সোনালি ধানের সুবাসে ম-ম উঠোন কাঙ্খিত দাম না পেয়ে হতাশ কৃষক

0

আকরামুজ্জামান ॥ যশোরে মাঠজুড়ে এখন সোনালি রঙের হাতছানি। শিশির ভেজা সকালে কিংবা পড়ন্ত বিকেলে বাতাস মেখে আনছে সদ্য কাটা আমন ধানের এক মিষ্টি সুবাস। এই সুবাসই জানান দিচ্ছে, আমন ধান ঘরে তোলার মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। চৌগাছা থেকে শুরু করে শার্শা পর্যন্ত, জেলার প্রতিটি কোণে এখন কর্মযজ্ঞের মেলা। কেউ ব্যস্ত ট্রাক্টর-মাড়াই মেশিনে ধান ঝেড়ে ফেলতে, কেউবা উঠোনে নতুন ধান রোদে দিতে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, এই উল্লাসের মধ্যে ইতোমধ্যে ৭০ শতাংশ জমির ধান কাটা শেষ।

যশোরের চৌগাছা, ঝিকরগাছা, মনিরামপুর, কেশবপুর, বাঘারপাড়া ও শার্শা-সব উপজেলাতেই এখন ধান কাটার তুমুল ব্যস্ততা। জেলার বাজারগুলোতেও নতুন ধানের রং ও গন্ধে এক ধরনের উৎসবমুখরতা দেখা যাচ্ছে।
যশোর অঞ্চলে এ বছর মৌসুমের শুরুতে কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি এবং স্থানীয়ভাবে তৈরি হওয়া জলাবদ্ধতার কারণে কিছু নিচু জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মনিরামপুর, কেশবপুর ও শার্শার কয়েকটি এলাকার কৃষকেরা জানান, অতিবৃষ্টির কারণে ধানের কুঁড়ি নষ্ট হয় এবং কিছু জায়গায় শিকড়ে পচন ধরে। তবে এসব ক্ষতি মোট উৎপাদনের তুলনায় খুবই সামান্য।

মাঠপর্যায়ের কৃষিবিদরা বলছেন, প্রাথমিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার পর যশোরে এবার ধানের সামগ্রিক ফলন বেশ ভালো হয়েছে। সময়মতো বৃষ্টি, বালাই কম হওয়া এবং আধুনিক জাতের বিস্তারের কারণে উৎপাদন ধীরে ধীরে বেড়েছে।

ধান কাটার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে যে দাম পাওয়া যাচ্ছে, তা গত বছরের তুলনায় একটু কম বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। চৌগাছা, নওয়াপাড়া ও কেশবপুর বাজারে নতুন আমন ধান মণপ্রতি ১২৫০ থেকে ১৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিছু এলাকায় দাম আরও কম। ফলে এ দামে সন্তুষ্ট নন কৃষক। তাদের দাবি উৎপাদন খরচের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ধানের দাম ১৭শ থেকে ১৮শ টাকা মণ হলে তারা লাভবান হতেন। অনেক কৃষকের ধারণা, শীতের মাঝামাঝিতে বাজারে ধানের দাম আরও একটু বাড়তে পারে।

ঝিকরগাছা উপজেলার কৃষক আনোয়ার হোসেন জানান, দেড় একর জমিতে আমন রোপণ করেছিলেন। ফলন ভালো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ইঁদুর কিছুটা ক্ষতি করেছে ঠিকই, তবু ১৬-১৭ মণ পাবো।’

মনিরামপুরের কৃষক নাসিম শেখ বলেন, ‘এবার ধান খুব ভালো ফলন হয়েছে। দামটাও যেন ভালো থাকে, তাহলে লাভ ঠিকই হবে।’

একই এলাকার চাষি গোলাম কিবরিয়া জানান, তার ছয় একর জমিতে কয়েকটি জাতের ধান লাগানো হয়েছিল। তিনি আশা করছেন, প্রতি একরে ৪২ থেকে ৫০ মণ ধান উঠবে। তার ভাষায়, ‘এবার রোগবালাই কম, তাই খরচও কম হয়েছে।’ তবে বাজারে বর্তমান মূল্য নিয়ে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

শার্শা এলাকার কৃষক মজনু মিয়া জানান, ‘এক একরে খরচ পড়েছে প্রায় ১৮-১৯ হাজার টাকা। নতুন ধান মণপ্রতি ১২০০-১৩৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। দাম আরও একটু বেশি থাকলে ভালোই হতো।’ তিনি আরও বলেন, শ্রমিকের হিসাব মিললে লাভ কম হয়, আর যারা নিজের জমিতে নিজেরা কাজ করেন, তাদের লাভ বেশি।

যশোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, মৌসুমের শুরুতে অতিবৃষ্টির কারণে জেলা জুড়ে কিছু জমিতে আংশিক ক্ষতি হয়। তবে এর প্রভাব তেমন পড়েনি। জেলায় বামপার ফলন হয়েছে। তবে নতুন উচ্চফলনশীল জাত, যেমন ব্রি-১০৩, ব্রি-১০৮সহ কয়েকটি জাতের ধানে ফলনের পাশাপাশি দামও বেশি বলে তিনি জানান।

স্থানীয় কৃষিবিদদের মতে, যশোরে এখন দ্রুত কমে যাচ্ছে পানি সেচের প্রয়োজনীয়তা। সময়মতো বৃষ্টিপাত হওয়ায় অনেক কৃষক এবার সেচ দিতে হয়নি বা কম দিতে হয়েছে। এতে প্রতিটি একরে খরচ কমেছে। এই সাশ্রয় কৃষকদের মোট লাভে সরাসরি প্রভাব ফেলবে তারা জানান।

গ্রামের মাঠে ঘুরে দেখা যায়, ধান কাটতে এসেছে অনেকেই। কেউ গ্রামের যুবক, কেউ দূরের শ্রমিক দল। নারী-পুরুষ মিলে ধান কাটা, বেঁধে রাখা, মাথায় করে আনা, সব মিলিয়ে গ্রামাঞ্চলে জমেছে কর্মব্যস্ততার মেলা। অনেক পরিবার ধান ঘরে তোলার পর নতুন আতপ চাল ভেজে পিঠা-পায়েস বানিয়ে মৌসুম উদ্যাপন করছেন।

যশোরের গ্রামগুলো তাই শুধু কৃষিকাজেই নয়, ঐতিহ্য, খাবার আর আনন্দ মিলিয়ে আমন মৌসুমকে এক ধরনের উৎসব হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। জেলায় চলতি মৌসুমে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৯শ ৭০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ হয়েছে।