বেতন কমবে পোশাক শ্রমিকদের

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে দেশের গার্মেন্টস সেকটরসহ বেশির ভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আয় কমে গেছে। লকডাউনের কারণে অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অস্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে আছে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান স্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়ার পথে। এমন পরিস্থিতিতে গার্মেন্টসের শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দিতে পারছে না বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। শুধু তাই নয়, বেতন-ভাতা দিতে না পেরে শ্রমিকদের ছাঁটাই করার ঘটনাও ঘটেছে অনেক প্রতিষ্ঠানে। গার্মেন্টস মালিকরা বলছেন, যেসব শ্রমিক ঈদে বাড়িতে চলে গেছেন, তারাতো চাকরি হারাবেনই, যারা ঠিক মতো কাজ করেন না, তারাও চাকরি হারাবেন। মালিকদের অনেকেই বলছেন, আগামী জুন থেকে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা আরও বাড়বে। আর যারা চাকরিতে থাকবেন, তাদেরও অনেকের বেতন কমে আসবে। এরইমধ্যে গার্মেন্টস মালিকরা প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে শ্রমিক কমানোর পাশাপাশি শ্রমিকদের বেতন কমানোর বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছেন।
এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইএ’র সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘করোনার এই দুঃসময়ে শিল্প-প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ। এই পরিস্থিতিতে সরকার, মালিক ও শ্রমিক— এই তিন পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, উৎপাদন নেই, এমন কারখানা শুধু বসিয়ে বসিয়ে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দিতে পারবে না।’ তিনি উল্লেখ করেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত তাদের শ্রম আইন তিন বছরের জন্য স্থগিত করেছে। আমাদেরও সেই পথেই এগোতে হবে। সিদ্দিকুর রহমান জানান, শ্রমিকরা কত টাকা বেতনে চাকরি করবে, শ্রমিকদের পক্ষ থেকেই এ ধরনের প্রপোজাল আসতে হবে। তা না-হলে আপনা-আপনিই গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। আর কারখানা বন্ধ থাকলে এমনিতেই শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়বেন। তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে অধিকাংশ মালিক শ্রমিকদের বোনাস দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে।’ আগামী জুনের পর থেকে কেবল অতি প্রয়োজনীয় শ্রমিক দিয়েই উৎপাদনে থাকতে হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘উৎপাদন ঠিক রাখার পাশাপাশি শ্রমিকরা যাতে করোনা বিস্তারের কারণ না হয়, সে জন্য এই ঈদে শ্রমিকদের গ্রামের বাড়িতে যেতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। এই নির্দেশ অমান্য করে কেউ গ্রামে গেলে, তার শাস্তিতো তাকে পেতেই হবে। কোনও মালিকই গ্রাম থেকে ফিরে আসা শ্রমিককে ১৪-১৫ দিন কোয়ারেন্টিনে রেখে বেতন দেবেন না। তবে কে গ্রামে গেছে, আর কে যায়নি, সেটা বের করা কঠিন।’
তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি মানার অংশ হিসেবে কিছু শ্রমিক কমাতে হবে। এছাড়া ক্রয়াদেশ না থাকার কারণেও শ্রমিককে বিদায় দিতে হবে। সেটা আগামী দু-এক মাস থেকেই। সে ক্ষেত্রে যারা ঈদে বাড়ি গেছেন, তারাই আগে ছাঁটাইয়ের তালিকায় পড়বেন।’ তিনি বলেন, ‘সরকারের নির্দেশে আমরা এপ্রিল ও মে—এই দুই মাস শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিয়েছি। এরপর যারা বাড়ি গিয়ে করোনা নিয়ে আসবেন তাদেরকে ১৪/১৫ দিন কোয়ারেন্টিনে রেখে কেউ বেতন দেবে না।’ এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ওয়াজেদ-উল ইসলাম খান বলেন, ‘শ্রমিকরা গার্মেন্টস মালিকদের দাস নয়। বাড়ি থেকে ফিরে কারখানায় জয়েন করতে পারবে না কেন? এটা কোন আইনে আছে।’ তিনি উল্লেখ করেন, ঈদ সবার জন্য। শ্রমিক বলে কি তাদের ঈদ নেই? তিনি বলেন, ‘করোনাকালীন বন্ধ থাকা কারখানার শ্রমিকরা মজুরি-ভাতা পাননি। কারখানাগুলোর মালিকদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’ এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিজিএমইএ’র মুখপাত্র কামরুল আলম বলেন, ‘আমরা শ্রমিকদের বাড়ি যেতে নিষেধ করেছি। যদি কোনও শ্রমিক বাড়ি গিয়ে থাকেন, তবে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তিনি উল্লেখ করেন, এবার শ্রমিকরা হয়তো বাড়ি যাবেন না। যাদের হাতে কাজ আছে, সেসব কারখানা হয়তো ২৬-২৭ তারিখেই খুলবে। ফলে এই তিন-চার দিনের জন্য যাওয়া-আসার চেষ্টা হয়তো কেউ করবেন না। বিজিএমইএ’র সভাপতি রুবানা হক বলেন, ‘আমাদের শ্রমিকদের বলে দেওয়া আছে— ঈদের তিন দিন কোনও শ্রমিক বাড়ি যাবেন না।’ তিনি উল্লেখ করেন, কারখানা খোলার দিন সব শ্রমিককে জিজ্ঞাসা করতে হবে বাড়ি গিয়েছিলেন কিনা। যদি বলেন যে, বাড়ি যাইনি। তাহলে তিনি জয়েন করবেন। বাকিরা জয়েন করতে পারবেন না।’
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘শ্রমিকদের জন্য নির্দেশ ছিল— তারা যেন বাড়িতে না যায়। কিন্তু কারা গেলো, বা কারা গেলো না, তা চিহ্নিত করা মুশকিল।’ তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে ফ্যাক্টরি চালাতে হবে। গ্রামে যাওয়া-আসার কারণে করোনায় আক্রান্তের আশঙ্কা থাকে। কাজেই বাড়িতে যাওয়া শ্রমিকের কারণে অন্য শ্রমিকরা যাতে আক্রান্ত না হয়, সেই দিকটা খেয়াল রাখতে হবে।’ তিনি উল্লেখ করেন, আগামী দিনগুলোতে কী হবে তা বলা মুশকিল। অর্ডারের কী হবে, তার ওপর নির্ভর করছে শ্রমিকের চাকরি। তার ওপর নির্ভর করছে কারখানার মালিকের টিকে থাকা। সর্বপরি দেশের অর্থনীতি সচল থাকার বিষয়। শ্রমিক নেতাদের দাবি, বর্তমানে চালু থাকা কারখানাগুলোর মধ্যে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কারখানা এখনও এপ্রিল মাসের মজুরি দেয়নি। পোশাক শ্রমিকদের মজুরি দিতে গত মার্চে মাসে পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করে সরকার, যেখান থেকে মাত্র দুই শতাংশ সুদে পোশাক শিল্প মালিকদের ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া এপ্রিলে মজুরি কমিয়ে ৬৫ শতাংশ ও ঈদ বোনাস অর্ধেক পরিশোধ করছেন মালিকরা। শুধু গার্মেন্টস নয়, অন্যান্য সেক্টরেও শ্রমিক কমানোর পরিকল্পনা করছেন মালিকরা। জানতে চাইলে কেপিসি ইন্ডাস্ট্রির মালিক কাজী সাজেদুর রহমান বলেন, ‘আমার কারখানা তিন মাস ধরে বন্ধ। এই তিন মাস বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিয়েছি। কিন্তু অর্থের অভাবে শ্রমিকদের এবার বোনাস দিতে পারিনি। আগামী মাস থেকে হয়তো বেতনও দেওয়া সম্ভব হবে না। ফলে জুন থেকে হয়তো কিছু শ্রমিককে বিদায় দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘সব প্রতিষ্ঠানের মালিকই এখন অর্থ সংকটে পড়তে যাচ্ছেন। আর অর্থ সংকটে পড়লে প্রথম আঘাতটা আসে শ্রমিকের ওপর।’