জাতীয়তাবাদের একজন আদর্শবান নেতা

0

কামরুল ইসলাম গোরা
আমার রাজনৈতিক গুরু ও রাজপথের বহু সংগ্রামের পথ প্রদর্শক মরহুম তরিকুল ইসলাম ছিলেন দেশ সেবায় নিবেদিত একজন আদর্শবান নেতা। তিনি ছিলেন রাজনৈতিক প্রজ্ঞায়, সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতায় ও সংগ্রামে-সমরে দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। বহু গুণের সংমিশ্রণে একজন সত্যিকার জাতীয়তাবাদের আদর্শিক নেতা ছিলেন তিনি। প্রিয় নেতা তরিকুল ইসলামের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর বিশাল কর্মময় জীবনের তুলনায় এই স্মৃতিচারণের শ্রদ্ধার্ঘ নিতান্তই তুচ্ছ।
বীর মুক্তিযোদ্ধা, দেশ বরেণ্য রাজনীতিবিদ, স্বৈরাচারের পতন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের লড়াকু সৈনিক, সাবেক সফল মন্ত্রী এবং বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য জননেতা তরিকুল ইসলাম ছিলেন দক্ষিণ বাংলার মানুষের একজন অবিসংবাদিত নেতা। ছাত্র জীবন থেকেই তাঁর সহজাত নেতৃত্বগুণ বিকশিত হয়েছিল।
শুরুতে বাম ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে তিনি ১৯৬৩-১৯৬৪ শিক্ষাবর্ষে যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পাকিস্তান সরকারের রক্তচক্ষূ উপেক্ষা করে ওই কলেজের শহীদ মিনার মেরামত করায় তাঁকে কারাবরণ করতে হয়েছিল। ১৯৬৮ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন করে দীর্ঘ সময় রাজশাহী ও যশোরে কারাভোগ করেন।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়ায় আবারো কারাভোগ করেন তিনি। অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনকারী এই নেতা একাত্তরে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন অমিত বিক্রমে। তিনি ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে মহান স্বাধীনতার ঘোষক ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অন্যতম সংগঠক তরিকুল ইসলাম
বিএনপির প্রথম আহ্বায়ক কমিটির ৭৬ সদস্যের অন্যতম ছিলেন। তিনি যশোর জেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন আহবায়ক ও পরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়াও তিনি বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, ভাইস চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় তিনি সকল স্তরের নেতা-কর্মীদের কাছে অনুকরণীয় ছিলেন এবং এখনও আছেন। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সরকারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ৩টি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এতগুলো পদের অধিকারী হয়েও তিনি ছিলেন একজন নিরাহংকার মানুষ।
নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের কাছে তিনি বটবৃক্ষের মতো আশ্রয়স্থল ছিলেন। পদ্মার এপারে বিএনপির সুদিন বা দুর্দিনে যে কোন নেতা-কর্মীর পাশে তিনি অভিভাবকের মতো দাঁড়িয়েছেন। তবে নিজস্ব মতাদর্শে তিনি ছিলেন নির্ভীক ও দৃৃঢ়প্রত্যয়ী। নিজের আদর্শ থেকে কোন ভাবেই তাকে বিচ্যুত করার সুযোগ তিনি দিতেন না।
তরিকুল ইসলাম ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় ১৯৭৮ সালে। এরপর থেকে নিয়মিত কর্মী সভা, বর্ধিত সভা, জনসভাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। খুব কাছ থেকে তার রাজনীতি দেখার সুযোগ হয়েছে, যার জন্য নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। তাঁর রাজনৈতিক কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করা আমার রুটিন কাজে পরিণত হয়েছিল। তরিকুল ভাইয়ের সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব ও সাংগঠনিক দক্ষতায় খুলনা বিভাগে বিএনপি খুব দ্রুত শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়। অবশ্য এজন্য তাঁকে বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। বারবার কারাবরণসহ নিপীড়ন-নির্যাতন সহ্য করেও নিষ্ঠা ও সাহসিকতার সাথে অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে তার নির্ভীক নেতৃত্ব আমাদের প্রেরণা যুগিয়েছে। মন্ত্রী হিসেবে দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে তিনি নিবেদিতভাবে কাজ করতেন।
জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কল্যাণে গণমানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়ে সামাজিক ন্যায়বিচার ভিত্তিক শোষণমুক্ত সমাজ ও গণতান্ত্রিক, মানবিক ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ছিল তরিকুল ইসলামের রাজনীতির মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্যে তিনি নিরলসভাবে কাজ করেছেন আজীবন। তাঁর রাজনীতি আমাদের সবসময় অনুপ্রেরণা যোগায়। দেখেছি যখনই গণতন্ত্র বিপদাপন্ন হয়েছে তখনই স্বৈরাচারের কবল থেকে দেশকে গণতন্ত্রের পথে উত্তরণে মরহুম তরিকুল ইসলাম ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। প্রকৃত গণতন্ত্রে বিশ্বাসী প্রগতিশীল এই রাজনীতিবিদ পিতা হিসেবেও ছিলেন সফল। তিনি তার দুই সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। পিতার দর্শন ও আদর্শে তাঁর সন্তানদ্বয় সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও স্বমহিমায় উদ্ভাসিত।
তার জানাযায় শরিক হতে গিয়ে অসংখ্য কর্মীর অশ্রুসিক্ত বেদনার্ত মুখ প্রমাণ করেছে নেতা তরিকুল ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা। প্রিয় নেতা তরিকুল ইসলামের চির প্রস্থান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের জন্য অপুরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। তাঁর দেখানো পথে আজও হাজার হাজার নেতা-কর্মী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শ ধারণ করে দেশ গঠনে কাজ করছেন। তরিকুল ইসলামের প্রতিষ্ঠিত দৈনিক লোকসমাজ পত্রিকার মাধ্যমে প্রিয় নেতার আদর্শময় জীবনের স্মৃতিকথা নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যাক এই কামনা করি। আল্লাহ আপনাকে (তরিকুল ইসলামকে) বেহেস্ত নসিব করুন। আমিন।
লেখক : শেখ কামরুল ইসলাম গোরা, সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাগেরহাট জেলা শাখা।