জননেতা তরিকুল ইসলাম : একটি নাম, একটি আদর্শ

0

অধ্যাপক মশিউল আযম ।। ৪ নভেম্বর, যশোরসহ দক্ষিণবঙ্গ তথা দেশব্যাপী গণমানুষের কাছে একটি শোকের দিন, বেদনার দিন, স্বজন হারানোর দিন। গত ২০১৮ সালের এ দিনে পাঁচ বছর আগে আমাদের সকলকে কাঁদিয়ে শোক সাগরে ভাসিয়ে আমাদের প্রিয়জন নেতা তরিকুল ইসলাম না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। সেখান হতে কেউ কোনদিন আর ফিরে আসে না।
ওইদিন বিকেল ৫ টায় ঢাকা অ্যাপোলে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যু সংবাদ মুহূর্তের মধ্যে বাতাসের বেগে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সাথে সাথেই ঢাকাসহ আশপাশের এলাকার নেতাকর্মীরা হাসপাতালে দ্রুত ছুটে যান। আবার অনেকে পরিবার-পরিজনদের সমবেদনা জানাতে আসেন যশোর শহরের তাঁর বাসভবনে।
পরদিন ৫ নভেম্বর একটি বিশেষ বিমানযোগে তাঁর মরদেহটি ঢাকা থেকে যশোর আনা হয়। যশোর বিমানবন্দরে লাশটি গ্রহণের জন্যে হাজার হাজার ভক্ত ও কর্মী ভিড় জমান। অতিরিক্ত ভিড়ের চাপে সেদিন বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বেষ্টনি ভেঙে পড়ে। সৃষ্টি হয় অচলাবস্থা। ফলে, নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত কর্মীদের খেতে হয় হিমশিম। সেখান হতে মরদেহটি একটি গাড়িবহর শোভাযাত্রা সহকারে তাঁর বাসভবনে আনা হয়। সেখানেও আপেক্ষামান ছিলেন শোকার্ত হাজার হাজার ভক্ত ও কর্মী। সকলে তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখানে সৃষ্টি হয় এক শোকার্ত পরিবেশ।
বাদআসর যশোর কেন্দ্রীয় ঈদগাহে তাঁর নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ওই জানাজায় শরিক হতে ও তাদের প্রাণপ্রিয় নেতার মুখখানি শেষবার দেখতে যশোর শহর অভিমুখে ছুটতে থাকেন জনতা। মানুষের ঢল নামে। সকাল ১০টার পর হতেই খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে হাজার হাজার কর্মী-ভক্তরা তাঁর ঘোপের বাসভবন ও শহরে জমায়েত হতে থাকেন। চারিদিকে, লোকে লোকারণ্য। শহরটি সেদিন পরিণত হয় এক বিশাল জনসমুদ্রে। জনতার ভিড়ে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা যানবাহনের প্রচন্ড চাপে সেদিন শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ অচল। কেননা, তরিকুল ইসলামের জানাজাটি ছিল যশোর জেলার স্মরণকালের ইতিহাসে বৃহত্তম জানাজা। ঈদগাহ কানায় কানায় পূর্ণ হবার পর তা ছাপিয়ে পার্শ্ববর্তী দক্ষিণে সার্কিট হাউজ, পূর্বে প্রধান ডাকঘর, উত্তরদিকে দড়াটানা, পশ্চিমে শিল্পকলা একাডেমি ও সিভিল সার্জন অফিস পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ওই নামাজে জানাজায় শরিক হতে ঢাকা থেকে আগত কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন মঈন খান, নিতাই রায় চৌধুরীসহ অনেকেই।
এরপর যশোর শহরের কারবালা গোরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়। সেখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত হন এই মহান নেতা। তিনি কত বড় মাপের নেতা ছিলেন, কতটা মাটি ও মানুষের হৃদয়ের খুব কাছাকাছি ছিলেন, সেদিনকার জনসমাগমেই তা প্রমাণিত হয়েছে দেশবাসীর কাছে।
১৯৪৬ সালের ১৬ নভেম্বর যশোর শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আলহাজ্ব আব্দুল আজিজের ঘরে, মা নুরজাহান বেগম এই শিশুটির জন্ম দেন। তাদের ৬ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয় অর্থাৎ সেজো। শৈশবকালে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন যশোর জিলা স্কুলে। ১৯৬১ সালে সেখান হতে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর যশোর এমএম কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯৬৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ১৯৬৬ সালে একই কলেজ হতে অর্থনীতিতে অনার্সসহ স্নাতক পাশ করেন। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতিতে এমএ পাশ করেন।
যশোরের এই কৃতী সন্তান তরিকুল ইসলাম ষাটের দশকে ছিলেন এদেশের একজন তুখোড় ছাত্রনেতা। তিনি সে সময় হতে প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনে এক বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তিনি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিন্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ভাসানী ন্যাপে যোগদান করেন এবং এদেশের প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে দেশব্যাপী রাজনীতিক কর্মকান্ডে নিজেকে ব্যাপৃত করেন। এ সময় তিনি নিজ এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় কৃষক সংগঠনেরও নেতৃত্ব প্রদান করেন। ‘৭০-এর নির্বাচনোত্তর উত্তাল আন্দোলনমুখর দিনগুলোতে তিনি বৃহত্তর যশোর জেলায় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে জাতির ক্রান্তিলগ্নে গুরু দায়িত্ব পালন করেন।
এদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি, একটি শোষণ ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, বাক স্বাধীনতা ইত্যাদি দাবি আদায়ের সংগ্রামে তাঁকে বহুবার কারাবরণ করতে হয়েছে। বলাবাহুল্য দক্ষিণবঙ্গের আর কোনো নেতাকে এতবার ও এত দীর্ঘ সময় কারাভোগ ও নির্যাতন সইতে হয়নি। ১৯৬৬ সালে এমএম কলেজে ছাত্রদের সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বদানে তৎকালীন এমএনএ আহম্মদ আলী সরদারের দায়েরকৃত মামলায় জেলখানায় যান। এরপর ১৯৬৮ সালে আয়ূব সরকারবিরোধী ও ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালীন সময়ে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্বদানের জন্যে পুলিশি নির্যাতন ও হাজতবাস করতে হয় তাঁকে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, তদানীন্তন পাকিন্তান সরকারবিরোধী আন্দোলনে জড়িত থাকার অপরাধে ১৯৬৬-৬৮ সালে রাজবন্দী হিসেবে রাজশাহী ও যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে যেতে হয়। তাঁর সাথে কলেজের শিক্ষক ও ছাত্র নেতারাও গ্রেফতার হন এবং জেল খাটেন। ওই সময়ে শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন অধ্যক্ষ আব্দুল হাই, অধ্যাপক শরীফ হোসেন, অধ্যাপক গাজী লুৎফর হোসেন, অধ্যাপক তরিবর রহমান ও অধ্যাপক আবু তাহের। ছাত্রনেতাদের মধ্যে ছিলেন তরিকুল ইসলাম, নূর মোহাম্মদ, আমজাদ হোসেন, খালেদুর রহমান টিটো, গোলাম মোস্তফা, এনামুল হক, আসাদুজ্জামান, আব্দুল মতিন, জাকারিয়া মিলন ও সিরাজুল ইসলাম বুলবুল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও ৬/৭ বারের বেশি সময় দায়েরকৃত রাজনৈতিক মামলায় কারাবরণ করতে হয়। ১৯৭৫ সালের ৭ই এপ্রিল বিশেষ ক্ষমতা আইনে তিনি গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যান। ওই সময়ে একই সাথে তাঁর দুই বন্ধু মাহবুবুর রহমান ও মাস্টার নূর জালালকেও আটক করা হয়। তিন মাস কারাভোগের পর মুক্তিলাভ করেন তিনি।
১৯৮২ সালে এরশাদ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর এবং ১৯৮৩ সালের এপ্রিল মাসে আবারও বিশেষ বাহিনীর হাতে তিনি আটক হন। ওই সময় দীর্ঘ তিন মাস ধরে নিখোঁজ থাকেন। তাঁকে ওই সময়ে বন্দি অবস্থায় নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। তথাকথিত এরশাদ হত্যাচেষ্টা মামলায় প্রধান আসামি হিসেবে নয় মাস ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। অবশেষে তাঁকে নিঃশর্তভাবে মুক্তি দেয়া হয়। ওই সময়ে তাঁর সাথে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলেন আলী রেজা রাজু, অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা, অধ্যাপক শেখ আব্দুল ওহাব, অধ্যাপক ইয়াকুব, অ্যাড. কাজী মুনিরুল হুদা, অ্যাড. ইসহক, আব্দুস সালাম আজাদ, ইউসুফ আলী, শাহীন, আবু মোর্ত্তজা ছোট, কচি ও মিনু।
পরবর্তীকালে ২০০৭ সালে ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারি হলে তিনি আবারও গ্রেফতার হন। দীর্ঘ ১৮ মাস কারাভোগের পর মুক্তি লাভ করেন। এরপর ২০০৯ সালের পর তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হতে থাকে। এমনকি ২০১৮ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্তও তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। মামলা তাঁর পিছু ছাড়েনি। জেলখানা ও মামলাই ছিল জীবনে তাঁর একমাত্র নিত্যসঙ্গী।
তরিকুল ইসলামের দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিযাত্রার উল্লেখযোগ্য দিনগুলোর মধ্যে ছিল প্রেসিডেন্ট জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি গঠন প্রক্রিয়ায় ভাসানী ন্যাপ প্রধান মশিয়ার রহমান যাদু মিয়ার সাথে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা। তিনি ১৯৮২ সালে ৫ মার্চ সড়ক ও রেল মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বপ্রাপ্ত হন এবং বিএনপি সরকারের আমলে ১৯৯১ সালে সমাজ কল্যাণ ও মহিলা বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী, ১৯৯২ সালে একই মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হন। ওই সময়ে ডাক ও টেলি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী ও পরবর্তীতে পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্বপ্রাপ্ত হন।
পরবর্তীকালে ২০০১ সালে বিএনপি সরকার পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর খাদ্য মন্ত্রণালয়, তথ্য এবং পরিবেশ ও মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দেশের একটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দল পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। যোগ্যতা, মেধা প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার সাথে দায়িত্ব পালনের জন্য ১৯৮৩ সালে তাঁকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, একই সময়কালে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের মত গুরু দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তিনি ছিলেন স্পষ্টবাদী, হক কথায় পারঙ্গম ও জনদরদী রাজনীতিক। আমৃত্যু তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও দূরদর্শীতার কারণে তিনি দলের নীতিনির্ধারণ কমিটির অন্যতম ছিলেন। দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও অনেক সিনিয়র নেতাদের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল। সকলেই তার মতামতকে খুবই গুরুত্ব ও প্রাধান্য দিতেন।
এবার আমি তরিকুল ইসলামকে নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক কিছু লেখনী লিখে যেতে চাই। এর সবই একটি জীবন্ত ইতিহাস, কোন কল্পনা-প্রসূত বা গল্পকাহিনী নয়। এটি তুলে না ধরলে সবই অজানা থেকে যাবে আগামী প্রজন্মের কাছে। তা সম্ভবপর হয়েছে বিভিন্ন কারণে। ষাটের দশক হতে খড়কীতে থেকে যশোর মুসলিম একাডেমি স্কুল, এমএম কলেজের ছাত্র হিসেবে পড়াশুনা, শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা ও উন্নয়ন কর্মী হিসেবে আমার বিচরণ ছিল সব মহলে। ফলে, এই মহীরুহকে খুব কাছ থেকে সুদীর্ঘকাল দেখার ও সান্নিধ্য লাভের সুযোগ হয়েছেন বহুবার। তার স্ত্রী, নার্গিস বেগমের বাবা, তাঁর শ্বশুর আব্দুল হাসিব ছিলেন আমার অগ্রজ সাংবাদিক। তাঁদের বড় ছেলে সুমিত আমার বড় মেয়ের সাথে মোমিন গার্লস স্কুলের শিক্ষক আব্দুল ওহাব স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তেন। নানা সুবাদে উভয় পরিবারের মাঝে ছিল ঘনিষ্ঠতা ও যাতায়াত। ছোট ছেলে অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির খুলনা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নানা কারণে আমার প্রতি তাঁর দুর্বলতা রয়েছে। আমাকে সব সময় চাচা হিসেবে সম্বোধন করে খুবই শ্রদ্ধাভরে বিনয়ের সাথে কথা বলেন। সাংবাদিক হিসেবে জেলার বিভিন্ন স্থানে তরিকুল ইসলামের সফর সঙ্গী হয়েছি বহুবার। সার্কিট হাউজ, রেস্টহাউজ প্রভৃতি স্থানে তিনি নিজে খাবার টেবিল হতে উঠে এসে খোঁজ নিতেন আমরা ঠিকমত খাবার খাচ্ছি কি না?
একটি মজার ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হয়। আমাদের এলাকায় দৌলতদিহি গ্রামের আব্দুল হাই তরফদার ছিলেন তাঁর একজন নিবেদিত প্রাণকর্মী ও ভক্ত। শীতকালে একদিন বিকেলে চুড়ামনকাটি বাজারে তাকে ছুটাছুটি করতে দেখি। বললাম : কি ব্যাপার এত অস্থির মনে হচ্ছে কেন আপনাকে ? তিনি খোলামেলা বললেন, নেতা সন্ধ্যারস খেতে চেয়েছেন। গ্রাম থেকে সন্ধ্যা রস নিয়ে শহরে তাঁর বাসায় যেতে হবে। আবার আমার ছাত্র সাতমাইলের ডা. আবু তোহাকে অনেকবার দেখেছি ঢাকা ও যশোরের বাসভবনে। ডায়াবেটিসের ওষুধ, গাছ বয়ে নিয়ে যেতে। একজন নেতার প্রতি ওই শ্রদ্ধা-ভালোবাসার কোনো তুলনা হয় না।
১৯৯৪ সালে তিনি তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। কর্মবীর মুন্সী মেহেরুল্লাহর ১৩৩তম জন্মবার্ষিকীতে তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। ওই বছরই ঝাউদিয়া মেহেরুল্লাহ একাডেমি হতে ছাতিয়ানতলা গ্রামের মুন্সী মেহেরুল্লাহর মাজার পর্যন্ত রাস্তা পাকাকরণের ব্যবস্থা করা হয়।
পরবর্তী বছর ১৯৯৫ সালে কর্মবীর মেহেরুল্লাহর ৮৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ৮ জুন এই মহান ব্যক্তির ওপর বাংলাদেশ টেলিভিশনে মেহেরুল্লাহ স্মরণে একটি আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আলোচক হিসেবে তরিকুল ইসলাম, ড. শমসের আলী, অধ্যাপক হাসান আব্দুল কাইয়ুমসহ আমারও অংশ নেবার কথা ছিল। কিন্তু অনিবার্য কারণে এর তিন দিন আগে আমাকে যশোরে ফিরে আসতে হয়। কেননা, ঢাকা টেলিভিশন থেকে কবি আব্দুল হাই শিকদারের নেতৃত্বে মেহেরুল্লাহর স্মৃতি বিজড়িত স্থানসমূহ টিভিতে ধারণ করা হবে। আমাকে আগে থেকেই সার্বিক যোগাযোগ ও কর্মক্ষেত্র প্রস্তুত রাখতে হবে। অবশেষে তরিকুল ইসলাম আমার হাতে সেদিন অনুষ্ঠানের পূর্বেই কয়েকটি স্মারক খাম তুলে দেন। আমি সেগুলি সংশ্লিষ্ট মহলে পৌঁছে দিই। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সেদিন স্মারক ডাক টিকেটের উদ্বোধন করেন। আগেই আব্দুল হাই শিকদার বিভিন্ন এলাকা ও মহলে গিয়ে মেহেরুল্লাহর উপর চিত্র ধারণ করেন। এখানে আমার সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। পরে এটি প্রকাশিত হয় এবং কৃতজ্ঞতা স্বীকারে আমার নামটি কথিকাতে শ্রদ্ধার সাথে উল্লেখ করেন, তাঁকে সার্বিক সহযোগিতার জন্যে।
ওই সময় জনগণের সুবিধার্থে তরিকুল ইসলাম চূড়ামনকাটি ইউনিয়ন পরিষদ পোস্ট অফিস সংলগ্ন একটি কার্ডফোন বুথ স্থাপন করেন। সেখানে পাঁচ টাকার কয়েন ওই বক্সে ফেললেই টেলিফোনে সেবা পাওয়াতে আর্থিক সাশ্রয় ও সময়ের অপচয় হতে রেহাই পান ও উপকৃত হন সাধারণ মানুষ।
একটি স্মৃতির কথা উল্লেখ না করলে নিজের কাছে আমি অপরাধী থেকে যাবো। আয়ূব সরকারবিরোধী আন্দোলনের ফলে ছাত্র সংসদের নেতা, কলেজের শিক্ষকসহ অনেকেই গ্রেফতার হন। (যা আমি আগেই উল্লেখ করেছি এই লেখার মধ্যে)। আমি ছিলাম ছাত্র সংসদের সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদক। বিতর্ক সম্পাদক উজির আহমেদ খাঁন ও ক্রীড়া সম্পাদক আতাউল হক মল্লিক। আমাদের তিনজনকে কোথাও যেতে হয়নি। তরিকুল ইসলাম যশোর জেলখানা হতে আমাকে একটি চিরকুটে লিখেন ; ছাত্র সংসদকে চলমান রাখতে হবে। এতে কোন শিথিলতা যেন না আসে। এই চিঠিই আমাকে সাহস অনুপ্রেরণা জোগায়। ছাত্র সংসদের সকল কর্মকান্ড ঠিকমত পরিচালনা ও চলমান রাখি। ওই সময়ে যশোর পূর্বাঞ্চল প্রেস হতে ছাত্র সংসদের বার্ষিক ম্যাগাজিন ছাপা হয়। ২৬৭ পৃষ্ঠার এই বার্ষিক ম্যাগাজিনটি যশোর এমএম কলেজের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ম্যাগাজিন হিসেবে পরিগণিত হয়। বার্ষিকীর জন্যে বরাদ্দকৃত সম্পূর্ণ টাকা ব্যয় করি ছাপার কাজে। এটি সম্ভব হয়েছিল তরিকুল ইসলামের ছোট একটি চিরকুটের কারণেই।
ঢাকা মিন্টো রোডে মন্ত্রীপাড়ায় মন্ত্রীরা থাকেন। আমি সকাল নয়টার আগেই বাসায় পৌঁছে যেতাম। তার একান্ত সচিব হাফিজ আমাকে সরাসরি মন্ত্রীর বেড রুমে নিয়ে যেতেন। অনেকের সেখানে প্রবেশের অনুমতি ছিল না। আমি আবার মন্ত্রীর গাড়িতেই সচিবালয়ে ঢুকতাম। কলেজ, বাঁচাতে শেখা ও বিভিন্ন কাজ সেরে যখন বাইরে আসতান তখন সচিবালয়ে দীর্ঘ লাইন। অপেক্ষাগারে সাক্ষাত, প্রার্থীদের ভিড়। আরেকটি ঘটনা বর্ণনা না করে পারছি না। ১৯৯৬ সাল, বিএনপি তখন ক্ষমতায়। আমি তখন যশোর জেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও কাজী শওকত শাহী সম্পাদক। আমাদের শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা, দাবি ও অধিকার আদায়ের আন্দোলনে দেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা বন্ধ করে রাজপথে নামি।
আমাদের দাবির প্রতি কোন সাড়া পাচ্ছিলাম না সরকারের কাছ থেকে। যশোরের শিক্ষক সমাজ শিক্ষক ফেডারেশনে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাদের কাছের মন্ত্রী তরিকুল ইসলামকে বিষয়টি প্রথমে জানাতে ও বোঝাতে হবে। যশোর মুসলিম একাডেমীতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমরা তাঁকে আমন্ত্রণ জানাই। তিনি আমাদের ডাকে সাড়া দেন। ধৈর্য ধরে আমাদের সকলের বক্তব্য শোনেন এবং কথা দেন আমাদের এই দাবিগুলো সরকারের কাছে তুলে ধরবেন। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি, অথচ তিনি আমাদের কাছে আসবেন, আমাদের পাশে থাকবেন আমরা তা ভাবতেও পারিনি। একমাত্র তরিকুল ইসলামের মতো উদার মনের মানুষের পক্ষেই সেটি সম্ভব। আমরা সফল হয়েছিলাম আমরা সফল হয়েছিলাম এবং শিক্ষক সমাজের জন্য কিছু আর্থিক সুবিধা লাভ করতে সমর্থ হয়েছিলাম। ওই সময়ে তিনি ব্যক্তিগত তহবিল থেকেও ২৫ হাজার টাকা অনুদান হিসেবে শিক্ষক সমিতিকে প্রদান করেন।
১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টা, সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি এখনও এলাকার মানুষ ভোলেনি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন দূরবর্তী এলাকার ভোটারদের আনা নেয়ার জন্যে একটি ট্রাকের ব্যবস্থা করা হয়। তরিকুল ইসলাম ছিলেন সেই নির্বাচনের একজন প্রার্থী। ভোটারদের বহনকারী ট্রাকটি মেহেরুল্লাহ নগর, রেলস্টেশনের রেলক্রসিং পার হওয়ার মুহূর্তেই হঠাৎ ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। ঠিক ওই মুহূর্তে খুলনা থেকে রাজশাহীগামী একটি ট্রেন রেলক্রসিং অতিক্রম করছিল। ট্রেনের ধাক্কায় ট্রাকটি উল্টে পড়ে। দ্রুতগামী মেল ট্রেনের চালক ট্রেনের বাঁশি বাজালেও তাতে কাজ হয়নি। দুইজন ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন ছাতিয়ানতলা গ্রামের জহুরুল আজিজের ছেলে যশোর এমএম কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রওশন আজিজ ও দোগাছিয়া গ্রামের খোরশেদ আলীর ছেলে ৭ম শ্রেণির ছাত্র আব্দুল হক। দুর্ঘটনায় ৫/৬ জন আহত হয়। দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পরপরই তরিকুল ইসলাম ঘটনাস্থলে দ্রুত পৌঁছান। তিনি বলেন, আমার ভোটের দরকার নেই। আহতদের আগে বাঁচান। চিকিৎসার যাবতীয় দায়িত্ব ও ব্যয়ভার তিনি বহন করেন। শোকার্ত পরিবারের পাশে সমবেদনা জানাতে ছুটে যান তাদের বাড়িতে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ওই পরিবারগুলির পাশে ছিলেন তিনি।
২০০৩ সালে কাজী নজরুল ইসলাম কলেজে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে তরিকুল ইসলামকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অনুষ্ঠানস্থলে মঞ্চে মন্ত্রীর আসনের পাশেই আসন গ্রহণ করেন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল বারী। ওই বিষয়টি নিয়ে তখন সকল মহলে মুখরোচক, আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়। তাহলে আব্দুল বারী দলত্যাগ করে বিএনপিতে যাচ্ছেন ? ওই অনুষ্ঠানে তিনি তরিকুল ইসলামের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, তরিকুল ইসলাম শুধু যশোরের মন্ত্রী নন, তিনি দেশেরও একজন মন্ত্রী। ফলে, তাঁর পাশে বসা যায়। এ না হলে তরিকুল ইসলাম। রাজনৈতিক অঙ্গণে তিনি ছিলেন এক আলাদা জগতের ভিন্ন ধর্মী মানুষ, খাঁটি পরীক্ষিত একজন রাজনীতিবিদ।
১৯৯৬ সাল প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া যশোরের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধন করবেন। প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে তিনি মহাব্যস্ত। এর মাঝে আগেরদিন রাতে সাংবাদিক হারুন জামিলকে দিয়ে জানতে চান দাওয়াতপত্র পেয়েছি কি-না ? শত ব্যস্ততার মাঝে কিভাবে সম্ভব ? এটি তরিকুল ইসলামের পক্ষেই শোভা পায়।
তাঁর শরণাপন্ন হয়ে কোন সাহায্য ও সহযোগিতা চেয়ে কাছে গেলে কাউকে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরতে হয়নি কখনও। দলমত নির্বিশেষে এমনকি পিয়ন, আয়া, মালী, পরিচ্ছন্নকর্মী নিয়োগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করেছেন। তিনি বলতেন, এরা কোথায় যাবে, আমার কাছে এসেছে বড় আশা নিয়ে। পরিশেষে আমাকে বলতে হয়, তরিকুল ইসলাম এদেশে বারবার জন্মে না। তাঁর মত প্রজ্ঞাবান, বিচক্ষণ, নিবেদিত প্রাণ ত্যাগী জনদরদী নেতা দেশে একবারই জন্মে।
(মো. মশিউল আযম প্রবীণ সাংবাদিক, লেখক ও উন্নয়ন কর্মী)