আবু নাসের অনীক ।। ‘মাস্টার মানইন্ড’ এই শব্দটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে ২৪ অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বেশ আলোচিত হয়েছে। মাস্টার মাইন্ডের ধারণাটি ১৯২৫ সালে লেখক নেপোলিয়ন হিল তার ‘দ্য ল অফ সাকসেস’ বইয়ে উল্লেখ করেছিলেন এবং তার ১৯৩৭ সালের ‘থিঙ্ক অ্যান্ড গ্রো রিচ’ বইতে আরও বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছিলেন।
হিল মাস্টার মাইন্ডের ধারণা সম্পর্কে বলেন, ‘যেখানে সমস্যা সমাধানের জন্য দুই বা ততোধিক লোককে একত্রিত হওয়া ‘মাস্টার মাইন্ড’ একক ব্যক্তিকে নির্দেশ করে। পজিটিভ এবং নেগেটিভ দুইটি বিষয়েই মাস্টার মাইন্ড থাকতে পারে।’
প্রধান উপদেষ্টা ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ’-এ বলতে যেয়ে মাহফুজ সম্পর্কে বলেন, “ এটি একটি সূক্ষ্মভাবে পরিকল্পিত জিনিস ছিল। এটি হঠাৎ করে আসেনি। এমনকি নেতৃত্বও (তাকে) চিনতে পারেনি তাই তারা তাকে ধরতে পারেনি, ছাত্ররা”, “বাংলাদেশের একটি নতুন সংস্করণ” তৈরি করছে, তারা “সাহসিকতার সাথে বুলেটের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে । বিশ্ব পরিসরে সম্মানিত প্রধান উপদেষ্টার ছাত্র সন্বয়কদের প্রতি অতিমাত্রায় ব্যক্তি কৃতজ্ঞতার প্রকাশ হিসাবে ২৪ এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ‘মাস্টার মাইন্ড’ এর অস্তিত্ব ঘোষণা করা এবং তাঁর সাথে তিনি যে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন সেটি দেশের একজন সাধারণ নাগরিক এবং এই আন্দোলনের একজন এক্টিভিস্ট হিসাবে প্রত্যাখ্যান করছি।
এটাও বলছি আপনার এই বক্তব্য গোটা জাতিকে বিভক্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পতিত ফ্যাসিস্টের সেইসময়ের বক্তব্যের পক্ষে সামাজিক জনসম্মতি উৎপাদনে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। আপনার এই বক্তব্যে আমেরিকা খুশি হলেও আমরা খুশি হতে পারছিনা। কেন এমনটা বলছি সেটিই এখানে আলোচনা করবো।
৫ জুন সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে কোর্ট রায় দেয়।
৬ জুন সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা পুনর্বহালে আদালতের দেওয়া রায় বাতিলের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ করে ছাত্ররা। ৯ জুন শিক্ষার্থীরা তাঁদের দাবি মানতে সরকারকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন। সরকার ছাত্রদের দাবি পূরণের প্রশ্নে উদাসিন থাকে এবং হাইকোর্টে দেখিয়ে দেয়। অন্যদিকে ৯ জুলাই হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে দুই শিক্ষার্থী আবেদন করে। একইসাথে অবরোধ, ব্লকেড এ ধরনের কর্মসূচি পালন করতে থাকে। ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে কোটা প্রসঙ্গে বলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরা পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে!”।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর এই কটাক্ষে ক্ষিপ্ত হয়েই ছাত্রদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে শ্লোগানে “আমি কে? তুমি কে? রাজাকার, রাজাকার! কে বলেছে, কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার!”। ছাত্রদের এই শ্লোগানকে ইস্যু করে সারা দেশে ছাত্রলীগ আন্দোলনকারী ছাত্রদেরকে নির্মমভাবে পেটায়। অহিংস আন্দোলনটি ১৬ জুলাই দিবাগত রাত থেকেই সহিংস হয়ে ওঠে। ইতিমধ্যেই সারা দেশে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ৬ জন।
রংপুরে আন্দোলনকারী বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের বুলেটে নিহত হওয়ার সচিত্র ছবি প্রকাশ পায়। জনমানুষের মধ্যে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এটি ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। রাজধানীসহ সারা দেশে আরো বহু সংখ্যক ছাত্র-জনতা ছাত্রলীগ নামধারী এই দানবদের হামলার শিকার হয়।
২১ জুলাই পর্যন্ত ৩২ জন হত্যার শিকার হয়। এই যে হত্যা শুরু করলো ফ্যাসিস্ট সরকার, এটাই সে তার পতনের পথ নিজেই তৈরি করে নিলো। কারণ দুই দিনের ব্যবধানে কোন আন্দোলনে বাংলাদেশের ইতিহাসে এত সংখ্যক হত্যার ইতিহাস ছিলো না। ২৪ জুলাই এই হত্যাকান্ডের সংখ্যা দাড়ায় ২০৩। যার মধ্যে বাসার মধ্যে থাকা শিশুও হত্যার শিকার হয়। ক্রমেই হত্যাকা- বাড়তে থাকে। গণগ্রেপ্তার চলতে থাকে। সাধারণ জনতা এর প্রতিক্রিয়াতে আর ঘরে বসে থাকে নাই।
হত্যাকান্ডের শিকার প্রথমে ছাত্ররা হলেও এই সংখ্যার সাথে যুক্ত হয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশাজীবী শত শত মানুষ। সাধারণ জনতা পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে যান। আহত হয় সহস্রাধিক। সন্তান হত্যার প্রতিবাদে অবিভাবকরা রাস্তায় নেমে আসেন। কোন মাস্টার মাইন্ডের পরিকল্পনায় বা আহ্বানে সেটা ঘটে নাই। সন্তানের রক্তই তাদের মধ্যে প্রতিবাদের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ তৈরি করেছিলো।
তৎকালীন সরকার চাইলেই বিনা রক্তপাতে; বিনা ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়েই ছাত্র আন্দোলনকে এড্রেস করতে পারতো। স্রেফ গোর্য়াতুমির কারণে এবং বল প্রয়োগে সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির জন্ম দেয়। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ জনতা নেমে আসে রাস্তায়। এই যে মৃত্যুর ঘটনা সংঘটিত হয় তার কারণেই বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে এককরে ফেলে। আন্দোলনের একটি পর্যায়ে সমন্বয়কদের ৬ জন ডিবি হেফাজতে,আবার অনেকে আত্মগোপনে চলে যান। সেই সময় ছাত্র সমন্বয়কদের বা কথিত মাস্টার মাইন্ডের কোন নির্দেশনা ছিলো না।
অনেকেই অনেক জায়গায় ছোট ছোট গোপন আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিলো। এরকম একটি গ্রুপ আলোচনায় আমি নিজে সেদিন অংশগ্রহণ করেছিলাম। পুরো আন্দোলনটি পরিচালিত হয়েছে স্বতঃস্ফূর্ততায়। ঠিক সেই মুহূর্তে প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন এবং সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠনের নেতৃত্বে ২ আগস্ট প্রেসক্লাব থেকে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে শহীদ মিনারে “দ্রোহযাত্রা” নামে মিছিলের কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়।
প্রেসক্লাব থেকে শহীদ মিনার হাজার হাজার মানুষ দ্রোহযাত্রায় অংশ নেয়। শহীদ মিনার থেকে প্রথম ঘোষিত হয় একদফা। ‘মাস্টার মাইন্ড’ এর নির্দেশনাতে সেই ঘোষণা দেওয়া হয়নি। মিছিলের আওয়াজ, সাধারণ ছাত্র-জনতার ক্ষোভে ফেটে পড়া সেদিন এক দফার আওয়াজে পরিণত হয়। সেদিনই ফেসবুকে আওয়াজ ওঠে ১ দফার। ইহা কোন ‘মাস্টার মাইন্ড’র ব্রেইন থেকে আসে নাই।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান এর সফলতা দাঁড়িয়ে আছে গত ১৫ বছর ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল- ছাত্র সংগঠনসহ বিভিন্ন শ্রেনি-পেশার মানুষের আন্দোলনের উপর। দীর্ঘ একটি সময় ধরে বঞ্চনা, নিপীড়ন, হত্যা-গুম, লুটতরাজ, গুন্ডাতন্ত্র-ক্ষমতাতন্ত্র কায়েম মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিলো। দেশের মানুষ একটি বিস্ফোরক অবস্থায় ছিলো। জুলাই-আগস্ট ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন দেশলাইয়ের কাঠির ভূমিকা রেখেছে। কাঠির আগুনটা ঠিক ওই বিস্ফোরকের মধ্যে যেয়ে পড়েছে। দুইয়ে মিলে চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটেছে। যা একটি সফল ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের ফলাফল তৈরি করেছে। এই সবকিছুই গণঅভ্যুত্থানের অনিবার্যতা তৈরি করেছিলো।
এখন আমাকে বলুন, এই আন্দোলনে ‘মাস্টার মাইন্ড’ বলে কিসের অস্তিত্ব আছে? এইটা কোন প্লান্ড মুভমেন্ট ছিলো না। আন্দোলনের শেষের দিকে বিভিন্ন ইন্টারেস্ট গ্রুপ এক্টিভ ছিলো। নির্বিচারে হত্যাকান্ড চালিয়ে হাসিনা নিজের পতন নিজেই ডেকে এনেছে উইদাউট এনি প্লান অফ মাস্টার মাইন্ড!
একটা সামান্য কোটা সংস্কার আন্দোলন কখনওই সরকার পতনের আন্দোলনে টার্ন করানো সম্ভব ছিলো না, যদি না এত মৃত্যুর মিছিল তৈরি না হত। এখন যদি এই আন্দোলনকে এরপরেও মেডিকিউলাস ডিজাইন আর ওয়েল প্লান্ড বলতে হয় তাহলে এত এত মৃত্যুটাকেও তার অংশ হিসাবেই ভাবতে হবে। এইটা শুধুমাত্র নিজেরা মৃত্যু ঘটাতে হবে এমনটা না। আপনি এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করবেন পরিকল্পিতভাবে, যে সরকারকে হান্ড্রেড ওভার টেমটেড করে ফেলবেন; সে তার টেমটেশন ধরে রাখতে পারবেনা। ফেইল করে যাবে। তখন তার পক্ষ থেকে ব্যাপক ক্যাজুয়ালিটি ঘটবে। যত ক্যাজুয়ালিটি ঘটবে ততই সরকার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। একটা পর্যায়ে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। এই যে ক্যাজুয়ালিটি এটাও কিন্তু নিজেরা না করে নিজেরা করার মতই।
প্রধান উপদেষ্টা এবং তার চিন্তায় যারা প্রভাবিত; এটাকে যেভাবে পরিকল্পিতভাবে দেখছেন তাদের জন্য ভাবনাটা এমন। তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বারংবার বলা হয়, এটি সরকারে পতনের একটি পরিকল্পিত আন্দোলন। আমরা সেসময় বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে সরকারের এই বক্তব্যের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে কথা বলেছি। এবং যৌক্তিকভাবে প্রমাণ করি সেটি ভুল বয়ান। আর আপনি এখন অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে এসে গ্লোবালি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের বয়ানের সমর্থনে কথা বলে আসলেন। আমরা কেউই আসলে অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করিনা। সে নোবেল লরিয়েট হোক আর রাজনীতিবিদ। শেখ হাসিনার ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বক্তব্য তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। এমন জলজ্যান্ত একটা উদাহরণ থাকার পরেও আপনি গ্লোবালি এমন একটা বক্তব্য হাজির করলেন যা চরমভাবে নেগেটিভ ইমপেক্ট ক্রিয়েট করলো দেশের মধ্যে। পুরো আন্দোলনটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার সুযোগ তৈরি করে দিলেন।
আমি প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের সাথে দৃঢ়ভাবে দ্বিমত পোষণ করি, একইসাথে তার এই বালখিল্য বক্তব্য খারিজ করছি। এই আন্দোলনে যেমন কোন মাস্টার মাইন্ড ছিলো না তেমনি এটা প্লান্ড কোন মুভমেন্টও ছিলো না সেটা নিশ্চয়ই ইতমধ্যেই পরিস্কার করতে পেরেছি। সরকারের ভুল পদক্ষেপ আন্দোলনকে সরকার পতনের আন্দোলনে টার্ন করিয়ে ছিলো। আদারওয়াইজ কোন বিহাইন্ড ব্রেইনের পক্ষে আটঘাট পরিকল্পনা করেও শেখ হাসিনাকে নামানো এবসুলুটলি অসম্ভব ছিলো। আর একটা বিষয় সেটা হলো মুভমেন্ট প্লান্ড এবং বিহাইন্ড ব্রেইন হলে বহু পক্ষকে কোনভাবেই একসাথে নামানো সম্ভব ছিলো না। স্বতঃস্ফুর্ত হওয়ার কারণে যে যার ইন্টারেস্ট থেকে মুভমেন্টে ইনভলভ হয়েছিলো।
জনাব প্রধান উপদেষ্টা একটা বালখিল্য বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন ছাত্র সমন্বয়কদের প্রতি অতি আবেগের ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে। যা টোটাল মুভমেন্ট এর এসেন্স মিসলিড করেছে। উনি গণঅভ্যুত্থান বলতে শুধুই বুঝেন, ছাত্রদের। ২৪ এর ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দল,ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে শ্রমজীবী মানুষের অংশগ্রহণই ছিলো সবচেয়ে বেশি। সহস্রাধিক শহীদদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত যে হিসাব পাওয়া গেছে তার মধ্যে ছাত্রের সংখ্যা ৯১ জন। এই ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে অছাত্ররাই শহীদ হয়েছেন বেশি। পরিসংখ্যান সেটাই বলছে। অথচ পুরো অভ্যুত্থানটিতে প্রধান উপদেষ্টা শুধুমাত্র ছাত্রদের নামটাই সামনে আনছেন সবসময়ই। এবং সেটি বিশেষ একটি ব্যানারের নাম। মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে ৭২ সালে যেমন শুধুমাত্র আওয়ামী লীগকেই ফোকাস করা হয়েছে; ২৪ এ এসেও তেমনটিই করা হচ্ছে।
এটা স্মরণে রাখুন, ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের একক কোন অথরিটি যদি জন্ম দেন, তার শেষ পরিণতি কিন্তু ফ্রাঙ্কেস্টাইন হবে। সো, নাগরিক সমাজ এবং সরকার উভয়েই সতর্ক হন। ৭২ সালের মতো নতুন আরো একটি ন্যারেটিভ তৈরি করার প্রজেক্ট বন্ধ করুন।
লেখক : আবু নাসের অনীক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।