিত আর্থিক স্ব”ছল জনগণের যে আচরণ তার সাথে বাংলাদেশের জনগণের আচরণের ফারাক তেমন একটা নেই। সেখানে যে শৃঙ্খলা, সে শৃঙ্খলা জনগণের সচেতনতার ফল না, সে শৃঙ্খলা হচ্ছে আইনের শৃঙ্খলা। সেখানে আইনের প্রয়োগ আছে যথার্থ, জনগণ বাধ্য হয় সেই আইনকে মান্য করতে। আমাদের দেশে আইন হয়ত আছে কিন্তু তার যথার্থ প্রয়োগ নেই, জনগণেরও সেই আইন মানতে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। প্রশ্ন উঠতে পারে আইনের যথার্থ প্রয়োগ নেই কেন? প্রকৃতপক্ষে আইনের প্রয়োগ কোনো ব্যক্তি বিশেষের বা গোষ্ঠি বিশেষের ইচ্ছাধীন বিষয় না। এটা একটা পদ্ধতিগত ব্যাপার। আইন যাদের করার তাদের ভিত্তি যদি আইনগত ভাবে স্বচ্ছ আর জোরালো না হয়, তখন তাদের প্রবর্তিত শুধু আইন না, সব রকম কর্মকান্ডের মধ্যেই সেই দুর্বলতার প্রতিফলন ঘটতে থাকে। সে কারণে দেখা যাবে, যে দেশে সরকার গঠন প্রক্রিয়া যত স্বচ্ছ সে দেশে আইনও তত কঠোর। ইউরোপের দেশগুলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। জনগণের মধ্যে থেকে নেতৃত্ব গড়ে তোলার একটা প্রক্রিয়া আমাদের দেশে নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও চালু ছিল। স্থানীয় সরকার নির্বাচন, কলেজ বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ, নানা ধরনের ট্রেড ইউনিয়ন ইত্যাদি এ সবই ছিল সেই প্রক্রিয়ার অংশ। আমাদের দেশে যারা রাজনৈতিক নেতা, দলমত নির্বিশেষে, তারা প্রায় সবাই এই প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে উঠে আসা। দুঃখের বিষয় গত ২০ বছর সময়কালে এই ধরনের প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে জনমতের প্রতিফলন ঘটতে পারে, রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে পর্যায়ক্রমে সমূলে উৎখাত করা হয়েছে। যদিও উৎখাতের এই কাজ শুরু হয়েছে বেশ আগে থেকেই। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা হয়েছে, সব ধরনের নির্বাচন প্রশ্ন বিদ্ধ করা হয়েছে, দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থে কলুষিত করা হয়েছে ট্রেড ইউনিয়নের কার্যক্রম, সংকোচিত করা হয়েছে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা ইত্যাদি। মানুষের আন্তরিক আকাক্সক্ষাকে পায়ে দলে কেন আমরা এই পথে হাঁটলাম সে ব্যাপারটা পরিষ্কার হওয়া দরকার। আর শুধু পরিষ্কার হওয়াই যথেষ্ট না, জনগণকে এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করাও এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যাহোক, জনসম্পৃক্ত রাজনীতির জোর কতটা থাকে অতীত রাজনীতির দিকে তাকালে সেটা স্পষ্ট হয়। ভারত বিভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে দল ছিল একটাই, মুসলিম লীগ। এই মুসলিম লীগ ছিল খাজা নাজিমুদ্দিন আকরাম খা প্রমুখ অভিজাতদের কবলভুক্ত। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত তরুণ, জনগণের সাথে সম্পৃক্ত একটা প্রগতিশীল ধারাও তৎকালীন যুক্ত বাংলার মুসলিম লীগের সেক্রেটারি আবুল হাশিমের তত্ত্বাবধানে সক্রিয় ছিল। এই ধারারই প্রতিনিধি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৪৯ সালে টাঙ্গাইলের নির্বাচনে করোটিয়ার প্রভাবশালী জমিদার মুসলিম লীগ প্রার্থী খরুরম খান পন্নিকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে। কিন্তু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার এই নির্বাচনী রায়কে খোঁড়া যুক্তিতে বাতিল করে শুধু না, যে ৪ জন প্রার্থী এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল ১৯৫০ সাল পর্যন্ত তাদের জন্য সব রকরমের নির্বাচনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। আশ্চর্যের ব্যাপার, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর নিজ ক্ষমতা বলে খুররম খান পন্নির উপর থেকে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয় এবং তিনি আবার ঐ আসনের উপ- নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থী হন। এবার বিপক্ষ প্রার্থী ছিলেন জনপ্রিয় তরুণ শামসুল হক। খুররম খান পন্নির আবারও শোচনীয় পরাজয় হয়। আর প্রকৃতপক্ষে এই পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগের প্রভাব প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে আসে এবং খাজা নাজিমুদ্দিন সোহরওয়ার্দি ফজলুল হকের মতো ক্ষমতা-বলয়ের খেলোয়াড়দেরও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ১৯৪৯ সালে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশ মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করে। এই গঠন প্রক্রিয়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। দলের সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ৫২’র ভাষা আন্দোলনে, ৫৪’র যুক্ত ফ্রন্ট নির্বাচনে এই দল নেতৃত্ব প্রদান করে। ১৯৪৯ সালের পর থেকে প্রায় দেড় দশকেরও বেশি সময় রাজনীতির ময়দানে একক ভাবে ছড়ি ঘুরিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। তার শিক্ষা-দীক্ষা-বংশ- আভিজাত্য গৌরব করার মতো ছিল না কিন্তু তার যেটা ছিল সেটা হলো জনভিত্তি। যে কারণে সব ধরনের রাজনীতিবিদরাই তাকে গণ্য করতে বাধ্য হয়েছে। এই ধারারই রাজনীতি বাংলাদেশে দাপট দেখিয়েছে ততদিন, যতদিন ন্যূনতম গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। সব রকমের আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে তারা, আন্দোলনকে পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে। গত শতকে ‘৬৯এর গণঅভ্যুত্থানে যেমন, তেমন স্বাধীনতা সংগ্রামেও। তরিকুল ইসলাম ছিলেন এই ধারারই উত্তরসূরী। মেজাজ ছিল চড়া, উচিৎ কথা বলতে দ্বিধা করতেন না, তারপরও তার সারল্য, কঠোর-কোমল-যৌক্তিক মানসিকতা, অপ্রকাশ্য ছিল না। জনগণের সাথে সম্পর্ক ছিল হার্দিক। রাজনীতি শুরু করেছিলেন একেবারে প্রাথমিক পর্যায় থেকে। জেল-জুলুম-নির্যাতন সহেছেন বেশুমার । উঠেছিলেন শীর্ষ পর্যায়ে। তার মধ্যে কোনো রাজনৈতিক দ্বিচারিতা ছিল না। কতবার নির্বাচনে হেরেছেন বা জিতেছেন সেটা বড় কথা না, কৃতিত্বের কথা এই, তিনি ছিলেন তার রাজনীতিতে অপরিহার্য। তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অগণতান্ত্রিক চাপ মোকাবেলার ক্ষেত্রে তার দল সামর্থ্যের পরিচয় দেয়নি। যাহোক, তরিকুল ইসলামের জনসম্পৃক্ততা সম্পর্কে একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। সময়টা গত শতাব্দীর ৮০’র দশকের শেষ দিকে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এরশাদ বিদায় নেবে এটা নিশ্চিত হয়েছে কিন্তু ক্ষমতার প্রশ্নটা কিভাবে মীমাংসিত হবে সেটা নিশ্চিত না। রাতে যথারীতি বাড়ি ফিরে নিশ্চিত হলাম যে আমার মা’র, তখন তার বয়স সপ্ততিপর হবে, বাথরুমে পড়ে যেয়ে স্মৃতি ভ্রংশ হচ্ছে। অতঃপর তোড়জোড় করে সিদ্ধান্ত নিতে বেশ রাত হলো। সদর হাসপাতাল ছাড়া তখন নেওয়ার মতো বিকল্প কোনো জায়গা ছিল না। আর সদর হাসপাতালে যখন নেওয়া হলো তখন অনেক রাত। বিপদ এমনই, ডাক্তারদের ধর্মঘট, হাসপাতাল প্রায় ফাঁকা। ইমারজেন্সিতে মাসহ আরো কিছু রোগী, আমি বাইরে দাঁড়িয়ে কিংকর্তব্যবিমূড়। রাত তখন দুটো আড়াইটে হবে। এমন সময় দেখি উত্তেজিত এক দঙ্গল লোক হাসপাতালের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলো আর তাদের সামনে যে আসছে তার হাঁটার ভঙ্গি দেখে চিনতে সমস্যা হলো না; তরিকুল ভাই। ক্রমান্বয়ে তারা এগিয়ে এলে তরিকুল ভাইয়ের কথা স্পষ্ট হলো। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে উচ্চস্বরে তিনি বলছেন, – পড়ে গেল তো মরে গেল না কেন? তাহলে তো এই রাতে আমার ঘুম থেকে উঠে হাসপাতালে আসতে হত না! ঘটনা হলো; কোনো এক গ্রামে এক ছেলে গাছ থেকে পড়ে যেয়ে হাত না পা ভেঙেছে। রাতের বেলায় সুচিকিৎসার আশায় তারা চলে এসেছে নেতার বাড়ি। ঘুম থেকে ডেকে তুলে এনেছে তাকে। অতঃপর যা হয়, সরব হয়ে উঠলো হাসপাতাল। ডাক্তার উঠে এল বাড়ি থেকে, আর যার যে রকম চিকিৎসা দরকার সেই মতো চিকিৎসা নিশ্চিত করা হলো। ঘটনা সামান্য কিন্তু তাৎপর্য বিরাট। প্রথমত, গ্রামের মানুষ বিপদে পড়ে মাঝরাতে নেতার বাড়ি যেয়ে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে দ্বিধাবোধ করেনি। দ্বিতীয়ত, তিনি যে বলছেন, – ‘পড়ে গেল তো মরে গেল না কেন — ’ মানুষের উপর কতটা অধিকার থাকলে চরম সংকটজনক সময়েও এরকম কথা কেবলমাত্র গাঢ় আন্তরিকতারই প্রকাশ ঘটায়, ভিন্ন কোনো অর্থ বহণ করে না। জনগণের উপর এই অধিকার প্রতিষ্ঠাই হলো প্রকৃত রাজনৈতিক নেতার বৈশিষ্ট্য, বিশিষ্টও তারা এইখানে। ফরমান নিয়ে রাজনৈতিক পদ অধিকার করা যায়। ভয়-ভীতি-লোভ আর টাকা ছড়িয়ে মানুষ জড়ো করে ‘ঐতিহাসিক’ জনসভাও করা যায় কিন্তু প্রকৃত রাজনৈতিক নেতা হতে হলে তাকে পার হতে হয় অনেক চড়াই- উৎরাই, মোকাবেলা করতে হয় অনেক সমস্যা-সংকট, উত্তীর্ণ হতে হয় নানা ধরনের পরীক্ষাতেও। গত বিশ বছরে ধারাক্রমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সংস্কৃতি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। এই ধ্বংস্তুপের ভেতর থেকে উঠে এসে কারা হতবিহ্বল জনতার সামনে সম্ভাবনার রুদ্ধ দুয়ার উন্মোচন করবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।