দুর্ভাগ্য যখন সৌভাগ্য

0
ইকতেদার আহমেদ
‘দুর্ভাগ্য’ শব্দটি সৌভাগ্যের বিপরীত শব্দ। একজন ব্যক্তি যোগ্যতা অনুযায়ী যথাযথভাবে মূল্যায়িত না হলে অথবা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে তাকে দুর্ভাগ্যবান বলা হয়। আবার একজন ব্যক্তি যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও অন্যায়ভাবে মূল্যায়িত হয়ে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যকে অতিক্রম করলে তাকে সৌভাগ্যবান বলা হয়। সমাজে এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যিনি মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী প্রধান করণিকের পদে আসীন হলে হয়তো তার মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রতি সুবিচার করা হতো; কিন্তু তিনি যদি উচ্চাদালতের বিচারক বা সরকারের সচিব পদে আসীন হন তাহলে বলতেই হবে তিনি সৌভাগ্যবান। আবার যখন একজন ব্যক্তি মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সময় ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে না পেরে করণিক পদ থেকেই চাকরির অবসরে চলে যান তাকে দুর্ভাগ্যবান ছাড়া আর কি-বা বলা যায়। যেকোনো ব্যক্তি সৌভাগ্য দিয়ে সিক্ত হলে আনন্দে উদ্বেলিত হয়। অপর দিকে দুঃখে ভারাক্রান্ত হলে হৃদয় ব্যথিত হয়। ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে অপক্ষোকৃত যিনি কম মেধাবী তার চাকরির অবস্থান তুলনামূলকভাবে অন্য বন্ধুবান্ধবের শীর্ষে হলে তাদের আক্ষেপ করা ছাড়া কি-বা করার থাকে।
রাজধানী শহর অথবা বিভাগীয় শহরের বাইরের জেলা শহরকে মফস্বল শহর বলা হয়। এরূপ একটি মফস্বল শহরের একটি পাড়ায় তিনটি পরিবারের মধ্যে আত্মীয়তা না থাকলেও পারস্পরিক সাহচর্যে আত্মীয়তার চেয়েও গভীরতর সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। এ তিনটি পরিবারে একই বয়সের তিনটি কন্যাশিশুর মধ্যে বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে ভাবের আদান-প্রদান ও পুতুল খেলার মাধ্যমে সখ্য গড়ে ওঠে। তিনটি শিশুর মধ্যে সবচেয় চটপটে ও বুদ্ধিদীপ্ত শিশুটির নাম ছিল শরীফা। শরীফার পিতা পুলিশ বিভাগের নিম্ন স্তরের কর্মকর্তা ছিলেন। অপর দু’টি শিশুর মধ্যে কিছুটা অস্থির, চঞ্চল ও খামখেয়ালি প্রকৃতির ছিল হনুফা। হনুফার বাবা জেলা কালেক্টরেটে করণিক ছিলেন। অবশিষ্ট শিশুটির নাম ছিল আলেমা। আলেমার বাবা মুন্সেফ আদালতের পেশকার ছিলেন।
শরীফা, হনুফা ও আলেমা একই প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করে প্রথমত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অতঃপর একই মহাবিদ্যালয় থেকে তারা উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক (বিজ্ঞান) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরীক্ষার ফলাফলের ক্ষেত্রে দেখা গেছে প্রতিটি পরীক্ষায় শরীফার ফলাফল আশানুরূপ না হলেও হনুফা ও আলেমার তুলনায় অপেক্ষাকৃত ভালো। তিন বান্ধবীর স্নাতক পর্যন্ত সামগ্রিক পরীক্ষার ফলাফল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের জন্য উপয্ক্তু বিবেচিত না হলেও তিন বান্ধবীর মধ্যে দেশের প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে যেকোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়নের অদম্য আগ্রহ জাগরিত হয়। তিন বান্ধবীর মধ্যে শরীফার মাধ্যমিক থেকে স্নাতক পর্যন্ত তিনটি পরীক্ষায় একটি তৃতীয় শ্রেণী ও দু’টি দ্বিতীয় শ্রেণী ছিল। অপর দিকে হনুফা ও আলেমা তিনটি পরীক্ষার কোনটিতেই সচরাচর তৃতীয় শ্রেণী পাওয়ার অপবাদ থেকে নিজেদের মুক্ত করে নিজ নিজ অবস্থানের কোনোরূপ পরিবর্তন ঘটাতে পারেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের আকাক্সক্ষাকে বাস্তবায়নের জন্য তিন বান্ধবী মফস্বল শহর থেকে যথারীতি বড় শহরে আগমন করে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়নের জন্য ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলেন। ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর দেখা গেলে শরীফা ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। অপর দিকে হনুফা ও আলেমা ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিন বান্ধবীর ১৪ বছরের শিক্ষাগত জীবনের ছেদ ঘটিয়ে শরীফা উন্নত জীবন গড়ার মানসে দেশের একটি প্রথিতযশা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়ন শুরু করলেন এবং তার অপর দু’বান্ধবী হনুফা ও আলেমা অগত্যা আগের স্মৃতি বিজড়িত মফস্বল শহরে প্রত্যাবর্তন করলেন। মফস্বল শহরে স্নাতকোত্তর পড়ার কোনো সুযোগ না থাকায় হনুফা ও আলেমা মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি গ্রহণ করলেন এবং নৈশ কলেজে একধরনের বিশেষ পেশাজীবী হওয়ার অধ্যয়ন শুরু করলেন। হনুফা ও আলেমা চাকরির পাশাপাশি বিশেষ পেশাজীবী হওয়ার অধ্যয়ন করায় তারা উভয়ে শরীফার চেয়ে বাস্তবমুখী হয়ে ওঠেন। এ দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে শরীফা মফস্বল শহরে এসে হনুফা ও আলেমার ব্যস্ততম কর্মজীবন ও শিক্ষাজীবন দেখে তাদের জীবনের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করার অভিপ্রায়ে তার বাবার কাছে বায়না ধরলেন যে তিনি আর বড় শহরে ফিরে যাবেন না এবং তার দু’বান্ধবীর মতো স্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি বিশেষ পেশাজীবী হওয়ার অধ্যয়ন করবেন। জনা দশেক সন্তানের সংসারে শরীফার বাবার চাকরির স্বল্প আয় যদিও তার কন্যার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে কষ্টকর ছিল তবুও সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবনের মঙ্গল চিন্তা করে শরীফার বাবা তাকে মফস্বল শহরে শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ ও বিশেষ পেশাজীবী হওয়ার নৈশ কলেজে অধ্যয়ন করা থেকে নিবৃত্ত করলেন।
হনুফা ও আলেমা নৈশ কলেজের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর শিক্ষকতার পেশা ত্যাগ করে শিক্ষানবিস হিসেবে বিশেষ পেশাজীবী হওয়ার পেশায় প্রবেশ করলেন। কিছুকাল এ পেশায় নিয়োজিত থেকে খুব একটা সুবিধা করতে না পেরে তারা উভয়ে দেওয়ানি ন্যায়ালয়ের প্রবেশ পদে যোগদান করলেন। এ পদটির চাকরি সাদামাটা ও জৌলসবিহীন। এ কারণে হনুফা প্রথম থেকে এ চাকরির সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেননি। তাই বছর দুয়েক চাকরি করার পর হনুফা পেশা পরিবর্তন করে জৌলুস ও চাকচিক্যে ভরপুর ভূমি প্রশাসনের সাথে সম্পৃক্ত সহকারী কশিনারের চাকরি গ্রহণ করলেন। শরীফা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়ন শেষে একটি বেসরকারি কলেজে অধ্যাপনা দিয়ে চাকরিজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে এ কলেজটি জাতীয়করণ করা হলে শরীফা সরকারি কলেজের শিক্ষক হিসেবে চাকরির শেষ পর্যায়ে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়ে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। হনুফা ৫৭ বছর পূর্তিতে চাকরি হতে অবসর গ্রহণের সময় যুগ্ম সচিবের সমমর্যাদাসম্পন্ন পদে আসীন ছিলেন। স্বভাবসুলভভাবে ধীরস্থির আলেমার চাকরি তার অপর দু’বান্ধবীর তুলনায় নিরস ঠেকলেও তিনি প্রথম দিক থেকেই এ চাকরিটিকে ঘিরেই তার জীবন নিয়ে পরিকল্পনা করতে থাকেন। স্বীয় বিভাগের শীর্ষ পদে পৌঁছার পর কোনো এক বিশেষ কারণে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সহকর্মীকে অতিক্রান্ত করে আলেমাকে অনুরূপ পদের উচ্চতর মর্যাদাসম্পন্ন পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এ নিয়োগের সুবাদে আলেমার চাকরিজীবন তার অপর দু’বান্ধবীর তুলনায় দীর্ঘতর হয়। আলেমার উচ্চতর মর্যাদাসম্পন্ন পদে নিয়োগ হওয়ার পর হনুফা তার তুলনায় তার বাল্যবান্ধবীর উচ্চ অবস্থান দেখে মানসিকভাবে এতই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, শেষ পর্যন্ত একটি নিবন্ধে পেশার পরিবর্তন না করলে তিনিও তার বান্ধবীর মতো উচ্চতর মর্যাদাসম্পন্ন অনুরূপ পদে আসীন হতে পারতেন- এ কথাগুলো লিখে আত্মসন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করেন।
শরীফা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির পর নিজেকে তার অপর দু’বান্ধবীর তুলনায় সৌভাগ্যবান মনে করলেও আলেমা উচ্চতর মর্যাদাসম্পন্ন পদে নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি উপলব্ধি করলেন সে দিন আলেমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার ব্যর্থতার দুর্ভাগ্যের মধ্যেই তার সৌভাগ্যের সোপান রচিত হয়েছে। শরীফাও হনুফার মতো ভাবতে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ত্যাগ করে তিনি যদি মফস্বল শহরে এসে বিশেষ পেশাজীবী হওয়ার অধ্যয়ন করতেন তাহলে হয়তো অধ্যাপক হিসেবে তার চাকরিজীবনের যবনিকা না ঘটে তিনিও তার বান্ধবীর মতো বড় কিছু হতে পারতেন। শরীফার বিশেষ পেশাজীবী হওয়ার অধ্যয়নে তার বাবা বাধা দেয়ায় অভিমানী শরীফা যখন তার বাবাকে অনুযোগ করে বললেন, সে দিন বান্ধবীর সঙ্গে মফস্বল শহরে বিশেষ পেশাজীবী হওয়ার অধ্যয়নের সুযোগ পেলে তার চাকরিজীবনের পরিণতি বান্ধবীর চেয়ে ভিন্নতর কিছু হতো না, তখন তার অভিজ্ঞ পুলিশ কর্মকর্তা পিতা, যিনি চাকরির সুবাদে বিভিন্ন পেশার বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তার সংস্পর্শে আসতে পেরেছিলেন, এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলেন- মাগো, এরূপ উচ্চতর মর্যাদাসম্পন্ন পদে চাকরি পাওয়া অত্যন্ত কষ্টকর। সাধারণত শিক্ষাজীবনে দু’তিনটি তৃতীয় শ্রেণী না থাকলে এরূপ উচ্চতর মর্যাদাসম্পন্ন পদে আসীন হওয়া যায় না। সে দিন তুমি বিশেষ পেশাজীবী হওয়ার বিষয়ে অধ্যয়ন করলেও শিক্ষাজীবনে দু’তিনটি তৃতীয় শ্রেণী না থাকার কারণে তোমার জীবনে এরূপ উচ্চতর মর্যাদাসম্পন্ন পদে চাকরি পাওয়ার সৌভাগ্য ঘটত না। অতএব, তোমার বান্ধবীর দুর্ভাগ্য যখন সৌভাগ্য তোমার সৌভাগ্য তখন দুর্ভাগ্য।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: [email protected]