জননেতা তরিকুল ইসলাম

0

জাকারিয়া মিলন
করোনা মহামারী ঘনিষ্ঠজনদের ছিনিয়ে নেওয়ায় যশোরের নিত্যসঙ্গীদের সংখ্যা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে; পুরাতন ঘনিষ্ঠ জনেরা, বন্ধুবান্ধব শ্রদ্ধেয়জনেরা অনেকেই বিদায় নিয়েছেন। ছাত্রজীবনে আমাদের সংগঠনের এক সময়ের নেত্রী ছাত্র ইউনিয়নের জেলা সভাপতি জনাবা নার্গিস বেগমের সাথে মাঝে মধ্যে আলাপ আলোচনা হয়। বিগত দিনে ছাত্র আন্দোলনের বিষয়াদি তথ্য নিয়ে কখনও কখনও মতবিনিময় হয়েছে। গত আগস্ট মাসে যশোরে সাক্ষাত হয়। অতীতের বিভিন্ন বিষয়ে স্মৃতিচারণা হয়। সঙ্গতকারণে জনাব তরিকুল ইসলামের একান্ত বিষয়াদি আলোচনায় আসে-উভয়েই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ উভয় নীরব হয়ে যাই। অপেক্ষামান দর্শনার্থীদের ঠেকিয়ে রাখা কষ্টকর হচ্ছিল। বর্তমানে তিনি জাতীয়তাবাদী দলের জেলা সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। ছাত্র-নেতৃত্বের অগ্নিকন্যাখ্যাত নার্গিস বেগমের এই দায়িত্ব নিঃসন্দেহে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তরিকুল ভাইয়ের আলোচনার ইতি টানলেন। ‘‘মিলন, দেখতে দেখতে ছয়টি বছর হয়ে গেল”।
আসলে আমিও ভেবে পাইনি সত্যি কি ছয়টি বছর ভাই নেই আমাদের মাঝে- যশোরের মানুষের পাশে, সমগ্র দেশের জনতার দাবি আদায়ের নেতৃত্বে। ২০১৮ সনের ৫ই নভেম্বর সংসদ প্লাজায় তার জানাযা পড়ার সুযোগ হয়েছিল। সন্তান দু’টি জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল। আমার চোখের পানি ধরে রাখা সম্ভব ছিল না। ছেলে দুটি’র প্রসঙ্গ উঠায় বলে রাখা ভাল- যোগ্য বাবা মা’র সুযোগ্য সন্তান।
বড় ছেলে জনাব শান্তনু ইসলাম সুমিত বহুল প্রচারিত লোকসমাজ পত্রিকার প্রকাশক এবং নিজস্ব ব্যবসা বাণিজ্য সফলতার সাথে পরিচালনা করছেন। ছোটটি অনিন্দ্য ইসলাম অমিত রাজনীতিতে বাবার যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে কাজ করে চলেছে- বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সাংঠনিক সম্পাদক। সত্য কথা বলতে কি দু’জনই অতি মেধাবী। কৃতিত্বের সাথে ছাত্রজীবন শেষ করেছে। যশোরের কমবেশী অনেকের সাথে আমার উঠা-বসা, নানাভাবে আলোচনা ক্রমে তাদের ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছি। মনটা ভরে গিয়েছে বাবা-মা, চাচা-চাচি সকলের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠতা। বাবা, বড় ভাই, মা, বড় বোন- উভয়ে আমার ছাত্র রাজনীতির মুরব্বী। এক সাথে সংগঠন করেছি- মজার বিষয় হল ওদের ডাক্তার চাচা আমিরুল ইসলাম করোনার শেষ ভাগে ইন্তেকাল করেছেন। আমার ক্লাসমেট ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু- অথচ ওরা সবসময় ‘মামা’ ডাকে, আসলে, মামা শব্দটা আদুরে-আব্দারের ডাক।
বর্তমান জামানায় যোগ্য সন্তান পাওয়া দুষ্কর। তরিকুল ইসলামের সম-সাময়িক রাজনীতিবিদ বন্ধু অনেকেই এ-দিক থেকে ভাগ্যবান হতে পারেননি। ছেলে দু’টির প্রশংসা শুনলে মন ভরে যায়। অমিতের সাংগঠনিক যোগ্যতা জনগণের সাথে যোগাযোগ। সুবক্তা হিসেবে ইতিমধ্যে সুনাম অর্জন করেছে।
জনাব তরিকুল ইসলাম কে নিয়ে লিখলে একটা চাপ্টার নয় বই হয়ে যাবে। মনে হয় তার জীবনী নিয়ে একটা বই প্রকাশ করা উচিত যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শিক্ষনীয়/পাথেয় হয়ে থাকবে।
রাজনীতির অঙ্গনের দৈন্যদশার অবক্ষয় নিয়ে লেখালেখি ও আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছিলাম পেশাজীবী হিসেবে ব্যাংকের সর্বোচ্চ পদে আসীন হতে অনেক ধাপ অতিক্রম করে পর্যায়ক্রমে উঠতে হয়েছে। সকল পেশায় একই নিয়ম রাজনীতির দলে প্রথমে চোঙ্গাফোকা সমর্থক কর্মী ধীরে ধীরে নেতৃত্বে, এলাকায় আঞ্চলিক জেলা বিভাগে অতঃপর ভাগ্যে কুলালে যোগ্যতায় জাতীয় পর্যায়। ভূঁইফোড় নেতৃত্ব, কোন ব্যাক গ্রাউণ্ড ছাড়া অবসরপ্রাপ্ত আমলা, ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর পদচারণা রাজনীতির ধারাবাহিকতা ব্যাহত করেছে। জনাব তরিকুল ইসলাম ছিলেন মাঠ পর্যায় থেকে উঠে আসা জনগণের নেতা। উত্তরাধিকার সূত্রেও নয় আকস্মিক আর্বিভূত নেতাও নয়।
ছাত্র জীবনে কলেজে শুরু থেকে ছাত্র ইউনিয়নের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। যশোরকে এক সময় প্রগতিশীল রাজনীতির সুতিকাগার বলা হতো- সেই-ঐতিহ্যবাহী মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ে সচেতন ছাত্রদের নেতৃত্বে আসা খুব সহজ বিষয় ছিল না। রাজনৈতিক পড়াশুনা, অনুশীলন, পরিশ্রম সাংগঠনিক যোগ্যতায় তিনি ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। তরিকুল ভাইয়ের সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে সম্পৃক্ত হওয়ার আমার সুযোগ হয়েছিল। সঙ্গত কারণে নানান আঙ্গিকে তাকে দেখার জানার পর্যালোচনারও সুযোগ হয়েছে। তরিকুল ভাই আমাদের যশোর জিলা স্কুলের সুপরিচিত ছাত্র। একই কলেজে আমার পড়ার সুযোগ হয়েছে। তাদের নেতৃত্বে ছাত্র সংগঠনে যোগদান করেছিলাম। সাংগঠনিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হয়ে ছাত্র নেতৃত্বে এসেছিলাম, পরবর্তীতে বড় ভাইয়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কলেজছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলাম।
নার্গিস আপার সাথেও বহু সভা-সমাবেশ করার সুযোগ হয়েছিল, সংগঠনের সভাপতি বড় আপার অনুসারী ছোট ভাইয়াটি পরবর্তীতে জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক পদে আসীন হয়েছিল। স্বৈরাচারী আয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে জনাব তরিকুল ইসলামকে পাকিস্তান আমলে দীর্ঘদিন কারাবরণ করতে হয়েছিল। তাদের অনুজ হিসেবে ও কর্মী হিসেবে কলেজ জীবনের সূচনাতে আমাকেও নেতাদের সাথে জেল খাটতে হয়েছে। তরিকুল ভাইয়ের সাথে দীর্ঘ জেল-জীবন কাটানোর সুযোগ হয়েছে। একত্রে দীর্ঘদিন থেকে নেতার চিন্তা চেতনা ও মন মানসিকতা দেখেছি, ধারণ করেছি। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ হিসেবে তাকে বহুবার কারাবরণ,করতে হয়েছে। শুধু কারাবরণ নয়, কঠোর নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। ১৯৮৩ সনে রাষ্ট্রপতি জনাব হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের হত্যা ষড়যন্ত্র মামলায় যশোরের ১৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। তরিকুল ভাই ছিলেন অন্যতম।
নির্যাতন সেলে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, প্রায় বছর খানেক আটক রাখা হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে তাকে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় বহুবার কারাবরণ করতে হয়। অকুতোভয় সাহসী তরিকুল ইসলামকে কাবু করতে পারেনি। প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির ধারাবাহিকতায় তিনি মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির রাজনীতিতে যুক্ত ও সম্পৃক্ত হন। ১৯৭৩ সনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তরিকুল ভাই যশোর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। নির্বাচনে সক্রিয় আমার কিছু কর্মীকেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষীবাহিনী তুলে নিয়ে যায়- নানা দুর্বুদ্ধি খাটিয়েও তরিকুল ইসলামের বিজয় ঠেকাতে পারেনি। পরবর্তীতে পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। যশোর থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য হয়েছেন। রাষ্ট্রের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন বহুবার। সাংসদ, মন্ত্রিত্ব তাকে জনগণের কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছে। পরবর্তীতে দলের নীতি নির্ধারণী দায়িত্বও পালন করেছেন। নিজ পৌর এলাকা, জেলা, সমগ্র দেশের জনগণের সেবা করার সুযোগ পেয়েছেন। রাজনৈতিক জ্ঞার্নাজন, নেতৃত্বের গুণাবলী সকল দায়িত্ব সফলতার সাথে পালন করে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। একথা অনস্বীকার্য সংগঠনে অর্থাৎ নেতৃত্বের প্রশ্নটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। নেতার সাংগঠনিক যোগ্যতা দলের ভিত্তি, বিকাশ প্রসার ঘটায়। মানুষের দ্বারপ্রান্তে পৌছায়। তরিকুল ইসলামের নেতৃত্বের গুণাবলী যশোরে জাতীয়তাবাদী দলের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপনে সহায়ক হয়েছে।
স্পষ্টবাদী বলিষ্ঠ আপোষহীন নেতৃত্বের অধিকারী তরিকুল ইসলাম, মানুষকে ভালোবেসেছেন, আপন করে নিয়েছেন, বিপদ আপদে ছুটে গিয়েছেন তাদের কাছে সাধারণ মানুষের পাশে দাড়িয়েছেন রাজনীতির মঞ্চে ময়দানে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদী কন্ঠ, ব্যক্তি জীবনে কারুর সাথে শত্রুতা পুষে রাখেননি। দলমত নির্বিশেষে সকলের সাথে মেলামেশা করেছেন, সবার সাথে সহ-অবস্থানে থেকেছেন। রাজনীতির অঙ্গনের বাইরে সাংস্কৃতিক, ক্রীড়াঙ্গনে তার পদচারণা সর্বজনবিদিত, বিশেষ করে ক্রীড়াঙ্গনে তার সরব উপস্থিতি ও অবদান স্মরণীয় হয়ে আছে। যশোর জীবনে তার সম-সাময়িকেরা রাজনীতি করা বন্ধুরা যাদের সাথে আমার ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার সুযোগ হয়েছে সে প্রেক্ষিতে তরিকুল ইসলামের বিশেষ বৈশিষ্ট্য বারবার স্মরণে আসে। অনেকেই রাজনীতিতে দল বদলিয়েছেন। জাতীয় পর্যায়ে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদদের দল বদলানোর ঘটনাও আমাদের জানা। অনেকেই রাজনীতির দল বদলিয়েছেন, কিন্তু তিনি ছিলেন অনড়। শত নির্যাতন, প্রলোভনেও তিনি দল পরিবর্তন করেননি, পথভ্রষ্ট হননি। নিজ নীতি, দলীয় আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সরকারী দল-বিরোধী দলের রাজনীতির নিয়মরীতি মেনে জীবন পরিচালনা করেছেন। মানুষের ভালবাসা পেয়েছেন। আওয়ামী সরকারের শাসন আমলে বিরোধী প্লাটফর্মে থাকা বহু মামলার আসামি তরিকুল ইসলামের চির বিদায় মানুষকে শোকাভিভুত করেছে; ঘরে আটকিয়ে রাখতে পারেনি ছুটে চলেছে- জনতার ঢল নেমেছে শেষ দেখার জন্য, জানাযা পড়ার জন্য; দোয়া করার জন্য শ্রদ্ধা ভালবাসায় আপ্লুত হয়েছে মানুষ। অশ্রু সজল নেত্রে বিদায় জানিয়েছে, যশোরের ইতিহাসে ওই বিশাল জনসমাবেশ স্মরনীয় হয়ে থাকবে। তরিকুল ইসলামকে ভুলবে না ভুলতে পারবে না। চির জাগরুক হয়ে থাকবেন মনের মনি কোঠায়; সকলের দোয়া মহান আল্লাহ রাব্বুল আল-আলামিন তার কর্মের প্রতিদান দিন- জান্নাত নসিব করুন, আমিন।

[লেখক : মোহাম্মদ জাকারিয়া,
সাবেক সাধারণ সম্পাদক যশোর জেলা ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র সংসদ
মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়]