২৪ তম প্রতীষ্ঠাবার্ষিকীর বিশেষ সংখ্যার একগুচ্ছ লেখা-৫

0

সেমোর সংস্পর্শে, উজানস্রোতে
মহিউদ্দীন মোহাম্মদ
এক. উজানপানে ধাই…
ভৈরববিধৌত অঞ্চল যশোরাদ্য দেশে যে মানুষটি কী এক অসাধারণ আকর্ষণে আমাদের মোহিত করেছিলেন, সবিশেষআত্মজ হয়ে উঠেছিলেন, সেই সেমোকে নিয়ে কথা বলাটা আর কারোর জন্যে না হোক, আমার জন্য যথেষ্ট ঝুঁকির। আবার আনন্দেরও। তার সাথে সংশ্রবে অনেকের অনেক প্রশ্নেরমুখে পড়তে হয়েছে আমাকে। যাপিত জীবনে সফল হতে পারিনি-এ অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা। প্রতিষ্ঠানবিরোধী চিন্তা-চেতনায় শামিল হওয়ার খেসারত নাকি আমার আধেক জীবন!
সেসব থাক। একটু বলি। আমি যে পরিবারের সন্তান-সেখানে আরেকটা সুযোগ ছিল আমার বড় মোল্লা-পুরত হওয়ার। কারণ পিতাজি ছিলেন এই অঞ্চলে খুব নাম করা মাওলানা। আমি যেহেতু পিতার লাইন ধরিনি, তাই এদের অনেকেই বলেছেন,আমি আমার জীবনকে বিসর্জন দিয়েছি। তারা মনে করেন গোল্লায় গিয়ে বিষ অর্জন করেছি। সবারই গল্প থাকে কিছু হতে পারা,কিছু না হতে পারার। যেমন অমলকান্তির কষ্টটা আমরা জানি। অমলকান্তি নাকি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। কিন্তু সে রোদ্দুরও হতে পারেনি।
বৈষয়িকভাবে যে উঁচু মাকামে বা তবকায় আমার থাকার কথা, তা না হয়ে জীবনে বিষ-অর্জনই কি শুধু করলাম? প্রশ্নটা ঘুরে ঘুরে আমাকে ত্যক্ত বিরক্ত করে। নানাভাবে বন্ধুত্বের খাতিরে আমরা যেসব মনিষ্যির সাথে মিশেছি-তাদের ভাবনায় হতে পারে বোলতায় রূপান্তরিত হয়েছি। যেমনটি রুমির কবিতায় উপমা হয়ে বক্তব্য বিবৃত হয়েছে। ‘ফুল থেকে মধুমকিা আহরণ করে মধু, আর বোলতা বিষ।’
আমার জীবনে কি এর সাজুয্য রয়েছে? যে জীবন বহন করেছি-তার তাৎপর্যটা এখনো আমি যুঝে নিতে পারিনি।
তবে এখনও উজানেই গন্তব্য নির্দিষ্ট হয়ে আছে শেষ-মেশ। সেই রুচিকে বদলাতে পারিনি। তাই ব্যর্থতা আমাকেও গ্রাস করে আছে। সুবিধাবাদের জিহ্বা একটু লকলক করলেই, আবার নিজেকে কোটরে স্থাপন করি। সেই আজব কোটরেই তর্জনি উচিয়ে রা করি ‘প্রাণভোমরা’।
তখন নব্বই দশকের শুরু। আর্টের প্রতি মোহগ্রস্ত। চিন্তাবিকাশের জন্য আলাদা বন্ধুবলয়ে শরিক হলাম। বন্ধ দুয়ার খুলে তুমুল আলো হাওয়ায় যেন শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছি। মনে হলো। নিজের খোলা দরোজায় যেখানে আমি প্রহরি,সেখানেই এক সিংহ পুরুষ নিশ্চিতভাবে সেলিম মোরশেদ।
সেমো তিনি একজন ব্যর্থ পুরুষ। আমার চে’ যোজন যোজন দূরত্বে তার ব্যর্থতা। সবাই যেটা পারে, সেটা তিনি পারেন না। এটা কি ব্যর্থতা না? তার মানে আমাদের পরিচিতজনরা যখন সবাই সুযোগ নিচ্ছে। বৈষয়িকভাবে স্ফিত হচ্ছে, তখন তিনি তরুণদের প্রশ্রয় দিয়ে নিজেকে শূন্যতার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। নিজের সংসার,সন্তান সবকিছু তছ-নছ। তবু তিনি চিতা,দার্ঢ্য।
আঠাশ উনত্রিশ বছরের সংশ্রব বা সহবতে এটাই প্রামাণ্য দলিল। তিনি কখনো আপোষ করতে পারেন নি। এটা করতে না পারাটাই তার জীবনের বড় ব্যর্থতা!(?)
সাহিত্য-সংস্কৃতির সুতিকাগারখ্যাত এই অঞ্চলের মানুষের চিন্তাকাঠামোটাই স্বাধীনতাপ্রিয়। নৃ-তাত্ত্বিকভাবেই বোধ হয় এমনই। তা পুনর্বার প্রজ্জ্বল হলো কতিপয় তরুণের কাছে সেদিন।
এখানের হাওয়ায় এস এম সুলতান, মধুসূদন, ফররুখ, আজীজুল হকের মত গুণী কবি সাহিত্যিকদের কথা শোনা যায়। সেই শোনার মধ্যে সংস্কৃতির জড়তাকে ছিন্ন করার প্রণোদনা জাগরিত হয়। কেননা তাদের নির্মাণ বিনির্মাণের কুশলতায় সমৃদ্ধ হয়েছে এই জনপদ।
আদমকে এই মাটির সন্তান করে তোলার প্রচেষ্টা সুলতানের, মধুসূদনের ‘রাবণ বিনির্মাণ’, ফররূখের নতুনভাব ও ভাষানুসন্ধান এবং আজীজুল হকের শব্দ দ্যোতনায় ‘চিন্তার সাম্প্রতিকতা’র সুনিপুণবিন্যাস-সৃষ্টিউল্লাসে দৃঢ় করে তারুণ্যকে।
সেই উদ্দীপ্ত তারুণ্যের সামনে, গৌরবময় যশোরে নব্বই দশকে ভাঙা-গড়ার সংস্কৃতির মেলবন্ধনে সেলিম হয়ে ওঠেন প্রয়োজনীয় ব্যক্তিত্ব। কবি মারুফুল আলম,পাবলো শাহি, অসিত বিশ্বাস, দুর্বাশা দুর্বার, তরুণ ভট্টাচার্য্য, টিটো জামান, মাশুক শাহি, মহিউদ্দীন মোহাম্মদ, সৈকত হাবীব, শেখ সিরাজউদ্দীন, মাসুমুল আলম, অতীন অভীক, ওয়াহিদুজ্জামান অর্ক, কবির মনি, মহসীন রেজা, ,সাদি তাইফ, আজিমুল হক, চিত্রশিল্পী মোজাই জীবন সফরি, তাবিথা পান্না, সাহিদুর রহমান,অন্যুন পৃন্স, জন প্রভুদান প্রমুখের কাছে নিপুণভাবেই উপস্থাপিত হয়েছিলেন তিনি বা আমাদের সেলিম ভাই। তার প্রতিষ্ঠানবিরোধী ভাবনাকে লালন করে উজানপানে ধেয়ে যূথবদ্ধ আন্দোলনের মন্ত্রণায় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন অনেকে।
সবাই একসাথে থেকে সোৎসাহে লিখেছেন-কবিতা,গল্প, নাটক,গান,চিত্রনাট্য,নৃত্যনাট্য। এঁকেছেন ছবি,করেছেন আবৃত্তি।
এসব করে সফলতা কোথায়? আমি জানি না। তবে এটা বুঝেছি তখন সাপের মুখে পা দিয়ে আমরা নেচেছি। ডিঙ্গা ভাসিয়েছি সাগরে। সফলতার উত্তর অন্যভাবে খুঁজেছি।
বিষ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি ঢোলকমলের। তার গানের চরণে যেমনটি রয়েছে-বন্ধুর পিরীতি যেন ঢোল কমলের বিষ।…
আমার মনে আছে একবারের কথা। আজিজুল হক, নকশাল বিদ্রোহের শেষসূর্যতাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল-‘জনযুদ্ধ ও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা’ সম্পর্কে। ‘প্রচল স্রোতের উল্টোদিকে বা উজানে রূপালি পুঁটিগুলোকে উঠে আসতে দেখেছেন? এই আসার লড়াইটা মূলত প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।’ এভাবেই বলেন তিনি। আমিও হয়ত সেই উজানেরই একটি ছোট্টপুঁটি।
দুই. যূথবদ্ধতার প্রাকপাঠ
মজাজলাধারের কি কোনো দাম আছে? না। তাই তরুণরা মজাজলাধারকে স্রোতময়-গতিশীল করে। ধ্বজাকে সামনের পানে নিতে বদ্ধপরিকর তারা। আমাদের েেত্রও তাই হচ্ছিল।
তখন এখানকার দুটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান যশোর ইনসটিটিউট পাবলিক লাইব্রেরি ও যশোর সাহিত্য পরিষদে আলাদাভাবে সাহিত্য আসর হতো। পাবলিক লাইব্রেরিরটার নাম ছিল শনিবাসর। সাহিত্য পরিষদেরটা রবিবাসর। সপ্তাহের দুটোদিন সাহিত্যকর্মীরা তাদের কর্মযজ্ঞ হাজির করতেন। পাঠ করতেন। কেউ বিচারকের আসনে বসে ভুলচুক ধরিয়ে দিতেন। তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা পর্যালোচনা চলত অনেকণ ধরে।
যশোর সাহিত্য পরিষদের রবিবাসরে কোনো কোনো দিন হাজির থাকতেন পঞ্চাশের দশকের অন্যতম কবি আজীজুল হক। তাঁর হাতে বহু প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে। তাঁর আকাঙ্াটা বোঝা যেত। তিনি চাইতেন এখানকার তরুণরা যেন আধুনিকমনস্ক হয়ে ওঠেন। তাঁকে কখনো সুবিধাবাদীর ভূমিকায় দেখা যায় নি। সে কারণে আমরা বলতাম-তিনি কার্যত অপ্রাতিষ্ঠানিক মানসিকতাকে লালন করেন। জীবনের শেষাধ্যায়ে তা ভালভাবে পরিলতি হয়েছে।
তাঁর কথা আনছি আরেকটা কারণে। যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্র দড়াটানা ব্রিজের উত্তরপাশে তখন ‘কালপত্র বইসমাবেশ’ নামে বিভূতোষ রায়ের একটা বইয়ের দোকান ছিল। যেটা মূলত চালাতেন কবি সৈকত হাবীব। এখানে দিনের অধিকাংশ সময় সাহিত্য-সংস্কৃতির সাথে জড়িত বিভিন্নজন হাজির হতেন। গুণীজনেরা আসতেন দেশের নানাপ্রান্ত থেকেও।
আজীজুল হক ও সেলিম মোরশেদকে আমরা একসাথে পেয়ে অনেকদিন জমজমাট আড্ডা দিয়েছি।
আমরা যারা নিয়মিত রাতের পর রাত, দিনের পর দিন আড্ডা মেরেছি কালপত্রসহ বিভিন্ন জায়গায়,তাদের মধ্যে কতিপয়ব্যক্তি লিটলম্যাগ নিয়ে নতুনভাবে ভাবার চেষ্টা চালাতে থাকেন। কেননা যশোরে চর্যা,শালপ্রাংশু, প্রমা,বিবর,স্বরবর্ণ, প্রহর-এসব নামে অনেক লিটলম্যাগ ছিল।

মৎস্যকন্যার সাগর অভিযান
মোস্তফা রুহুল কুদ্দুস
মৎস্যকন্যা টেংরি। হাড্ডিসার শরীর পাতলা লিকলিকে গড়ন। যেন তালপাতার সেপাই। টেংরা ওর সহোদর। মোটা তরতাজা জোয়ান। চেহারা সুরতে ভিন্ন হলেও দু ভাই-বোনের মধ্যে ভীষণ ভাব। একজন আরেকজন ছাড়া থাকতে পারে না। পিতা-মাতাকে হারাবার পর আরো গভীর হয় ওদের সম্পর্ক।
টেংরি তখন ছোট। ওকে বাসায় রেখে খাবার আনতে যায় পিতা-মাতা। কিন্তু আর ফেরেনি। সেখানে এক জেলের জালে আটকা পড়ে তারা। এতিম হয়ে যায় টেংরা-টেংরি। অল্প বয়সে পিতা-মাতাকে হারিয়ে বড়ই অসহায় হয়ে পড়ে ওরা। সেই থেকে টেংরি জেলেদের ওপর ভীষণ ্যাপা। দুচোখে দেখতে পারে না ওদের।
টেংরা টেংরির বসবাস একটা মরা নদীতে। এক সময় এই নদীতে বড় বড় মাছ ছিল। শোল, বোয়াল, রুই, কাতলা কত কী। অথৈ পানিতে ওরা মনের সুখে ঘুরে বেড়াতো। বর্ষা মওসুমে স্রোতের কলকল শব্দে বয়ে যেতো আনন্দের বন্যা। খুশিতে শোল-বোয়াল নাচানাচি করতো। শিং, মাগুরা ধরতো গান। আনন্দ উৎসবের কোন কমতি ছিল না নদীতে। এতো কিছুর পরও সেখানে টেংরা টেংরি ছিল অবহেলিত। বড় মাছেরা ওদের খোঁজ-খবর পর্যন্ত রাখতো না। সুযোগ পেলে তাড়া করতো। আছড়ে পিছড়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করতো। এখন আর সেই দিন নেই। নদী শুকিয়ে গেছে। কোথাও হাঁটু পানি। কোথাও মাজা পানি। ওপারের মানুষ পায়ে হেঁটে এপারে আসে। এপারের মানুষ ওপারে যায়। নদী পারাপারে আর নৌকা লাগে না। শোল-বোয়াল, রুই, কাতলা কোন কিছুই আর নদীতে নেই। কিভাবে যেন হাওয়া হয়ে গেছে। এখন টেংরা, টেংরির রাজত্ব। নদী জুড়ে দুই ভাই-বোনের একচ্ছত্র আধিপত্য। তারপরও ওদের মনে সুখ নেই। আগে অবহেলিত থাকলেও মনের ভেতর ছিল বিরাট বলÑ রুই, কাতলা অভিভাবক, রাজাধিরাজ। কোন বহির্শত্রু আক্রমণ করে সহজে কাবু করতে পারবে না।
এখন সঙ্গী নেই, সাথী নেই। নেই কোনো অভিভাবক। ওদিকে শিকারিরা বসে আছে ওঁৎ পেতে। সুযোগ পেলেই ওরা জাল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে নদীতে। বড়ই অসহায় মনে হয় টেংরা টেংরির। এতো কষ্ট আর এতো নিরাপত্তাহীন জীবন আর সহ্য হয় না। একদিন টেংরি বিনয়ের সাথে বলে-
: ভাইয়া এভাবে আর থাকা যায় না। চলো আমরা অন্য কোথাও চলে যাই।
: কোথায় যাবি?
: এই নদীইতো সাগরে চলে গেছে। সেখানে ইয়া বড় মাছ। জাহাজের মতো জলজ প্রাণী। এক সাথে থাকলে কেউ আমাদের ওপর চোখ রাঙাতে পারবে না। টেংরির কথা শুনে টেংরা মিছিমিছি হাসে। বলে-
: তার মানে তুই সাগরে যেতে চাস?
: হ্যাঁ, সাগরে যাওয়াই নিরাপদ। চারদিকে চেয়ে দেখ মানুষ নামের রাুসে শিকারিরা কিভাবে জাল নিয়ে বসে আছে। ওই জালে আটকা পড়ার চেয়ে সাগরে বড় ভাইদের সাথে মিলে মিশে থাকাই ভালো।
টেংরা ভেংচি কেটে বলে-
: এই চেহারায় রুব্বানের পাঠ! তালপাতার সেপাই হয়ে বোয়াল মাছের সাথে মিতালি !
: ভাইয়া, আমার চেহারা খারাপ বলে উপহাস করছো?
: একটা কথা সব সময় মাথায় রাখবি- সাগর হলো বড় মাছের জন্যে। আর আমাদের মতো চুনোপুঁটিদের জন্য খাল-বিল, মরা নদী।
: কিন্তু জীবন বাজানো ফরজ যে। এখানে তো বেঁচে থাকার কোন গ্যারান্টি নেই।
: যেখানেই যাই মৃত্যু একদিন হবেই। সেই মৃত্যুর ভয়ে আমি মাতৃভূমি ছাড়তে রাজি নই। যেখানে জন্মেছি, সেখানেই মরতে চাই।
: তাহলে তুমি সাগরে যাবে না?
: না, না, কনো না।
টেংরা সিদ্ধান্তে অনড়। মুখ ভার করে বসে আছে টেংরি। দু’জনই চুপচাপ। কোন দিশে না পেয়ে মনের দুঃখে স্থান ত্যাগ করে টেংরি।
দিন যায় রাত যায়। একে একে পার হয়ে যায় দু সপ্তাহ। কিন্তু টেংরি আর ফেরে না। একমাত্র বোনকে না পেয়ে ভীষণ চিন্তায় পড়ে টেংরা। এখানে ওখানে সবখানে খোঁজে। তখনো নদী পাড়ে শিকারিদের ভিড়। তাহলে কি কারো জালে আটকা পড়েছে টেংরি। এক অজানা আতঙ্কে গার লোম শিউরে ওঠে টেংরার।
না, টেংরি মরেনি।
স্বাস্থ্য শরীর খারাপ হলেও ভীষণ জেদি ও। ভাইয়ার কাছ থেকে অপমানিত হয়ে মনে মনে সাগরে যাবার জিদ ধরে টেংরি। যেই ভাবা সেই কাজ। মরা নদীর আঁকাবাঁকা পথ ধরে ছুটে চলে সাগরের দিকে। দিন রাত অবিরাম চলার পর টেংরি কান্ত শ্রান্ত দেহে হাজির হয় সাগরে। প্রবেশমুখে বিশাল আকৃতির একটা বোয়াল মাছ হাঁ করে ছিল। তার পেটে ঢুকে পড়ে টেংরি।
বিরাট পেট। যেন ফুটবল খেলার মাঠ। সেখানে মনের সুখে ছুটোছুটি করে, খেলা করে। ভাবে- এতদিন যে সাগরের গল্প শুনেছে, এটাই সেই সাগর। কিছুণ পর বোয়াল মাছটি মুখ বন্ধ করে। আর নিঃশ্বাস নিতে পারে না টেংরি। বন্ধ হয়ে আসে দম। জীবন যায় যায় অবস্থা, বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য বারবার আল্লাহকে স্মরণ করে। হঠাৎ মনে পড়ে যায়, ইউনুস নবীর কথা। একটা দোয়া পড়ে তিনি এমন একটা মহাবিপদ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। টেংরি বারবার সেই দোয়াটি পড়তে থাকে। এবার বোয়াল মাছ হাঁ করে। স্বস্তি পায় টেংরি। নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসে। ফুড়–ৎ করে বেরিয়ে আসে বোয়ালের পেট থেকে। বিরাট বিপদ থেকে উদ্ধার পায় টেংরি। বাইরে এসে খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারে, ওটা সাগর নয়-বোয়াল মাছ। আর দেরি করে না। দুহাতে কান ধরে শপথ করে আবার পিছন ফেরে। উল্টো যাত্রা শুরু করে সেই নদীপথে মাতৃভূমির উদ্দেশ্যে।
এদিকে, বোনকে হারিয়ে টেংরার চোখে ঘুম নেই। নাওয়া-খাওয়া প্রায় বন্ধ। দিনরাত শুধু ভাবে আর নিজকে ধিক্কার দেয়- নিশ্চয়ই ‘ও’ আমার জন্যে নিরুদ্দেশ হয়েছে। তার ভাবনার মধ্যে হাফাতে হাফাতে এসে পার কাছে হুমড়ি থেয়ে পড়ে টেংরি। টেংরা ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। নিজের চোখ দুটোকেও বিশ্বাস করতে পারে না। টেংরিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে-
: বোন আমার, এখনো বেঁচে আছিস? তোর চেহারা এমন বিধস্ত কেন?
: আমি ভুল করেছি ভাইয়া। আমাকে মা করো।
: পাগলি মেয়ে। কি ভুল করেছিস?
: তোমার ওপর অভিমান করে আমি সাগরে গিয়েছিলাম।
: সাগরে! তারপর?
: সেখানে এক বোয়াল মাছের পেটে আটকা পড়েছিলাম।
: ওরা তোকে বন্ধু করে নেয়নি।
: বন্ধু ! দম আটকে প্রায় মেরে ফেলেছিল। দোয়া ইউনুস পড়ে মুক্তি পেয়েছি। সত্যি ভাইয়া, ওরা সাগরের মাছ। আমাদের মতো চুনোপুটিদের ওরা কেয়ার করে না।
: সে কথাতো আগেই বলেছিলাম, এটা আমাদের মাতৃভূমি। পরদেশে বেঁচে থাকার চেয়ে নিজ দেশের মৃত্যু অনেক ভালো।
ভাইয়ার কথার কোন উত্তর দিতে পারে না টেংরি। মাথা নিচু করে বোবার মত বসে থাকে। টেংরা আবার শুরু করে-
: একটা কথা বলবো টেংরি?
: অবশ্যই। তুমি যা বলবে, আমি মাথা পেতে নেব।
: আল্লাহ আমাদের কেন সৃষ্টি করেছেন জানিস?
: তুমিই বলো ভাইয়া ।
: মাছেরা মানুষের জন্য সৃষ্টি হয়েছে। তাদের খাদ্য তালিকায় স্থান পেলে আমাদের জীবন সার্থক। আর সেটাই আমাদের ইবাদাত। কাজেই মরতে যখন হবেই সাগরে যাবো কেন। আল্লাহর হুকুম মতো মানুষের হাতে মরবো।
: ভাইয়া, সত্যিই আমি ভুলের মধ্যে ছিলাম। তোমার কথায় আমার চোখ খুলে গেছে। এখন আর মৃত্যুর ভয় নেই। মানুষের কল্যাণ করে জীবনকে সার্থক করতে চাই।
বোনের কথায় খুশিতে বাগবাগ টেংরা আনন্দের আতিশয্যে আবার ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে।

গল্প :
শ্বশুর আব্বা
জহির সাদিক
আমার বিয়ের দিন শ্বশুর তার মেয়েকে নতুন জামাইয়ের হাতে তুলে দেবার সময় নিজের মেয়ে সম্পর্কে এক গাদা হাবিজাবি নেগেটিভ কথা শোনালেন। উনার মেয়ে নাকি খুব রগচটা, অল্পতেই রেগে যায়, ধৈর্য্য কম, ঘুম থেকে দেরিতে উঠে, পড়াশোনার চেয়ে গল্প উপন্যাসে মনোযোগ বেশি, আরও কি সব জানি বললেন।
শ্বশুর আরও বললেন যে এইসব খারাপ অভ্যাস পরিহার করার জন্য উনি নাকি উনার মেয়েকে অনেকবার বলেছেন কিন্তু কোন লাভ হয়নি। শ্বশুর এক নিঃশ্বাসে তার মেয়েকে বিদায় দেবার সময় এইসব হতাশার কথাগুলো আমাকে বললেন।
তারপর চোখ মুছতে মুছতে বললেন, তবে বাবা আমার মেয়েটির মনটা অনেক সুন্দর।
আমি বললাম, জ্বি! আমি জানি।
শ্বশুর মশাই চোখ ছানাবড়া করে ফেললেন।
তুমি জানো মানে?? তুমি কি আমার মেয়েকে আগে থেকে চেনো নাকি??
খেয়াল করলাম আমার নতুন বউ তার পায়ের হাই হিল দিয়ে আমার পায়ের উপরে জোরে একটা চাপ দিল। আমি ব্যথায় উহ্ করে উঠলাম।
না..না.. আমি আপনার মেয়েকে চিনি না। আগে কখনও দেখিনি.. কখনও কথাও হয়নি।
আমার বউয়ের চোখ ভর্তি পানি। অথচ সে এই ভেজা চোখ নিয়ে আমার কথা শুনে ফিক করে হেসে উঠলো। কান্না আর দুষ্টুমি যে একসাথে করা যায় আমি এই প্রথম দেখলাম।
শ্বশুর আব্বা বেশ গর্ব নিয়ে বললো, তাহলে ঠিক আছে। ও যেটা বলছিলাম। একবার ওর মনের ভিতরে তুমি যদি ঢুকতে পারো তাহলে বুঝবে যে মেয়েটি আমার কতটা ভালো। তুমি আমার মেয়েকে অযতœ করো না বাবা। চেষ্টা করো ওকে যতেœ রাখার।
আমি মুখে কিছু না বলে বেশ ঝাঁকুনি দিয়ে মাথা নাড়লাম। মনে মনে বললাম বছর তিনেক ধরে আপনার মেয়ের সাথে প্রেম করছি। আপনার মেয়ের মন সকাল বিকেল ও দুপুরে প্রতি বেলায় বেলায় কেমন উঠানামা করে তা আমার থেকে কেউ বেশি জানেনা। আমার মাথা নড়ানোর ভংগী দেখে শ্বশুর আব্বা খুশি হলেন।
বললেন তোমার মাথা ঝাঁকুনি দেখে আমি খুশি হয়েছি বাবা। তবে তুমি আমার মেয়েকে বেশি প্রশ্রয় দিবা না, সবসময় একটু শাসনের মধ্যে রাখবা।
এবার আমি খুশি হয়ে মাথা নাড়লাম। বললাম, জ্বি।।
খেয়াল করলাম নতুন বউ তার পায়ের সূঁচালো হিল দিয়ে আমার পায়ের উপরে আবার জোরে একটা গুতা দিল। আমি ব্যথায় উহ্ করে উঠলাম। আমার সাথে এইসব হবে আগে জানলে শেরওয়ানির সাথে মিলিটারি বুট পরে আসতাম।
কি হলো তুমি কিছুণ পরপর এমন উহ্ করে উঠছো কেন??
না..না..ওসব কিছু না.. মাঝে মাঝে টেনশন করলে আমি উহ্ করে উঠি।
নিশ্চয় আমার কথা শুনে তুমি টেনশন করছো। টেনশন করো না বাবা। আমিতো তোমাকে সত্যটাই বলেছি। পরে তুমি যাতে আমাদের কে কোন দোষ দিতে না পারো তাই আজই বললাম। সত্য যতই তিক্ত হোক না কেন তা বলে ফেলাটাই উত্তম।
যেহেতু আমি আমার মেয়েকে সারাজীবনের জন্য তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি সেহেতু নেগেটিভ দিকটাও তোমার জেনে রাখা ভালো।
খেয়াল করলাম কথাগুলো বলে আমার শ্বশুর আব্বা সত্যি সত্যি কাঁদছেন। মানুষটির উপর কেন জানি আমার মায়া হচ্ছে। বয়স্ক একটা মানুষ তার মেয়ের জন্য শিশুর মত কাঁদছে দৃশ্যটি দেখে আমারও চোখে পানি আসলো। আমি চেষ্টা করলাম চোখের পানিকে দমিয়ে রাখতে। কারন আমাদের এই সমাজ নতুন বরের কান্না দেখতে মোটেই অভ্যস্ত না।
উনার মেয়ের সাথে যে আমার গত তিনবছর ধরে জানাশোনা মানে প্রেম ভালোবাসা ছিল এসবের ছিটেফোঁটাও উনি জানেন না। উনার বদ্ধমূল ধারনা লাফাঙ্গা টাইপ পোলাপাইনরা প্রেম করে বেড়ায়। উনি জানতে পারলে কখনোই উনার মেয়েকে একজন লাফাঙ্গার হাতে তুলে দিতেন না। বিয়ের আগে যেকোনো ধরনের প্রেম ভালোবাসার উনি ঘোরতর বিরোধী। শুধুমাত্র প্রেমের বিয়ে হবার কারনে উনি উনার ছোট শ্যালিকার বিয়ে পর্যন্ত বয়কট করেছিলেন।
শ্বশুর মশাই আপাদমস্তক একজন পরহেজগার মানুষ। উনার এই মেয়ে জন্ম হবার বছর তিনেক আগে উনি হজ্জ পালন করেন। আমার এই শ্বশুর আব্বা উনার এলাকার হাই স্কুলের হেড মাস্টার ছিলেন। বছর পাঁচেক আগে রিটায়ার্ড করেছেন। আশেপাশের এলাকার সবাই উনাকে খুব শ্রদ্ধা করেন। স্যার বলে ডাকেন।
মেডিকেলে ভর্তির আগ পর্যন্ত নিজের মেয়েকে বালিকা বিদ্যালয় এবং মহিলা কলেজে পড়িয়েছেন। মেডিকেলের লেডিস হোস্টেলে রেখে আসার দিন উনি উনার মেয়েকে অনেক ধরনের উপদেশ দিয়েছিলেন। তারমধ্যে অন্যতম উপদেশ ছিল কোনভাবেই ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব করা যাবেনা। মেয়ের উপরে উনার অগাধ বিশ্বাস ছিল যে মেয়ে তার কথা রাখবে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য মেয়ে তার বাবার কথা রাখেনি। তিন মাস যেতে না যেতেই আমার সাথে পরিচয় হবার পর মেয়ে তার বাবার সব উপদেশ নিমিষেই ভুলে গিয়েছিল। আমার শ্বশুরের মেয়ের নাম শিমু। শিমু মাঝেমধ্যেই বলতো আমাদের এভাবে কথাবলা মোটেই ঠিক হচ্ছে না। বাবা জানতে পারলে খুবই কষ্ট পাবেন।
আমার খালু শ্বশুর ছিলেন আমাদের বিয়ের ঘটক। ঘটক হিসেবে ভদ্রলোকের নামডাক আছে। এটা তার উনত্রিশ নম্বর বিয়ে। এরমধ্যে দশটা প্রেমের বিয়ে আছে। প্রেমের বিয়ের ঘটকালি করা নাকি খুবই ডিফিকাল্ট। দুই পরে পরিবার কন্টিনিউয়াস নাক সিটকাইতে থাকে। দুই পরিবারই মনে করে পাত্র পাত্রী জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করে ফেলেছে। এই ভুলের মাশুল তাদেরকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।
বিয়ের কিছুদিন আগে আমরা দু’জনে একদিন খালুশ্বশুরকে আমাদের সম্পর্কের কথা জানালাম। জানার পর খালু কিছুণ জিহবায় কামড় দিয়ে বসে ছিলেন। উনি চেহারাটা এমন করে রেখেছিলেন মনে হয় আমরা ভয়ংকর খারাপ কিছু করে ফেলেছি। উনি স্বাভাবিক হবার পর বললেন যে আমাদের এই সম্পর্কের কথা কোনভাবেই বড় দুলাভাই মানে আমার শ্বশুরকে বলা যাবে না। জানলে উনি ভীষন কষ্ট পাবেন এবং কিছুতেই বিয়েতে রাজি হবেন না। অন্যভাবে মানে তোমরা কেউ কাউকে চেনোনা এমনভাবে বিয়ের এরেঞ্জমেন্টটা করতে হবে।
যাহোক খালু শ্বশুরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কোন ধরনের ঝামেলা ছাড়াই আমাদের বিয়ে সম্পন্ন হলো।
বিয়ের তিনদিন পর আমি শ্বশুরালয়ে বেড়াতে আসছি। নতুন জামাইয়ের যতœ আত্তির কোন কমতি নেই। আমার শ্বশুর কিছুণ পর পর এসে আমার খোঁজ খবর নিচ্ছেন। আমার পাশে বসে ইতিহাসের সব মজার মজার কাহিনী শুনিয়ে যাচ্ছেন। ইতিহাস নাকি উনার খুব পছন্দের একটা সাবজেক্ট। তার দুঃখ যে তার কোন ছেলেমেয়ে ইতিহাস পছন্দ করে না। উনি এরমধ্যে আমাকে মোঘল সাম্রাজ্যের দশ শতাংশ বলে শেষ করে ফেলেছেন। আরও নব্বই শতাংশ বাকি। উনি ইতিহাসের গল্প বলেন আর আমি বিদগ্ধ শ্রোতার মত হা করে শুনি। আমি টের পাচ্ছি যে শ্বশুর আব্বা আমাকে পছন্দ করতে শুরু করেছেন।
উনার মেয়ে এসে কিছুসময় পরপর আমার মুখের হা টা বন্ধ করে দিয়ে যাচ্ছে।
শ্বশুর বললেন যে উনার আলমারিতে প্রচুর ইতিহাসের বই আছে। শ্বশুর আব্বার আপাতত প্লান হলো আমাকে মোঘল ইতিহাস বলা শেষ করে ব্যবিলনের ইতিহাস শুরু করবেন।
আজ আমার শ্বশুরগৃহে প্রথম রাত্রিযাপন। রাত এগারোটার দিকে শ্বশুর মহোদয়ের কাছ থেকে ছাড়া পেয়েছি। ইতিহাসের গল্প শুনে বেশ খানিকটা কান্তিবোধ করছি। চোখে প্রচন্ড ঘুম। বালিশে মাথা দেবার সাথে সাথে ঘুমের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেলাম।
ভোর সাড়ে চারটার দিকে কে যেন আমাদের দরজাতে নক করছেন। আমার ঘুম ভেঙে গেছে। আমি স্পষ্ট শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
এই শিমু.. কে যেন দরজা নক করছে.. একটু উঠে দরজা খুলে দেখো না প্লিজ।
ঘুমচোখে বললো, আমি পারবো না.. তুমি উঠে দরজা খোলো।
আরে ধুর! আমি এই বাড়ির নতুন জামাই না??
কিসের আবার নতুন জামাই??.. অলরেডি ষাট ঘন্টা শেষ.. শোনো, আমি নিশ্চিত আব্বা দরজা নক করছে.. তোমাকে নিয়ে নামাজ পড়ে হাঁটতে বের হবেন.. কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি আব্বার সাথে যাও.. বেশি দেরি করলে উনি কিন্তু েেপ যাবেন।
আমি ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে দেখি শ্বশুর আব্বা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি।
তাড়াতাড়ি রেডি হও বাবা.. নামাজ পড়ে আমরা হাঁটতে বের হবো.. তোমাকে সাত মিনিট সময় দিলাম.. এরমধ্যে রেডি হয়ে ড্রয়িং রুমে চলে এসো।
আমি যত দ্রুত সম্ভব রেডি হলাম। শিমুর হালকা নাক ডাকার শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
আমরা দু’জনে বাসার পাশের মসজিদে নামাজ পড়লাম। নামাজ শেষে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। চারদিকে এখনও ঠিকমত ভোরের আলো ফোটেনি। ভদ্রলোক এই বয়সেও বেশ জোরে হাঁটছেন। আমি উনার পিছে পিছে হাঁটছি।
কি হলো বাবা.. তুমি এত পিছে কেন.. আমার পাশাপাশি এসে হাঁটো। আমরা এই রোড দিয়ে সোজা দুই কিলোমিটার যাবো। ওখানে একটা চায়ের দোকান আছে। সেখানে দশ মিনিটের একটা বিশ্রাম নেব। সেইসময় আমরা এক গ্লাস পানি, একটা রং চা এবং দুটো বিস্কুট খাবো। তারপর একই পথে আবার ফিরে আসবো।
আমি শ্বশুরের পাশে হাঁটছি আর উনার কথা শুনছি। অনেক পরিচিত মানুষ উনাকে সালাম দিচ্ছেন। উনি প্রত্যেকটি সালামের উত্তর দিচ্ছেন। উনাকে বেশ উৎফুল্ল মনে হচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে মিশরীয় সভ্যতা নিয়ে কিছু বলা শুরু করলেন। বিড়বিড় করে বললাম এই সব সভ্যতার ব্যাপার স্যাপার আপনার মেয়েকে শোনালে আমাদের ভবিষ্যৎ অনেক আরামদায়ক হতো।
এরপর বাকী যে তিনদিন শ্বশুরালয়ে ছিলাম ওই তিনদিনে উনি মোঘল সাম্রাজ্যের পুরোটা এবং ব্যবিলনের ইতিহাস বলে শেষ করে ফেলেছেন। প্রতিদিন ভোরবেলা শ্বশুর আমাকে সাথে নিয়ে হাঁটতে বের হতেন। এরপর বেড়াতে আসলে উনি ইসলামিক ইতিহাস শুরু করবেন সেটাও বলে রেখেছেন।
বিয়ের ছয়মাস পর জাপানে তিন বছরের জন্য একটা মনবুশো স্কলারশিপে আমার নাম বের হলো। আমরা দুজন জাপান চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিই। তাড়াহুড়ো করে জাপান যাবার আগের দিন বিদায় নিতে শ্বশুর বাড়িতে আসি।
বিদায়ের শেষ মুহূর্তে বাসে উঠার সময় আমার শ্বশুর আমাকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মত কেঁদে ফেললেন। বললেন, আমি নাকি উনার বন্ধুর মত। আমার মত এত সুন্দর মনোযোগ দিয়ে কেউ নাকি আগে কখনও ইতিহাসের গল্পগুলো শোনেনি।
মানুষটার জন্য সত্যি আমার খুব মায়া হচ্ছে। শিমুর চোখে কোন পানি নেই অথচ শ্বশুর আব্বার জন্য আমার দুচোখ পানিতে টলমল করছে !!!

গল্প :
জঙ্গলের নাম ফেরদৌস
বেনজীন খান
বলছিলাম, একটি জঙ্গলের কথা। যে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ছিলো একটি নদী। নদীটিতে ছিলো স্বচ্ছ পানির ধারা। সেখানে ছিলো মাছ আর প্রাণের মেলা। ছিলো গাড়ো সবুজের সমাহার। আর ছিলো ভরপুর আলো ও তার প্রতিবেশী– নিবিড় ছায়া। গতিময় বাতাসের প্রবাহ, আন্দোলিত ফুল, সুবাসের নৃত্য, ফলের প্রাচুর্য, পাখি পশু আর কীট-পতঙ্গের গানে জঙ্গলটি ছিলো ঠিক যেনো– জান্নাতুল ফেরদৌস।
এ-জঙ্গলের জন্ম ইতিহাস বেশ পুরনো। ভূগোল মতে হিমালয় সৃষ্টির কিছুদিন পরের কথা। পুনরায় শোধরানো হবে শর্তে অতি মায়াবতী পাহাড়– মেঘ থেকে পানি ধার করে দিতে থাকে উষর ভূমিতে। সেই থেকে শুরু জঙ্গলের যাত্রা।
এত এত নিয়ামত ছিলো এখানে যে, ভিনদেশী পশুরা এসে কেউই আর ফেরেনি আপন দেশে। জঙ্গলটি তাই ধীরে ধীরে হয়ে উঠলো পুরো জগত; বৈচিত্র্যের সমাহার! এভাবেই চলে এসেছে জঙ্গলটির দীর্ঘ অজানা কালের ইতিহাস।
প্রেম মায়া আর সমতার ভিত্তিতে জঙ্গলটিতে সবুজ অরণ্য আর পশুতে চলত অপার লীলে। কীটপতঙ্গ আর অনুজীবগুলোও সেই লীলে উপভোগ করতো নৃত্যের তালে তালে। এ-স্বর্গীয় পরিচয় তাই গুপ্ত থাকেনি হিমালয়ের দণি পাদদেশে। বরং তা পৌঁছে যায় গোলোকের একের পর এক প্রান্ত অবধি।
সেও আজকের কথা নয়!
একদা কোনো এক প্রত্যুশে খেয়াল করলো জঙ্গল অধিবাসী– উত্তর পশ্চিম পাহাড়ের গা-ঘেঁষে অপরিচিত পশুকুলের একটি ধারার নিয়মিত আনাগোনা। নিরীহ জঙ্গলবাসী প্রথম প্রথম ভেবেছিলো– হয়তো ওপারে মোড়ক লেগেছে, দেখা দিয়েছে যারপরনাই খাদ্যের অভাব।
প্রচুর্যে ভরপুর আদিবাসীগণ– সুন্দরী গাছ, গোলপাতা, সঙ্ঘবদ্ধ বাঁশ; ফজলি আম, লেবু, পেয়ারা; ছোলা, মুসুড়ি, ধান; জবা, হাসনাহেনা, বেলি। গরু, মহিষ, বাঘ, হনুমান, বানর, হরিণ, খরগোশ। কেঁচো, ব্যাঙ, কচ্ছপ, শামুক। ঝিয়া, মায়া, খলিসা, ইলিশ। ঘুঘু, পেঁচা, দোয়েল, কোকিল আর ময়ূর কেউ-ই ভাবেনি কখনো, এই আগন্তুকদের থাকতে পারে কোনো গোপন অভিসার! তারা বেঘোরে নিমগ্ন ছিলো তাদের জান্নাতুল ফেরদৌসে।
কিন্তু নিরীহ হরিণ একদিন খেয়াল করলো– বানরেরা আর গাছের পাতা ফেলে না। ফেউ সতর্ক করে না বাঘের আগমন। শামুক নিজেকে খোলসে গুটিয়ে ফেলেছে। ময়ূর তার পেখম মেলছে না। কেঁচো মাটিকে উলটপালট করছেনা, অণুজীবরা ঘুমিয়ে গেছে। সবুজ বন দুলছে না। বাতাস থমকে গেছে। মেঘ মলিন, পানির ধারা দিতে গররাজি। হাসনাহেনা কামিনী গন্ধ বন্ধ রেখেছে। গুমোট আবহাওয়ায় নাভিশ্বাস সকলের। তাদের জঙ্গলে এখন প্রবাহিত হচ্ছে ঘৃণা আর বিদ্বেষ!
এমতাবস্তায় পূর্বতন প্রাচুর্যের গৌরবগাঁথা বিস্তারের ন্যায় আজও নিরীহ হরিণ আর ঘুঘু পাখির দীর্ঘশ্বাস পৌঁছে গেলো গোলকের নানা প্রান্ত পর্যন্ত।
অবশেষে জঙ্গলদেশে নেমে এলো সুফল-কুফল দুই-ই। প্রবেশ করতে থাকলো নানা রঙের তস্কর-ত্রাতা। জঙ্গলদেশ হারিয়ে ফেললো তার সম্পূর্ণ নিজস্বতা। আপন দেশে এখন ভূমিপুত্র পরবাসী। এখন সেখানে নিয়মিত যুদ্ধ ঝরে; প্রবাসী পশুকুলের মধ্যে যুদ্ধ। আর ভূমিপুত্রকে হতে হয়– প।
এক সময় যুদ্ধের দামামায় জঙ্গল তামা হয়ে যায়। ঝরে যায় শান্ত সবুজ। অন্ধকার ছায়াও সরে যায়। হারিয়ে যায় জোনাকি আলো। মায়াবতী প্রেম কবরে লুকাই। কেবল জেগে থাকে উজ্জ্বল– চিতা।
ফাটল ধরে জঙ্গলে, মাটিতে, মন আর মননে। আর ফাটলের গোহীন থেকে উদগীরণ হতে থাকে দু’টি অন্ধকার রে– চক্র ও চাঁদ। পশুকূল ভেবেছিলো হয়তো এবার থীতো হবে জঙ্গল। কিন্তু কিছু দিন বাদেই দেখা গেলো চক্রের ধাক্কায় ফাটল ধরলো চাঁদে, আর সেই অবসরে চাঁদ চিরে বের হয়ে এলো– সূর্য। জঙ্গল-ফেরদৌস এখন হয়ে গেলো তিনটি ভাগে বিভক্ত– চক্র, চাঁদ ও সূর্যে; প্রকারান্তরে যা হয়ে উঠলো একেকটি নরক, যথাক্রমে: তমিস্রা রৌরবকালসূত্র।
প্রতিটি জঙ্গলেই এখন অবৈধ মিলনে মিলনে ভরপুর জন্ম নিয়েছে– দাঁতাল শুয়োর, কুৎসিত হায়েনা, ধেড়ে ইঁদুর, বিষধর সাপ আর সুযোগ সন্ধানী শকুন। তাদের দাপাদাপিতে থরহরিকম্প জঙ্গলময়। খেয়েই চলেছে উপর-নিচে সর্বত্র। ফলবতী বৃগুলো মুড়ো হয়ে গেছে। দাঁতাল শূয়োরের খোড়াখুড়িতে গোড়ার মাটি সরে গিয়ে শিকড়সুদ্ধ উলুঙ্গ এখন। তারা আকাশ থেকে সরিয়ে দিয়েছে সবুজের প্রাচীর। সূর্যের বিষাক্ত আগুনকে করেছে আলিঙ্গন। তাতেই ছারখার হয়েছে জঙ্গলের আদি বাসিন্দা সমূহ– কীটপতঙ্গ, ব্যাকটেরিয়া, অণুজীব। বিরাগভাজন মেঘ। শর্ত ভঙ্গে অনুতপ্ত পাহাড়। ফিরে গেছে জলের ধারা।
অতঃপর একদিন প্রতিশোধে প্রকৃতি, ঈশানকোণে পাঠিয়ে দিলো কালো মেঘ। মেঘ বয়ে আনলো বাতাস। সে বাতাসে মাটি ছেড়ে উলঙ্গ ছিন্নভিন্ন শীকড়সহ কান্ড সমূহ গেলো উপড়ে। দেখা গেলো, অতিশয় বিশাল কাণ্ডের তলে চাপা পড়ে মরে অতিকায় দাঁতাল শুয়োর, কুৎসিত হায়েনা, ধেড়ে ইঁদুর, বিষাক্ত সাপ। আর তৎনাতই পালে পালে এসে গেলো কুৎসিত শকুন। মুহূর্তে শুরু হলো– ভোগের বিকার উল্লাস।
মহাপ্রলয় শেষে কিছুদিন সুনসান নীরবতা। মৃত শ্মশান পুরীতে দেখা গেলো, ুদ্ররা বেঁচে আছে অতিকায় গুড়ির ছোট ছোট ফাঁকফোকরে। ধীরে ধীরে তারা বের হতে লাগলো। পালিয়ে যাওয়া মায়াবী হরীণ এসে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! হঠাৎই সে শুনতে পেলো পেছনে তার খসখস শব্দ। তাকিয়ে দেখে– নিরীহ খরগোশ। বললো, শ্মশান পুরির দেিণ দেখে এলাম, পঁচা সার ভেদ কোরে পাপড়ি মেলছে– রসুন ফুলের গোলাপি কুঁড়ি।

আলফ্রেড বার্নার্ড নোবেলের উইল
আরফাতুন নাবিলা
সম্মানজনক ও দামি পুরস্কার হলেও নোবেল পুরস্কারের পেছনে আছে কারখানায় বিস্ফোরণ ও মৃত্যুর মতো করুণ ঘটনা। নাইট্রোগিসারিন দিয়ে বিভিন্ন বিস্ফোরক ও ডিনামাইট তৈরির কারিগর আলফ্রেড নোবেল মর্মান্তিক এ ঘটনার পর নিজের অর্জিত অর্থ মানবকল্যাণে বিলিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। লিখেছেন আরফাতুন নাবিলা
দারিদ্র্য থেকে বাস্তবতার শিা
১৯০১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত বিশ্বের অন্যতম সম্মানজনক এবং দামি পুরস্কার হিসেবে পরিচিত নোবেল পুরস্কারের কথা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পৃথিবীর সেরা মানুষদের কথা। প্রতি বছর রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, চিকিৎসা, সাহিত্য ও শান্তিতে যে মানুষগুলো এই পুরস্কার পাচ্ছেন, বিশ্ববাসীর প্রতি তাদের অবদান অনস্বীকার্য। অথচ সম্মানীয় এই পুরস্কারটি দেওয়ার ব্যবস্থা যিনি করে রেখে গিয়েছিলেন, তার শৈশব কেটেছিল ভীষণ দরিদ্রতার মধ্য দিয়ে। বলছি নোবেল পুরস্কারের জনক আলফ্রেড বার্নার্ড নোবেলের কথা। ১৮৩৩ সালের ২৩ অক্টোবর সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে এক গরিব পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। নোবেলের পরিবার তার জন্মের আগে দরিদ্র ছিল না। বাবা ইমানুয়েল নোবেল ছিলেন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী। হঠাৎ করেই ব্যবসায় পরপর মন্দা দেখা দেওয়ায় তিনি ঋণখেলাপি হয়ে পড়েন। নোবেল বাবার চতুর্থ সন্তান। তার জন্মের পরই এমন ঘটনা ঘটায় যতœ বলতে তেমন কিছুই তার ভাগ্যে জোটেনি। কিছুদিন পর তাদের একমাত্র থাকার জায়গা বাড়িটিও আগুনে পুড়ে গেলে পুরো পরিবার সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে পড়ে। নোবেলের মাত্র চার বছর বয়সে বাবা নতুন কাজের আশায় ফিনল্যান্ড চলে যান। সে সময় সুইডেনে থাকাকালে নোবেলের পরিবারকে সাহায্য করেন তার নানা। নোবেলের মাকে তিনি একটি মুদির দোকান খুলে দেন, যেখানে অল্প বয়সী নোবেল দিন-রাত পরিশ্রম করতেন। একে তো দরিদ্র পরিবার, তার ওপর দোকানের আয়েই চলে সংসার। লেখাপড়ার সুযোগ বলতে আকর্ষণীয় তেমন কিছুই জোটেনি সে সময়। তবু অল্প বয়সেই বুঝে গিয়েছিলেন এই দরিদ্রতা কাটাতে হলে তাকে শিতি হতেই হবে। মাত্র সাত বছর বয়সে জ্যাকব’স প্যারিশ অ্যাপলজিস্ট স্কুল’ নামে একটি দরিদ্র সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলের শিকরা বেশ রু মেজাজের অধিকারী হওয়ায় প্রায় সময়ই শিার্থীদের ভাগ্যে জুটত বেতের বাড়ি। তবে নোবেল শান্ত মেজাজের আর শৃঙ্খলা মেনে চলায় তাকে স্কুলে পড়তে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। দোকান আর লেখাপড়া সব সামলিয়েই চলছিলেন তিনি।
এদিকে বাবা ইমানুয়েলেরও তত দিনে ব্যবসার চেহারা ফিরতে শুরু করেছে। ব্যবসায়ী হওয়ার সুবাদে ব্যবসার নানা বিষয় নিয়ে তার জানা ছিল। বুদ্ধি খাঁটিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন রাশিয়ান মিলিটারির জন্য অস্ত্র তৈরির একটি কোম্পানি। এই ব্যবসায় অল্প সময়েই তার ভাগ্য ফেরে। পরিবারকেও রাশিয়া নিয়ে আসেন। নোবেলের বয়স তখন ৯ বছর। অল্প বয়স থেকেই নোবেলের বুদ্ধিমত্তা প্রকাশ পেয়েছিল। মাত্র এক বছর বয়সেই তিনি রাশিয়ান ভাষা আর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ইংরেজি, ফরাসি আর জার্মান ভাষা শিখে ফেলেন। বাবা ইমানুয়েল তার সন্তানদের রাশিয়ার কোনো স্কুলে না পড়িয়ে বাড়িতেই গৃহশিক রেখে দেন। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়লেও নোবেল আগ্রহী হয়ে ওঠেন রসায়নের প্রতি। তবে তার সাহিত্যের প্রতিও ঝোঁক ছিল। রসায়ন ভালো লাগলেও সে বিষয়ে কী কাজ করা যায়, তা নিয়ে না ভেবে কিশোর বয়সে সিদ্ধান্ত নেন শিক হবেন। ছেলের বিষয়ে জানতে পেরে বাবা সুকৌশলে ছেলেকে পাঠিয়ে দেন ইউরোপে। উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে এসে ছেলে তার ব্যবসায় মনোযোগ দেবে।
বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচয়
বাবার কথা মেনে ঘুরতে বের হয়ে যান নোবেল। নিউ ইয়র্ক ও প্যারিস ঘুরতে গিয়ে সময় কাটাতে লাগলেন রাসায়নিক গবেষণাগার আর ফ্যাক্টরিতে। আর্থিক সংকট ও স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেওয়ায় ১৯ বছর বয়সে ফিরে আসেন রাশিয়ায়। এক হাজারেরও বেশি শ্রমিক নিয়ে গড়ে তোলা বাবার ফ্যাক্টরি দেখাশোনার দায়িত্ব নিলেও নিজের শরীর তত দিনে বেশ খারাপ হতে শুরু হয়েছে নোবেলের। এদিকে ব্যবসার অবস্থাও ভঙ্গুর। রাশিয়া ক্রিমিয়ার যুদ্ধে হেরে যাওয়ায় ইমানুয়েলের অস্ত্রের মূল্য পরিশোধ না করায় ব্যবসা তত দিনে বন্ধ হওয়ার উপক্রম। অস্ত্র ব্যবসার পাশাপাশি গান পাউডারের চেয়েও শক্তিশালী নাইট্রোগিসারিন আবিষ্কারের চেষ্টায় ব্যর্থ হওয়াতেও ইমানুয়েলের ব্যবসায় আর্থিক তি বিশাল আকারে দেখা যায়। রাশিয়ায় সব রেখে ইমানুয়েল পুরো পরিবার নিয়ে তখন সুইডেন চলে যায়। ছিলেন শুধু নোবেলের দুই ভাই রবার্ট ও লাডভিগ। ব্যবসার যেটুকু টিকে আছে তাই দেখাশোনা করতেন দুজন। নোবেল ফিরে গিয়ে স্টকহোমে শুরু করেন গবেষণার কাজ। বয়স মাত্র ২৫ হলেও অসুস্থতা নোবেলের পিছু ছাড়েনি। এদিকে পরিবারের অবস্থাও ভালো নয়। একটি ছোট কারখানায় নিজের ল্যাবের কাজ শুরু করেন। রোজ ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করেন, ঘুমের জন্য সময় পেতেন খুব কম। বিজ্ঞানের অজানা দিক দিয়ে পরিশ্রম তাকে সে সময় ফিরিয়ে দেয়নি। খুব অল্পদিনেই তিনি নাইট্রোগিসারিনের বিস্ফোরণ ঘটানো শিখে ফেলেন। এই দুর্ঘটনাই নোবেলের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
বিস্ফোরণ থেকে নতুন সূচনা
কারখানার কাজ, গবেষণা, পরিবারের দেখাশোনা সবই চলছিল ভালোমতোই। কারখানায় নোবেলের ছোট ভাইসহ আরও কয়েকজন কাজ করতেন। ১৮৬৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর একতলা সে কারখানায় ভয়াবহ এক বিস্ফোরণ হয়। সে বিস্ফোরণে নোবেলের ছোট ভাই এমিল, একজন সহকর্মী, ঝাড়–দারসহ পাঁচজন মানুষ মারা যান। কারখানায় তখন ব্যাক পাউডার (গাউন পাউডারের একটি ধরন) ও নাইট্রোগিসারিন নিয়ে কাজ হতো। তবে কাজের সময় তেমন কোনো সুরাবিধি মানা হতো না। ব্যক্তিগতভাবে কারও ওপর মৃত্যুর দায়ভার না পড়লেও এসব উপাদানের কারণে তাদের মৃত্যু হয় বলে পুলিশ জানায়। এ ঘটনায় নোবেল মানসিকভাবে বেশ বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন। তবে এভাবে চুপচাপ থাকলে যে নাইট্রোগিসারিন নিয়ে কোনো সমাধান মিলবে না, তাও তিনি জানতেন। তাই আবারও শুরু করেন গবেষণার কাজ।
দুর্ঘটনার আগে ১৮৬৩ সালে কাঠের পাগ সমন্বিত একটি ডেটোনেটর (বিস্ফোরক পণ্য) আবিষ্কার করেছিলেন নোবেল। ধাতব পাত্রে নাইট্রোগিসারিন রেখে সেটি কাঠের পাগের সাহায্যে বড় একটি চার্জারে চার্জ দেওয়া হতো। পাগ দিয়ে ব্যাক পাউডারকে অল্প চার্জ দিলেই তা তরল নাইট্রোগিসারিনকে বিশাল আকারে বিস্ফোরিত হতে সাহায্য করত। এই আবিষ্কার নোবেলকে প্রথম উদ্ভাবক হিসেবে খেতাব এনে দেয়। একই বছর নাইট্রোগিসারিনের সঙ্গে কাঠকয়লার গুঁড়োসহ কয়েক ধরনের গুঁড়ো মিশিয়ে একটি নতুন বিস্ফোরক আবিষ্কার করেন। সলিড বানানো হলেও তাপ দিলে সেটি বিস্ফোরকে পরিণত হতো। ১৮৬৪ সালে এই বিস্ফোরকের পেটেন্ট সুইডিশ পেটেন্ট অফিসে জমা দেওয়া হলেও দুর্ঘটনার জন্য সেটি তখন মঞ্জুর হয়নি। এরপর নতুন করে আবারও কিসেলগার, কাঠের গুঁড়ো, ছিদ্রযুক্ত সিলিকা আর দানাদার কিছু উপাদান দিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৮৬৭ সালে নাইট্রোগিসারিনকে এই পদার্থগুলো দিয়ে শোষণ করিয়ে কাগজে মুড়ে তৈরি করেন ডিনামাইট। এর আবিষ্কারের পর নানা ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহার শুরু হয়। এই ডিনামাইট তৈরি যে মানুষের তি করবে, এমনটি ভাবেননি নোবেল। তার উদ্দেশ্য ছিল মানবকল্যাণেই এর ব্যবহার করা। এদিকে ভাইয়ের মৃত্যুর পর নাইট্রোগিসারিনের বিস্ফোরণকে কীভাবে অব্যর্থভাবে করা যায়, তা নিয়ে ভাবা শুরু করেছিলেন তিনি। গবেষণার ফলে আবিষ্কার করেন ছোট ধাতুর তৈরি বাস্টিং ক্যাপ ডেটোনেটোর। এটি কেবল নির্দিষ্ট তাপে বিস্ফোরিত হবে। তার এই উদ্ভাবনের পর সে সময়ের কোনো বিস্ফোরণে তো বটেই, বর্তমানেও এর ব্যবহার হচ্ছে। ১৮৭৫ সালে আবিষ্কার করেন ডিনামাইটের চেয়ে অধিক শক্তিশালী, স্থিতিশীল, নিরাপদ এবং পানির নিচেও বিস্ফোরণযোগ্য ‘গ্যালিগনাইট’ বিস্ফোরক। ১৮৮৭ সালে নাইট্রোসেলুলোজ ও নাইট্রোগিসারিনের মিশ্রণে বুলেট এবং কামানের শেলে ব্যবহারের জন্য ‘ব্যালিস্টিট’ নামে প্রোপ্যালেন্ট তৈরি করেন। ফরাসি মিলিটারিরা এর প্রতি কোনো আগ্রহ না দেখালে তিনি ইতালির মিলিটারির কাছে লাইসেন্স করিয়ে নেন। তার এমন সিদ্ধান্তে ফরাসি সরকার তার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালায়, গবেষণাগারে অভিযান চালিয়ে অনেক সরঞ্জাম বাজেয়াপ্ত করে। সরকারের এমন কাজে মনঃুণ্ হয়ে ফ্রান্স ছেড়ে আজীবনের জন্য ইতালিতে চলে যান নোবেল।
নোবেল পুরস্কারের যাত্রা
ডিনামাইট আবিষ্কারের পর নোবেলকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তবে যতই তার উপার্জন বাড়তে থাকে, ততই তিনি মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করেন। এর মূল কারণ ছিল ভাইয়ের মৃত্যুর পর সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি খবর। বিস্ফোরণের সেই ঘটনার পর একটি পত্রিকা ভুল করে নোবেলের মৃত্যুসংবাদ ছেপে শিরোনামে লিখেছিল, ‘মৃত্যু ব্যবসায়ীর মৃত্যু’। দিনের পর দিন এই পীড়া নিয়ে বাঁচতে চাননি নোবেল। ডিনামাইট আবিষ্কারকে নিজের ভুল ভেবে এর প্রায়শ্চিত্ত করতে এবং পৃথিবীকে সুন্দর করতে দারুণ এক সিদ্ধান্ত নেন। নিজের ৯৪ ভাগ সম্পত্তি দিয়ে পদার্থ, রসায়ন, চিকিৎসা, সাহিত্য, শান্তি এই পাঁচটি বিষয়ে বৈশ্বিকভাবে সেরা ব্যক্তিদের পুরস্কার দেওয়ার জন্য ফান্ড নির্মাণ করেন। ১৯০১ সালে তার মৃত্যুর পাঁচ বছর পর প্রথমবারের মতো নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।
আলফ্রেড নোবেলের উইল
আলফ্রেড নোবেল তার উইলে যে মানুষগুলো তার সঙ্গে ছিলেন এমন বেশ কয়েকজনকে প্রচুর অর্থ দান করে গেছেন। ভাই রবার্ট নোবেলের দুই ছেলে হালমার নোবেল এবং লুডভিগ নোবেল প্রত্যেকের জন্য দুই লাখ ক্রাউন, ভাইপো ইমানুয়েল নোবেলকে তিন লাখ ও ভাতিজি মিনা নোবেলকে এক লাখ ক্রাউন, ভাই রবার্ট নোবেলের মেয়ে ইনগিবোর্গ ও টায়রা দুজনের প্রত্যেককে এক লাখ ক্রাউন, প্যারিসের মিসেস ব্র্যান্ডের সঙ্গে অবস্থানরত মিসেস ওলগা বোয়েতগারকে এক লাখ ফ্রাংক, মিসেস সোফি ক্যাপি ভন ক্যাপিভারকে বছরে ছয় হাজার হাঙ্গেরিয়ান ফোরিন, স্টকহোমের মিস্টার আলারিক লিয়েদবেককে এক লাখ ক্রাউন, প্যারিসের মিস এলিস অ্যান্টুনকে বছরে আড়াই হাজার ফ্রাংক, আমেরিকার টেক্সাসের ওয়াটারফোর্ড নিবাসী মিস্টার আলফ্রেড হ্যামন্ডকে দশ হাজার আমেরিকান ডলার দিয়ে যান আলফ্রেড নোবেল।
নোবেলের ভাষায় বাকি সম্পদের বিলিবণ্টন
আমার মূলধন, যা আমার নির্বাহী কর্মকর্তারা নিরাপদে বিনিয়োগ করেছেন, তা দিয়ে একটা তহবিল গঠন করা হবে। এই তহবিল থেকে বার্ষিক যে সুদ পাওয়া যাবে, তা প্রতি বছর পুরস্কার হিসেবে পাবেন যারা আগের বছর মানুষের কল্যাণে সর্বোচ্চ অবদান রেখেছেন। বার্ষিক অর্জিত মোট সুদকে সমান পাঁচ ভাগে ভাগ করা হবে। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বা উদ্ভাবন করেছেন এমন ব্যক্তিরা এক ভাগ করে, কোনো আদর্শ স্থাপনের ল্েয সাহিত্যে সবচেয়ে ভালো কাজ করেছেন, দুটি দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব সৃষ্টির ল্েয, সেনাবাহিনীর বিলুপ্তি বা সৈন্যসংখ্যা কমানোর ল্েয, শান্তি সম্মেলনের আয়োজন ও প্রচারের ল্েয সবচেয়ে বেশি কিংবা সবচেয়ে ভালো কাজ করেছেন এমন ব্যক্তিরা এক ভাগ করে পাবেন। পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নের পুরস্কার দেবে সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস, শরীরতত্ত্ব কিংবা চিকিৎসাবিজ্ঞানের পুরস্কার দেবে স্টকহোমের ক্যারোলিন ইনস্টিটিউট, সাহিত্যের পুরস্কার দেবে অ্যাকাডেমি ইন স্টকহোম এবং শান্তি পুরস্কার দেবে নরওয়ের পার্লামেন্ট (স্টরটিং) র্কর্তৃক নিয়োজিত পাঁচ সদস্যের এক কমিটি। এই পুরস্কার দেওয়ার জন্য মনোনয়নের েেত্র কোনো ধরনের জাতীয়তার প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। স্ক্যানডিন্যাভিয়ান হোক বা না হোক, যোগ্যতম ব্যক্তিই এই পুরস্কার পাবে। আমার উইল কার্যকর করার জন্য মিস্টার র‌্যাগনার শোলম্যান ও মিস্টার রুডলফ লিজেকুইস্টকে নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করছি। এই কাজের জন্য তারা যে কষ্ট করবেন, তার তিপূরণ হিসেবে মিস্টার র‌্যাগনার শোলম্যান এক লাখ ক্রাউন মিস্টার রুডলফ লিজেকুইস্টকে পঞ্চাশ হাজার ক্রাউন পাবেন। বর্তমানে আমার সম্পদের মধ্যে কিছু অংশ প্যারিস ও সেন্ট রেমোতে রিয়েল এস্টেট হিসেবে এবং আমানত হিসেবে ইউনিয়ন ব্যাংক অব স্টকল্যান্ডের গাসগো ও লন্ডন শাখায়; প্যারিসের কম্পটয়ের ন্যাশনাল ডি-স্কম্পটি এবং আলফেন মেসিন অ্যান্ড কোম্পানিতে; প্যারিসের স্টকব্রোকার এমভি পিটার অব ব্যাংক ট্রান্স-আটলান্টিকে; বার্লিনের ডিরেকশান ডার ডিসকনটো গেশেলস্ক্রাফট এবং জোসেফ গোল্ডস্মিডট অ্যান্ড কোম্পানিতে; রাশিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকে এবং পিটারসবুর্গে মিস্টার ইমানুয়েল নোবেলের কাছে; গুটেনবার্গ ও স্টকহোমে স্ক্যানডিনাভিস্কা ক্রেডিট আক্টিয়েবোলাগেটে এবং প্যারিসের ৫৯ নম্বর মালাকফ অ্যাভিনিউতে আমার স্ট্রং-বক্সে জমা আছে। এগুলো ছাড়াও আছে পেটেন্ট, পেটেন্ট ফি বা রয়্যালটি থেকে আয়। আমার নির্বাহীরা এই হিসাবের পূর্ণ বিবরণ আমার দলিলপত্র থেকে খুঁজে বের করবেন।
আমার এই উইলটিই একমাত্র বৈধ উইল। আমার মৃত্যুর পর যদি এর আগে করা কোনো উইল খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে সেগুলো বৈধ বলে গণ্য হবে না। সবশেষে আমার বিশেষ ইচ্ছা আমার মৃত্যুর পর কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আমার শিরা কেটে দেখবেন এবং মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হবেন। তারপর আমার দেহ কোনো শ্মশানে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হবে।
প্যারিস, ২৭ নভেম্বর, ১৮৯৫
আলফ্রেড বার্নার্ড নোবেল