করোনা নিয়ে নানা বিভ্রান্তি

0
আমিরুল আলম খান
করোনা নিয়ে বিভ্রান্তির অন্ত নেই। জানুয়ারি মাসে চীনে করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই নানা কথা বিশেষজ্ঞ থেকে সাধারণ মানুষের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এখনও তা চলছেই। বরং মনে হচ্ছে এই একটি অসুখ নিয়ে কাজের বুয়া, ছাত্র, শিক্ষক, পরিবহণ শ্রমিক, ছোট দোকানদার, বড় ব্যবসায়ী, ডাক্তার, কবিরাজ, হেকিম, বিজ্ঞানী, রাজনীতি্‌ রাজা, বাদশাহ, মোল্লা, পুরুত সবাই এত বেশি জানেন যে তার হিসেব করার ক্ষমতা কোন সুপার কম্পিউটারেরও নেই। যে যেমন পারছে, পরামর্শ দিচ্ছেন, ওষুধ-পথ্য বাতলে দিচ্ছেন। কেউ ধর্মশাস্ত্র ঘেটে, কেউ কল্পকাহিনি ঘেঁটে করোনা সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান ভাণ্ডার পূর্ণ করে দিচ্ছেন। পত্রিকা, টিভি চ্যানেলে তো আছেই, সাইবার যুগে সহজেই ফোনকল, ফেসবুক, ইউটিউব, ভাইবার, ইমো আরও কত কত মাধ্যমে মুহূর্তে ছড়াচ্ছে সে সব অব্যর্থ দাওয়াই তা ঠাওর করাই কঠিন। কার কথা শুনব, মানব?
চীনে করোনা ছড়াতে শুরু করলে দেখলাম তাদের সবার মুখে মাস্ক, হাতে দস্তানা, চোখে চশমা, পরনে বিশেষ ধরনের পোশাক(পিপিই)। সাবান-পানিতে হাত ধোয়ার পরামর্শ। সবাইকে ঘরে থাকার নির্দেশ ইত্যাদি। কিন্তু হঠাত করেই এক মার্কিন ডাক্তার না বিজ্ঞানী বললেন, মাস্ক পরে লাভ নেই। ওসব ফালতু। আর যায় কোথায়? আমেরিকার ডাক্তার বলেছেন! আমাদের দেশের ডাক্তাররাও বলা শুরু করলেন মাস্কের দরকার নেই। হাত ধুতে হবে। স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে। ব্যস, বাজার থেকে হ্যান্ড ওয়াশ, স্যানিটাইজার হাওয়া। টিস্যু পেপার নিয়ে কাড়াকাড়িঙ্কিন্তু মাস্ক ছাড়া বাইরে গেলেই পুলিশের পিটুনি। যাব কোথায়? এবার অন্য হুজ্জত শুরু হল। গেরুয়াধারীরা বলল, গোমূত্র আর গোবর পিঠে খেলে করোনা দুনিয়া ছেড়ে পালাবে। তার সাথে ভারতের গেরুয়া মন্ত্রী যোগ দিয়ে সারা ভারতে কত মানুষকে গরুর মুত খাইয়ে যমের সাথে সাক্ষাৎ করতে হয়েছে সে আরেক হিসেব।এর পর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কাসর-ঘণ্টা বাজিয়ে করোনা তাড়ানোর ডিক্রি জারি করলেন। তার আবার ৯-বাতিক। জারি হল নতুন ফরমান। রাত ৯-টায় ৯-মিনিট আলো নিভিয়ে রাখলেই করোনা ভোঁ দৌড়ে ভারত থেকে পালাবে!
পন্ডিতের অভাব দুনিয়ায় কখনো কোন কালে কোন দেশে ছিল না, হবেও না। চীনের হুবেই ঠান্ডা প্রদেশ। এদেশের কিছু লোক গুনেগেথে ছড়ালো, করোনা গরমে মরে ভূত হবে। আমাদের এই গরমের দেশে আসলে করোনা ভাইরাস অক্কা পাবেই। তা কত তাপে মরবে এ ভাইরাস? হিসেবটা খুব লম্বা। একেবারে ২০ থেকে ৭০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিদান। ২০ ডিগ্রি না হয় বুঝলাম; কিন্তু ৭০ ডিগ্রি? আমাদের দেশে ৪২/৪৩ হলেই মানুষ মরে। ঊষর মরুর দেশ আরবে নাকি ৫০ ছুঁই ছুঁই হয়। যারা গরমের তত্ত্ব ফেরি করছিলেন তাদের মুখে ছাই দিয়ে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর তো বটেই ইরান, সৌদি আরব, ইরাক, আমিরাতের মত মরুদেশে দিব্যি করোনা মানুষের দেহে আসন গেঁড়ে বসল! ভারতের কেরালায় প্রথম ধরা পড়ল, তারপর ছড়িয়ে পড়ল। মহারাষ্ট্রেও। কে না জানে কেরালা বাংলাদেশ থেকে ঢের ঢের গরম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হুঁশিয়ারি দিয়ে দূরে দূরে থাকার পরামর্শ দিল। কেতাবি ভাষায় ‘সামাজিক দূরত্ব’ হজায় রাখা। পরে দেখল, এতে ফল হচ্ছে না, তুড়ি বলে এখন বলছে, ‘ব্যক্তিগত দূরত্ব’ রেখে চলতে। সৌদি আরবে কয়েকজন করোনায় আক্রান্ত হলে ওমরাহ বন্ধ করে ফরমান জারি করলেন বাদশাহ। পরে পবিত্র ক্বাবা এবং মদিনায় মসজিদে নববিও বন্ধ করা হল সাময়িকভাবে। আজানের বাণী পর্যন্ত সংশোধন করে বলা হল, ঘরে নামাজ আদায় করতে।পাকিস্তানের ক্রিকেট খেলোয়াড় প্রধানমন্ত্রী ইমরাণ খাঁ মসজিদে জুম্মা নামাজ বন্ধে গররাজি। শেষমেষ প্রেসিডেন্ট ফতোয়া চেয়ে মিশরের আল আজহার বিশ্ববিধালয়ে চিঠি পাঠালেন। ফতোয়ায় বলা হল, “রোগ সংক্রমণ এড়াতে মসজিদে জামাতে না গিয়ে বাড়িতে একাকি নামাজ আদায় করাই উত্তম।” সিন্ধু প্রদেশে মসজিদ বন্ধ করে দিল। বাংলাদেশের মুসল্লিরা জামাত বন্ধ মানতে নারাজ। তারা মসজিদেই জামাতে নামাজ আদায়ে অনড় রইলেন। ওদিকে দিল্লির নিজামিয়া মারকাজ থেকে করোনা ছড়িয়ে পড়লে ভারত কঠোর অবস্থান নিতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশেও মসজিদে জামাতে নামাজ না পড়ে ঘরে বসে নামাজ আদায়ের আদেশ জারি হয়েছে। তাবলিগ জামাতিদের ঘরে ফিরে যেতে বলা হয়েছে।
করোনা নিয়ে কত কথা বাজার সয়লাব করেছে তার নিকাশ করা কঠিন। কোথা থেকে কেউ বোধহয় বলে দিলেন, থানকুনি করোনার নিদান। আর যাই কোথা। গা-গ্রাম থেকে থানকুনি উধাও। লোকে পাগল হয়ে ছুটল থানকুনির পিছনে। কেউ দিল কালো জিরার নিদান। মধুর সাথে মিশিয়ে খাওয়ার পরামর্শ। সেটা বেশ জারি আছে এখনও। কেউ বললেন, পবিত্র তুলসীই ধন্বন্তরী। কিন্তু ট্রাম্প সাহেব সবার ওপর ট্রাম্প মেরেছেন। তিনি একেবারে কাগজে লিখে এনে ক্যামেরার সামনে দুটো ধন্বন্তরীর নাম ঘোষণা করলেন। তার একটা ম্যালিরিয়া চিকিতসায় ব্যবহার করা হয়। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন। আমেরিকা দুনিয়ার নাম্বার ওয়ান সুপার পাওয়ার। করোনা তার ধারে কাছে ভিড়বে না এমন কথা ট্রাম্প সাহেবের মুখে লেগেই থাকত। কিন্তু সাহেবের বরাত খারাপ। এখন আমেরিকার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। সেখানে এখন আক্রান্তের সংখ্যা চার লাখ ছাড়িয়েছে। মারা গেছে ১২,৮৫৭ জন। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। মোট আক্রান্ত ও প্রতিদিন আক্রান্তের হিসেবে আমাএরিকা এখন সবার উপরে। আর মৃতের সংখ্যায় তৃতীয়। ভারতকে ধমক দিয়ে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন আমেরিকায় পাঠাতে বাধ্য করেছেন ট্রাম্প সাহেব। অথচ আমারিকার জনসংখ্যা মাত্র ৩০ কোটি, যেখানে চীনের ১৪০ কোটি, ভারতের ১৩০ কোটি।
করোনা নিয়ে পশ্চিমের নাক আগে থেকেই ওঁচা। সাদা চামড়ার দেমাগ ছিলই। আর ছিল সভ্যতার বড়াই। ওদের চিকিৎসাও দুনিয়ার সেরা। তাই গা করে প্রথম দিকে। ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন তো শ্মশান এখন। সুইজারল্যান্ডের মত দেশও বিরাণপ্রায়। সুইডেন তো গা এলিয়েই বসে ছিল গত পরশু তক। এখন চোখে সর্ষে ফুল দেখছে। কিন্তু পয়লা থেকেই হুঁশিয়ার তাইওয়ান আর ভিয়েতনাম। কোন পথই তারা খোলা রাখে নি। সুফলও পেয়েছে। ভিয়েতনামে একজনও মারা যায় নি; আক্রান্ত মাত্র ২৫১ জন। তার মধ্যে ১২৬ জন সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে গেছেন। আর তাইওয়ানে মারা গেছেন মাত্র তিন জন, আক্রান্ত ৩৭৯ জন।
বাংলাদেশে করোনা নিয়ে নানা বিভ্রান্তি আমরা দেখেছি। অনেক ডাক্তার বলেছেন, মাস্ক পরার দরকার নেই। সরকারের এক দাম্ভিক মন্ত্রী দম্ভ দেখিয়ে বলেন, করোনার চেয়ে তাদের ক্ষমতা নাকি অনেক বেশি। মিডিয়া উথাল পাথাল করে ডঙ্কা বাজানো হল, দেশের সব হাসপাতাল করোনা মোকাবেলায় সম্পূর্ণ প্রস্তুত। কাজের বেলা দেখা গেল, করোনাভয়ে রোগী পালাচ্ছে হাসপাতাল থেকে। সাধারণ রোগীও হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছে না। ডাক্তার, নার্স, সহকারীদের সুরক্ষা সামগ্রী নেইই। কিন্তু কর্তাদের গলাবাজি থামে না।
১৬ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হল আকস্মিকভাবে। কিন্তু কোন নির্দেশনা ছারাই। লাখে লাখে মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে ছুটল। বাসে ট্রাকে, ট্রেনে, লঞ্চে ফেরিরে মানুষের দাঁড়ানোর জায়গা নেই। সবাই ছুটছে। আর মিডিয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে নেটিজেনদের সে কী শাপ-শাপান্ত!গরিব মানুষের থাকার জায়গা নেই। খাবে কী? এসব চিন্তায় তাদের মাথা খারাপ। ওদিকে মিডিয়া জুড়ে কোন কর্পোরেট কম্পানির কত লোকসান তার ফিরিস্তি, গরিবের খবর নেই সেখানে। প্রণোদনার নামে ধনীদের সুবিধার দুয়ার খুলে দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ধনীদের জন্য খুব উদার। পোশাক শিল্পের মাকিলদের জন্যও জান কোরবান অনেকের। আমেরিকার বরাত পেয়ে পোশাক মালিকদের দেঁতো হাসি ধরে না। খবর দিয়ে শ্রমিকদের ঢাকায় ফিরিয়ে আবা। আগের মতই গরু-ছাগলের মত করে। পরিবহণ দৌড়াচ্ছে, দোকান চলছে। কাঁচা বাজারে বেচাকেনার ধুম। চেইন শপ চালু। পুলিশ ছুটছে। কিন্তু কোথাও স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টা দেখভালের কেউ নেই। শুধু মুখে একটা মাস্ক। আর কোন সুরক্ষা ব্যবস্থা নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি। কিন্তু কোন নির্দেশনা নেই। সংসদ টিভিতে দূর শিক্ষণের নামে চলছে লুটপাটের হিড়িক। আর কিছু সংগঠনের রিলিফ দেবার নামে ফটো সেশন। মোট কথা করোনা নিয়ে বিভ্রান্তির অন্ত নেই। কোথায় এর শেষ তাও জানে না কেউ।
আমিরুল আলম খান, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
[email protected]