বিনিয়োগ বাড়াতে কর কাঠামোর সংস্কার জরুরি

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ক্রমাগত নীতি বদলানো এবং ব্যবসাবান্ধব কর কাঠামোর অভাবে বাড়ছে না বিনিয়োগ। এ অবস্থায় করনীতি ও কর প্রশাসন আলাদা করা প্রয়োজন। পাশাপাশি রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর জন্য ডিজিটাল কর ব্যবস্থা প্রবর্তন করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। গতকাল রিসার্জেন্ট বাংলাদেশ আয়োজিত ‘টুওয়ার্ডস এ কনডিউসিভ ট্যাক্স সিস্টেম: দ্য রিফর্ম ইমপ্যারেটিভ অ্যান্ড প্রায়োরিটি’ শীর্ষক আলোচনা সভায় কর ব্যবস্থার সংস্কার ও ডিজিটাইজেশনের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন তারা।
ভার্চুয়াল এ আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, দেশ ডিজিটাল হলেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কার্যক্রম এখনো সনাতনী পদ্ধতিতে চলছে। লেনদেন ও কার্যক্রমে ডিজিটাল ব্যবস্থা বাড়ানো গেলে কর আহরণ বাড়বে। হয়রানি কমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, রাজস্ব বাড়ানোর জন্য যেসব সিদ্ধান্ত ও নীতি নেয়া হয়, তা অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসাবান্ধব নয়। তাই বিনিয়োগ সেভাবে আসছে না। অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, রাজস্ব বোর্ডের সাবেক কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সরকারের একজন মন্ত্রী ও মন্ত্রী মর্যাদার প্রধানমন্ত্রীর দুই উপদেষ্টাও এসব পরামর্শকে বাস্তবসম্মত বলে উল্লেখ করেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ও এনবিআরের কাজ বিপরীতধর্মী। কিন্তু একজন সচিব এ দুই প্রতিষ্ঠানের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় কর বিভাগের সংস্কার ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে সুপারিশ করবেন বলে জানান তিনি।
ভার্চুয়াল সংলাপে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেন, এনবিআর এখনো ব্রিটিশ জমিদারদের মতো সনদনির্ভর কর পদ্ধতিতে চলছে। ব্যবসায়ীদের কাছে এনবিআর চাহিদা অনুযায়ী ট্যাক্স দাবি করে। কোনো কোম্পানি তা পরিশোধ না করলে ওই কোম্পানির সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করে রাখে। তখন সরবরাহকারীর বিল, শ্রমিকদের বেতন দিতে পারে না কোম্পানিটি। দীর্ঘদিন মামলা চলার পর ওই কোম্পানি জয়লাভ করলেও তার ব্যবসা করার সামর্থ্য থাকে না। এক্ষেত্রে এনবিআরের যে কর্মকর্তা ব্যাংক হিসাব জব্দের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, তার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যবস্থা করা জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, ভ্যাটহার অনেক বেশি, এটি কমিয়ে একক হার করতে হবে। এনবিআর কাস্টমস ডিউটি থেকে বেশি আয় করতে আগ্রহী। আয়কর ও করবহির্ভূত রাজস্ব বাড়াতে হবে। করনীতি ও প্রশাসন দুটি ভিন্ন বিষয়। কর প্রশাসনকে আলাদা করে এনবিআর চেয়ারম্যানকে কমপক্ষে পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ দেয়ার ব্যাপারে মত দেন তিনি।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ২০১২ সালের ভ্যাট আইন বেশ ভালো আইন। কিন্তু যখন বাস্তবায়ন করা হলো, তখন আইনটি পুরনো আইনের চেয়ে দুর্বল হয়ে গেল। ফলে ভ্যাট আইন এক ধরনের সেলস ট্যাক্স সংগ্রহ করার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তিনি আরো বলেন, প্রতিটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় রাজস্ব খাত সংস্কারের কথা বলে সরকার, কিন্তু পরে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় না। কর কাঠামোর সংস্কার ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে এসডিজি অর্জন কিংবা মধ্যম বা উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি। কর কাঠামো সংস্কার করতে উচ্চ পর্যায়ের কমিশন গঠনের পরামর্শ দেন এ বিশেষজ্ঞ।
রিসার্জেন্ট বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত ওই সভায় কর প্রশাসনের কয়েকটি হয়রানি তুলে ধরেন ব্যবসায়ীরা। এ প্রসঙ্গে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, তিনি ইপিজেডের কারখানার জন্য কাঁচামাল হিসেবে ২০ লাখ টাকার কাগজ আমদানি করেছিলেন। বিমানযোগে আমদানি করা কাগজ ঢাকা পৌঁছলে কাস্টমস কর্মকর্তারা ওই কাগজের কোনো এইচএস কোড না পেয়ে ১১ লাখ টাকা কর আরোপ করেন। ইপিজেডভুক্ত কারখানার কাঁচামাল আমদানি ডিউটি ফ্রি—এ তথ্য জানানোর পরও কর দিয়েই কাগজ ছাড় করাতে হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
একই বিষয়ে বিএসআরএমের চেয়ারম্যান আলী হোসেন আকবর আলী জানান, ৪০০ কোটি টাকা অগ্রিম কর পরিশোধ করেছেন তারা। কিন্তু এনবিআরের সিস্টেম আপডেট না হওয়ার কারণে তা ফেরত পাচ্ছেন না। এ সময় আয়কর রিটার্ন দাখিলের পর চালানের ফটোকপি হারানোর কারণে এনবিআরের কর্মকর্তার মাধ্যমে নিজের বোনের হয়রানির তথ্য তুলে ধরেন আবুল কাসেম খান।
অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এমসিসিআইয়ের সভাপতি ব্যারিস্টার নিহাদ কবির। তিনি বলেন, বাংলাদেশের কর জিডিপি অনুপাত অনেক কম। এটা বাড়ানোর জন্য ব্যবসাবান্ধব, করদাতাবান্ধব পরিবেশ দরকার। এতে বিনিয়োগ ও রাজস্ব দুটোই বাড়বে।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম মনে করেন, বিনিয়োগ বাড়াতে হলে কর ব্যবস্থায় সংস্কার জরুরি। এমসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি নাসিম মঞ্জুর বলেন, রাজস্ব ব্যবস্থাকে বিক্রিনির্ভর কর ব্যবস্থা থেকে আয়নির্ভর কর ব্যবস্থায় যেতে হবে। উেস কর কাটাও আয়কর আইনের পরিপন্থী।
বিল্ডের চেয়ারপারসন আবুল কাশেম খান বলেন, দেশ ডিজিটাল হলেও রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থা এখনো সনাতনী পদ্ধতিতে চলছে। অনেক নগদ লেনদেন হচ্ছে, যেগুলোর করের আওতার বাইরে থাকছে। সব লেনদেন ব্যাংকিং চ্যানেলে বা অনলাইনের মাধ্যমে আনা গেলে কর আহরণ সহজ হবে বলে পরামর্শ দেন তিনি।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দিন বলেন, নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হলেও অল্টারনেটিভ ডিসপুট রিজল্যুশন (এডিআর) শুরু করা যায়নি। এডিআর না হওয়ায় ব্যবসার পরিবেশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।এনবিআরের সাবেক সদস্য মো. ফরিদউদ্দিন বলেন, ২০০৮ সালে কর প্রশাসন ও করনীতি আলাদা করার বিষয়ে একটি নির্দেশনা জারি করা হয়। কিন্তু কোনো কারণে তা বাস্তবায়ন হয়নি।
মোবাইল অপারেটর রবির সিইও মাহতাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হলেও অসংখ্য এসআরও জারি করে ১৯৯১-তে ফেরত যাওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। আপিল করার আগেই এনবিআরের দাবি করা অর্থ ৩০ শতাংশ জমা দিতে হয়। এ ধরনের নীতি থাকলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হবেন না।