করোনাকালের দুশ্চিন্তা : অতিমারীর পিছু নেয় দুর্ভিক্ষ

0
আমিরুল আলম খান
ইতিহাস বলে, মানুষ মরে মানুষে মানুষে ভেদাভেদের কারণে। স্বাভাবিক মৃত্যুর চেয়ে ভেদাভেদে মানুষ মরে অনেক বেশি সংখ্যায়। যেদিন থেকে মানুষের যূথবদ্ধ জীবনের অবসান ঘটেছে সেদিন থেকেই মানুষের অপমৃত্যুর কারণ এই ভেদাভেদ। সম্পদের ভেদাভেদ। বৈষম্য। বস্তুর ওপর, সম্পদের ওপর মানুষের সমান অধিকারের অবসান তীব্র হলেই ধেয়ে আসে মহামারী।
যখনই দুর্যোগ এসেছে, ভেদাভেদ দাঁত বের করে হেসেছে। সম্পদের বিলি বণ্টনে চুরি বেড়েছে। যাদের হাতে ক্ষমতা তারা আরও সম্পদের মালিক হয়েছে দুর্যোগকে কাজে লাগিয়ে। দুর্ভিক্ষের কারণ খাদ্যের অভাব নয়, খাদ্যের মজুতদারি। মুনাফার লোভে মানুষ মজুতদারি করে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে। হ্যাঁ, খাদ্য উৎপাদন কম হলে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি তৈরি হয়। আর সেই ঝুঁকিকে পূঁজি করে গড়ে ওঠে মজুতদারি। তারপর একদিকে দুর্ভিক্ষ, অন্যদিকে কিছু লোকের সম্পদের পাহাড়। অনেক প্রাণের বিনিময়ে কিছু মানুষের সম্পদের মালিক হওয়া অনেক পুরনো খেলা। করোনা ভাইরাস নিয়ে এখন সেই অমানবিক খেলা শুরু হয়েছে দেশে দেশে।
এ দুনিয়ায় মানুষ যেমন মানবিক, তেমনি অমানবিক, হিংস্রও। বলা যায় মানবিকতায় যেমন সে সেরা, দস্যুপনায়ও সেরা। অনেক মানুষ যখন সর্বস্ব বাজি রেখে আর্ত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়, তখন দুর্বৃত্তরাও সক্রিয় হয়ে ওঠে আখের গোছাতে। কবি বলেছেন, মানুষের মাঝেই আছে সুর এবং অসুর। কেউ সর্বস্ব বিলিয়ে শান্তি পায়, কেই অপরের সর্বস্ব লুট করে সুখ খোঁজে। এদেশে ভয়ংকরতম দুর্ভিক্ষ হানা দিয়েছিল ১১৭৬ সনে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে ইতিহাসের কলঙ্ক হয়ে আছে সে দুর্ভিক্ষ। পলাশির যুদ্ধের ঠিক ১১ বছরের মাথায়। অনাবৃষ্টিতে ফসল ফলে নি। তাই খাদ্যের অভাব শুরু হল। কিন্তু সেকালে বাংলার (বিহার ও উড়িষ্যাসহ) তিন কোটি মানুষের খেয়ে বেঁচে থাকার মত খাদ্যাভাব হয় নি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্ষুধার্ত মানুষের রক্ষায় তাদের পাশে দাঁড়ায় নি। বরং খাদ্যের একচেটিয়া ব্যবসা নিজেদের হাতে তুলে নেয়। কোম্পানির লোকেরা রাতারাতি বড়লোক বনে যায়। দেশে ফিরে খুলে বসে ব্যবসায়, নানা কোম্পানি। গড়ে তোলে শিল্প বিপ্লবের ভিত। রাজস্ব আদায় আগের বছরের পাঁচ লাখ পাউন্ড থেকে বাড়িয়ে ১০ লাখ পাউন্ড আদায় করে। কৃষক, তাঁতি, কামার, কুমোর, ব্যবসায়ীর সব কিছু কেড়ে নেয় কোম্পানি আর তাদের এদেশীয় দালালরা। এভাবে এক কোটি মানুষ না খেয়ে মারা যায় দুনিয়ার সবচেয়ে উর্বর বাংলাদেশে। ছোট ছোট খাদ্যাভাব আগেও হয়েছে। কিন্তু মৃত্যুর এমন ভয়াবহ ইতিহাস বাংলায় আগে কখনও ঘটে না।
ইংরেজ আমলে তিন তিনটে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ বাংলায় হানা দিয়েছে। ১১৭৬ সনের ঠিক এক শ বছর পর ১২৭৬ সনে আরেকবার। সেবারও দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যায়। ইংরেজ আমলের শেষ দুর্ভিক্ষ ১৩৫০ সনে(১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষের দিকে। জাপানি বাহিনি বার্মা দখল করে ধেয়ে আসছে বাংলার দিকে। আসামে ঢুকে পড়েছে। দেশে খাদ্যাভাবের পদধ্বনি। সরকার সব খাবার সেনাদের জন্য গুদামে ভরে সাধারণ মানুষকে না খেয়ে মরার দিকে ঠেলে দেয়। ময়লা থেকে কুকুরের সাথে খাবার কাড়াকাড়ি খেয়েছে মানুষ। তবু বাঁচতে পারে নি। হাজারে লাশ পড়ে থেকে রাস্তায়। কাকে-কুকুরে খেয়েছে সে লাশ। সে দুর্ভিক্ষের ক্ষত এখনও বাংলায় জ্বলজ্বল করছে। হাজার হাজার পরিবার উজাড় হয়ে গেছে, বাঁচার আশায় মানুষ নোয়াখানি, কুমিল্লা, ঢাকা থেকে কলকাতায় ছুটেছে। ছড়িয়ে পড়েছে কলকাতার আশেপাশের জেলাগুলোয়। নদিয়া, চব্বিশ পরগনা, যশোর, খুলনায় আজও তাদের উত্তরপুরুষদের দেখা মেলে লাখে লাখে। কিন্তু এ দুর্ভিক্ষ হবার কথা ছিল না। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, খাদ্যের অভাব ছিল না। অন্তত মানুষ না খেয়ে মরার মত খাদ্যের অভাব ছিল না। যা ঘটেছিল, তা হল মজুতদারি। সরকারের তত্ত্বাবধানে ঘটে সে মজুতদারি। তার সাথে দেশীয় কিছু অসৎ ব্যবসায়ী ইংরেজ সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে মেতে উঠেছিল মজুতদারিতে।
বাংলায় সর্বশেষ প্রলয়ংকরী দুর্ভিক্ষ হানা দেয় স্বাধীনতার পর, ১৯৭৪ সালে। সেবার বন্যা হয়েছিল। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ফসল হানি ঘটে।ময়মনসিং, ঢাকা, কুমিল্লায় ব্যাপক ফসল হানি হয়েছিল। কিন্তু দেশের খাদ্য ভাণ্ডার বলে খ্যাত উত্তর বাংলা, মধ্য বাংলায় ভাল ফসল ফলেছিল। যশোর, খুলনা বা বরিশালেও ভাল ফসল হয়েছিল। রংপুরে অভাব ছিল খাদ্যের। কিন্তু দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী, পাবনায় পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। বগুড়া, দিনাজপুরে অনেক বেশি উদবৃত্ত ধান উৎপন্ন হয়েছিল। এত বেশি উৎপন্ন হয়েছিল, যে সেখানে এম মণ ধান বিক্রি করে এক সের লবণ কেনা যাচ্ছিল না। কিন্তু ভেঙে পড়েছিল ব্যবস্থাপনা। জেলায় জেলায় জারি করা হয় কর্ডোনিং। এক জেলার ধান-চাল অন্য জেলায় চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। ফলে দেশের পশ্চিম দিকে যখন ধান চালের দাম একেবারে পড়ে যায়, উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে দেখা দেয়ে নিদারুণ খাদ্য সংকট। তখন বাংলাদেশ খাদ্য ঘাটতির দেশ। বছরে প্রায় ১৮ লক্ষ টন খাদ্য ঘাটতি হত। বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে হত। সে সময় আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক ছিল না। স্বাধীনতা যুদ্ধে আমেরিকা বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিল। ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রধান মিত্র। সে কালের বৈশ্বিক রাজনীতিতে আমেরিকা বাংলাদেশকে শায়েস্তা করতে বাংলাদেশের জন্য খাদ্য বোঝাই জাহাজ আটকে দেয়। ফলে সময় মত খাদ্য এসে না পৌঁছানোয় অন্তত ৭০ লক্ষ মানুষ না খেয়ে মারা যায়।
অমর্ত্য সেন তাঁর “দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ” বইয়ে গবেষণায় প্রমাণ করেছেন, ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ এড়ানো যেত। এটা প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ নয়। এ দুর্ভিক্ষের আসল কারণ রাজনৈতিক, অব্যবস্থাপনা, ব্যাপক লুটপাট এবং মানুষকে কাজ দিতে পারার ব্যর্থতা। তাঁর মতে, শুধু রিলিফ দিয়ে দুর্ভিক্ষ সামাল দেয়া যায় না। তাতে দুর্নীতি বাড়ে। মানুষকে কাজ দিতে পারাই আসল কথা। সেটাই দুর্যোগ মোকাবেলার টেকসই পদ্ধতি। গণতন্ত্রহীনতাকেও তিনি অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এই গবেষণার জন্যই অমর্ত্য সেন নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। সারা বিশ্বে পরিচিত হন কল্যাণ অর্থনীতির প্রবক্তা হিসেবে।
আমরা লক্ষ করছি, এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর ক্ষমতাধর দেশগুলোয় করোনা সবচেয়ে মারাত্মক হয়ে উঠেছে। আবার যে সব দেশ, বেশি আত্মতুষ্টিতে ভুগেছে তাদের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, ব্রিটেন, সুইডেন এবং সর্বপরি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এর সেরা নজির।
চীন প্রথমদিকে ঠিক কতটা তৎপরতা দেখিয়েছিল তা নিয়ে বিস্তর সমালোচনা আছে। তারা অনেক তথ্য গোপন করেছে এসব অভিযোগ বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস করে। ইরানও আমাদের একই বার্তা দেয়। আবার দ্রুত সক্রিয় হয়ে তাইওয়ান, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর অভাবনীয় সাফল্য দেখায়। মালয়েশিয়া তাবলিগ জামায়াতিদের নিয়ন্ত্রণ না করায় বিপদে পড়েছে। ভারতেও দিল্লির তাবলিগের হেড কোয়ার্টার নিজাম মারকাজে হাজার হাজার তাবলিগি মুসল্লীদের মাধ্যমে করোনা ছড়িয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ায়ও একটি ক্ষুদ্র খ্রিস্টান সম্পদায়ের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। ইরান, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন ইসলামী দেশ মসজিদে জামাতে নামাজ আদায় স্থগিত করে। এমন কি, পবিত্র ক্বাবা শরিফ ও মদিনায় মসজিদে নববীও সাময়িক বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু আমরা সে সিদ্ধান্ত নিতে অন্তত তিন সপ্তাহ হেলায় নষ্ট করেছি।
ইউরোপের অনেক দেশে, বিশেষ করে ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, ব্রিটেন, সুইডেন, নেদারল্যান্ডসে যে গাছাড়া ভাব দেখেছি তা রীতিমত অবিশ্বাস্য। সবচেয়ে বে-আক্কেল ভূমিকা দেখিয়েছেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি কারো কথাই কানে তোলেন নি। এমন কি গোয়েন্দা রিপোর্ট, চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের সতর্ক বার্তাও তাঁকে সামান্য বিচলিত করে নি। এখন সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে আমেরিকা। প্রেসিডেন্ট নিজেই বলেছেন সেখানে অন্তত এক কোটি মানুষ মারা যেতে পারে! কী ভয়ংকর পরিস্থিতি!
বাংলাদেশে আমরা সিদ্ধান্তহীনতা, সমন্বয়হীনতার চূড়ান্ত রূপ দেখছি। এই দুর্দিনেও, আমারিকার বরাত পেয়ে গার্মেন্ট শ্রমিকদের কাজে যোগদানে বাধ্য করার মত নিষ্ঠুর আয়োজনে বিজিএমঅএ আর সরকারের ভূমিকায় দেশবাসী ক্ষুব্ধ। এর কী ভয়ংকর পরিণতি হবে কাউ জানি না। লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষের জীবন নিয়ে যারা এই নিষ্ঠুর খেলার দুঃসাহস দেখিয়েছে যারা তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত।
অন্যদিকে দেশের পরিবহণ মালিকরা তাদের গরিব কর্মীদের নিয়ে আরেক মারণ খেলায় মেতেছে। শ্রমিকদের তারা নিজেদের স্বার্থে লাঠিয়াল বাহিনি হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু এই দুর্দিনে তাদের সুরক্ষার সামান্য আয়োজন নেই। খাদ্য যোগানোর ব্যবস্থা করে নি কেউ। পরিববহণ শ্রমিকরা কী বুঝতে পারছে, তাদের যে মালিক লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করে নিজেরা সম্পদের পাহাড় বানায়, বিপদে তাদের কেউ তাদের পাশে নেই, কখনও পাশে থাকে না? দোকান কর্মচারীদের অবস্থাও একই রকম। কোন সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই তারা রাতদিন কাজ করছেন।
পরিকল্পনা ছাড়া, কোন রকম সমন্বয় ছাড়া, নির্দেশনা ছাড়া সরকারি ছুটি ঘোষণা ছিল চরম হঠকারিতা। যেসব প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে তার সবই লুটেরাদের পকেটে যাবে। মালিকপক্ষের জন্যই সকল ব্যবস্থা। প্রায় ১০ কোটি অভাবী মানুষ কী খাবে, কীভাবে খাবার পাবে তার সুনির্দিষ্ট কোন ব্যবস্থা নেই। বরং সর্বত্র চলছে বিশৃঙ্খলা। তাতে সংক্রমণ আরো চড়িয়ে পাড়ার আশংকা বাড়ছে। কোথায় তার চিকিৎসা পাবে তার কোনই পরিকল্পনা নেই!
সরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তি না করা, হাসপাতাল থেকে ভয়ে রোগীদের পালিয়ে যাওয়া প্রমাণ করে দেশে প্রশাসন কত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। হাসপাতালগুলোয় চরম অব্যবস্থাপনা। চিকিৎসক, নার্স অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সরকার ন্যূনতম সুরক্ষা ব্যবস্থা করতে পারে নি দীর্ঘ তিন মাসে। বেসরকারি হাসপাতালগুলো বন্ধ রেখে জনগণের সঙ্গে যে মাস্তানি করেছে তার বিরুদ্ধে সরকার কোনই ব্যবস্থা নিতে পারে নি।
দুর্ভিক্ষ শুধু ফসলহানীতেই হয় না, খাদ্যাভাবেই হয় না। অতিমারীর পিছু পিছুও আসে দুর্ভিক্ষ। তখন যে কোন রোগ দ্রুত ছড়ায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ শুধু অপুষ্টিতেই মারা যায়। অপুষ্টি নানা রোগের আস্তানা বানায় শরীরে। তাতেই তারা মারা যায়। রাস্তায় পড়ে থাকে মরদেহ। পরিবেশ দূষিত হয়ে পড়ে। সে মহামৃত্যুর মিছিল সামাল দেয়ার জন্য কাউকেই পাওয়া যায় না।
আমরা কী এখনও সতর্ক হব না?
আমিরুল আলম খান, যশোর বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান