রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের লাভ-লোকসান

0

সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের পর বছর ধরে লোকসান দিচ্ছে আর একই পণ্য বা সেবা প্রদানকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফার পাহাড় গড়ছে বিভিন্ন শিল্প খাতের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে এমন প্রতিবেদন প্রায়ই সংবাদ মাধ্যমে দেখা যায়। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসানে থাকার বড় কারণ হিসেবে অনিয়ম, অদতা ও দুর্নীতির কথাই বলা হয়। এছাড়া চরম অব্যবস্থাপনা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকেও খানিকটা দায়ী করা হয় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে ওঠার পেছনে। এর পাশাপাশি একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে মুনাফায় ফিরতে না পারলে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তা করা উচিত বলে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শের কথাও উঠে আসে বিভিন্ন সভা-সেমিনার আর সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু যে প্রশ্নটা সামনে আসে না বা আলোচিত হয় না সেটা হলো রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের লোকসানি হওয়ার নেপথ্যে কোনো নীতিনির্ধারণী দুর্বলতা আছে কি না, থাকলে সে দায় কার? এ ছাড়া বেসরকারি খাতে লোকসান হলে সেটা উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীর দায় হিসেবে থেকে যায়। কিন্তু সরকারি কল-কারখানা বা সেবা-প্রতিষ্ঠানে লোকসান হলে তার দায় কারও ওপর চাপে না।
রবিবার জাতীয় একটি সংবাদপত্রে ‘ডুবছে ৩৬ সরকারি প্রতিষ্ঠান’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বিভিন্ন শিল্প ও সেবা খাতে সরকারি-বেসরকারি কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি শীর্ষ লাভজনক এবং শীর্ষ লোকসানি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা তালিকাও হাজির করা হয়। প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, গত ২ নভেম্বর মন্ত্রিসভা বৈঠকে সব সরকারি কোম্পানি ও সংস্থার লাভ-লোকসান অনুমোদন করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, সর্বোচ্চ লোকসানে থাকা সরকারের ১০ সংস্থার মধ্যে লুটপাটের শিকার হওয়া বেসিক ব্যাংক রয়েছে। তবে লোকসানে বেসিক ব্যাংককে ছাড়িয়ে গিয়ে শীর্ষস্থান দখল করেছে কৃষি ব্যাংক। এই ব্যাংকের লোকসান ১ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া সরকারি তথ্যানুসারে, লোকসানের তালিকায় থাকা অন্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই রয়েছে। এর মধ্যে সার কারখানাগুলো লোকসানের শীর্ষে। দেখা যাচ্ছে দেশের সবগুলো বেসরকারি টেলিযোগাযোগ কোম্পানি যখন চুটিয়ে ব্যবসা করছে, তখন উল্টোপথে হাঁটছে সরকারি মালিকানাধীন টেলিটক। একইভাবে দেখা যায় বেসরকারি সিমেন্ট কোম্পানিগুলো চুটিয়ে ব্যবসা করলেও মার খাচ্ছে সরকারি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। ছাতক সিমেন্ট কোম্পানি গত অর্থবছরে ৪০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা ১৪টি সুগার মিলের সব কটি লোকসান দিচ্ছে বছরের পর বছর।
অন্যদিকে, লোকসানের বিপুল খতিয়ানের পাশাপাশি সরকারি মালিকানাধীন ৬৫টি কোম্পানি গত অর্থবছরে ১৫ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। গত অর্থবছরে চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক মুনাফা করেছে ৪ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংক একাই করেছে ২ হাজার ২০৬ কোটি টাকা। সরকারি মালিকানাধীন পেট্রোলিয়াম ও বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানিগুলো বরাবরের মতো মুনাফা করেছে। এর মধ্যে ৪ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন। বরাবরের মতো চট্টগ্রাম বন্দরও মুনাফা করেছে। যার পরিমাণ ১ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। যদিও স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালনা করা হলে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে আরও বেশি লাভ আসার কথা বলে মনে করেন অনেকেই।
রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার েেত্র অন্যতম বিবেচনা হিসেবে কাজ করে সরকারগুলো দেশের অর্থনীতিকে কোন পথে পরিচালিত করতে চায় তার ওপর। এর ওপরই নির্ভর করে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকার কী পরিমাণ বিনিয়োগ করবে কি করবে না, ভর্তুকি দেবে কি দেবে না, প্রাযুক্তিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন করবে কি করবে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সারা দুনিয়া প্লাস্টিকের বিকল্প খুঁজছে আর বিশ্ববাজারে পাটপণ্যের চাহিদা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। পাটের রমরমা চাহিদা দেখে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার নতুন করে তাদের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোতে বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বেসরকারিকরণের ধারায় যাচ্ছে। বেসরকারিকরণ যে একমাত্র সমাধান নয় সেটা উপলব্ধি করা যেতে পারে ২০১০ সালে বাংলাদেশ প্রাইভেটাইজেশন কমিশন প্রকাশিত ‘বেসরকারিকরণকৃত শিল্পপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সমীা’ প্রতিবেদন থেকে। এতে বলা হয় ১৯৯৩ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়া ৭৫টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩১টিই বন্ধ পাওয়া গেছে। এ েেত্র সস্তায় জমি ও যন্ত্রপাতি লুট করা হয়েছে, অথবা পরিত্যক্ত জমি দেখিয়ে বিপুল ব্যাংকঋণ নেওয়া হয়েছে। এেেত্র বলা যায় সারা দুনিয়াতেই এখন রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিতে বিনিয়োগ বাড়ছে। ফোর্বস ম্যাগাজিনের তথ্যানুসারে ২০০৫ সালে বিশ্বের শীর্ষ ৫০০ কোম্পানির মধ্যে মাত্র ৪৯টি ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত। কিন্তু ২০১৪ সালে এই তালিকায় রাষ্ট্রীয় কোম্পানির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১১৪টিতে। ফলে ঢালাও বেসরকারিকরণের পথে না হেঁটে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সংকট নিরসনের পথেও হাঁটতে পারে।