আল্লামা শফীর প্রতি জানাই শ্রদ্ধা

0

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির ও হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক দেশের প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ সর্বজন শ্রদ্ধেয় শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী গত শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ১০৪ বছর। বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে তিনি ভুগছিলেন। নাস্তিক মুরতাদ বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা দেশের কওমি শিার কিংবদন্তী এ আলেমের ইন্তেকালে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। তাঁর মৃত্যু সংবাদে হাটহাজারীসহ দেশের কওমী মাদরাসার অগণিত ছাত্র-শিক কান্নায় ভেঙে পড়েন। সারাদেশে তার অসংখ্য অনুসারী, ছাত্র, শিক ও ভক্ত শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। তাঁর ইন্তেকালে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আহমদ শফীর ইচ্ছা অনুযায়ী, শনিবার হাটহাজারী মাদরাসায় জানাজা শেষে সেখানকার কবরস্থানে দাফন করা হয়। উল্লেখ করা প্রয়োজন, হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগের চব্বিশ ঘন্টা না পেরুতেই তিনি দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। তাঁর ইন্তেকালের মধ্য দিয়ে আল্লামা শফী একটি যুগের অবসান হয়েছে। আলেম সমাজ বলছে, তাঁর মৃত্যু ইসলামী জাগরণ ও আন্দোলনে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে থাকবে।
আল্লামা শাহ আহমদ শফী ১৯১৬ সালে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থানার পাখিয়ারটিলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হাটহাজারীর আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম এবং ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসায় শিা লাভ করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম তথা হাটহাজারী মাদরাসায় হাদিসের শিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৭৪ বছর এই মাদরাসায় অধ্যাপক ও মহাপরিচালক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। কর্মজীবনে তিনি কওমী মাদরাসা শিাবোর্ড বেফাক-এর সভাপতি এবং কওমী মাদরাসা শিার সর্বোচ্চ পরিষদ আল হাইয়াতুল উলিয়া লিল জামিয়াতিল কাওমিয়ার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দেশের হাজার হাজার আলেমের শিক ছিলেন। দেশে ও বিদেশে তাঁর রয়েছে হাজার হাজার ভক্ত ও অনুরাগী। কওমি ধারার ইসলামী শিা বিস্তারের পথিকৃৎ বিশ্ববরেণ্য এ আলেম ও আধ্যাত্মিক নেতা অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন। হাটহাজারী মাদরাসাকে কেন্দ্র করেই তাঁর কর্মজীবন আবর্তিত হয়েছে। হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক হিসেবে দেশের কওমি মাদরাসাগুলোর নেতৃত্বে তিনি নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর পুরো ধ্যান-জ্ঞান ছিল ইসলামের সঠিক প্রচার-প্রসার নিয়ে। তিনি নীরবে-নিভৃতে ইসলামের খেদমত করে গেছেন। ২০১০ সালে তিনি অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ গঠন করেন। ২০১৩ সালের ৫ মে নাস্তিক ও মুরতাদদের বিরুদ্ধে শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশের ডাক দেন। এ মহাসমাবেশে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের অংশগ্রহণে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। তখন থেকেই মূলত দেশ-বিদেশে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এবং এর পুরধা ব্যক্তিত্ব আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নাম ছড়িয়ে পড়ে। ৯২ ভাগ মুসলমানের পে ঈমান ও আক্বিদা রায় তিনি সোচ্চার হন। বিভিন্ন অনৈসলামিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ এবং সরকারকে দিকনির্দেশনা দেন। সরকারও তাঁর এসব দিকনির্দেশনা শ্রদ্ধা ও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে। সাম্প্রতিককালে সরকারের সাথে তাঁর সুসম্পর্কের কারণে কওমী মাদরাসার সনদ সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে। তাঁর গড়া সংগঠন যখন দেশের মুসলমানদের কাছে জনপ্রিয় ও ভক্তি-শ্রদ্ধার বিষয়ে পরিণত হয়, তখন এর নেতৃত্ব নিয়ে নানা টানাপড়েন ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়। মাঝে মাঝে বিভক্তি দেখা দেয়। সংগঠনের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালনরত তাঁর ছোট ছেলে মাওলানা আনাস মাদানির বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকান্ড এবং জ্যেষ্ঠ নেতাদের উপো করে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা সংগঠনটিকে বিতর্কের মুখে ঠেলে দেয়। পুত্রস্নেহে তিনি দুর্বল হয়ে পড়ায় হাটহাজারী মাদরাসায় আনাস মাদানির কথাই হয় শেষ কথা। তিনি মাদরাসায় একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার এই দোর্দন্ড প্রতাপের কারণে মাদরাসার ছাত্র-শিকরা হয়ে ওঠেন ত্যক্ত-বিরক্ত। অবশেষে গত সপ্তাহ ধরে তাদের ােভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তাদের দাবির মুখে আনাস মাদানিকে মাদরাসার সহকারী শিা পরিচালকের পদ এবং একইসঙ্গে শিকের পদও হারাতে হয়। এমনকি এর জেরে আল্লামা শাহ আহমদ শফীকেও মহাপরিচালকের পদ থেকে সরে যেতে হয়। তার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। ইসলামের প্রচার-প্রসারে শাহ আহমদ শফীর ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। ইসলামের সঠিক জ্ঞান ও ধারা প্রচারে তিনি নিরলস সক্রিয় থেকেছেন। ইসলামের একজন সেবক হিসেবে তিনি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে পরিচিত ছিলেন। হাজার হাজার আলেমেদ্বীনের শিক, অসংখ্য মসজিদ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ও পৃষ্ঠপোষক এবং দ্বীনি, সামাজিক ও সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানের সাথে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। কওমি ধারার অভিভাবক হিসেবে তাঁকে সকলেই শ্রদ্ধা ও সম্মান করেন। তিনি বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে রয়েছে, হক ও বাতিলের চিরন্তন দ্বন্দ্ব, ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা, ইসলাম ও রাজনীতি, সত্যের দিকে করুন আহ্বান এবং সুন্নাত ও বিদ-আতের সঠিক পরিচয়। উর্দু ভাষায় রচিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, ফয়জুল জারি (বুখারির ব্যাখ্যা), আল-বায়ানুল ফাসিল বাইনাল হক ওয়াল বাতিল, ইসলাম ও সিয়াসাত এবং ইজহারে হাকিকাত। শাহ আহমদ শফীর ইন্তেকালে দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান একজন বড় অভিভাবক হারালো। তারা ইসলামের সঠিক দিকনির্দেশনা থেকেও বঞ্চিত হলো। তবে তাঁর অনুসারী ও শিষ্যদের উচিৎ হবে সবকিছু ভুলে গিয়ে তাঁর রেখে যাওয়া দিকনির্দেশনা, আদর্শ এবং দর্শনকে কাজে লাগিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামের খেদমতে নিয়োজিত হওয়া। আমরা প্রখ্যাত এই আলেমেদ্বীন শায়খুল ইসলাম শাহ আহমদ শফীর ইন্তেকালে গভীর শোক জ্ঞাপন, তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করি এবং জান্নাতুল ফেরদৌস কামনা করি। ঐক্যের আহ্বান জানাই আলেম সমাজের প্রতি।