নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে নাভিশ্বাস

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, আদা ও রসুনের দাম সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ ১০০ টাকার নিচে নয়। মোটা পেঁয়াজের দাম ৭০ টাকা। কাঁচা মরিচের কেজি ২০০ টাকা। আদা ২০০ টাকা। রসুন প্রতিকেজি প্রকারভেদে ১২০ থেকে ১৬০ টাকা। এতদিনে চালের দামও বাড়তে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে ভোজ্যতেলের দাম। সব ধরনের চালের দামই গত ক’দিনে প্রতিকেজিতে কয়েক টাকা করে বেড়েছে। লুজ সয়াবিন ও পামওয়েল প্রতিকেজিতে অন্তত ১০ টাকা বেড়েছে। শাক-সবজিও আক্রা; দাম অত্যাধিক। আলু ছাড়া কোনো সবজিই ৫০ টাকার নিচে নয়। আলু ৪০ টাকা প্রতিকেজি। কোনো কোনো সবজির দাম ১০০ টাকা কিংবা তারও বেশি। ডালের দাম দেশি ১১০ টাকা, বিদেশি ৭০-৮০ টাকা প্রতিকেজি। এক ডজন ডিমের দাম ১১০ থেকে ১১৫ টাকা। মাছ-মুরগী ও সব ধরনের গোশতের দাম বাড়তি। পেঁয়াজ-কাঁচা মরিচ-আদা-রসুন কম হলেও চলে; না হলেও চলতে পারে। মাছ-মুরগী ও গোশতও না হয় আপাতত বাদ দেয়া গেলো, কিন্তু ডাল, শাক-সবজি না হলে চলে কী করে! এসবের দাম এখন যা, তা দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষ, নিম্ন মধ্যবিত্ত, এমন কি মধ্যবিত্তের পক্ষে কেনা কঠিন। নিত্যপণ্যের এই উচ্চমূল্যে বস্তুত ক্রেতাদের নাভিশ্বাস উঠেছে। করোনা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও দীর্ঘ বন্যায় উৎপাদনের ক্ষতি হয়েছে বটে; তবে এত ক্ষতি হয়নি যাতে মূল্য পরিস্থিতি এতটা নাজুক হয়ে পড়তে পারে। বাজারে চাল, ডাল, তেল, আদাসহ নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। তারপরও সব কিছুর দাম ও হু হু করে বাড়ছে।
টিসিবি’র হিসাবে, গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় প্রতিটি নিত্যপণ্যের দামই বেড়েছে। ইতোমধ্যেই মোটা চালের দাম ১৮.৯৫ শতাংশ ও চিকন চালের দাম ৮.৭৪ শতাংশ বেড়েছে। ভোজ্য তেলের মধ্যে সুপার পামওয়েল ২৬.১৫, লুজ সয়াবিন ১৩.১৩ ও লুজ পামওয়েল ২৯.১৭ শতাংশ বেড়েছে। ডালের মধ্যে বড় দানার মসুর ২১.৭৫ শতাংশ, মাঝারি দানার মসুর ৩৮.৩৬ শতাংশ এবং চিকন দানার মসুর ৯.৫২ শতাংশ বেড়েছে। আলুর দাম বেড়েছে ৬৪.৪৪ শতাংশ। সাধারণ ও স্বল্প আয়ের মানুষ আর কিছু না হোক, ডাল ও আলু ভর্তা দিয়ে দুটো ভাত খাবে, সে উপায়ও থাকছে না। চাল-ডাল-আলু ইত্যাদির দাম বাড়লে কিংবা সংকট দেখা দিলে মানুষ বিচলিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। কারণ, এগুলো কোনোরকমে বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য খাদ্যপণ্য। দেশ খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে বলে দাবি করা হয়। এবছরও বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। ডাল-তেলের বেশির ভাগই আমদানি করতে হয়। কাজেই এদের সংকট দেখা দেয়ার কথা নয়। আর আলু তো পর্যাপ্তই দেশে উৎপাদিত হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব পণ্যের দাম বাড়ার পেছনে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীর কারসাজিই প্রধানত দায়ী। মজুদ করে কিংবা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে তারা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। অস্বাভাবিক মুনাফা লুণ্ঠনের এটা সহজপথ। চালের বাজারে যে অস্থিরতার লক্ষণ যাচ্ছে, তার জন্য ব্যবসায়ী ও মিলাররাই দায়ী বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। ব্যবসায়ীরা অনেকেই ধান মজুদ করেছে। মিলাররাও অনেকে ধানের বড় বড় মজুদ গড়ে তুলেছে। মিলারদের মাধ্যমে বাজারে চালের সরবরাহ আসে। আবার তারা সরকারের ধান-চাল সংগ্রহেরও অবলম্বন। এই সুযোগটিই তারা বরাবর নেয়। চালের বাজারের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ তাদের কবজাতেই। এবার বোরোর উৎপাদন আশাতিরিক্ত হওয়ার পরও সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৯ লাখ টন। সংগ্রহ হয়েছে ১০ লাখ টন। এ ব্যর্থতার জন্য মিলারদেরই দায়ী করা হচ্ছে। তাদের অনেকেই চুক্তি অনুযায়ী ধান-চাল সরবরাহ করেনি। তাহলে এত ধান গেলো কোথায়? বাজার ও ধান-চালের ব্যবসা মিলারদের হাতে কেন্দ্রিভূত হওয়ার খেসারত এখন ক্রেতা-ভোক্তদের কড়ায় গন্ডায় দিতে হচ্ছে।
আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই সততাপরায়ন ও বিশ্বস্ত নয়। তাদের মধ্যে ন্যায়বোধ ও মানবিক গুণাবলীও অত্যন্ত কম। এ কারণে অন্যায় মজুদ ও যথেচ্ছ দাম বাড়িয়ে মুনাফা শিকার তাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলামে ৪০ দিনের বেশি খাদ্যপণ্য মজুদ বারিত করা হয়েছে। একে অপরাধ ও মজুদদারদের অপরাধী বলে অভিহিত করা হয়েছে। কাজেই, যারা পণ্য মজুদ করে কিংবা পণ্যের দাম বাড়ায়, তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার রয়েছে। আমরা বরাবরই লক্ষ করছি, সরকার ব্যবসায়ী-মজুদদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অপারগ। বাজারের ওপর সরকারের বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণ নেই। ব্যবসায়ী-মজুদদাররা যা ইচ্ছা তাই করছে, আর সরকার নিরব থাকাকেই শ্রেয় বিবেচনা করছে। তাহলে ক্রেতাভোক্তার স্বার্থ দেখবে কে? মানুষের আয়-রোজগার এমনিতে কমে গেছে। ৬৬ শতাংশ মানুষ শুধুমাত্র করোনাকারণে কর্ম হারিয়ে নিরালম্ব হয়ে পড়েছে। উপার্জন কমেছে ৭৪ শতাংশ মানুষের। এমতাবস্থায়, অসৎ ব্যবসায়ী ও মজুদদারদের ইচ্ছার ওপর তাদের ছেড়ে দেয়া মোটেই সমাচীন নয়। দরিদ্র-অসহায়, কর্মহীন, নিম্ন ও বাঁধা আয়ের মানুষের স্বার্থে সরকারের উচিৎ বাজারের ওপর শক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা এবং অসৎ ব্যবসায়ী-মজুদদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া।