ভারতে বাড়তির দিকে দাম রফতানি বন্ধের দাবি

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ইস্পাত শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল আকরিক লোহা। ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে শিল্প কাঁচামালটির দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়তির দিকে রয়েছে। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে ভারতজুড়ে লকডাউন শুরু হলে উত্তোলন ও সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার কারণে আকরিক লোহার দাম আকাশ ছুঁয়েছে। লকডাউন না থাকলেও এখন অবধি ধাতুটির দাম কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে ভারতীয় ইস্পাত উৎপাদনকারীদের। অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে বাড়তি দামে আকরিক লোহা কিনতে হচ্ছে তাদের। বাড়ছে ইস্পাত উৎপাদনের ব্যয়। এ পরিস্থিতিতে দ্রুত শিল্প কাঁচামালটির মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টানা সম্ভব না হলে ভারতীয় ইস্পাত শিল্প আর্থিকভাবে লোকসানের মুখে পড়বে। তাই দেশটির ইস্পাত শিল্পসংশ্লিষ্টরা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে চিঠি লিখে আকরিক
লোহার ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টানতে শিল্প কাঁচামালটির রফতানি সাময়িক বন্ধের দাবি তুলেছেন। খবর বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ও ইন্ডিয়া টুডে।
এ বিষয়ে ভারতের বহ্মপুত্র মেটালিকস লিমিটেডের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা কৌশিক আগারওয়াল বলেন, গত ছয় মাসে ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে আকরিক লোহা ও প্যালেটের দাম প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়েছে। এ দুটি উপকরণ ইস্পাত তৈরিতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। করোনার কারণে ভারতীয় ইস্পাত শিল্প আগে থেকেই ধুঁকছে। এর মধ্যে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি চ্যালেঞ্জ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। দ্রুত অবস্থার উন্নতি না হলে ইস্পাত শিল্প গভীর সংকটে পড়তে পারে। সম্ভাব্য সংকট এড়াতে এ মুহূর্তে সবচেয়ে কার্যকর উপায় আকরিক লোহা রফতানি সাময়িক বন্ধ রাখা। তাহলে ভারতের বাজারে শিল্প কাঁচামালটির দাম হাতের নাগালে নেমে আসবে। উপকার হবে ইস্পাত উৎপাদনকারীদের।
ভারতীয় ইস্পাত উৎপাদনকারীদের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বরাবর চিঠি দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০১৮-২৯ অর্থবছরে ভারত থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে আকরিক লোহা রফতানি ১৩৩ শতাংশ বেড়েছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরেও ভারত থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে ৩ কোটি ৭৬ লাখ ৯০ হাজার টন আকরিক লোহা রফতানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ২ কোটি ১৫ লাখ ৪০ হাজার টন বেশি। এর আগের অর্থবছরে ভারত থেকে ১ কোটি ৬১ লাখ ৫০ হাজার টন আকরিক লোহা রফতানি হয়েছিল। এটা ভারতীয় রফতানি খাতের জন্য খুবই ভালো একটি খবর। তবে করোনা পরিস্থিতিতে আকরিক লোহার ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধিতে ইস্পাত শিল্পের সংকট নিয়েও সবাইকে ভাবতে হবে। লকডাউন-পরবর্তী সময়ে বাড়তি দামে কাঁচামাল কিনে ইস্পাত উৎপাদন অব্যাহত রাখা ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানের জন্য কষ্ট কম। এসব প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও আকরিক লোহা রফতানিতে লাগাম টানা জরুরি।
করোনা মহামারীর সময়ে ভারতজুড়ে লকডাউন চলায় আকরিক লোহা উত্তোলনে রীতিমতো ধস নেমেছে। এ পরিস্থিতি শিল্প কাঁচামালটির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ওড়িশা মাইনিং করপোরেশনের (ওএমসি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল-জুলাই সময়ে ভারতের খনিগুলো থেকে সব মিলিয়ে ৪ কোটি ৭০ লাখ টন আকরিক লোহা উত্তোলন হয়েছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় গত এপ্রিল-জুলাই সময়ে ভারতে শিল্প কাঁচামালটির উত্তোলন কমেছে ৫০ শতাংশ।
মার্চে ভারতে করোনা সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। ওই মাসের শেষে টানা লকডাউনে যায় দেশটি। জুন-জুলাইয়ে ধাপে ধাপে লকডাউন তুলে নেয়া হয়। লকডাউনের সময় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে অনেকে খনির কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। শ্রমিকরা বাড়ি চলে যাওয়ায় অনেক খনির কার্যক্রম সীমিত ছিল। মূলত এসব কারণে এপ্রিল-জুলাই সময়ে ভারতে শিল্প কাঁচামালটির উত্তোলনে রীতিমতো ধস নেমেছে, যা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে আকরিক লোহার।
ভারতের সবচেয়ে বড় আকরিক লোহা উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল মিনারেল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (এনএমডিসি)। রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠান ভারতের বাজারে শিল্প কাঁচামালটির মূল্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠানটি আকরিক লোহার মাসভিত্তিক দাম ২২ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চে উন্নীত করেছে। বর্তমানে ভারতের বাজারে ভবিষ্যতে সরবরাহের চুক্তিতে প্রতি টন আকরিক লোহা ৩ হাজার ২৫০ রুপির (স্থানীয় মুদ্রা) বেশিতে বিক্রি হচ্ছে। সেপ্টেম্বরে শিল্প কাঁচামালটির দাম টনে ৩০০ রুপি বাড়িয়েছে এনএমডিসি। এর আগে আগস্টে প্রতি টন আকরিক লোহার দাম আগের মাসের তুলনায় ৫০০ রুপি বাড়ানো হয়েছিল।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা সংক্রমণ এড়াতে লকডাউন চলার সময় ভারতের ইস্পাত কারখানাগুলোও উৎপাদন গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। তবে লকডাউন শিথিল হওয়ার পর থেকে পূর্ণোদ্যমে উৎপাদন শুরু করেছে এসব কারখানা। ফলে লকডাউনে কমলেও পরবর্তী সময়ে ভারতের বাজারে আকরিক লোহার চাহিদা বেড়েছে। সেই তুলনায় বাড়েনি শিল্প ধাতুটির উত্তোলন। উত্তোলন ও চাহিদায় এমন ভারসাম্যহীনতা ভারতের বাজারে আকরিক লোহার দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
এনএমডিসির তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল-আগস্ট সময়ে প্রতিষ্ঠানটির আওতায় আকরিক লোহার সম্মিলিত বিক্রি দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৮ লাখ টনে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪ শতাংশ কম। তবে এ মন্দা ভাবের সিংহভাগ লকডাউনের সময় বিদ্যমান ছিল। পরবর্তী সময়ে শিল্প কাঁচামালটির বেচাকেনায় গতি ফিরতে শুরু করেছে। এ ধারাবাহিকতায় গত আগস্টে সব মিলিয়ে ১৭ লাখ ৯০ হাজার টন আকরিক লোহা বিক্রি করেছে এনএমডিসি। এক বছরের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির আওতায় শিল্প কাঁচামালটির বিক্রি বেড়েছে এক-পঞ্চমাংশ বা ২০ শতাংশ।
লকডাউন-পরবর্তী ভারতে ইস্পাত শিল্পে গতি যত দ্রুত ফিরেছে, ততই আকরিক লোহার চাহিদা বেড়েছে। সেই তুলনায় বাড়েনি শিল্প কাঁচামালটির উত্তোলন। স্বাভাবিকভাবে চাহিদা ও উত্তোলনে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে ক্রমাগত আকরিক লোহার দাম চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। সেপ্টেম্বরেই শিল্প কাঁচামালটির দাম বেড়ে ২২ মাসের সর্বোচ্চে উঠেছে, যা ভারতের ইস্পাত শিল্পসংশ্লিষ্টদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।
এ বিষয়ে ওড়িশাভিত্তিক কাশভি পাওয়ার অ্যান্ড স্টিল প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেবব্রত বেহেরা বলেন, সব মিলিয়ে চরম সংকটের মধ্য দিয়ে সময় পার করছে ভারতের ইস্পাত শিল্প। একদিকে করোনা মহামারীর ধাক্কা সামলানো, অন্যদিকে আকরিক লোহার ক্রমবর্ধমান দাম—এ দুই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে শিল্পটিকে। এ পরিস্থিতিতে তুলনামূলক কম দামে কাঁচামাল সরবরাহ করা সম্ভব না হলে অনেক ইস্পাত কারখানা উৎপাদন কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে বা সাময়িক বন্ধ রাখতে বাধ্য হবে। এটা রফতানিমুখী ইস্পাত শিল্পের জন্য মোটেও সুখকর কোনো বিষয় নয়। তাই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারস্থ হয়েছেন শিল্পসংশ্লিষ্টরা। আকরিক লোহা রফতানি সাময়িক বন্ধ রেখে হলেও ইস্পাত শিল্পের সম্ভাব্য এ সংকট এড়ানোর অনুরোধ করা হয়েছে।