২০ শয্যার হাসপাতালে একজন চিকিৎসক নেই ওষুধ, হয় না কোনো অপারেশন

যশোর মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে

0

বি এম আসাদ ॥ একজন মেডিকেল অফিসার সামলাচ্ছেন একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল। তিনিই শুধু রোগীদের ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন। রোগীরা ব্যবস্থাপত্র পেলেও পাচ্ছেন না ওষুধ। অপারেশন হয় না কয়েক বছর। গত দুই মাসে স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে ৪৫ জনের। অবহেলিত এ হাসপাতালটির অবস্থায় খোদ যশোর শহরে সার্কিট হাউসের পাশে। নাম মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র।

১৬ মার্চ রোববার বেলা ১১ টায় মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় কেউ সন্তান নিয়ে, আবার কেউ আসছেন একা কাগজপত্র হাতে। যাচ্ছেন মেডিকেল অফিসার সাদিয়া রায়হানের কক্ষে। রুমি, ঋতু ও মুন্নী তারা একেক করে ওই চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসাপত্র (প্রেসক্রিপশন) নিয়ে নিয়ে বাসায় ফিরে যাচ্ছেন। কিন্তু তাদের হাতে কোসো ওষুধ নেই। শুধু রুমি কিংবা মুন্নি নয় তাদের মত আরো ৪৫ জন রোগী এদিন চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে আসেন এবং চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। কিন্তু কেউই এখান থেকে কোনো ওষুধ পাননি।

হাসপাতালের স্টাফরা জানান, কোনো সময় রোগী বৃদ্ধি পায় আবার কোনদিন কমে যায়। ওই কেন্দ্রের ৮নং কক্ষ ফার্মেসি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ফার্মাসিস্ট আছিয়া খাতুন বসে আছেন চেয়ারে। ৪-৫ মাস আগে পাওয়া কিছু প্যারাসিটামল আর স্যালবুটামল রয়েছে ফার্মেসিতে। অন্য কোনো ওষুধ নেই। ফার্মাসিস্ট আছিয়া খাতুন জানান, কয়েক মাস আগে কয়েক প্রকার ওষুধ পাওয়া গিয়েছিল। তাই এখনো আছে। নতুন কোনো ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে না। দীর্ঘ কয়েক মাস যাবত চলছে এভাবেই।পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের তিন নম্বর কক্ষে গিয়ে দেখা যায় ভিজিটর রিনা খাতুন রোগীর প্রেসার মাপছেন। এছাড়া আর কিছু করার নেই তার। অফিস কক্ষ ছিল দরজা বন্ধ। সংযুক্তির মাধ্যমে ১২ জন কর্মকর্তা কর্মচারী থাকলেও অধিকাংশ কর্মচারী দুপুর ১টায় ছিল না অফিসে।

মা ও শিশুরা এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসলে তাদের শুধু প্রেসক্রিপশন ছাড়া আর কিছুই পান না। সংশি¬ষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছেন, বরাদ্দ বা সরবরাহ না থাকার কারণে রোগীদের ওষুধপত্র দেওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থা চলছে দীর্ঘ এক বছর ধরে।

সূত্র জানিয়েছেন, যশোর মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের বর্তমান কাজ হচ্ছে, প্রসূতি মায়েদের একজন মেডিকেল অফিসারের মাধ্যমে ওষুদের রোগীদের প্রেসক্রিপশন দেওয়া এবং গর্ভবতী মায়েদের নরমাল ডেলিভারি করা। বিনামূল্যে সিজার করার সক্ষমতা নেই তাদের। প্রতিদিন এক থেকে দু শ প্রসুতি মা ও শিশুরা যশোর মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে চিকিৎসা সেবা নিতে আসেন। প্রসূতি মায়েদের মধ্যে যাদের সিজার করা প্রয়োজন, তাদের যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যে সকল মা স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব করেন তাদেরকে এ কেন্দ্রে রেখে সন্তান প্রসব করানো হয়। এরপর দিনের দিন আবার কারোর একদিন রেখে পরদিন ছেড়ে দেওয়া হয়।

প্রতিমাসে ২০ থেকে ২৫ টি নরমাল ডেলিভারি করা হয় হাসপাতালে। মেডিকেল অফিসার ডা. রায়হানই ডেলিভারির কাজ করে থাকেন। যাদের সন্তান ডেলিভারিতে জটিলতা দেখা দেয় বা সিজার করার প্রয়োজন হয় তখন তাৎক্ষণিকভাবে ওই প্রসূতি মাকে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে পাঠানো হয়।

এর আগে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে সিজার করা থেকে শুরু করে সব ধরনের অপারেশন করা হতো গর্ভবতী মায়েদের। তখন প্রতিমাসে তিন থেকে চার হাজার রোগী হতো এ হাসপাতালে। এখানে সিজার করলে আর্থিক সাশ্রয় হতো রোগীদের। এ কারণে তারা যশোর মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে এসে বের করতেন। কিন্তু বর্তমানে এখানে আর সেই ভিড় নেই। আছে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির মেডিকেল প্রতিনিধিদের ভিড়। পাশাপাশি কিছু শিশু চিকিৎসা নেয়। আর কিছু প্রসূতি মা। মাসে যাদের মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ২শ হতে ২২০ জন। এর আগে প্রতিমাসে সাড়ে তিন হাজার থেকে ৪ হাজার রোগী চিকিৎসা নিতেন। তখন ডিজিও ডিগ্রিধারী একজন জুনিয়র গাইনি কনসালটেন্ট ছিলেন। এখন আছেন একজন মেডিকেল অফিসার। রোগী সিজার করার জন্য বিশেষজ্ঞ কোনো গাইনি চিকিৎসক নেই। মেডিকেল অফিসার যতটুকু চিকিৎসা দিচ্ছেন অতটুকুতেই শেষ।

সূত্র জানায়, ২০ শয্যার হাসপাতালে কমপক্ষে ৫০ জন জনবল প্রয়োজন। সেখানে আছে মাত্র ৬ জন। এ হাসপাতালে একজন মেডিকেল অফিসার, একজন ফিমেল অ্যাসিস্ট্যান্ট, একজন সরকারি নার্সিং অ্যাটেনডেন্স, একজন এফডবি¬উভি, একজন এমএলএসএস, ও একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী, একজন ড্রাইভারের পদ রয়েছে। প্রত্যেকটি পদে আছেন একজন কওে, ৬ জন কর্মরত আছেন। এর বাইরে কোনো পদ নেই। নেই কোনো লোক। এ অবস্থায় কাজের সুবিধার্থে সংযুক্তি একজন ফার্মাসিস্ট, একজন ক্লিনিক ভিজিটর, একজন আয়া, দুজন মিডওয়াইফারি মিলে ৬ জন সংযুক্তিতে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে আনা হয়েছে সদর উপজেলা থেকে। সব মিলিয়ে ১২ জন কর্মরত আছেন অতি গুরুত্বপূর্ণ এ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে। যেখানে ৫০ জন জনবল থাকার কথা সেখানে ১২ জন জনবল রোগীদের চিকিৎসা সেবায় কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না।

অপরদিকে রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসলেও তারা পাচ্ছেন না কোনো ওষুধ। রোগী এলেই তাদের ওষুধের একটি প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিয়ে বলে দেওয়া হচ্ছে বাইরে থেকে ওষুধ কিনে নিতে। অর্থের অভাবে অনেকে প্রেসক্রিপশন নিয়ে বাসায় রেখে দিচ্ছেন। জনবলও না থাকার কারণে ২০ হাসপাতালটি এখন জনগণের কোনো কাজে আসছে না।

প্রসূতি মা ও শিশুদের জরুরি চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য পাকিস্তান আমলে ৭২ শতক জমির ওপর সরকারিভাবে ২০ বেডের এ হাসপাতাল স্থপিত হয়।

এ ব্যাপারে জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপ-পরিচালক মো. দিলদার হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ঢাকা থেকে তাদের কোনো সরকারি ওষুধ দেওয়া হচ্ছে না। সরকারিভাবে ওষুধ সারবরাহ এখন বন্ধ রয়েছে। বরাদ্দ এখনো পাস না হওয়ায় সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।

যশোর মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের ইনচার্জ মেডিকেল অফিসার ডা. সাদিয়া রায়হান বলেন, আমরা কয়েকজন মানুষ ছাড়া এখানে কোনো কিছুই নেই। সরবরাহ না থাকার কারণে তারা রোগীদের ওষুধ দিতে পারছেন না। শুধু প্রেসক্রিপশন দিতে হচ্ছে রোগীদের। যেসব প্রসূতি মা স্বাভাবিক ভাবে সন্তান প্রসব করছেন তাদেরকেই হাসপাতালে নরমাল ডেলিভারি করানো হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলায় চারটি এরকম মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে। সেখানকার অবস্থা একই রকম। নেই প্রযোজনীয় জনবল, নেই ওষুধ।