উন্নয়ন পরিমাপে ‘মাথাপিছু সামাজিক শান্তি’

0

প্রফেসর ড. এম এ মান্নান
আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বহুল-উচ্চারিত একটি শব্দ ‘উন্নয়ন’। অর্থনীতি শাস্ত্রে জিডিপি বা জিএনপি দিয়ে উন্নয়নকে পরিমাপ করা হয়। কিন্তু এই উন্নয়নের চূড়ান্ত ফলকে আমরা কিভাবে বিচার করছি সেটি একটি প্রশ্ন। আমরা যখন ‘ন্যাশনাল ইনকাম একাউন্টিং’ করি তখন এমন অনেক কিছু বাদ দেয়া হয়; যেগুলো হিসাবের খাতায় যোগ হলে আমাদের মতো দেশগুলোর প্রকৃত আয় অনেক বেড়ে যেত। সমাজের সব অর্থনৈতিক কমকাণ্ড আমাদের মাথাপিছু আয়ের হিসাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। কিন্তু আমাদের উন্নয়নকে কি আমরা ‘মাথাপিছু সামাজিক শান্তি’ (per capita social peace) দিয়ে বিচার করতে পারি না? সামাজিক শান্তিই তো উন্নয়নের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। আর বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাষ্ট্রীয় অর্থ তথা গরিব করদাতাদের যে টাকা নিয়ে শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করে সেটা আসলে একধরনের সামাজিক ঋণ। ওই শিক্ষার্থী তার কর্মজীবনে প্রবেশের পর কিভাবে এই ঋণ পরিশোধ করবে সেটি যেমন একটি বিকল্প চিন্তাধারা হতে পারে, তেমনি পারে সমাজে শান্তির প্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করতে।
পশ্চিমা বিশ্বে এখন আর কোনো কল্যাণ রাষ্ট্র নেই। ইংল্যান্ডে একসময় কিছুটা ছিল। তখন শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি দেয়া হতো। কিন্তু মার্গারেট থেচার এসে সেগুলো বন্ধ করে দেন। ফলে শিক্ষাও এখন সেখানে বাজারের পণ্য। তুমি যদি মূল্য পরিশোধ করতে পারো তাহলে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে। আমেরিকার ক্ষেত্রে এ কথা সত্য। পশ্চিমা সমাজে এ ধরনের খাতে খেটে খাওয়া মানুষের অবদান কম। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিক্ষা খাতে বিপুল পরিমাণে ভর্তুকি দেয়া হয়। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা খাতে। ভর্তুকির এই টাকা আসে খেটে খাওয়া মানুষের কাছ থেকে। আমাদের কর কাঠামোটিই এমন। সরকার একজন কারখানা মালিকের কাছ থেকে যে কর আদায় করছে তা ওই মালিক কৌশলে ক্রেতার ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে। আর পণ্য ব্যবহারকারী হলো গরিব। এভাবে উপাদনগত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে ৮০-৯০ ভাগ কর গরিবের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে। তাই আমি মনে করি যারা এসব গরিবের পয়সায় উচ্চশিক্ষা নিতে পেরেছে তাদের উচিত হবে এসব গরিবের ঋণ শোধ করা। এ জন্য তাদের অনুপ্রাণিত করতে হবে। অথবা এমন কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ম্যাকানিজম থাকা উচিত, যার মাধ্যমে তারা ওই ঋণ পরিশোধ করতে পারে। একে আমি সামাজিক ঋণ বলি, যা একজন নাগরিকের নিজস্ব দায়িত্ব বোধ থেকে পরিশোধ করা উচিত।
উন্নয়নের ধারণায় সম্প্রতি যে বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে তা হলো উন্নয়নের চূড়ান্ত ফলটি কী হওয়া উচিত। উন্নয়ন মানে কি শুধু দৃশ্যমান বস্তুগত উন্নয়ন নাকি মানসিক প্রশান্তি অর্জন। মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে চায়। যে উন্নয়ন বিষণœœতা তৈরি করে, ঘুম নষ্ট করে, নারী নির্যাতন বৃদ্ধি করে, নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে, সড়কে বের হলে ঘরে ফেরার নিশ্চয়তা থাকে না, অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি করে, হানাহানির জন্ম দেয় সেটি আসলেই উন্নয়ন কি না সেই প্রশ্ন উঠেছে। আমি মনে করি, আমাদের উচিত হবে মাথাপিছু সামাজিক শান্তি কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে তার ভিত্তিতে উন্নয়নকে বিবেচনা করা। বিষয়টি নিয়ে আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। এই মাথাপিছু সামাজিক শান্তি কিন্তু গণনাযোগ্য একটি বিষয়। দু’টি গ্রুপের মধ্যে পরীক্ষাকালে এর একটি হয় নিয়ন্ত্রিত গ্রুপ আর অন্যটি হয় উন্মুক্ত গ্রুপ। নিয়ন্ত্রিত গ্রুপের উপর ওষুধ প্রয়োগ করা হয়, অন্যটির উপর হয় না। এর মাধ্যমে ওষুধটির সুফল-কুফল পরীক্ষা করা হয়। একই পদ্ধতিতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সামাজিক শান্তি কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে তা-ও সহজে পরীক্ষা করা সম্ভব। যেমন দেশে ৬৪টি জেলা রয়েছে। আমরা দেখতে পারি সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ জেলা কোনটি। যেখানে হানাহানি কম, পারিবারিক সম্পর্ক ভালো, প্রতিবেশীদের মধ্যে সৌহার্দ্য বেশি, আদালতে মামলার সংখ্যা কম, ইত্যাদি দিয়ে সহজেই একটি জেলার শান্তিপূর্ণ অবস্থার মূল্যায়ন করা হবে। মাথাপিছু আয় দিয়ে আর্থিক সামর্থ্যরে একটি হিসাব আমরা করছি। আমরা এভাবে মাথাপিছু সামাজিক শান্তির বিষয়টিও পরিমাপ করতে পারি। এই সামাজিক শান্তি পরিমাপের ব্যবস্থা হলো উন্নয়নের বিকল্প চিন্তাধারা।
এটি দিয়ে আমরা দৃশ্যমান উন্নয়নের চূড়ান্ত ফলটি দেখতে চাচ্ছি। আমরা যেসব কাজ করছি তা সাধারণ মানুষের জীবনে কী প্রভাব ফেলছে সেটি দিয়েও উন্নয়নকে বিচার করতে হবে। শুধু গগনচুম্বী অট্টালিকা নির্মাণ করলেই হবে না। মানুষ যেন রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারে সেই ব্যবস্থাও করতে হবে। এমন উন্নয়ন করা হলো, যে কারণে শব্দদূষণ ঘটে মানুষের ঘুম কেড়ে নিল। এমন সড়ক, মেট্রোরেল, পাতাল রেল তৈরি করা হলো যে কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হয়ে গেল। মানুষ বিশুদ্ধ বাতাসের অভাবে রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। ঢাকা এরই মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর তালিকায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে। তাহলে আমরা কিভাবে উন্নত হচ্ছি? যে উন্নয়নে জীবনের নিরাপত্তা নেই, ঘর থেকে বের হওয়ার পর নিরাপদে চলার নিশ্চয়তা থাকবে না সেটা উন্নয়ন হতে পারে না। তাই আমি আমাদের নীতি প্রণেতাদের অনুরোধ করব একটি সামাজিক শান্তি সূচক তৈরি করতে। উন্নয়নের চূড়ান্ত লক্ষ্যটি হবে আমাদের বিচার্য বিষয়। যে উন্নয়ন বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেয় সেটি উন্নয়ন নয়। আমাদের দৈন্য এখানেই। আমাদের দৈন্য সম্পদের নয়, ধ্যানধারণার। এই অবস্থা তৈরি হয়েছে কারণ আমরা পশ্চিমাদের উচ্ছিষ্ট ধ্যানধারণাগুলো গ্রহণ করছি। এটা প্রায় প্রতিটি স্বল্পোন্নত দেশের একটি দুঃখজনক প্রবণতা ও ধরন। আমরা তাদের কাছ থেকে এসব ধ্যানধারণা গ্রহণ করছি, যারা এখন সেগুলো বাতিল করে দিচ্ছে। ইউরোপের দেশগুলো এক হয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন করেছে, অভিন্ন মুদ্রা ইউরো চালু করেছে। যদিও এটা নিয়ে সমস্যা চলছে; কিন্তু তারা বুঝতে পেরেছে জাতিরাষ্ট্র ধারণা দিয়ে আগামীতে চলা যাবে না।
সেটি নিশ্চিত হওয়ার পরেই তা থেকে বেরিয়ে আসতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। ঠিক তখনই আমরা জাতিরাষ্ট্র ধারণাকে আরো আঁকড়ে ধরতে হানাহানি করছি। তাই আমি বলছি, একবিংশ শতকে ওই উচ্ছিষ্ট ধ্যানধারণা দিয়ে কোনো অনুন্নত দেশের পক্ষে কথিত উন্নত দেশ হওয়া সম্ভব নয়। এসব দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর উচিত হবে তাদের নিজের সমাজ, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও চেতনার আলোকে একটি নিজস্ব উন্নয়নের মডেল তৈরি করা। তার ওপরেই উন্নয়নের বুনিয়াদটি তৈরি করতে হবে। আমরা যদি সেই বুনিয়াদটি তৈরি করতে পারতাম তাহলে অনেক শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের পথে অগ্রসর হতে পারতাম। সেটি না থাকায় উন্নয়নের পথে অগ্রসর হওয়া নিয়ে আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। প্রতিবেশী ভারতে আজকের পরিস্থিতি ঠিক সেই কারণেই। বাহ্যিক দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে সেখানে মুসলমানদের আঘাত করতে নতুন নাগরিকত্ব আইন করা হয়েছে। কিন্তু সেই আঘাত লেগেছে সেখানকার সনাতন মূল্যবোধ, সমাজ, সংস্কৃতি ও জাতিগত বৈচিত্র্যের ওপর। ফলে সব বিশ্বাসী মানুষ আইনটির প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে। সবার বিশ্বাস, ধারণা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধকে নাড়িয়ে দিয়েছে এই বিল। এই আইন যে কাউকে আঘাত করতে পারে- সেই ভীতি তৈরি হয়েছে সবার মনে। এটা একান্তভাবে পশ্চিমা ধারণা থেকে এসেছে। আর সেটি করতে গিয়ে পুরো ভারতে এক বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়েছে। আসলে আমরা অনুকরণ করা শিখেছি। কিন্তু আত্মস্থ করা শিখিনি। অনুকরণ করা চুরি করারই নামান্তর। অন্যদিকে আত্মস্থ করার মানে হলো অন্যের কাছে থেকে গ্রহণ করা বিষয়গুলো নিজের উপযোগী করে তৈরি করে নেয়া। অনুকরণ করা সহজ কিন্তু আত্মস্থ করা কঠিন। প্রকৃত উন্নয়নে সেই কঠিন কাজটি করতে হবে আমাদের।হ
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
[email protected]